শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গ, বীর মুক্তিযোদ্ধা নঈমের চিরবিদায়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম:শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশনে বড় অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমরা একটা পিঁপড়ার জীবন দিতে পারি না সেখানে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর জীবন সংকট। একটা জীবন পৃথিবীর সবকিছুর চেয়েও মূল্যবান সেই জীবন নষ্ট হবে এ দুর্ভাবনায় খুবই শঙ্কায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তাঁর স্ত্রীর চেষ্টায় দেশের সূর্যসন্তানরা তাদের আমরণ অনশন প্রত্যাহার করেছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কিছু হতে পারে না। গভীর দুর্ভাবনা থেকে লিখেছিলাম, দুর্যোগে কাউকে পাশে পাওয়ার মতো মানুষের বড় অভাব। সেই অভাব দূর করেছেন জনাব জাফর ইকবাল। এ যে কত বড় কাজ বোঝানো যাবে না। এটা খুবই সত্য, রাষ্ট্রের প্রায় সবকিছু নড়বড়ে, নিয়ন্ত্রণহীন। কেউ তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের অনেকেই হাওয়ায় ভেসে বেড়ান, মাটিতে পা পড়ে না। অসুবিধা হলে তবেই শেখ হাসিনা। তার আগে তারাই সব। শুনে অবাক হলাম, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন নিয়ে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা আছে। রাষ্ট্রের সবাই ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু দেখেন না। অথচ সব জায়গায় ষড়যন্ত্র থাকে না, প্রকৃত সমস্যাও থাকে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সূচনা কী নিয়ে, ছাত্ররা কেন ভিসিকে আটকে রেখেছিল তা খুঁজে বের করতে হবে। নিরাসক্তভাবে প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের না করলে একটা থেকে আরেকটায় যাবে, সমাধান কিছুই হবে না। ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য কেউ নন। এক ফরিদ উদ্দিন যাবেন, আরেকজন আসবেন। এতে দেশের কোনো হেরফের হবে না। তাই কারও জন্য ছাত্রছাত্রীরা লাঞ্ছিত হতে পারে না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই লাগামহীন পরিবেশেও যে শৃঙ্খলার পরিচয় দিচ্ছে তা দেখার মতো। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বেই, তাই আগুন জ্বলার আগেই সবকিছু শান্ত করা দরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের বাইরে বহুদিন দেখেছি। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা, মায়া-মমতা কারও কাছ থেকে শুনে উপলব্ধি করতে হবে না, নিজের চোখেই বহুদিন দেখেছি। তাই অনেক সময় অনেক ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যখন জড়ানো হয় তখন বিশ্বাস হতে চায় না, চাটুকার কোটারিদের কথা আর আমার দেখা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক রকম মনে হয় না। ভিসি ফরিদ উদ্দিন কি এমন অপরিহার্য হয়ে পড়লেন যে তাঁকে সরানো যাবে না? সামান্য মর্যাদাবোধ থাকলে এত কিছুর পর কেউ খুঁট্টি মেরে বসে থাকতে পারেন না। যদিও মান-মর্যাদাবোধ সম্পন্ন লোকজন এখন ভালো জায়গা পায় না। চাটুকারের জমানায় তলপিবাহকের প্রাধান্যই বেশি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে বহু বছর থেকে চিনি, তাঁকে ভালোবাসি। তাঁর পুলিশকে সব সময় খারাপ বলতে ভালো লাগে না, মন সায়ও দেয় না। কিন্তু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে উদ্ধারে যে নির্মম নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তা বলার মতো না। টিভি চ্যানেলগুলো সেই গভীর রাতে পুলিশের লাঠিপেটা যেভাবে দেখিয়েছে তার তুলনা হয় না। আগেকার দিনে গ্রামগঞ্জে যেভাবে সাপ মারা হতো সে রকম লাঠিপেটা করেছিল নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের। কাজটা মোটেই ভালো হয়নি। যারা এ রকম আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য দায়ী তাদের বিচার হওয়া উচিত। তাদের বিচার না হলে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৃঙ্খলা থাকবে না। সরকারি কামান-বন্দুক পেলেই ওভাবে ব্যবহার করা যাবে তা সত্য নয়। পুলিশের হাতে লাঠি বা অস্ত্র দেওয়া হয়েছে সব সময় ব্যবহার করার জন্য নয়। এই সাদা কথাটা পুলিশের সব সদস্যের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সবার মনে রাখা উচিত। তা না হলে কোনো না কোনো সময় বিপদে পড়তেই হবে। প্রায় সাত দিন হতে চলল ছাত্ররা অনশন ভঙ্গ করেছে। এখনো উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ক্যাম্পাসে কেন বসে আছেন বুঝতে পারছি না। তাঁকে যদি বরখাস্ত না করা হয় শুধু অধ্যাপক জাফর ইকবালের সম্মানহানি হবে না। জনাব জাফর ইকবাল জাতির পক্ষ থেকে অনশনরত শিক্ষার্থীদের কথা দিয়েছেন। তাঁর কথা রক্ষা না করা জাতিকে অসম্মান করা, উপেক্ষা করার শামিল। তাই যত তাড়াতাড়ি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে অবাঞ্ছিত ভিসিকে তুলে আনা হবে ততই মঙ্গল। যারা যে দায়িত্বের উপযুক্ত নয় তাদের সে দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের, দেশের ক্ষতি ছাড়া লাভের কিছু দেখছি না। চাটুকাররা চাটি মারবেই। পোঁ ধরাই যাদের স্বভাব তাদের কাছ থেকে অন্য রকম ভালো কিছু আশা করা যায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্ররা আন্দোলনরত ছাত্রদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে তাই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনো আন্দোলন করা ছাত্রের পাশে যাওয়া যাবে না, তাদের সাহায্য করা যাবে না এটা কোনো সভ্যতার নজির হতে পারে না। কিছুদিন আগে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে যারাই গেছে তাদের সবার হাতে হাতে নগদ টাকা, প্যাকেটে প্যাকেটে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল তা কি রাষ্ট্রবিরোধী ছিল? ২০১৫ সালে আমরা বাইরে বাইরে রাস্তাঘাটে ৩০৮ দিন অবস্থান করেছিলাম সেখানে অনেক মানুষ টাকাপয়সা, খাবার-দাবার দিয়ে সাহায্য করেছে। তারা কি অন্যায় করেছে? আমার তো আজও স্পষ্ট মনে আছে বিএনপি সরকারের সময় ১৯৯২-৯৩-এর দিকে প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষকরা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন। প্রায় ১৪-১৫ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেটাও কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছিল? সাবেক ছাত্ররা তাদের সতীর্থদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাহায্য করেছে এসব কাজে সম্মান দেওয়া উচিত, পুরস্কার দেওয়া উচিত, তিরস্কার নয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পাঁচ ছাত্রকে গ্রেফতার করার মতো নিন্দনীয় কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে উল্লেখ করার মতো দ্বিতীয়টি নেই। শিক্ষার্থীরা অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ফরিদ উদ্দিনকে সরিয়ে আনলে দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হবে লক্ষণীয়, শান্তি-সম্প্রীতির বাতাস বয়ে যাবে সেখানে। শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গ করায় ছাত্রছাত্রীদের যেমন অভিনন্দন জানাচ্ছি, তেমনি অধ্যাপক জাফর ইকবালকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। এ অবক্ষয়ের জমানায় তিনি প্রকৃত শিক্ষকের, অভিভাবকের ধর্ম পালন করেছেন।

বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের বাগানের সব ফুল-ফল বোঁটা ছিঁড়ে ধীরে ধীরে ঝরে যাচ্ছে। আর ৫-১০ বছর পর হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কাউকেই পাওয়া যাবে না। যখন আমার সঙ্গে কেউ ছিল না, অস্ত্র ছিল না, বস্ত্র ছিল না, আশ্রয়ের জায়গা ছিল না, ঠিক সে সময় আগে পিছে কোনো কিছু না ভেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল পাথারের আবু নঈম মোহাম্মদ তাদের মধ্যে একজন। খুবই সাদাসিধা অতি সাধারণ মানুষ। ১৮-২০ বছর বয়সে সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গোড়ান-সাটিয়াচরা-কালিহাতী যুদ্ধের পর আমি যখন একেবারে নিঃস্ব-রিক্ত-দিশাহারা একমাত্র সিলেটের ফারুক ছাড়া কেউ ছিল না। আমাদের নেতারা আগেই টাঙ্গাইল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী শেষ চেষ্টা করেছিলেন কালিহাতীর যুদ্ধে। তারপর তাঁকেও আর পাওয়া যায়নি। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়, সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা গিয়েছিলেন। আমাদের সামনে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। গুলি ছাড়া একটা পুলিশের বেটাগান, সঙ্গে সিলেটের ফারুক। ওভাবেই দিনের পর দিন উদ্দেশ্যহীনভাবে পাহাড়-চর-ভর ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। মানুষের মধ্যেও তেমন আগ্রহ ছিল না। বরং ভয়ই ছিল বেশি। এমনি একসময় শ্বশুরালয় চরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাহাজের বাড়ির পাশে এক ছনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সঙ্গে একটা ছোট্ট টু ইন ওয়ান রেডিও টেপ ছিল। রাত সাড়ে ১০টা-পৌনে ১১টায় হঠাৎই আকাশবাণী বেতার থেকে ভেসে আসছিল, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/তবে একলা চলো রে/একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।’ তন্ময় হয়ে গানটি শুনছিলাম। ওর আগে কত শতবার শুনেছি। কিন্তু অমন তন্ময় হইনি। মনে হচ্ছিল কবিগুরু যেন আমার জন্যই গানটি রচনা করেছিলেন। শ্বশুরালয় চলে গিয়েছিলাম সন্ধ্যার কিছু পরে। যাওয়ার পথে যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে মনে হয়েছে সবাই যেন মুখ ফিরিয়ে আছে। গানটি শোনার পর তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম। প্রায় রাত ১টা-দেড়টা পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীন হেঁটে এক বাড়িতে থাকার জন্য ডাক দিয়েছিলাম। দু-তিন ডাকেই তারা সাড়া দিয়েছিলেন। বাড়ির লোকজন দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন কত আপন। আমার ডাকের অপেক্ষায় যেন তারা এতক্ষণ ছিলেন। খুব যত্ন করে মাটির ঘরে ছেঁড়া কাথায় শুতে দিয়েছিলেন। খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিলেন। শত আপত্তিতেও শেষ পর্যন্ত মুড়ি এনে দিয়েছিলেন। তৃপ্তি ভরে সে মুড়ি খেয়েছিলাম। সকাল সাড়ে ৬টা-৭টার দিকে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম। কী যেন খেতে দিয়েছিলেন আজ আর মনে নেই। কিন্তু তাদের বড় আপন মনে হচ্ছিল। রাস্তায় বেরিয়ে যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছিল মনে হচ্ছিল তারা যেন কত চেনা কত আপন। প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার হেঁটে গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটিতে বাবা-মা-ভাই-বোনের কাছে গিয়েছিলাম। বাড়িতে পা দিতেই পাকিস্তান নৌবাহিনীর এক সৈনিক কস্তূরীপাড়ার মনিরুল ইসলাম এসেছিল। কালিহাতী যুদ্ধে ইপিআরদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রের খবর নিয়ে এসেছে। আমার কাছেও খবরটা ছিল। তাই আর দেরি না করে কালিহাতীর দিকে ছুটেছিলাম অস্ত্র উদ্ধারের আশায়। ছোট ফারুক, মনির আর আমি তিনজন হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যায় পেয়েছিলাম ঘাটাইলের মোয়াজ্জেম হোসেন খান, বিখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদ, করটিয়া কলেজের ছাত্র শাজাহানকে। কালিহাতীর এক হতদরিদ্র দিনমজুর অস্ত্রের সন্ধান জানত। সে আমাদের জন্য অস্ত্রগুলো বের করে দিয়েছিল। সেসব অস্ত্র  নিয়ে ফেরার  পথে  কস্তূরীপাড়ার শামসুল হককে পেয়েছিলাম। ১৬-১৭ বছরের টগবগে যুবক। যেদিন আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেদিন থেকে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত আমার সঙ্গেই ছিল। কত ঝড় গেছে, তুফান গেছে, কত উথাল-পাতাল হয়েছে। কিন্তু কস্তূরীপাড়ার শামসু আমাকে ছাড়েনি। এ সময় আমার সহপাঠী সাদৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুরকে পত্র দিয়েছিলাম। সেও পাঁচ-ছয় জন নিয়ে মরিচাতে আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। তারপর আমরা সংগ্রামপুরে পাতার ক্যাম্প আক্রমণ করি। খবর ছিল এলএমজিসহ বেশ কয়েকটি অস্ত্র তাদের পাতার ক্যাম্পে আছে। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তাই তাদের ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই পাতার ক্যাম্পের মূল ব্যবসায়ী উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান মমতাজ খান সেই তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল। সেখান থেকে গিয়েছিলাম সখীপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে নুরে আজম, আবু হানিফ, মোতালেব গুরখা, খোরশেদ আলম আরও, আবদুল হালিম মাস্টার, হামিদুল হক বীরপ্রতীক, আরও কয়েকজন শরিক হয়েছিল। পরদিন এসেছিল পাথারের আবু নঈম মোহাম্মদ। শাজাহান সংগ্রামপুর পাতার ক্যাম্পের কাছ থেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। আবু নঈম মোহাম্মদ একেবারে সাদামাটা এক নাবুঝ মানুষ। তার প্রতিটি কথাবার্তা, হাঁটাচলা লক্ষ্য করছিলাম। একেবারে সরল সোজা। যুদ্ধের গতি যখন বেড়ে যায়, যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে, সংগঠন শক্তিশালী হয় সব সময় সব কাজে সবার আগে দেখা যেত আবু নঈম মোহাম্মদকে। চর-ভর-পাহাড় যেখানেই মুক্তিবাহিনী সেখানেই আবু নঈম। আমার দলের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করেছে রাতদিন। তখন এমন দিন যায়নি যেদিন আমি ২৫-৩০, এমনকি ৪০ কিলোমিটার একদিক থেকে আরেকদিকে যাইনি। আমার ছোটাছুটির চোটে একসময় হানাদার পাকিস্তানিরা বলতে শুরু করেছিল, ‘শালা কাদের সিদ্দিকী কিয়া হ্যায়, দানব হ্যায়, ইয়া মানব। কাভি ইধার কাভি ওধার। শালা জরুর ভূত হোগা।’ অনেকটা তেমনই ছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা হয়তো খবর পেয়েছে আমি গোপালপুর কিংবা ভূঞাপুরে। প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হয়ে ২-৪ কিলোমিটার যাওয়ার পরই তাদের কাছে খবর আসে কাদের সিদ্দিকীকে এইমাত্র নাগরপুর-এলাসিনের কাছে দেখা গেছে। কাদের সিদ্দিকী যখন গোপালপুর-ভূঞাপুর থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে নাগরপুর কিংবা এলাসিন তখন সেদিকেই যেতে হবে। উল্টো পথ ধরে কয়েক কিলোমিটার চলতেই তাদের কাছে আবার খবর আসে নাগরপুরে নয়, অল্প কিছুক্ষণ আগে তাকে মির্জাপুরের পাথরঘাটায় দেখা গেছে। এই ছিল আমার তখনকার ছোটাছুটির গতি-প্রকৃতি। তাই কোনোমতেই হানাদাররা আমার ওপর সরাসরি আক্রমণ করতে পারেনি, বরং আমরাই অনেক আক্রমণ করেছি তাদের ঘাঁটির ওপর। যুদ্ধের মধ্যেও আবু নঈম মোহাম্মদ অনেক ভালো করেছে, সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। বল্লার যুদ্ধ, বাসাইল থানা দখল, ধলাপাড়ার যুদ্ধ, দেওপাড়া ফরেস্ট অফিস আক্রমণ এমনি নানা অভিযানে সে অংশ নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হলে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে আবু নঈম মোহাম্মদের কোম্পানি ক্যাম্প করে। ’৭২-এর ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেদিন কাদেরিয়া বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র নিতে টাঙ্গাইল যান সেদিন আবু নঈম মোহাম্মদকে তার প্লাটুনসহ গোড়াই-টাঙ্গাইলের সীমান্ত থেকে সোহাগপাড়া পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গোড়াই থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে ১০-১৫ গজ পরপর কাদেরিয়া বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যখন আসেন তার কয়েক মিনিট আগে সে তার ডিউটি ছেড়ে খুব সম্ভবত প্রকৃতির ডাকে এদিক-ওদিক গিয়েছিল। টিম কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান তাকে দেখতে পাননি। বঙ্গবন্ধু এলে তাকে নিয়ে আমরা টাঙ্গাইলের পথে রওনা হই। রাস্তার দুই পাশে যে মুক্তিযোদ্ধারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরও আস্তে আস্তে তুলে আনা হয়। সেখানে আবু নঈম মোহাম্মদও আমাদের পিছে পিছে চলে আসে। বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে অস্ত্র জমা দেওয়া প্যারেডেও সে শরিক হয়। বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে অস্ত্র নিয়ে টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে ১০ লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে সাড়া জাগানো বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু ঢাকা চলে আসেন। আমাদের মধ্যে তখন আনন্দ আর আনন্দ। বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে অস্ত্র দিয়ে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সফলতা খুঁজে পাই। অন্যান্য রুটিনমাফিক কাজের মধ্যে ২৬ বা ২৭ তারিখ জেল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। টাঙ্গাইল জেলে ধারণক্ষমতা ছিল ৬০ জনের। সেখানে প্রায় ৩৮০-৩৯০ জন রাজাকার-আলবদর-দালালকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের কোনো অসুবিধা হয় কি না, খাওয়া-দাওয়া কেমন হয়, প্রস্রাব-পায়খানা, গোসল-আসলের ব্যবস্থা কেমন তাই দেখতে গিয়েছিলাম। জেলখানার ভিতরে কিছু সময় এদিক-ওদিক দেখার পরই আবু নঈম মোহাম্মদ আমার চোখে পড়ে। এই নঈম তুই এখানে কেন? তার সোজাসাপটা উত্তর, ‘বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধু আসার সময় সকালে গোড়াইতে ডিউটিতে ছিলাম। টাঙ্গাইলের সব অনুষ্ঠান শেষে ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্প গেলে সেখান থেকে জেলখানায় পৌঁছে দিয়ে যায়। মনে হয় এখানেও ডিউটি দিয়েছে তাই করতাছি।’ আমি ঠিক বুঝতে পারিনি নঈম কী বলছে। কাদেরিয়া বাহিনীর তখন সদর দফতর ছিল জেলখানার পাশে টাঙ্গাইলের এসডিওর দফতর। দফতরে গিয়ে আনোয়ারুল আলম শহীদকে জিজ্ঞেস করি, ব্যাপার কী? তিনি বলেন, ‘আমি বলতে পারব না। যে কজন মুক্তিযোদ্ধা জেলখানায় আছে তাদের সবাইকে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান রেখেছেন।’ ব্রিগেডিয়ার সাহেব পাশেই ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল ২৪ তারিখ আবু নঈম মোহাম্মদকে কিছু সময় ডিউটিতে দেখা যায়নি বলে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। সে জানেই না তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমার খুব বিচিত্র লেগেছিল। খুব খারাপ লাগছিল মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে রাজাকার-আলবদরের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এটা কী করে সম্ভব! মুক্তিযোদ্ধারা শাস্তি পাওয়ার কাজ করলে অবশ্যই পাবে। কিন্তু রাজাকার-আলবদর-দালালদের সঙ্গে কেন? তাদের আটক রাখার আলাদা জায়গা করতে হবে। তক্ষুনি গাড়ি দিয়ে আবু নঈম মোহাম্মদকে তার ক্যাম্প গোড়াই ক্যাডেট কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন আমি যাই গোড়াই ক্যাডেট কলেজের কাদেরিয়া বাহিনীর ক্যাম্প দেখতে। তাদের সঙ্গেই দুপুরের খাবার খাই। আবু নঈম মোহাম্মদ তার দুই দিন জেলে থাকার অনেক মজার মজার কথা বলে। কাগজে সে কিছু নোট করেছিল সেসব নোট আমার হাতে তুলে দেয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তার প্রতিবাদে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলাম। সেখানেও আবু নঈম মোহাম্মদ শরিক হয়েছিল। ডা. শরিফের নেতৃত্বে চান্দভূই হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই হাসপাতালে ডা. শরিফের সহযোগী ছিল পাথারের আবু নঈম মোহাম্মদ। নঈম যেখানে যে কাজই করেছে অন্তর দিয়ে করেছে। প্রতিরোধযুদ্ধের সময় কলকাতা-ইংল্যান্ড-জার্মানি ও অন্যান্য বহু জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা এসে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, সংসদ সদস্যরাও চান্দভূইয়ে আসতেন। একবার যশোরের সংসদ সদস্য ও গভর্নর রওশন আলী এবং আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন এসেছিলেন চান্দভূই ক্যাম্পে। তারা বেশ কয়েকদিন ছিলেন। তাদের বিদায়ে একটা নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। খাবার-দাবার অতি সাধারণ হলেও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। ভোজের আয়োজন করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে। সেখানে অতিথিদের উদ্দেশ আবু নঈম মোহাম্মদ এক অসাধারণ বক্তব্য দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হৃদয়স্পর্শী অনেক কথার এক ফাঁকে বলেছিল, ‘আমাদের আশপাশে যত কলাগাছ ছিল তার বাকল কেটে খাবার থালা বানাতে বানাতে সব গাছ শহীদ হয়ে গেছে। এখন খাবার জন্য কলার খোলও পাওয়া যায় না। আপনারা যারা শিক্ষিত জ্ঞানী এই কথাটা মনে রাখবেন নিশ্চয়ই একদিন আমাদের জয় হবে। সেখানে হয়তো আমরা না-ও থাকতে পারি। কিন্তু জয় আমাদের হবেই। কারণ আমরা ন্যায়ের পক্ষে আছি।’ সেই আবু নঈম মোহাম্মদ শনিবার ২৯ জানুয়ারি আমাদের হৃদয়ের বোঁটা ছিঁড়ে পরপারে চলে গেছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আর ৫-১০ বছরের মধ্যে আমরা সবাই চলে যাব। পড়ে থাকবে শুধু স্মৃতি। মনে হয় সে স্মৃতিও খুব একটা নিরাপদ থাকবে না। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আবু নঈম মোহাম্মদকে সেই সঙ্গে আরও যারা ইহজগত ত্যাগ করেছে তাদের হেফাজত করুন, বেহেশতবাসী করুন।

লেখক : রাজনীতিক।সূএ:বাংলাদেশে প্রতিদিন

 www.ksjleague.com

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ‌আমরা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হতে দেব না : হাসনাত আব্দুল্লাহ

» লক্ষ্মীপুরে জুলাই বিপ্লবে নিহত ও আহতদের স্মরণে জেলা প্রশাসনের সভা 

» রবি আজিয়াটাকে অ্যাডভান্সড ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট সল্যুশন দেবে ব্র্যাক ব্যাংক

» ১৫০ কৃষি উদ্যোক্তার জন্য ইউসিবির দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ আয়োজন

» আওয়ামী সন্ত্রাসীর হামলায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনের মৃত্যু

» বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম করলে কঠোর ব্যবস্থা: পরিবেশ উপদেষ্টা

» চিন্ময় দাসকে গ্রেফতারের বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ

» ‘শ্রম অধিকার চর্চার দীর্ঘস্থায়ী চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা জরুরি’

» জুলাই বিপ্লব ইতিহাসের ইতিবাচক পরিবর্তন : শফিকুর রহমান

» মিরপুর থানার ৩ নং বিট পুলিশ নিয়ে আলোচনা সভা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গ, বীর মুক্তিযোদ্ধা নঈমের চিরবিদায়

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম:শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আমরণ অনশনে বড় অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমরা একটা পিঁপড়ার জীবন দিতে পারি না সেখানে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর জীবন সংকট। একটা জীবন পৃথিবীর সবকিছুর চেয়েও মূল্যবান সেই জীবন নষ্ট হবে এ দুর্ভাবনায় খুবই শঙ্কায় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তাঁর স্ত্রীর চেষ্টায় দেশের সূর্যসন্তানরা তাদের আমরণ অনশন প্রত্যাহার করেছে। এর চেয়ে খুশির খবর আর কিছু হতে পারে না। গভীর দুর্ভাবনা থেকে লিখেছিলাম, দুর্যোগে কাউকে পাশে পাওয়ার মতো মানুষের বড় অভাব। সেই অভাব দূর করেছেন জনাব জাফর ইকবাল। এ যে কত বড় কাজ বোঝানো যাবে না। এটা খুবই সত্য, রাষ্ট্রের প্রায় সবকিছু নড়বড়ে, নিয়ন্ত্রণহীন। কেউ তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। যাদের হাতে ক্ষমতা তাদের অনেকেই হাওয়ায় ভেসে বেড়ান, মাটিতে পা পড়ে না। অসুবিধা হলে তবেই শেখ হাসিনা। তার আগে তারাই সব। শুনে অবাক হলাম, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন নিয়ে নানা রকম আলোচনা-সমালোচনা আছে। রাষ্ট্রের সবাই ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু দেখেন না। অথচ সব জায়গায় ষড়যন্ত্র থাকে না, প্রকৃত সমস্যাও থাকে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সূচনা কী নিয়ে, ছাত্ররা কেন ভিসিকে আটকে রেখেছিল তা খুঁজে বের করতে হবে। নিরাসক্তভাবে প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের না করলে একটা থেকে আরেকটায় যাবে, সমাধান কিছুই হবে না। ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য কেউ নন। এক ফরিদ উদ্দিন যাবেন, আরেকজন আসবেন। এতে দেশের কোনো হেরফের হবে না। তাই কারও জন্য ছাত্রছাত্রীরা লাঞ্ছিত হতে পারে না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই লাগামহীন পরিবেশেও যে শৃঙ্খলার পরিচয় দিচ্ছে তা দেখার মতো। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বেই, তাই আগুন জ্বলার আগেই সবকিছু শান্ত করা দরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের বাইরে বহুদিন দেখেছি। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি তাঁর অফুরন্ত ভালোবাসা, মায়া-মমতা কারও কাছ থেকে শুনে উপলব্ধি করতে হবে না, নিজের চোখেই বহুদিন দেখেছি। তাই অনেক সময় অনেক ঘটনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যখন জড়ানো হয় তখন বিশ্বাস হতে চায় না, চাটুকার কোটারিদের কথা আর আমার দেখা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক রকম মনে হয় না। ভিসি ফরিদ উদ্দিন কি এমন অপরিহার্য হয়ে পড়লেন যে তাঁকে সরানো যাবে না? সামান্য মর্যাদাবোধ থাকলে এত কিছুর পর কেউ খুঁট্টি মেরে বসে থাকতে পারেন না। যদিও মান-মর্যাদাবোধ সম্পন্ন লোকজন এখন ভালো জায়গা পায় না। চাটুকারের জমানায় তলপিবাহকের প্রাধান্যই বেশি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে বহু বছর থেকে চিনি, তাঁকে ভালোবাসি। তাঁর পুলিশকে সব সময় খারাপ বলতে ভালো লাগে না, মন সায়ও দেয় না। কিন্তু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে উদ্ধারে যে নির্মম নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে তা বলার মতো না। টিভি চ্যানেলগুলো সেই গভীর রাতে পুলিশের লাঠিপেটা যেভাবে দেখিয়েছে তার তুলনা হয় না। আগেকার দিনে গ্রামগঞ্জে যেভাবে সাপ মারা হতো সে রকম লাঠিপেটা করেছিল নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের। কাজটা মোটেই ভালো হয়নি। যারা এ রকম আক্রমণাত্মক অভিযানের জন্য দায়ী তাদের বিচার হওয়া উচিত। তাদের বিচার না হলে শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৃঙ্খলা থাকবে না। সরকারি কামান-বন্দুক পেলেই ওভাবে ব্যবহার করা যাবে তা সত্য নয়। পুলিশের হাতে লাঠি বা অস্ত্র দেওয়া হয়েছে সব সময় ব্যবহার করার জন্য নয়। এই সাদা কথাটা পুলিশের সব সদস্যের, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সবার মনে রাখা উচিত। তা না হলে কোনো না কোনো সময় বিপদে পড়তেই হবে। প্রায় সাত দিন হতে চলল ছাত্ররা অনশন ভঙ্গ করেছে। এখনো উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ক্যাম্পাসে কেন বসে আছেন বুঝতে পারছি না। তাঁকে যদি বরখাস্ত না করা হয় শুধু অধ্যাপক জাফর ইকবালের সম্মানহানি হবে না। জনাব জাফর ইকবাল জাতির পক্ষ থেকে অনশনরত শিক্ষার্থীদের কথা দিয়েছেন। তাঁর কথা রক্ষা না করা জাতিকে অসম্মান করা, উপেক্ষা করার শামিল। তাই যত তাড়াতাড়ি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে অবাঞ্ছিত ভিসিকে তুলে আনা হবে ততই মঙ্গল। যারা যে দায়িত্বের উপযুক্ত নয় তাদের সে দায়িত্ব দিয়ে রাষ্ট্রের, দেশের ক্ষতি ছাড়া লাভের কিছু দেখছি না। চাটুকাররা চাটি মারবেই। পোঁ ধরাই যাদের স্বভাব তাদের কাছ থেকে অন্য রকম ভালো কিছু আশা করা যায় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্ররা আন্দোলনরত ছাত্রদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেছে তাই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। কোনো আন্দোলন করা ছাত্রের পাশে যাওয়া যাবে না, তাদের সাহায্য করা যাবে না এটা কোনো সভ্যতার নজির হতে পারে না। কিছুদিন আগে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে যারাই গেছে তাদের সবার হাতে হাতে নগদ টাকা, প্যাকেটে প্যাকেটে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল তা কি রাষ্ট্রবিরোধী ছিল? ২০১৫ সালে আমরা বাইরে বাইরে রাস্তাঘাটে ৩০৮ দিন অবস্থান করেছিলাম সেখানে অনেক মানুষ টাকাপয়সা, খাবার-দাবার দিয়ে সাহায্য করেছে। তারা কি অন্যায় করেছে? আমার তো আজও স্পষ্ট মনে আছে বিএনপি সরকারের সময় ১৯৯২-৯৩-এর দিকে প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষকরা দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য অবস্থান ধর্মঘট করেছিলেন। প্রায় ১৪-১৫ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সৈয়দ আবুল হোসেন প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেটাও কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছিল? সাবেক ছাত্ররা তাদের সতীর্থদের পাশে দাঁড়িয়েছে সাহায্য করেছে এসব কাজে সম্মান দেওয়া উচিত, পুরস্কার দেওয়া উচিত, তিরস্কার নয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক পাঁচ ছাত্রকে গ্রেফতার করার মতো নিন্দনীয় কাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে উল্লেখ করার মতো দ্বিতীয়টি নেই। শিক্ষার্থীরা অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। ফরিদ উদ্দিনকে সরিয়ে আনলে দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ হবে লক্ষণীয়, শান্তি-সম্প্রীতির বাতাস বয়ে যাবে সেখানে। শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গ করায় ছাত্রছাত্রীদের যেমন অভিনন্দন জানাচ্ছি, তেমনি অধ্যাপক জাফর ইকবালকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। এ অবক্ষয়ের জমানায় তিনি প্রকৃত শিক্ষকের, অভিভাবকের ধর্ম পালন করেছেন।

বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের বাগানের সব ফুল-ফল বোঁটা ছিঁড়ে ধীরে ধীরে ঝরে যাচ্ছে। আর ৫-১০ বছর পর হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কাউকেই পাওয়া যাবে না। যখন আমার সঙ্গে কেউ ছিল না, অস্ত্র ছিল না, বস্ত্র ছিল না, আশ্রয়ের জায়গা ছিল না, ঠিক সে সময় আগে পিছে কোনো কিছু না ভেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল পাথারের আবু নঈম মোহাম্মদ তাদের মধ্যে একজন। খুবই সাদাসিধা অতি সাধারণ মানুষ। ১৮-২০ বছর বয়সে সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গোড়ান-সাটিয়াচরা-কালিহাতী যুদ্ধের পর আমি যখন একেবারে নিঃস্ব-রিক্ত-দিশাহারা একমাত্র সিলেটের ফারুক ছাড়া কেউ ছিল না। আমাদের নেতারা আগেই টাঙ্গাইল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী শেষ চেষ্টা করেছিলেন কালিহাতীর যুদ্ধে। তারপর তাঁকেও আর পাওয়া যায়নি। সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়, সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা গিয়েছিলেন। আমাদের সামনে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। গুলি ছাড়া একটা পুলিশের বেটাগান, সঙ্গে সিলেটের ফারুক। ওভাবেই দিনের পর দিন উদ্দেশ্যহীনভাবে পাহাড়-চর-ভর ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। মানুষের মধ্যেও তেমন আগ্রহ ছিল না। বরং ভয়ই ছিল বেশি। এমনি একসময় শ্বশুরালয় চরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বাহাজের বাড়ির পাশে এক ছনের ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সঙ্গে একটা ছোট্ট টু ইন ওয়ান রেডিও টেপ ছিল। রাত সাড়ে ১০টা-পৌনে ১১টায় হঠাৎই আকাশবাণী বেতার থেকে ভেসে আসছিল, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে/তবে একলা চলো রে/একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।’ তন্ময় হয়ে গানটি শুনছিলাম। ওর আগে কত শতবার শুনেছি। কিন্তু অমন তন্ময় হইনি। মনে হচ্ছিল কবিগুরু যেন আমার জন্যই গানটি রচনা করেছিলেন। শ্বশুরালয় চলে গিয়েছিলাম সন্ধ্যার কিছু পরে। যাওয়ার পথে যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে মনে হয়েছে সবাই যেন মুখ ফিরিয়ে আছে। গানটি শোনার পর তখনই বেরিয়ে পড়েছিলাম। প্রায় রাত ১টা-দেড়টা পর্যন্ত উদ্দেশ্যহীন হেঁটে এক বাড়িতে থাকার জন্য ডাক দিয়েছিলাম। দু-তিন ডাকেই তারা সাড়া দিয়েছিলেন। বাড়ির লোকজন দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন কত আপন। আমার ডাকের অপেক্ষায় যেন তারা এতক্ষণ ছিলেন। খুব যত্ন করে মাটির ঘরে ছেঁড়া কাথায় শুতে দিয়েছিলেন। খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিলেন। শত আপত্তিতেও শেষ পর্যন্ত মুড়ি এনে দিয়েছিলেন। তৃপ্তি ভরে সে মুড়ি খেয়েছিলাম। সকাল সাড়ে ৬টা-৭টার দিকে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলাম। কী যেন খেতে দিয়েছিলেন আজ আর মনে নেই। কিন্তু তাদের বড় আপন মনে হচ্ছিল। রাস্তায় বেরিয়ে যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছিল মনে হচ্ছিল তারা যেন কত চেনা কত আপন। প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার হেঁটে গ্রামের বাড়ি ছাতিহাটিতে বাবা-মা-ভাই-বোনের কাছে গিয়েছিলাম। বাড়িতে পা দিতেই পাকিস্তান নৌবাহিনীর এক সৈনিক কস্তূরীপাড়ার মনিরুল ইসলাম এসেছিল। কালিহাতী যুদ্ধে ইপিআরদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রের খবর নিয়ে এসেছে। আমার কাছেও খবরটা ছিল। তাই আর দেরি না করে কালিহাতীর দিকে ছুটেছিলাম অস্ত্র উদ্ধারের আশায়। ছোট ফারুক, মনির আর আমি তিনজন হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যায় পেয়েছিলাম ঘাটাইলের মোয়াজ্জেম হোসেন খান, বিখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশীদ, করটিয়া কলেজের ছাত্র শাজাহানকে। কালিহাতীর এক হতদরিদ্র দিনমজুর অস্ত্রের সন্ধান জানত। সে আমাদের জন্য অস্ত্রগুলো বের করে দিয়েছিল। সেসব অস্ত্র  নিয়ে ফেরার  পথে  কস্তূরীপাড়ার শামসুল হককে পেয়েছিলাম। ১৬-১৭ বছরের টগবগে যুবক। যেদিন আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেদিন থেকে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত আমার সঙ্গেই ছিল। কত ঝড় গেছে, তুফান গেছে, কত উথাল-পাতাল হয়েছে। কিন্তু কস্তূরীপাড়ার শামসু আমাকে ছাড়েনি। এ সময় আমার সহপাঠী সাদৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুরকে পত্র দিয়েছিলাম। সেও পাঁচ-ছয় জন নিয়ে মরিচাতে আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল। তারপর আমরা সংগ্রামপুরে পাতার ক্যাম্প আক্রমণ করি। খবর ছিল এলএমজিসহ বেশ কয়েকটি অস্ত্র তাদের পাতার ক্যাম্পে আছে। কিন্তু খোঁজাখুঁজি করে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। তাই তাদের ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই পাতার ক্যাম্পের মূল ব্যবসায়ী উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাঠান মমতাজ খান সেই তখন থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল। সেখান থেকে গিয়েছিলাম সখীপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে নুরে আজম, আবু হানিফ, মোতালেব গুরখা, খোরশেদ আলম আরও, আবদুল হালিম মাস্টার, হামিদুল হক বীরপ্রতীক, আরও কয়েকজন শরিক হয়েছিল। পরদিন এসেছিল পাথারের আবু নঈম মোহাম্মদ। শাজাহান সংগ্রামপুর পাতার ক্যাম্পের কাছ থেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। আবু নঈম মোহাম্মদ একেবারে সাদামাটা এক নাবুঝ মানুষ। তার প্রতিটি কথাবার্তা, হাঁটাচলা লক্ষ্য করছিলাম। একেবারে সরল সোজা। যুদ্ধের গতি যখন বেড়ে যায়, যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে, সংগঠন শক্তিশালী হয় সব সময় সব কাজে সবার আগে দেখা যেত আবু নঈম মোহাম্মদকে। চর-ভর-পাহাড় যেখানেই মুক্তিবাহিনী সেখানেই আবু নঈম। আমার দলের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করেছে রাতদিন। তখন এমন দিন যায়নি যেদিন আমি ২৫-৩০, এমনকি ৪০ কিলোমিটার একদিক থেকে আরেকদিকে যাইনি। আমার ছোটাছুটির চোটে একসময় হানাদার পাকিস্তানিরা বলতে শুরু করেছিল, ‘শালা কাদের সিদ্দিকী কিয়া হ্যায়, দানব হ্যায়, ইয়া মানব। কাভি ইধার কাভি ওধার। শালা জরুর ভূত হোগা।’ অনেকটা তেমনই ছিল। পাকিস্তানি হানাদাররা হয়তো খবর পেয়েছে আমি গোপালপুর কিংবা ভূঞাপুরে। প্রস্তুতি নিয়ে রওনা হয়ে ২-৪ কিলোমিটার যাওয়ার পরই তাদের কাছে খবর আসে কাদের সিদ্দিকীকে এইমাত্র নাগরপুর-এলাসিনের কাছে দেখা গেছে। কাদের সিদ্দিকী যখন গোপালপুর-ভূঞাপুর থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে নাগরপুর কিংবা এলাসিন তখন সেদিকেই যেতে হবে। উল্টো পথ ধরে কয়েক কিলোমিটার চলতেই তাদের কাছে আবার খবর আসে নাগরপুরে নয়, অল্প কিছুক্ষণ আগে তাকে মির্জাপুরের পাথরঘাটায় দেখা গেছে। এই ছিল আমার তখনকার ছোটাছুটির গতি-প্রকৃতি। তাই কোনোমতেই হানাদাররা আমার ওপর সরাসরি আক্রমণ করতে পারেনি, বরং আমরাই অনেক আক্রমণ করেছি তাদের ঘাঁটির ওপর। যুদ্ধের মধ্যেও আবু নঈম মোহাম্মদ অনেক ভালো করেছে, সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। বল্লার যুদ্ধ, বাসাইল থানা দখল, ধলাপাড়ার যুদ্ধ, দেওপাড়া ফরেস্ট অফিস আক্রমণ এমনি নানা অভিযানে সে অংশ নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হলে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে আবু নঈম মোহাম্মদের কোম্পানি ক্যাম্প করে। ’৭২-এর ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যেদিন কাদেরিয়া বাহিনীর হাত থেকে অস্ত্র নিতে টাঙ্গাইল যান সেদিন আবু নঈম মোহাম্মদকে তার প্লাটুনসহ গোড়াই-টাঙ্গাইলের সীমান্ত থেকে সোহাগপাড়া পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে দায়িত্ব দেওয়া হয়। গোড়াই থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে ১০-১৫ গজ পরপর কাদেরিয়া বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যখন আসেন তার কয়েক মিনিট আগে সে তার ডিউটি ছেড়ে খুব সম্ভবত প্রকৃতির ডাকে এদিক-ওদিক গিয়েছিল। টিম কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান তাকে দেখতে পাননি। বঙ্গবন্ধু এলে তাকে নিয়ে আমরা টাঙ্গাইলের পথে রওনা হই। রাস্তার দুই পাশে যে মুক্তিযোদ্ধারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদেরও আস্তে আস্তে তুলে আনা হয়। সেখানে আবু নঈম মোহাম্মদও আমাদের পিছে পিছে চলে আসে। বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে অস্ত্র জমা দেওয়া প্যারেডেও সে শরিক হয়। বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে অস্ত্র নিয়ে টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে ১০ লক্ষাধিক মানুষের মধ্যে সাড়া জাগানো বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু ঢাকা চলে আসেন। আমাদের মধ্যে তখন আনন্দ আর আনন্দ। বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে অস্ত্র দিয়ে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সফলতা খুঁজে পাই। অন্যান্য রুটিনমাফিক কাজের মধ্যে ২৬ বা ২৭ তারিখ জেল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। টাঙ্গাইল জেলে ধারণক্ষমতা ছিল ৬০ জনের। সেখানে প্রায় ৩৮০-৩৯০ জন রাজাকার-আলবদর-দালালকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাদের কোনো অসুবিধা হয় কি না, খাওয়া-দাওয়া কেমন হয়, প্রস্রাব-পায়খানা, গোসল-আসলের ব্যবস্থা কেমন তাই দেখতে গিয়েছিলাম। জেলখানার ভিতরে কিছু সময় এদিক-ওদিক দেখার পরই আবু নঈম মোহাম্মদ আমার চোখে পড়ে। এই নঈম তুই এখানে কেন? তার সোজাসাপটা উত্তর, ‘বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধু আসার সময় সকালে গোড়াইতে ডিউটিতে ছিলাম। টাঙ্গাইলের সব অনুষ্ঠান শেষে ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্প গেলে সেখান থেকে জেলখানায় পৌঁছে দিয়ে যায়। মনে হয় এখানেও ডিউটি দিয়েছে তাই করতাছি।’ আমি ঠিক বুঝতে পারিনি নঈম কী বলছে। কাদেরিয়া বাহিনীর তখন সদর দফতর ছিল জেলখানার পাশে টাঙ্গাইলের এসডিওর দফতর। দফতরে গিয়ে আনোয়ারুল আলম শহীদকে জিজ্ঞেস করি, ব্যাপার কী? তিনি বলেন, ‘আমি বলতে পারব না। যে কজন মুক্তিযোদ্ধা জেলখানায় আছে তাদের সবাইকে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান রেখেছেন।’ ব্রিগেডিয়ার সাহেব পাশেই ছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল ২৪ তারিখ আবু নঈম মোহাম্মদকে কিছু সময় ডিউটিতে দেখা যায়নি বলে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। সে জানেই না তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমার খুব বিচিত্র লেগেছিল। খুব খারাপ লাগছিল মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে রাজাকার-আলবদরের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে এটা কী করে সম্ভব! মুক্তিযোদ্ধারা শাস্তি পাওয়ার কাজ করলে অবশ্যই পাবে। কিন্তু রাজাকার-আলবদর-দালালদের সঙ্গে কেন? তাদের আটক রাখার আলাদা জায়গা করতে হবে। তক্ষুনি গাড়ি দিয়ে আবু নঈম মোহাম্মদকে তার ক্যাম্প গোড়াই ক্যাডেট কলেজে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরদিন আমি যাই গোড়াই ক্যাডেট কলেজের কাদেরিয়া বাহিনীর ক্যাম্প দেখতে। তাদের সঙ্গেই দুপুরের খাবার খাই। আবু নঈম মোহাম্মদ তার দুই দিন জেলে থাকার অনেক মজার মজার কথা বলে। কাগজে সে কিছু নোট করেছিল সেসব নোট আমার হাতে তুলে দেয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তার প্রতিবাদে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিলাম। সেখানেও আবু নঈম মোহাম্মদ শরিক হয়েছিল। ডা. শরিফের নেতৃত্বে চান্দভূই হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই হাসপাতালে ডা. শরিফের সহযোগী ছিল পাথারের আবু নঈম মোহাম্মদ। নঈম যেখানে যে কাজই করেছে অন্তর দিয়ে করেছে। প্রতিরোধযুদ্ধের সময় কলকাতা-ইংল্যান্ড-জার্মানি ও অন্যান্য বহু জায়গা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা এসে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা, সংসদ সদস্যরাও চান্দভূইয়ে আসতেন। একবার যশোরের সংসদ সদস্য ও গভর্নর রওশন আলী এবং আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আনোয়ার হোসেন এসেছিলেন চান্দভূই ক্যাম্পে। তারা বেশ কয়েকদিন ছিলেন। তাদের বিদায়ে একটা নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। খাবার-দাবার অতি সাধারণ হলেও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি ছিল না। ভোজের আয়োজন করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে। সেখানে অতিথিদের উদ্দেশ আবু নঈম মোহাম্মদ এক অসাধারণ বক্তব্য দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হৃদয়স্পর্শী অনেক কথার এক ফাঁকে বলেছিল, ‘আমাদের আশপাশে যত কলাগাছ ছিল তার বাকল কেটে খাবার থালা বানাতে বানাতে সব গাছ শহীদ হয়ে গেছে। এখন খাবার জন্য কলার খোলও পাওয়া যায় না। আপনারা যারা শিক্ষিত জ্ঞানী এই কথাটা মনে রাখবেন নিশ্চয়ই একদিন আমাদের জয় হবে। সেখানে হয়তো আমরা না-ও থাকতে পারি। কিন্তু জয় আমাদের হবেই। কারণ আমরা ন্যায়ের পক্ষে আছি।’ সেই আবু নঈম মোহাম্মদ শনিবার ২৯ জানুয়ারি আমাদের হৃদয়ের বোঁটা ছিঁড়ে পরপারে চলে গেছে (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আর ৫-১০ বছরের মধ্যে আমরা সবাই চলে যাব। পড়ে থাকবে শুধু স্মৃতি। মনে হয় সে স্মৃতিও খুব একটা নিরাপদ থাকবে না। আল্লাহ রব্বুল আলামিন আবু নঈম মোহাম্মদকে সেই সঙ্গে আরও যারা ইহজগত ত্যাগ করেছে তাদের হেফাজত করুন, বেহেশতবাসী করুন।

লেখক : রাজনীতিক।সূএ:বাংলাদেশে প্রতিদিন

 www.ksjleague.com

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com