টিসিবি’র লাইনও অনেক দীর্ঘ। বাজার দর নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকার এমনটাই মনে করছে সাধারণ মানুষ।
নিত্যপণ্যের দামের এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার জন্য করোনায় উৎপাদন কমে যাওয়া, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতা ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। আবার কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ বাজারের সুশাসনের অভাবকেও দায়ী করছেন। এ ছাড়া ইউক্রেন ও রাশিয়ার বর্তমান সংকট বাংলাদেশের বাজারেও প্রভাব পড়বে।
সূত্রমতে, চলতি অর্থবছর সাড়ে ৩ কোটি টন চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের লাইনে আছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ টন চাল। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত থাকবে ১ কোটি ১৮ লাখ টন। আগে কখনোই এত বেশি চাল উদ্বৃত্ত হয়নি। বিভিন্ন সূত্র বলছে, আগে শুধু মিলারদের কাছে ধান মজুত থাকতো। এবার শুধু মিলার নয়, মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী, বড় বড় অনেক কোম্পানি, এমনকি অনলাইন ব্যবসায়ীরাও ধান/চাল ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আবার মজুতও করছে।
সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন, উদ্বৃত্ত থাকা সত্ত্বেও চালের দাম ক্রমাগত বাড়ছে কেন? এ ছাড়া প্রতি বছর ভরা মৌসুমে চালের দাম কমলেও এবার কমেনি বরং বেড়েছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, বাজারে কারসাজি চলছে, যা সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কারসাজি শুধু চালের বাজারে নয়, রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে, রমজান সামনে রেখে সেসব খাদ্যপণ্যও চলে গেছে সিন্ডিকেটের কবজায়। বাজারে সব পণ্যেই এখন ঊর্ধ্বমুখী। করোনা মহামারির কারণে সাধারণ মানুষ এমনিতেই কষ্টে আছে। খাদ্যপণ্যের ক্রমাগত দামবৃদ্ধি তাদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই খাদ্যপণ্যের কারসাজি রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। আর রমজানকে সামনে রেখে তদারকি ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা টিসিবি’র হিসাবে গত এক সপ্তাহে চাল, ময়দা, ভোজ্য তেল, আমদানিকৃত পিয়াজে দাম বেড়েছে। এসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে মোটা চাল ৩.২৩ শতাংশ, মাঝারি চাল ১.৮৯ শতাংশ, সরু ৩.১৩ শতাংশ বেড়েছে এক সপ্তাহে। এ ছাড়া খোলা ও প্যাকেটজাত ময়দার কেজিতে ২ টাকা, লুজ সয়াবিন লিটারে ৫ টাকা, লুজ সয়াবিনের লিটারে ১০ টাকা বেড়েছে। বেড়েছে আলু, জিরা, লবঙ্গ ও মুরগির দামও।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, দাম কমাতে সরকারকে ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। টিসিবিকে আরও সক্রিয় করতে হবে। আর টিসিবি’র মাধ্যমে একটি কার্ড পদ্ধতি করা যেতে পারে। একটি বিশেষ শ্রেণি এই কার্ডের মাধ্যমে সপ্তাহে বা মাসে টিসিবি থেকে বাজার করবে। এর পাশাপাশি দেশে যেসব বড় ব্যবসায়ী সিস্টেমের বাইরে কাজ করেন তাদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে।
দোকান মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মাহমুদ বলেন, প্রথমত- সরকারকে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট হার কমাতে হবে। এ ছাড়া যারা আমদানি করে তাদের থেকে পণ্য ডিলার, এরপর পাইকার, এরপর খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছে কয়েক হাত যেতেই দাম বেড়ে যাচ্ছে। এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। একই পণ্যে কয়েকবার ভ্যাট আদায় হচ্ছে। এতেও পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের সুযোগসন্ধানী আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম বাড়ে তখন সঙ্গে সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। যখন দাম কমে, তখন পণ্যের দাম কমার প্রবণতা দেখা যায় না। তিনি বলেন, আয় বৈষম্য বেশ বেড়েছে। বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। কিন্তু উন্নয়নের মহাসড়কে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যদি পিষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেই উন্নয়ন আমাদেরকে পিষ্ট করবে। এজন্য সরকারকে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
সম্প্রতি বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য আওয়ামী লীগের সিন্ডিকেট দায়ী। আওয়ামী লীগ সিন্ডিকেট ইচ্ছা করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছে। দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দুর্ভোগে পড়েছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের কোনো ভাবাবেগ নেই।
এদিকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও ওএমএস’র আটা পাচ্ছেন না রাজধানীর পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকার ভোক্তারা। আটা শেষ বলে খালি হাতে ফেরত যেতে হচ্ছে অনেককেই। তাদের মধ্যে একজন রিকশাচালক আবু বক্কর। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাস্তায় প্রচুর যানজটের কারণে রিকশা চালিয়েও বেশি লাভবান হতে পারছেন না তিনি। এজন্য এসেছিলেন পণ্য কিনতে। কম টাকায় আটা কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। আজ কেনা হলো না।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত আব্দুল রশিদ নামে এক শিক্ষক বলেন, ২২ হাজার টাকা বেতনে আগে পরিবারে সব ধরনের খরচ ও মাস শেষে কিছু টাকা সঞ্চয় করা যেতো। কিন্তু এখন পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য এভাবে বাড়তে থাকে মানুষের জীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও গভীর হবে। জাকারিয়া নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, নিয়মিত ব্যয় বাড়লেও আয় আগের পরিমাণই আছে।
সরকারি বিপণন সংস্থার (টিসিবি) তথ্যও বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৫.১৭ শতাংশ। রাজধানীর বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। সূএ: মানবজমিন