ছবি সংগৃহীত
আজ ২৮ অক্টোবর। ২০০৬ সালের এই দিনে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রকাশ্যে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে জামায়াত-শিবিরের ছয় নেতাকর্মীকে হত্যা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন রাজপথে দিনভর ব্যাপক তাণ্ডব চালায় আওয়ামী লীগ।
রাজপথে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার পর সেই লাশের ওপর নৃত্যের ঘটনাটি দেশের ইতিহাসে একটি অন্যতম নৃশংস ঘটনা, যা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠে দেশে-বিদেশে।
সেদিন বিষয়টি হঠাৎ করে ঘটেনি। আগেই লগি-বৈঠা নিয়ে রাজপথে এসে প্রতিপক্ষকে দমনের ঘোষণা দিয়েছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কে এম হাসান যদি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেয় তাহলে সারাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যাতে লগি-বৈঠা হাতে ঢাকায় চলে আসে।
সেদিন যা ঘটেছিল
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ছিল বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিন। বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট সরকার তখন বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সেদিন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের শপথ হওয়ার কথা ছিল। তিনি যেন শপথ নিতে না পারেন সেজন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট তুমুল আন্দোলন করছিল। আওয়ামী লীগ আগেই ঘোষণা দিয়েছিল যে, কেএম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। কে এম হাসান দায়িত্ব নেবেন না – এমন একটি গুঞ্জন আগেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ২৭ অক্টোবর রাতে কেএম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
কেএম হাসান এক বিবৃতিতে জানিয়ে দেন যে, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের সংলাপে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেননি। বিচারপতি কেএম হাসান অপারগতা প্রকাশ করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করে।
এমন অবস্থায় ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের ঘোষণা দেয় জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। পল্টন ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। এছাড়া বিএনপি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে এবং জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। পল্টন ময়দানে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল শ্রমিক দলও। সংঘাতের আশঙ্কায় পল্টন ময়দান এবং আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
এমন আশঙ্কার মধ্যেই পল্টন-বায়তুল মোকাররম এলাকায় জামায়াতে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সেদিন ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে গুলি এবং লগি-বৈঠা দিয়ে জামায়াতে ইসলাম ছয় নেতাকর্মীকে পিটিয়ে মারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা, যা গভীর আলোড়ন তৈরি করেছিল। ২৮ অক্টোবরের আগের দিন এবং পরের দিনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘাত হয়েছিল।
এসব ঘটনায় মামলা হলেও ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলা প্রত্যাহার করা হয়। জামায়াতের দাবি, সেদিনের ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসন ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। তাই দিনব্যাপী চলে আওয়ামী লীগের তাণ্ডব।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘এটি ছিল স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের উত্থানের প্রথম মহড়া। সেদিনও বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিল। তবে সরকারের যে ভূমিকা পালন করা দরকার ছিল তা তারা করেনি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সেদিন জামায়াত-বিএনপির মধ্যে সমন্বয় থাকলে দিনভর তাণ্ডব চালাতে পারত না আওয়ামী লীগ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী-এই দুটি মিলেই একটা বিরাট শক্তি। এরা একসাথে থাকলে বাকি সব দলকেও পরাজিত করা যায়। সেই ধরনের পরিকল্পনা ছিল না, সমন্বয়কও ছিল না। আর সেই সুযোগেই এই পরিস্থিতি হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২৮ অক্টোবরে লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যা আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। রক্তাক্ত ২৮ অক্টোবর রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সূএ:ঢাকা মেইল ডটকম