যুদ্ধ নয়

তসলিমা নাসরিন : ১. রাশিয়া নাকি রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনের লোকদের ধর্ষণ করার জন্য ভায়াগ্রা বিতরণ করছে। শত্রুদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এটি নাকি যুদ্ধের পরিকল্পনা। কর্নেল গাদ্দাফিও নাকি সৈন্যদের ভায়াগ্রা দিয়ে গণধর্ষণের জন্য উৎসাহ দিতেন। এসব খবর কিন্তু আমার বানানো নয়। সবই জাতিসংঘের খবর।

 

প্রতিদিন রাশিয়া আর ইউক্রেনের এই জ্বালাও পোড়াও, ধ্বংস করো, ভাঙো, গুঁড়িয়ে দাও, হত্যা করো যেভাবে চলছে, যেভাবে সহায় সম্পদ আর প্রাণিকুলের হত্যাযজ্ঞ চলছে, আমি অবাক হই এরা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি? ধ্বংসাত্মক খেলা খেলতে মানুষ পারে, আবার নির্মাণও তো পারে। ঘৃণা যেমন জানে, ভালোবাসতেও জানে কম নয়। বসে আছি কবে হবে যুদ্ধের অবসান।

 

ভাবছিলাম রাশিয়া যে সৈন্যদের ভায়াগ্রা দিয়েছে ইউক্রেনের নারী পুরুষ শিশুকে ধর্ষণ করার জন্য, রাশিয়ার সৈন্যরা কিন্তু ভায়াগ্রা সেবন করে যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ধর্ষণ করেছে এক শ ইউক্রেনবাসীকে। আর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনও ভায়াগ্রার দরকার হয়নি, তারা দুই লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছিল ভায়াগ্রা ছাড়াই।

 

আসলে ধর্ষণের জন্য ভায়াগ্রার দরকার হয় না। যেটির দরকার হয় সেটি হলো- প্রথমত নারীর প্রতি ঘৃণা, দ্বিতীয়ত নিজের পেশি এবং পৌরুষের জন্য গৌরব। সেটি পাকিস্তানি সেনাদের ছিল বলে দুই লক্ষাধিক মেয়েকে এত নির্বিকারে ধর্ষণ করতে পেরেছে।

 

২. ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা সব এক, তাদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য আমি পাইনি। জীবনে তো নানা জাতের নানা ধর্মের মৌলবাদী দেখা হলো, তাদের ঘৃণাগুলো এক, তাদের ঘৃণা প্রকাশের ভাষাও এক, তাদের যুক্তিও একই রকম হাস্যকর, তাদের অদূরদর্শিতা একই ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ, অলৌকিকতাকে তারা একই রকম সত্য বলে মানে। মৌলবাদীদের সুযোগ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন। কোথাও তারা ছোট অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, কোথাও বড়। কোথাও তারা সন্ত্রাসের সুযোগ পায়, কোথাও পায় না। ধর্ম কাউকে আচ্ছন্ন করে রাখলে ধর্মান্ধ হওয়াটা সহজ, ধর্মান্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকলে মৌলবাদী হওয়াটা সহজ, মৌলবাদী হলে সন্ত্রাসী হওয়াটা মোটেও কঠিন নয়।

আশির দশকে বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করা যেত। এখন সেটা করা যায় না। মতটি ধার্মিকের বা মৌলবাদীর মতের মতো হতে হবে, তা হলেই প্রকাশযোগ্য, তা না হলে নয়। প্রখ্যাত প্রচার মাধ্যমগুলোয় তো সম্ভব নয়, সামাজিক মাধ্যমেও যদি ইসলামের সমালোচনা কেউ করে, তবে সরকার যেমন শাস্তি দেয়, মৌলবাদী গোষ্ঠীও তেমন দেয়। সন্ত্রাসীরা তক্কে তক্কে থাকে প্রাণ উড়িয়ে দেওয়ার। পাকিস্তানেরও একই হাল। আশির দশকে, এমনকি নব্বইয়ের দশকেও ভারতে হিন্দু ধর্ম নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করা সম্ভব ছিল, এখন নয়। এখন রক্ষণশীল মতের বাইরে মত প্রকাশ করলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধে। আমরা সামনে যতটা এগোই, পেছোই তারও চেয়ে বেশি।

 

শুধু ধর্মই মানুষকে সন্ত্রাসে উদ্বুদ্ধ করে না। রাশিয়া আর ইউক্রেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম তো এক, জাতও অনেকটা এক, ভাষাও অনেকটা এক, তাহলে কেন এই যুদ্ধ! অহমিকা, অসভ্যতা, অনুদারতা, অসহিষ্ণুতা মানুষকে এমনই অন্ধ করে ফেলে যে মানুষ সন্ত্রাস করতে পিছপা হয় না। রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনের ১১০০ শহর এবং গ্রামে এখন বিদ্যুৎ আর পানি নেই। গত কয়েকদিন ক্ষেপণাস্ত্র আর কামিকাজে ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনের ১৬টি শহরে ১৯০টির মতো বড় হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ইউরোপেরই দেশ এসটোনিয়া এখন রাশিয়াকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেছে।

 

একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধ দেখার পর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বলে যাওয়া দেখার পর, অগুনতি উদ্বাস্তু মানুষ, অগুনতি পচা গলা লাশ দেখার পর ভেবেছিলাম আর বোধহয় কোনও দেশে কেউ যুদ্ধের মতো ভয়ংকর নাশকতার কাজ আর করবে না। কিন্তু ঠিকই করছে, যতবারই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখছি, মনে পড়ছে সেই একাত্তরের স্মৃতি।

 

৩. জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন একটি ভালো কাজ করেছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা এ দুটি ধারায় করা মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে দুটি ধারা বাতিল করার জন্য বলা হয়েছে সে দুটো হলো- (১) কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালান, তাহলে ১৪ বছরের জেল বা ১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (২) কেউ যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে তাহলে সাত বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়াও জাতিসংঘ ডিজিটাল আইনের ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।

 

কোনও রাষ্ট্র নিজেকে গণতন্ত্র বলে দাবি করবে, আর অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাবে, রাজতন্ত্রের আচার আচরণ চালু রাখবে, জনগণের অধিকার আর স্বাধীনতার ওপর বুলডোজার চালিয়ে দেবে, নির্বিচারে মুক্তচিন্তকদের শূলে চড়াবে, এসব আর কতদিন লুকিয়ে রাখা যাবে? একদিন তো প্রতিবাদ হবেই। দেশের ভিতরে বসে প্রতিবাদ করলে জেলে পচতে হয়, নয়তো গুম হয়ে যেতে হয়, খুন হয়ে যেতে হয়, নয়তো নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে হয়। জাতিসংঘ থেকে প্রতিবাদ হওয়া মানে দুনিয়াকে বলে দেওয়া গণতন্ত্রের দাবিদার বাংলাদেশটি আসলে গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনও শর্তই মানে না। লজ্জায় মাথা নত হয় সভ্য মানুষের। যারা রাষ্ট্রক্ষমতা উপভোগ করছে, তাদের অবশ্য লজ্জা শরমের বালাই নেই।

 

আশা করছি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই অব্যাহত থাকবে। মুক্তচিন্তা এবং রুদ্ধচিন্তার মধ্যে যুদ্ধ চলবেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মত প্রকাশের অধিকার নষ্ট করার যে ধারাগুলো আছে, সেসব অচিরে বাতিল হবে। এবং আইনের ভুলত্রুটিগুলো অচিরে সংশোধিত হবে। আমাদের মতো দুর্ভাগাদের তো বাঁচিয়ে রাখে কেবল আশাই। আশা না থাকলে হতাশা জমে জমে পাহাড় হতে থাকে, সেই পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে একদিন অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মৃত্যু থেকে বাঁচতেই আমাদের একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে হয়।

 

৪. ভারতে এখন দেশপ্রেমের হিসাব-নিকাশ চলছে। শুনেছি যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চায় না, তাদের দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে। আমি এইসব ঝামেলা থেকে বেঁচেছি। আমাকে আমার দেশের প্রতি প্রেম দেখানোর কোনও দায় নেই। দেশের প্রতি আমার দায় থাকার কথা নয়।

 

আমি কিন্তু মনে করি এই অন্যায়ের যুগে যারা স্ট্যাটাস কুও মানে, তাদেরই দেশপ্রেমটা সন্দেহজনক। দেশের সমালোচনা মানুষ তো তখনই করে, যখন দেশটির ভালো চায়। দেশ ব্যাপারটা তো বিশাল, কেউ যদি নিন্দেও করে, তাতে কি সত্যিই দেশের কিছু আসে যায়?

 

দেশের জন্য প্রেমটা থাকতেই হবে কেন? আমি যদি মানুষ হিসেবে সৎ হই, কাউকে না ঠকাই, কারও ক্ষতি না করি, দুর্নীতি না করি, প্রতারণা না করি, মিথ্যে না বলি, সমতার সমাজ যদি চাই, দরিদ্র আর দুর্বলকে সাহায্য করি, তাহলেই কি নাগরিক হিসেবে আমি শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য নই? দেশের জন্য প্রেমটা ঠিক কী জিনিস, আমি বুঝি না। মানুষ নিয়েই তো দেশ, মানুষ নিয়েই তো বিরাট এই পৃথিবী। মানুষের জন্য আমার মায়া আছে, মমতা আছে। আইসল্যান্ডের একটি নিরীহ মানুষের জন্য আমার যে মায়া, আমার দেশের একটি নিরীহ মানুষের জন্যও আমার ঠিক তেমনই মায়া। আমি এই মায়াকে বেশি বা কম করতে পারি না, কেউ কাছে থাকে বা কেউ দূরে থাকে- এই যুক্তিতে।

 

আমি যুদ্ধ দেখা মানুষ। আমি পৃথিবীর কোথাও আর যুদ্ধ হোক চাই না। আর মৃত্যু দেখতে চাই না। বিচ্ছেদ আর বিভেদগুলো ঘুচে যাক। পৃথিবীর সব মানুষ মিলেমিশে বাঁচুক। সুখে আনন্দে বাঁচুক। আমরা মঙ্গলগ্রহে চলে যেতে পারছি, কিন্তু আজও পৃথিবীর ভিতরের দারিদ্র্য, বর্বরতা, অসভ্যতা দূর করতে পারছি না! অবাক লাগে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের এসেছে: মাসুদ সাঈদী

» নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান

» অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ চারজন মাদক চোরা কারবারি আটক

» সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব, যা জানালেন বদিউল আলম

» ২ মার্চ ‘জাতীয় পতাকা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান মঈন খানের

» কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়: আইজিপি

» সুন্দর ব্যবহার ও আচরণের বিনিময়ে জান্নাত! হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

» বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পট লোন পেলেন সিলেটের সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা

» ‘ইউসিবি নাইট’ আয়োজনে গ্রাহক ও অংশীদারদের অব্যাহত সহযোগিতার স্বীকৃতি

» ইসলামপুর ওয়ার্ড কৃষক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

যুদ্ধ নয়

তসলিমা নাসরিন : ১. রাশিয়া নাকি রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনের লোকদের ধর্ষণ করার জন্য ভায়াগ্রা বিতরণ করছে। শত্রুদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এটি নাকি যুদ্ধের পরিকল্পনা। কর্নেল গাদ্দাফিও নাকি সৈন্যদের ভায়াগ্রা দিয়ে গণধর্ষণের জন্য উৎসাহ দিতেন। এসব খবর কিন্তু আমার বানানো নয়। সবই জাতিসংঘের খবর।

 

প্রতিদিন রাশিয়া আর ইউক্রেনের এই জ্বালাও পোড়াও, ধ্বংস করো, ভাঙো, গুঁড়িয়ে দাও, হত্যা করো যেভাবে চলছে, যেভাবে সহায় সম্পদ আর প্রাণিকুলের হত্যাযজ্ঞ চলছে, আমি অবাক হই এরা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে কোনও শিক্ষাই নেয়নি? ধ্বংসাত্মক খেলা খেলতে মানুষ পারে, আবার নির্মাণও তো পারে। ঘৃণা যেমন জানে, ভালোবাসতেও জানে কম নয়। বসে আছি কবে হবে যুদ্ধের অবসান।

 

ভাবছিলাম রাশিয়া যে সৈন্যদের ভায়াগ্রা দিয়েছে ইউক্রেনের নারী পুরুষ শিশুকে ধর্ষণ করার জন্য, রাশিয়ার সৈন্যরা কিন্তু ভায়াগ্রা সেবন করে যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ধর্ষণ করেছে এক শ ইউক্রেনবাসীকে। আর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনও ভায়াগ্রার দরকার হয়নি, তারা দুই লক্ষ বাঙালি নারীকে ধর্ষণ করেছিল ভায়াগ্রা ছাড়াই।

 

আসলে ধর্ষণের জন্য ভায়াগ্রার দরকার হয় না। যেটির দরকার হয় সেটি হলো- প্রথমত নারীর প্রতি ঘৃণা, দ্বিতীয়ত নিজের পেশি এবং পৌরুষের জন্য গৌরব। সেটি পাকিস্তানি সেনাদের ছিল বলে দুই লক্ষাধিক মেয়েকে এত নির্বিকারে ধর্ষণ করতে পেরেছে।

 

২. ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা সব এক, তাদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য আমি পাইনি। জীবনে তো নানা জাতের নানা ধর্মের মৌলবাদী দেখা হলো, তাদের ঘৃণাগুলো এক, তাদের ঘৃণা প্রকাশের ভাষাও এক, তাদের যুক্তিও একই রকম হাস্যকর, তাদের অদূরদর্শিতা একই ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ, অলৌকিকতাকে তারা একই রকম সত্য বলে মানে। মৌলবাদীদের সুযোগ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন। কোথাও তারা ছোট অপরাধের সঙ্গে যুক্ত, কোথাও বড়। কোথাও তারা সন্ত্রাসের সুযোগ পায়, কোথাও পায় না। ধর্ম কাউকে আচ্ছন্ন করে রাখলে ধর্মান্ধ হওয়াটা সহজ, ধর্মান্ধতায় বুঁদ হয়ে থাকলে মৌলবাদী হওয়াটা সহজ, মৌলবাদী হলে সন্ত্রাসী হওয়াটা মোটেও কঠিন নয়।

আশির দশকে বাংলাদেশে ইসলাম নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করা যেত। এখন সেটা করা যায় না। মতটি ধার্মিকের বা মৌলবাদীর মতের মতো হতে হবে, তা হলেই প্রকাশযোগ্য, তা না হলে নয়। প্রখ্যাত প্রচার মাধ্যমগুলোয় তো সম্ভব নয়, সামাজিক মাধ্যমেও যদি ইসলামের সমালোচনা কেউ করে, তবে সরকার যেমন শাস্তি দেয়, মৌলবাদী গোষ্ঠীও তেমন দেয়। সন্ত্রাসীরা তক্কে তক্কে থাকে প্রাণ উড়িয়ে দেওয়ার। পাকিস্তানেরও একই হাল। আশির দশকে, এমনকি নব্বইয়ের দশকেও ভারতে হিন্দু ধর্ম নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করা সম্ভব ছিল, এখন নয়। এখন রক্ষণশীল মতের বাইরে মত প্রকাশ করলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধে। আমরা সামনে যতটা এগোই, পেছোই তারও চেয়ে বেশি।

 

শুধু ধর্মই মানুষকে সন্ত্রাসে উদ্বুদ্ধ করে না। রাশিয়া আর ইউক্রেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম তো এক, জাতও অনেকটা এক, ভাষাও অনেকটা এক, তাহলে কেন এই যুদ্ধ! অহমিকা, অসভ্যতা, অনুদারতা, অসহিষ্ণুতা মানুষকে এমনই অন্ধ করে ফেলে যে মানুষ সন্ত্রাস করতে পিছপা হয় না। রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনের ১১০০ শহর এবং গ্রামে এখন বিদ্যুৎ আর পানি নেই। গত কয়েকদিন ক্ষেপণাস্ত্র আর কামিকাজে ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনের ১৬টি শহরে ১৯০টির মতো বড় হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। ইউরোপেরই দেশ এসটোনিয়া এখন রাশিয়াকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ ঘোষণা করেছে।

 

একাত্তরে বাংলাদেশের যুদ্ধ দেখার পর, গ্রামের পর গ্রাম জ্বলে যাওয়া দেখার পর, অগুনতি উদ্বাস্তু মানুষ, অগুনতি পচা গলা লাশ দেখার পর ভেবেছিলাম আর বোধহয় কোনও দেশে কেউ যুদ্ধের মতো ভয়ংকর নাশকতার কাজ আর করবে না। কিন্তু ঠিকই করছে, যতবারই রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ দেখছি, মনে পড়ছে সেই একাত্তরের স্মৃতি।

 

৩. জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন একটি ভালো কাজ করেছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা বাতিলের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি তারা এ দুটি ধারায় করা মামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে দুটি ধারা বাতিল করার জন্য বলা হয়েছে সে দুটো হলো- (১) কেউ যদি ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালান, তাহলে ১৪ বছরের জেল বা ১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। (২) কেউ যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে তাহলে সাত বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়াও জাতিসংঘ ডিজিটাল আইনের ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছে।

 

কোনও রাষ্ট্র নিজেকে গণতন্ত্র বলে দাবি করবে, আর অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাবে, রাজতন্ত্রের আচার আচরণ চালু রাখবে, জনগণের অধিকার আর স্বাধীনতার ওপর বুলডোজার চালিয়ে দেবে, নির্বিচারে মুক্তচিন্তকদের শূলে চড়াবে, এসব আর কতদিন লুকিয়ে রাখা যাবে? একদিন তো প্রতিবাদ হবেই। দেশের ভিতরে বসে প্রতিবাদ করলে জেলে পচতে হয়, নয়তো গুম হয়ে যেতে হয়, খুন হয়ে যেতে হয়, নয়তো নির্বাসনদণ্ড ভোগ করতে হয়। জাতিসংঘ থেকে প্রতিবাদ হওয়া মানে দুনিয়াকে বলে দেওয়া গণতন্ত্রের দাবিদার বাংলাদেশটি আসলে গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনও শর্তই মানে না। লজ্জায় মাথা নত হয় সভ্য মানুষের। যারা রাষ্ট্রক্ষমতা উপভোগ করছে, তাদের অবশ্য লজ্জা শরমের বালাই নেই।

 

আশা করছি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই অব্যাহত থাকবে। মুক্তচিন্তা এবং রুদ্ধচিন্তার মধ্যে যুদ্ধ চলবেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মত প্রকাশের অধিকার নষ্ট করার যে ধারাগুলো আছে, সেসব অচিরে বাতিল হবে। এবং আইনের ভুলত্রুটিগুলো অচিরে সংশোধিত হবে। আমাদের মতো দুর্ভাগাদের তো বাঁচিয়ে রাখে কেবল আশাই। আশা না থাকলে হতাশা জমে জমে পাহাড় হতে থাকে, সেই পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে একদিন অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। মৃত্যু থেকে বাঁচতেই আমাদের একটি বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতে হয়।

 

৪. ভারতে এখন দেশপ্রেমের হিসাব-নিকাশ চলছে। শুনেছি যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চায় না, তাদের দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে। আমি এইসব ঝামেলা থেকে বেঁচেছি। আমাকে আমার দেশের প্রতি প্রেম দেখানোর কোনও দায় নেই। দেশের প্রতি আমার দায় থাকার কথা নয়।

 

আমি কিন্তু মনে করি এই অন্যায়ের যুগে যারা স্ট্যাটাস কুও মানে, তাদেরই দেশপ্রেমটা সন্দেহজনক। দেশের সমালোচনা মানুষ তো তখনই করে, যখন দেশটির ভালো চায়। দেশ ব্যাপারটা তো বিশাল, কেউ যদি নিন্দেও করে, তাতে কি সত্যিই দেশের কিছু আসে যায়?

 

দেশের জন্য প্রেমটা থাকতেই হবে কেন? আমি যদি মানুষ হিসেবে সৎ হই, কাউকে না ঠকাই, কারও ক্ষতি না করি, দুর্নীতি না করি, প্রতারণা না করি, মিথ্যে না বলি, সমতার সমাজ যদি চাই, দরিদ্র আর দুর্বলকে সাহায্য করি, তাহলেই কি নাগরিক হিসেবে আমি শ্রদ্ধা পাওয়ার যোগ্য নই? দেশের জন্য প্রেমটা ঠিক কী জিনিস, আমি বুঝি না। মানুষ নিয়েই তো দেশ, মানুষ নিয়েই তো বিরাট এই পৃথিবী। মানুষের জন্য আমার মায়া আছে, মমতা আছে। আইসল্যান্ডের একটি নিরীহ মানুষের জন্য আমার যে মায়া, আমার দেশের একটি নিরীহ মানুষের জন্যও আমার ঠিক তেমনই মায়া। আমি এই মায়াকে বেশি বা কম করতে পারি না, কেউ কাছে থাকে বা কেউ দূরে থাকে- এই যুক্তিতে।

 

আমি যুদ্ধ দেখা মানুষ। আমি পৃথিবীর কোথাও আর যুদ্ধ হোক চাই না। আর মৃত্যু দেখতে চাই না। বিচ্ছেদ আর বিভেদগুলো ঘুচে যাক। পৃথিবীর সব মানুষ মিলেমিশে বাঁচুক। সুখে আনন্দে বাঁচুক। আমরা মঙ্গলগ্রহে চলে যেতে পারছি, কিন্তু আজও পৃথিবীর ভিতরের দারিদ্র্য, বর্বরতা, অসভ্যতা দূর করতে পারছি না! অবাক লাগে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com