অ আ আবীর আকাশ : বিশ্ব যখন প্রযুক্তির দখলে, মানুষ যখন মুহূর্তেই অসীম তথ্যের সাগরে ডুবে যাচ্ছে, তখন বইয়ের প্রতি মানুষের টান ক্রমশ কমে আসছে—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসের যে ক্ষয়, তা নিয়ে শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক সবাই উদ্বিগ্ন। এমন এক সময়ে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে যে গণগ্রন্থাগার প্রকল্প শুরু হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে আশার আলো দেখাচ্ছে। এই উদ্যোগ শুধু বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনবে না, বরং একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করতে পারে। এ জন্য প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি হিসেবে রাজীব কুমার সরকার সকল প্রশংসার দাবিদার। বাস্তবায়নে উপজেলা প্রশাসনেরও অনন্য ভূমিকা রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে ইতিমধ্যে গণগ্রন্থাগার স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ২২টি ইউনিয়ন পরিষদেও গ্রন্থাগার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে এই গণগ্রন্থাগারগুলো গড়ে তোলা হচ্ছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, এবং সমাজের নানা পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছেন। এর মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরে বই পড়ার সংস্কৃতি পুনর্জীবিত হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের বার্তা বহন করছে।
বাংলাদেশে গ্রামীণ পর্যায়ে পাঠাগার ব্যবস্থা বরাবরই অবহেলিত। শহরে কিছু পাবলিক লাইব্রেরি থাকলেও গ্রামের মানুষের নাগালের বাইরে ছিল এমন সুযোগ। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার, বিনোদনের বিকল্প মাধ্যম এবং ডিজিটাল আসক্তির কারণে বই পড়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। ২০২১সালে মিডিয়াসহ বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তরুণদের পাঠ্যক্রমের বাইরের বই পড়ার হার প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছে। এই প্রেক্ষাপটে লক্ষ্মীপুরের প্রশাসনের এই উদ্যোগ অত্যন্ত যুগোপযোগী ও প্রগতিশীল।
গণগ্রন্থাগার শুধু বই পড়ার জায়গা নয়; এটি হতে পারে মতবিনিময়ের, চিন্তাচর্চার, সৃজনশীলতা বিকাশের কেন্দ্র। কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত এই গ্রন্থাগারে আসছে, যা প্রমাণ করে তারা জ্ঞানার্জনে আগ্রহী। বইয়ের আলোয় তারা যেমন নিজস্ব চিন্তাভাবনা বিকশিত করতে পারছে, তেমনি সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও তৈরি হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের মনোযোগের স্থায়িত্ব দিন দিন কমছে, কারণ তারা দীর্ঘসময় ধরে মুঠোফোনের স্ক্রিনে আটকে থাকছে। এই পরিস্থিতিতে পাঠাগার হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ সমাধান।
লক্ষ্মীপুরের গণগ্রন্থাগারগুলোর সফল বাস্তবায়নের পেছনে জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকারের অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি শুধু একজন প্রশাসক নন, বরং একজন লেখক, গবেষক, সাহিত্য আলোচক, প্রাবন্ধিক ও বহু গ্রন্থের রচয়িতা। জাতীয় পর্যায়ের একজন বিতার্কিক তিনি। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং সাংস্কৃতিক চেতনা এই প্রকল্পকে প্রাণবন্ত করেছে। তাঁর মতে, এই উদ্যোগ কেবল আনুষ্ঠানিক প্রকল্প নয়, বরং এটি একটি স্থায়ী ও কার্যকর সামাজিক পরিবর্তনের অংশ। তাঁর নেতৃত্বে প্রশাসন বিষয়টি পরিকল্পিত বাজেট বরাদ্দ এবং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে।
তবে, এই প্রকল্পের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, গণগ্রন্থাগারে কী ধরনের বই থাকবে, সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি সেখানে নিতান্তই পুরনো, অপ্রাসঙ্গিক বা কম মানের বই রাখা হয়, তাহলে তরুণদের আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব হবে না। পাঠাগারগুলিতে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, জীবনী, সমাজবিজ্ঞানসহ বহুমুখী বিষয়ক বই রাখা দরকার। সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের চাহিদা ও রুচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বইয়ের সংগ্রহ নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, গ্রন্থাগারে কেবল বই থাকলেই হবে না; সেটিকে প্রাণবন্ত করতে হবে। পুঁথিপাঠের আসর, সাহিত্যসভা, লেখক–পাঠক মিলনমেলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, গল্পকথার অনুষ্ঠান, কবিতার আসর প্রভৃতি আয়োজনের মাধ্যমে পাঠাগার হয়ে উঠতে পারে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এতে শুধু বই পড়ার অভ্যাসই নয়, সামাজিক মেলবন্ধন এবং সৃজনশীল চর্চার ক্ষেত্রও তৈরি হবে।
তৃতীয়ত, পাঠাগারের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রন্থাগারগুলো পরিচালনায় কমিটি থাকতে হবে, যারা বইয়ের সংরক্ষণ, পাঠক সেবা, নতুন বই সংগ্রহ এবং নিয়মিত কার্যক্রমের তদারকি করবে। স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে তোলা যেতে পারে, যারা শিশুদের গল্পপাঠের সেশন পরিচালনা করবে কিংবা বই সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেবে।
এছাড়া তরুণদের জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়েও গ্রন্থাগারগুলো ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন—কর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন, কৃষি প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সচেতনতা ইত্যাদি বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ বই ও পুস্তিকা রাখা যেতে পারে। এতে করে শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, স্থানীয় কৃষক, শ্রমিক, নারী, যুবক–সবার জন্যই গ্রন্থাগার উপকারি হয়ে উঠতে পারে।
লক্ষ্মীপুরের এই মডেল দেশের অন্যান্য জেলার জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ সমাজের সব স্তরের মানুষের একসঙ্গে কাজ করলে প্রতিটি জেলায় গণগ্রন্থাগার স্থাপন সম্ভব। এতে বই পড়ার হার বৃদ্ধি পাবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে।
একটি গণগ্রন্থাগার সমাজের দারিদ্র্য দূরীকরণেও ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, বই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়, আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং জীবনের গতি দেয়। শিক্ষিত, সচেতন এবং সংস্কৃতিসমৃদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য গণগ্রন্থাগার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
লক্ষ্মীপুরের গণগ্রন্থাগার প্রকল্প আমাদের শেখায়, একজন সরকারি কর্মকর্তার সদিচ্ছা এবং নেতৃত্ব থাকলে কত বড় সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব। জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকারের মতো মানুষরা প্রমাণ করেছেন, প্রশাসন শুধু সরকারি আদেশ–নির্দেশ বাস্তবায়নের জায়গা নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনেরও বড় হাতিয়ার হতে পারে। তাঁর মতো নেতাদের নেতৃত্বেই সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে।
সবশেষে বলা যায়, গণগ্রন্থাগার শুধুমাত্র একটি স্থাপনা নয়, এটি একটি আন্দোলন। একটি আলোর মশাল, যা মানুষকে অজানা জগতের সন্ধান দেয়, মনের দরজা খুলে দেয় এবং জীবনের মানে বোঝাতে সাহায্য করে। লক্ষ্মীপুরের এই উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে এগিয়ে যায়, তবে শুধু জেলার মানুষ নয়, গোটা দেশের জন্য এটি হতে পারে এক অনন্য উদাহরণ। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে বইয়ের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এই প্রয়াসকে তাই স্বাগত এবং অভিনন্দন জানাতেই হয়।