যাওয়া-আসা এই তো নিয়ম

ছবি সংগৃহীত

 

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম:  পাঠক অনেকেই জানেন তীব্র দাবদাহে সংগ্রামপুরের সিলিমপুর সোনার বাংলা মৎস্য খামারে পুকুর খনন নিয়ে পড়ে আছি। বিশেষ করে কিছু গাছ লাগাতে মনটা কেন যেন বড় আনচান করছিল। আম, জাম, মাল্টা, জাম্বুরা, আমড়া যেসব গাছ আছে সেসব গাছের তেমন যত্ন নেই। তারপরও গাছে গাছে ডালে ডালে প্রচুর ফল। কেন যেন ফলগুলো দেখে বুকের ভিতর এক অন্যরকম অনুরণন সৃষ্টি হয়। এত অনাদরের পরও আল্লাহর সে কি অপার মহিমা। তাই প্রতি মুহূর্তে মনে হয় গাছগুলোর যদি যত্ন নিতে পারতাম, একটু পানি দিতে পারতাম, একটু সার, একটু গোবর, একটুখানি ছাই আরও যা যা গাছ চায় তাহলে কত না ভালো হতো। গত দুই মাস নিয়মিত যাতায়াত করি। সিলিমপুরে কাজের লোক যারা আছে তাদের প্রতি আমার একটা ধারণা ছিল তারা কাজ করে না, শুধু শুধু ফাঁকি দেয়, বসে থাকে। ইদানীং অনেক মানুষেরই দায়িত্ববোধ নেই, কাজকে ভালোবাসে না, অলস বসে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু এই কদিন নিয়মিত সময় দিয়ে দেখলাম যারা কায়িক পরিশ্রম করে তাদের মতো সোনার মানুষ হয় না। ত্রুটি তাদের নয়, যারা তদারকি করে ত্রুটি তাদের। কাকে কী করতে হবে, কখন করতে হবে কেউ জানে না, বলতে পারে না। কারণ চোখ নেই, দেখে না। যুক্তিবিদ্যায় দেখেছি, চোখ থাকলেও আমরা আমাদের চোখের সামনে সব দেখি না, অনেক কিছু চোখের আড়ালেই থেকে যায়। যা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। কিন্তু কিছু মানুষ যারা বড় বড় জিনিসও দেখে না, দেখতে পায় না। খামারে গিয়ে অনেক সময় দেখি এটা ওটা এখানে সেখানে পড়ে আছে। একটু সরিয়ে রাখতে একটু ঝাড়পোঁছ করে রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। লোকজন আছে, তারা যে কাজ করে না তেমন নয়। যাকে যা বলা হয় তার চাইতেও বেশি করে। মুক্তিযুদ্ধে যেমনটা দেখেছি, যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছি তার চাইতে অনেক বেশি করেছে, ভালো করেছে। পুকুরগুলো সংস্কার করা হচ্ছে। বেকু, টাপি মাটি এদিক ওদিক নিচ্ছে, খাম-খোঁটা গাড়ছে। কী প্রচন্ড দাবদাহ, তার মধ্যেও সবার মুখে হাসি। বুক জুড়িয়ে যায়। তাই বেশ আগ্রহ নিয়ে কাজটা দেখছিলাম বা কদিন থেকে দেখছি। অনেকে হয়তো মনে করতে পারে গ্রামে একটা দুটা পুকুর সংস্কারে পড়ে থাকা আপনার কাজ নয়। বলতেই পারেন। কিন্তু আমি যদি এখন একটা গাছে ফুল ফোটাতে পারি, ফল ফলাতে পারি সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ যখন যেভাবে রাখেন তাতেই খুশি থাকতে শিখেছি। জীবনে বহু ঝড়-তুফান পেরিয়ে এসেছি। এখন যাওয়ার পালা। তাই কোনো লোভ-ক্ষমতা স্পর্শ করে না, অবহেলা আহত করে না। হেলাফেলা নিয়ে, ক্ষমতা-অক্ষমতা নিয়ে একটি সত্য ঘটনা আগামী পর্বে লেখার চেষ্টা করব।

সিলিমপুরে থাকলে পত্র-পত্রিকা একটু দেরিতে পাই। পত্রিকায় চোখ পড়তেই হঠাৎই দেখলাম প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আর নেই। মৃত্যু সংবাদ তো প্রতিদিনই পাই। জন্ম আর মৃত্যু শাশ্বত সত্য। মৃত্যু সংবাদ অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখেছি অনেক বছর। আমার প্রেম আমার ভালোবাসা যে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে সেই বঙ্গবন্ধু ওভাবে আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যাবেন মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি। আর তাঁর মৃত্যু তো স্বাভাবিক ছিল না। যে মানুষটা সারা জীবন আমাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন, সুখ ত্যাগ করেছেন সেই মানুষটা ঘাতকের গুলিতে নিহত হয়েছেন। যখন বিপথগামী খুনিরা আক্রমণ করেছিল তখন বঙ্গবন্ধুর আর তাঁর আশপাশের লোকজনের কেমন লেগেছে। এমন একটি বিরাট মানুষ চন্দ্র-সূর্যের সমান যার উচ্চতা তাঁর বুকের ভিতর কেমন তোলপাড় করেছে, কেমন অসহায় লেগেছে তাঁর বা তাঁদের। এসব যখনই ভাবি তখন কেমন যেন হয়ে যাই। কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। ঠিক একইভাবে দেহরক্ষীদের গুলিতে ভারতের মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছিলাম সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে যখন বর্ধমানের খোশবাগানে ড. স্বরূপ দত্তের চেম্বারে ছিলাম। আমার স্ত্রী নাসরীন সিদ্দিকীর সব থেকে বড় দুঃখ সে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দেখা পায়নি। মার সঙ্গে, ভাইবোনের সঙ্গে ইন্দিরাজির যখনই সে ছবি দেখে তখনই আফসোস করে। মা-বাবা চলে গেছেন সেটাও বুকে আলোড়ন তোলে। তাই মৃত্যুকে গ্রহণ করার শক্তি আগেই অর্জন করেছিলাম। কিন্তু তারপরও মাঝেসাজে কিছু মৃত্যু নাড়া দেয়। এ জে মোহাম্মদ আলী তেমন একজন। আমি তাকে চিনতাম না। তিনি যখন বড় হয়েছেন আমি তখন নির্বাসনে। দেশে এসেছি ’৯০ সালে। তারপর হাজারো উত্থালপাথাল অতিক্রম করে এতটা পথ পারি দিয়েছি। কয়েকদিন আগে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা। তিনি আমার থেকে সাত বছরের বড়। আমার আর তার মাঝে এক ভাই, এক বোন ছিল। তারা চলে গেছে প্রায় ৭৫ বছর আগে। চা খেতে খেতে কথার ফাঁকে হঠাৎই কেন যেন বলেছিলাম, আমার জীবন গুরুহীন শুরু। আমি কোনো প্রেম করতে পারিনি বা করিনি। ছেলেবেলায় কোনো জ্ঞান বুদ্ধি ছিল না। ছিলাম অজো মূর্খ। একেবারে বাউন্ডুলে বাঁধনহারা। আপনাকে দেখে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম। ভীরুতা কেটেছিল। রাজনীতিতে না এলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো না, তাঁকে পেতাম না। তিনি আমার প্রেম, তিনিই আমার ভালোবাসা। আজ আমার মধ্যে যত প্রশান্তি তার সবই বঙ্গবন্ধু। আজকে রাস্তাঘাটের একটা পোকপাখালি, একেবারে অন্নহীন বস্ত্রহীন শিশুরাও যে আমার কাছে আদরণীয় সম্মানের সে শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য। দেশ ও দেশের একমুঠো মাটি একটি মানুষের জীবনে কত বড় সম্পদ তা শুধু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে মানুষকে ভালোবেসে জেনেছি। আমার সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন না। কারণ দেশপ্রেম ছেলেখেলা নয়। চুরি-চামারি করে টাকা-পয়সা, গাড়ি বাড়ি করা যায়। কিন্তু একমুঠো মাটি হাতে নিলে তাতে মায়ের স্পর্শ অনুভব করা যায় না। এটা আল্লাহর দয়া না হলে কারও পক্ষে সম্ভব না। এটা অবশ্যই সত্য, একজন মানুষ হিসেবে, একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি, আল্লাহর দয়া না হলে আমাদের কারও কিছুই করার নেই। নিজের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইবার শক্তিটুকুও আমাদের নেই। এ বিশ্বাস ও অনুভূতি এক দিনে আসেনি বা জাগেনি। এটা চলতে চলতে দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে নানা উত্থালপাথালের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়। এত কিছুর পরও প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীর মৃত্যু আমাকে যারপরনাই নাড়া দিয়েছে। এমনিতে আমি ক্ষমতাবানদের নিয়ে ভাবি না। স্বাভাবিক খবরাখবরের বাইরে বেশি খবরও রাখি না বা রাখতে চাই না। আমার সব ভাবনা নেংটি পুঁচকি নিয়ে, যাদের কিছু নেই তাদের নিয়ে কারবার। কিন্তু এ জে মোহাম্মদ আলী আমার হৃদয়জুড়ে আছেন। যতদিন বেঁচে থাকব থাকবেন ততদিন। স্বাধীনতার পরপরই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর হুকুমে একটা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান করেছিলাম। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকভাবে বঙ্গবন্ধু নিজেই ২-৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সোনার বাংলার মূলধন ছিল ৫ লাখ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সেতুগুলো ভেঙেছিলাম সেগুলো তাড়াতাড়ি করে ফেলার প্রয়োজন ছিল তাই গঠন করেছিলাম সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড। কেবল স্বাধীন হয়েছি আর মুক্তিযুদ্ধে আমরা অত বড় বিজয় অর্জন করেছি। সবার মধ্যে ছিল চনমনে অসাধ্য সাধনের প্রবণতা বা দুর্বার ইচ্ছা। সেভাবেই কাজ হতো। কত নেতা-কর্মী সোনার বাংলায় যেতেন, প্রবীণরা ফোন করতেন, চিঠি লিখতেন আমরা সাধ্যমতো সম্মানের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করতাম। আমরা ’৪৮ সালে প্রথম টাঙ্গাইলের যে বাড়ি এসেছিলাম তার দলিলে ছিল ৮০১ টাকা। এখন সেই বাড়ি বা সেটুকু জায়গার দাম না হলেও ৮-১০ কোটি টাকা হবে। তাই সময় পার হলে অনেকে অনেক কিছু ভুলে যায়। কী রোগেই ধরেছে আমাকে, আমি তেমন কিছু ভুলতে পারি না। তেমনি এ জে মোহাম্মদ আলীও একজন। সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড একসময় অগ্রণী ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেটা ধীরে ধীরে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা মঞ্জুরিতে পৌঁছে। ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা শুধু মঞ্জুরি পত্রেই ছিল। আসল ২ কোটি ৯৪ লাখ, বাকি ১ কোটি ৪৬ লাখ সুদ ও অন্যান্য ব্যাংক চার্জ। তারপরও জমি বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা একবারে শোধ করতে চাইলে ব্যাংক কোনো উত্তর দেয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের সামরিক শাসনের আগ পর্যন্ত সব সময় আমাদের ঋণ নিয়মিত ছিল। অনিয়মিত হয়েছে ১/১১-এর সামরিক জমানায়। এত সবের পরও মনে হয় এযাবৎ ৪ কোটি ৫০ লাখ মঞ্জুরির বিপরীতে আমরা ব্যাংককে ১১-১২ কোটি দিয়েছি। তারপরও তাদের নাকি এখনো ৮-১০ কোটি পাওনা। অথচ আইনে আছে কোনো ঋণ কোনোকালেই দ্বিগুণের বেশি হবে না। সে হিসাবে ৩ কোটি ৯ কোটি হতে পারত। সে যাক, নানা কারণে লতিফ ভাই কালিহাতীর আসন ছেড়েছিলেন। মারাত্মক চাপাচাপিতে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলাম। তারও আগের ঘটনা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না এটাই ছিল দলীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাসাইল-সখীপুরের বিনা ভোটে এমপি শওকত মোমেন শাজাহান ২০ জানুয়ারি হঠাৎই মারা যায়। তার মৃত্যুও এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। মারা যাওয়ার ৫-৬ ঘণ্টা আগে রাত ১১টা সাড়ে ১১টায় ফোন করেছিল, ‘স্যার, বাসাইল উপজেলার চেয়ারম্যান কাজী অলিদ আমাকে বাসাইল আওয়ামী লীগ অফিসে চেয়ার নিয়ে মারতে এসেছিল। এ অপমান সহ্য করে রাজনীতি করা যায়? বাঁচা যায়? আপনাদের সঙ্গে কত সময় রাজনীতির কারণে কত রকম কত কিছু করেছি। কিন্তু কাছে গেলে সন্তানের মতো আদরযত্ন ভালোবাসা পেয়েছি। স্যার, আমি হয়তো বাঁচব না। মাফ করে দিয়েন।’ এর কয়েক ঘণ্টা পর ৬টার দিকে জানানো হয়েছিল শাজাহান আর ইহজগতে নেই। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শওকত মোমেন শাজাহানের ছেলে জয়ের বাসাইলে প্রধান শক্তি ছিল অলিদ। শাজাহানের মৃত্যুতে সখীপুর-বাসাইল আসন শূন্য হয়। আমাদের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্ম হয়েছিল সখীপুর-বাসাইল থেকে। তাই চারদিকে আওয়াজ উঠে আমাকে নির্বাচন করতে হবে। আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। তারপরও ’১৪ সালে উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলাম। সেই প্রথম ঋণ খেলাপি দেখিয়ে আমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়। আমি ব্যাপারটা জানতাম না। তাই অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে ঋণটি পুনঃতফসিলের অথবা একবারে সমন্বয়ের অনুরোধ জানিয়ে ছিলাম। সে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত হিসেব কিতেব করে ৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা পাওনা দেখিয়ে ২৬/০৮/২০১৫ইং তারিখের ৪২৭তম বোর্ডে উত্থাপন করা হয়। বোর্ড টেবিলে বসেই প্রস্তাবিত পাওনা ৯ কোটি ৫৬ লাখকে আরও ১ কোটি ২৯ লাখ বাড়িয়ে ১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ১০ বছরে সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থাকে অশ্রেণিকৃত ঘোষণা করা হয়। ঋণটি ১০ বছরে শোধ করতে হবে এমন শর্ত থাকলেও কবে কত কিস্তিতে শোধ করতে হবে তার কোনো উল্লেখ ছিল না। সেখানে আরও চারটি বিশেষণ জুড়ে দেয়।

“স্মারকটি পর্যালোচনাস্তে পরিষদ লক্ষ্য করেন যে,

 

(ক) ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল কাদের সিদ্দিকী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যুদ্ধে অপরিসীম অবদানের জন্য তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হন;

(খ) ঋণগ্রহীতা ইতঃপূর্বে কোনো সুদ মওকুফ সুবিধা ভোগ করেননি;

(গ) ঋণ হিসাবটি দীর্ঘদিন যাবৎ মন্দ হিসাবে শ্রেণিকৃত এবং

(ঘ) আদালতের মাধ্যমে ঋণ আদায় সময় সাপেক্ষ।”

সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত চিঠি পেয়ে কালিহাতীর জন্য আমি মনোনয়নপত্র দাখিল করি। সময়টা ছিল ১১/১০/২০১৫ইং তারিখ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। যাচাই-বাছাই ১৩/১০/২০১৫ইং তারিখ। যাচাই-বাছাইয়ের সময় ১২/১০/২০১৫ইং তারিখের স্বাক্ষরে অগ্রণী ব্যাংক টাঙ্গাইল ব্রাঞ্চ থেকে একখানা চিঠি হাজির করা হয়, ‘সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড ঋণ খেলাপি নয়, অশ্রেণিকৃত এই পত্র দেওয়া ব্যাংকের একটি ধারণাগত ভুল।’ তাই আমার মনোনয়নপত্র রিটার্নিং অফিসার গ্রহণ করেননি। আমি নির্বাচন কমিশনে আপিল করলে শুনানি হয়। সব কাগজপত্র জমা দিই। ওর আগে আবু হেনা প্রধান নির্বাচন কমিশন থাকতে আমি একবার নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। মনোনয়নপত্র বাতিলের শুনানি শেষে সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে রায় ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নুরুল হুদা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করে চেম্বারে চলে যান। হয়তো এইচ টি ইমামের সঙ্গে কথা বলে কয়েক ঘণ্টা পর আপিল নামঞ্জুর করেন। যাই হাই কোর্টে। সেই তখনই দেখা এ জে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি যে একজন ভালো প্রবীণ আইনজীবী এটা আমাকে বলেছিল হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি গৌর গোপাল সাহার ছেলে সুব্রত সাহা। গৌর গোপাল সাহা টাঙ্গাইলের সাবালিয়ার মানুষ। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইল কোর্টে ওকালতি করতেন। আমাদের কাজও করতেন। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তার ছেলে সুব্রতও খুবই ভালো। সুব্রতই বলেছিল, ‘কাকা, এ জে মোহাম্মদ আলী খুবই পরিপক্ব আইনজীবী। গিয়েছিলাম তার কাছে। বড় ভালো লেগেছিল। ভীষণ সম্মান দেখিয়েছিলেন। আন্তরিকভাবে কোর্টে দাঁড়িয়েছিলেন। তার আবার প্রধান সহকারী ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী। ’৭৫-এ তার বাবা আবদুর রউফ চৌধুরীর সঙ্গে আমি ছিলাম জেলা গভর্নর। পরিচয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তার কাছে সব রকমের সহায়তা পেয়েছি। এ জে মোহাম্মদ আলী কোর্টে দাঁড়ালেন। কথাবার্তা হলো। সব কাগজপত্র দেখালেন। নির্বাচন কমিশনের হয়ে তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নানা কথা বলার চেষ্টা করলেন। বললেন, ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়নি। তাকে ১০ বছরের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জজদ্বয় নিজেরাই বললেন, সুযোগ মানে এই ১০ বছর তিনি তার কোম্পানির জন্য কোনো অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারবেন না? তিনি একজন রাজনীতিক মানুষ, ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না? তাহলে এর চেয়ে তার ফাঁসি হওয়াই ভালো। কোর্ট রায় দিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের মনোনয়ন বৈধ। আমরা রিটার্নিং অফিসারের কাছে গেলাম তিনি সানন্দে মার্কা দিয়ে দিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম লাফালাফি করতে থাকলেন- তিনি আপিল করবেন, আপিল করবেন। প্রশ্ন এলো তিনি তো পক্ষের নন, সরকার তো পক্ষের নয়। তাহলে আপিল করবেন কী করে? তিনি থামলেন। তখন নির্বাচন কমিশন আপিল করবে। সেখানেও প্রশ্ন এলো, কত নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায়। নিম্ন আদালত হাই কোর্টে আসে না। নির্বাচন কমিশনে আমি গিয়েছিলাম। আদালত হিসাবে সেখানে ন্যায়বিচার পাইনি। তাই তার থেকে উচ্চ আদালতে গেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে কোনো প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে হাই কোর্টে গেলে হাই কোর্ট প্রার্থীর পক্ষে রায় দিলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের আপিল করার কোনো এখতিয়ার থাকার কথা নয়। কারণ তারা বাদী-বিবাদী নন। সে যাই হোক সাধারণত প্রার্থী মার্কা পেয়ে যাওয়ার পর নির্বাচন পর্যন্ত আর কোনো আইনি কার্যক্রম চলার কথা না। কিন্তু যেহেতু আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, এক কথায় সব অস্ত্র তাঁর পায়ের কাছে বিছিয়ে দিয়েছি সেহেতু আমার ক্ষেত্রে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে কেন? সেখানে তো প্রভাব খাটাতেই হবে। নির্বাচন কমিশন আপিল করলেন। ৪-৬ মাস মামলা চলল। এই সময় এ জে মোহাম্মদ আলীকে যে সহযোগিতা করতে দেখেছি তার কোনো তুলনা হয় না। দু-একবার সম্মানী দিতে গেছি। পকেটে টাকা নিয়ে যখন কথা হয়েছে একবার তো বলেই বসলেন, আপনার মতো মানুষের কাছ থেকে টাকা নেব তার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। টাকা দিতে চাইলে আপনার মামলায় থাকতে পারব না।’ তার কথা আমাকে স্পর্শ করেছিল। হঠাৎই মানুষটি চলে গেলেন। এখন তো দলাদলির কারবার। গুণের কোনো কদর নেই, মূল্যায়ন নেই। তবু বলছি এ জে মোহাম্মদ আলী বড় ভালো মানুষ ছিলেন, একজন গুণী মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করুন। আমিন।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com     সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম

» খালেদা জিয়াকে ১২ বছর সেনাবাহিনী থেকে দূরে রাখা হয়েছে : ফখরুল

» খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতাদের সাক্ষাৎ

» রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানদের সাক্ষাৎ

» হাসিনার পতন হলেও ফ্যাসিবাদ মাঠে সক্রিয় : মাহমুদুর রহমান

» আমি ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচনে বিশ্বাসী: সিইসি

» প্রাথমিকের ৫ কোটি ৩২ লাখ বইয়ে ব্যয় ২৭৬ কোটি টাকা

» খালেদা জিয়াকে আনতে পেরে আমরা গর্বিত: প্রধান উপদেষ্টা

» বেসিস সদস্যদের জামানতবিহীন ঋণ প্রদান করবে ব্র্যাক ব্যাংক

» অনলাইনে গ্যাস বিল পরিশোধে উপায় এবং তিতাস গ্যাসের অংশীদারত্ব

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

যাওয়া-আসা এই তো নিয়ম

ছবি সংগৃহীত

 

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম:  পাঠক অনেকেই জানেন তীব্র দাবদাহে সংগ্রামপুরের সিলিমপুর সোনার বাংলা মৎস্য খামারে পুকুর খনন নিয়ে পড়ে আছি। বিশেষ করে কিছু গাছ লাগাতে মনটা কেন যেন বড় আনচান করছিল। আম, জাম, মাল্টা, জাম্বুরা, আমড়া যেসব গাছ আছে সেসব গাছের তেমন যত্ন নেই। তারপরও গাছে গাছে ডালে ডালে প্রচুর ফল। কেন যেন ফলগুলো দেখে বুকের ভিতর এক অন্যরকম অনুরণন সৃষ্টি হয়। এত অনাদরের পরও আল্লাহর সে কি অপার মহিমা। তাই প্রতি মুহূর্তে মনে হয় গাছগুলোর যদি যত্ন নিতে পারতাম, একটু পানি দিতে পারতাম, একটু সার, একটু গোবর, একটুখানি ছাই আরও যা যা গাছ চায় তাহলে কত না ভালো হতো। গত দুই মাস নিয়মিত যাতায়াত করি। সিলিমপুরে কাজের লোক যারা আছে তাদের প্রতি আমার একটা ধারণা ছিল তারা কাজ করে না, শুধু শুধু ফাঁকি দেয়, বসে থাকে। ইদানীং অনেক মানুষেরই দায়িত্ববোধ নেই, কাজকে ভালোবাসে না, অলস বসে থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু এই কদিন নিয়মিত সময় দিয়ে দেখলাম যারা কায়িক পরিশ্রম করে তাদের মতো সোনার মানুষ হয় না। ত্রুটি তাদের নয়, যারা তদারকি করে ত্রুটি তাদের। কাকে কী করতে হবে, কখন করতে হবে কেউ জানে না, বলতে পারে না। কারণ চোখ নেই, দেখে না। যুক্তিবিদ্যায় দেখেছি, চোখ থাকলেও আমরা আমাদের চোখের সামনে সব দেখি না, অনেক কিছু চোখের আড়ালেই থেকে যায়। যা অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখতে হয়। কিন্তু কিছু মানুষ যারা বড় বড় জিনিসও দেখে না, দেখতে পায় না। খামারে গিয়ে অনেক সময় দেখি এটা ওটা এখানে সেখানে পড়ে আছে। একটু সরিয়ে রাখতে একটু ঝাড়পোঁছ করে রাখতে কোনো অসুবিধা নেই। লোকজন আছে, তারা যে কাজ করে না তেমন নয়। যাকে যা বলা হয় তার চাইতেও বেশি করে। মুক্তিযুদ্ধে যেমনটা দেখেছি, যাকে যে দায়িত্ব দিয়েছি তার চাইতে অনেক বেশি করেছে, ভালো করেছে। পুকুরগুলো সংস্কার করা হচ্ছে। বেকু, টাপি মাটি এদিক ওদিক নিচ্ছে, খাম-খোঁটা গাড়ছে। কী প্রচন্ড দাবদাহ, তার মধ্যেও সবার মুখে হাসি। বুক জুড়িয়ে যায়। তাই বেশ আগ্রহ নিয়ে কাজটা দেখছিলাম বা কদিন থেকে দেখছি। অনেকে হয়তো মনে করতে পারে গ্রামে একটা দুটা পুকুর সংস্কারে পড়ে থাকা আপনার কাজ নয়। বলতেই পারেন। কিন্তু আমি যদি এখন একটা গাছে ফুল ফোটাতে পারি, ফল ফলাতে পারি সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ যখন যেভাবে রাখেন তাতেই খুশি থাকতে শিখেছি। জীবনে বহু ঝড়-তুফান পেরিয়ে এসেছি। এখন যাওয়ার পালা। তাই কোনো লোভ-ক্ষমতা স্পর্শ করে না, অবহেলা আহত করে না। হেলাফেলা নিয়ে, ক্ষমতা-অক্ষমতা নিয়ে একটি সত্য ঘটনা আগামী পর্বে লেখার চেষ্টা করব।

সিলিমপুরে থাকলে পত্র-পত্রিকা একটু দেরিতে পাই। পত্রিকায় চোখ পড়তেই হঠাৎই দেখলাম প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আর নেই। মৃত্যু সংবাদ তো প্রতিদিনই পাই। জন্ম আর মৃত্যু শাশ্বত সত্য। মৃত্যু সংবাদ অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখেছি অনেক বছর। আমার প্রেম আমার ভালোবাসা যে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে সেই বঙ্গবন্ধু ওভাবে আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যাবেন মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি। আর তাঁর মৃত্যু তো স্বাভাবিক ছিল না। যে মানুষটা সারা জীবন আমাদের জন্য সংগ্রাম করেছেন, সুখ ত্যাগ করেছেন সেই মানুষটা ঘাতকের গুলিতে নিহত হয়েছেন। যখন বিপথগামী খুনিরা আক্রমণ করেছিল তখন বঙ্গবন্ধুর আর তাঁর আশপাশের লোকজনের কেমন লেগেছে। এমন একটি বিরাট মানুষ চন্দ্র-সূর্যের সমান যার উচ্চতা তাঁর বুকের ভিতর কেমন তোলপাড় করেছে, কেমন অসহায় লেগেছে তাঁর বা তাঁদের। এসব যখনই ভাবি তখন কেমন যেন হয়ে যাই। কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। ঠিক একইভাবে দেহরক্ষীদের গুলিতে ভারতের মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছিলাম সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে যখন বর্ধমানের খোশবাগানে ড. স্বরূপ দত্তের চেম্বারে ছিলাম। আমার স্ত্রী নাসরীন সিদ্দিকীর সব থেকে বড় দুঃখ সে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দেখা পায়নি। মার সঙ্গে, ভাইবোনের সঙ্গে ইন্দিরাজির যখনই সে ছবি দেখে তখনই আফসোস করে। মা-বাবা চলে গেছেন সেটাও বুকে আলোড়ন তোলে। তাই মৃত্যুকে গ্রহণ করার শক্তি আগেই অর্জন করেছিলাম। কিন্তু তারপরও মাঝেসাজে কিছু মৃত্যু নাড়া দেয়। এ জে মোহাম্মদ আলী তেমন একজন। আমি তাকে চিনতাম না। তিনি যখন বড় হয়েছেন আমি তখন নির্বাসনে। দেশে এসেছি ’৯০ সালে। তারপর হাজারো উত্থালপাথাল অতিক্রম করে এতটা পথ পারি দিয়েছি। কয়েকদিন আগে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা। তিনি আমার থেকে সাত বছরের বড়। আমার আর তার মাঝে এক ভাই, এক বোন ছিল। তারা চলে গেছে প্রায় ৭৫ বছর আগে। চা খেতে খেতে কথার ফাঁকে হঠাৎই কেন যেন বলেছিলাম, আমার জীবন গুরুহীন শুরু। আমি কোনো প্রেম করতে পারিনি বা করিনি। ছেলেবেলায় কোনো জ্ঞান বুদ্ধি ছিল না। ছিলাম অজো মূর্খ। একেবারে বাউন্ডুলে বাঁধনহারা। আপনাকে দেখে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম। ভীরুতা কেটেছিল। রাজনীতিতে না এলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতো না, তাঁকে পেতাম না। তিনি আমার প্রেম, তিনিই আমার ভালোবাসা। আজ আমার মধ্যে যত প্রশান্তি তার সবই বঙ্গবন্ধু। আজকে রাস্তাঘাটের একটা পোকপাখালি, একেবারে অন্নহীন বস্ত্রহীন শিশুরাও যে আমার কাছে আদরণীয় সম্মানের সে শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্য। দেশ ও দেশের একমুঠো মাটি একটি মানুষের জীবনে কত বড় সম্পদ তা শুধু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে মানুষকে ভালোবেসে জেনেছি। আমার সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন না। কারণ দেশপ্রেম ছেলেখেলা নয়। চুরি-চামারি করে টাকা-পয়সা, গাড়ি বাড়ি করা যায়। কিন্তু একমুঠো মাটি হাতে নিলে তাতে মায়ের স্পর্শ অনুভব করা যায় না। এটা আল্লাহর দয়া না হলে কারও পক্ষে সম্ভব না। এটা অবশ্যই সত্য, একজন মানুষ হিসেবে, একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি, আল্লাহর দয়া না হলে আমাদের কারও কিছুই করার নেই। নিজের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইবার শক্তিটুকুও আমাদের নেই। এ বিশ্বাস ও অনুভূতি এক দিনে আসেনি বা জাগেনি। এটা চলতে চলতে দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে নানা উত্থালপাথালের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়। এত কিছুর পরও প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলীর মৃত্যু আমাকে যারপরনাই নাড়া দিয়েছে। এমনিতে আমি ক্ষমতাবানদের নিয়ে ভাবি না। স্বাভাবিক খবরাখবরের বাইরে বেশি খবরও রাখি না বা রাখতে চাই না। আমার সব ভাবনা নেংটি পুঁচকি নিয়ে, যাদের কিছু নেই তাদের নিয়ে কারবার। কিন্তু এ জে মোহাম্মদ আলী আমার হৃদয়জুড়ে আছেন। যতদিন বেঁচে থাকব থাকবেন ততদিন। স্বাধীনতার পরপরই বিধ্বস্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর হুকুমে একটা নির্মাণ প্রতিষ্ঠান করেছিলাম। সেই প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকভাবে বঙ্গবন্ধু নিজেই ২-৩ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সোনার বাংলার মূলধন ছিল ৫ লাখ। আমরা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সেতুগুলো ভেঙেছিলাম সেগুলো তাড়াতাড়ি করে ফেলার প্রয়োজন ছিল তাই গঠন করেছিলাম সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড। কেবল স্বাধীন হয়েছি আর মুক্তিযুদ্ধে আমরা অত বড় বিজয় অর্জন করেছি। সবার মধ্যে ছিল চনমনে অসাধ্য সাধনের প্রবণতা বা দুর্বার ইচ্ছা। সেভাবেই কাজ হতো। কত নেতা-কর্মী সোনার বাংলায় যেতেন, প্রবীণরা ফোন করতেন, চিঠি লিখতেন আমরা সাধ্যমতো সম্মানের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা করতাম। আমরা ’৪৮ সালে প্রথম টাঙ্গাইলের যে বাড়ি এসেছিলাম তার দলিলে ছিল ৮০১ টাকা। এখন সেই বাড়ি বা সেটুকু জায়গার দাম না হলেও ৮-১০ কোটি টাকা হবে। তাই সময় পার হলে অনেকে অনেক কিছু ভুলে যায়। কী রোগেই ধরেছে আমাকে, আমি তেমন কিছু ভুলতে পারি না। তেমনি এ জে মোহাম্মদ আলীও একজন। সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড একসময় অগ্রণী ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেটা ধীরে ধীরে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা মঞ্জুরিতে পৌঁছে। ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা শুধু মঞ্জুরি পত্রেই ছিল। আসল ২ কোটি ৯৪ লাখ, বাকি ১ কোটি ৪৬ লাখ সুদ ও অন্যান্য ব্যাংক চার্জ। তারপরও জমি বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা একবারে শোধ করতে চাইলে ব্যাংক কোনো উত্তর দেয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের সামরিক শাসনের আগ পর্যন্ত সব সময় আমাদের ঋণ নিয়মিত ছিল। অনিয়মিত হয়েছে ১/১১-এর সামরিক জমানায়। এত সবের পরও মনে হয় এযাবৎ ৪ কোটি ৫০ লাখ মঞ্জুরির বিপরীতে আমরা ব্যাংককে ১১-১২ কোটি দিয়েছি। তারপরও তাদের নাকি এখনো ৮-১০ কোটি পাওনা। অথচ আইনে আছে কোনো ঋণ কোনোকালেই দ্বিগুণের বেশি হবে না। সে হিসাবে ৩ কোটি ৯ কোটি হতে পারত। সে যাক, নানা কারণে লতিফ ভাই কালিহাতীর আসন ছেড়েছিলেন। মারাত্মক চাপাচাপিতে আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলাম। তারও আগের ঘটনা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না এটাই ছিল দলীয় সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাসাইল-সখীপুরের বিনা ভোটে এমপি শওকত মোমেন শাজাহান ২০ জানুয়ারি হঠাৎই মারা যায়। তার মৃত্যুও এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। মারা যাওয়ার ৫-৬ ঘণ্টা আগে রাত ১১টা সাড়ে ১১টায় ফোন করেছিল, ‘স্যার, বাসাইল উপজেলার চেয়ারম্যান কাজী অলিদ আমাকে বাসাইল আওয়ামী লীগ অফিসে চেয়ার নিয়ে মারতে এসেছিল। এ অপমান সহ্য করে রাজনীতি করা যায়? বাঁচা যায়? আপনাদের সঙ্গে কত সময় রাজনীতির কারণে কত রকম কত কিছু করেছি। কিন্তু কাছে গেলে সন্তানের মতো আদরযত্ন ভালোবাসা পেয়েছি। স্যার, আমি হয়তো বাঁচব না। মাফ করে দিয়েন।’ এর কয়েক ঘণ্টা পর ৬টার দিকে জানানো হয়েছিল শাজাহান আর ইহজগতে নেই। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শওকত মোমেন শাজাহানের ছেলে জয়ের বাসাইলে প্রধান শক্তি ছিল অলিদ। শাজাহানের মৃত্যুতে সখীপুর-বাসাইল আসন শূন্য হয়। আমাদের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্ম হয়েছিল সখীপুর-বাসাইল থেকে। তাই চারদিকে আওয়াজ উঠে আমাকে নির্বাচন করতে হবে। আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। তারপরও ’১৪ সালে উপনির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলাম। সেই প্রথম ঋণ খেলাপি দেখিয়ে আমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়। আমি ব্যাপারটা জানতাম না। তাই অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে ঋণটি পুনঃতফসিলের অথবা একবারে সমন্বয়ের অনুরোধ জানিয়ে ছিলাম। সে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত হিসেব কিতেব করে ৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা পাওনা দেখিয়ে ২৬/০৮/২০১৫ইং তারিখের ৪২৭তম বোর্ডে উত্থাপন করা হয়। বোর্ড টেবিলে বসেই প্রস্তাবিত পাওনা ৯ কোটি ৫৬ লাখকে আরও ১ কোটি ২৯ লাখ বাড়িয়ে ১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ১০ বছরে সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থাকে অশ্রেণিকৃত ঘোষণা করা হয়। ঋণটি ১০ বছরে শোধ করতে হবে এমন শর্ত থাকলেও কবে কত কিস্তিতে শোধ করতে হবে তার কোনো উল্লেখ ছিল না। সেখানে আরও চারটি বিশেষণ জুড়ে দেয়।

“স্মারকটি পর্যালোচনাস্তে পরিষদ লক্ষ্য করেন যে,

 

(ক) ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জনাব আব্দুল কাদের সিদ্দিকী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতা যুদ্ধে অপরিসীম অবদানের জন্য তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হন;

(খ) ঋণগ্রহীতা ইতঃপূর্বে কোনো সুদ মওকুফ সুবিধা ভোগ করেননি;

(গ) ঋণ হিসাবটি দীর্ঘদিন যাবৎ মন্দ হিসাবে শ্রেণিকৃত এবং

(ঘ) আদালতের মাধ্যমে ঋণ আদায় সময় সাপেক্ষ।”

সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত চিঠি পেয়ে কালিহাতীর জন্য আমি মনোনয়নপত্র দাখিল করি। সময়টা ছিল ১১/১০/২০১৫ইং তারিখ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। যাচাই-বাছাই ১৩/১০/২০১৫ইং তারিখ। যাচাই-বাছাইয়ের সময় ১২/১০/২০১৫ইং তারিখের স্বাক্ষরে অগ্রণী ব্যাংক টাঙ্গাইল ব্রাঞ্চ থেকে একখানা চিঠি হাজির করা হয়, ‘সোনার বাংলা প্রকৌশলিক সংস্থা (প্রাঃ) লিমিটেড ঋণ খেলাপি নয়, অশ্রেণিকৃত এই পত্র দেওয়া ব্যাংকের একটি ধারণাগত ভুল।’ তাই আমার মনোনয়নপত্র রিটার্নিং অফিসার গ্রহণ করেননি। আমি নির্বাচন কমিশনে আপিল করলে শুনানি হয়। সব কাগজপত্র জমা দিই। ওর আগে আবু হেনা প্রধান নির্বাচন কমিশন থাকতে আমি একবার নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিলাম। মনোনয়নপত্র বাতিলের শুনানি শেষে সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে রায় ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নুরুল হুদা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করে চেম্বারে চলে যান। হয়তো এইচ টি ইমামের সঙ্গে কথা বলে কয়েক ঘণ্টা পর আপিল নামঞ্জুর করেন। যাই হাই কোর্টে। সেই তখনই দেখা এ জে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। তিনি যে একজন ভালো প্রবীণ আইনজীবী এটা আমাকে বলেছিল হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি গৌর গোপাল সাহার ছেলে সুব্রত সাহা। গৌর গোপাল সাহা টাঙ্গাইলের সাবালিয়ার মানুষ। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইল কোর্টে ওকালতি করতেন। আমাদের কাজও করতেন। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তার ছেলে সুব্রতও খুবই ভালো। সুব্রতই বলেছিল, ‘কাকা, এ জে মোহাম্মদ আলী খুবই পরিপক্ব আইনজীবী। গিয়েছিলাম তার কাছে। বড় ভালো লেগেছিল। ভীষণ সম্মান দেখিয়েছিলেন। আন্তরিকভাবে কোর্টে দাঁড়িয়েছিলেন। তার আবার প্রধান সহকারী ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী। ’৭৫-এ তার বাবা আবদুর রউফ চৌধুরীর সঙ্গে আমি ছিলাম জেলা গভর্নর। পরিচয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত তার কাছে সব রকমের সহায়তা পেয়েছি। এ জে মোহাম্মদ আলী কোর্টে দাঁড়ালেন। কথাবার্তা হলো। সব কাগজপত্র দেখালেন। নির্বাচন কমিশনের হয়ে তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম নানা কথা বলার চেষ্টা করলেন। বললেন, ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়নি। তাকে ১০ বছরের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জজদ্বয় নিজেরাই বললেন, সুযোগ মানে এই ১০ বছর তিনি তার কোম্পানির জন্য কোনো অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে পারবেন না? তিনি একজন রাজনীতিক মানুষ, ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না? তাহলে এর চেয়ে তার ফাঁসি হওয়াই ভালো। কোর্ট রায় দিলেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের মনোনয়ন বৈধ। আমরা রিটার্নিং অফিসারের কাছে গেলাম তিনি সানন্দে মার্কা দিয়ে দিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম লাফালাফি করতে থাকলেন- তিনি আপিল করবেন, আপিল করবেন। প্রশ্ন এলো তিনি তো পক্ষের নন, সরকার তো পক্ষের নয়। তাহলে আপিল করবেন কী করে? তিনি থামলেন। তখন নির্বাচন কমিশন আপিল করবে। সেখানেও প্রশ্ন এলো, কত নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায়। নিম্ন আদালত হাই কোর্টে আসে না। নির্বাচন কমিশনে আমি গিয়েছিলাম। আদালত হিসাবে সেখানে ন্যায়বিচার পাইনি। তাই তার থেকে উচ্চ আদালতে গেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে কোনো প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের রায়ে সংক্ষুব্ধ হয়ে হাই কোর্টে গেলে হাই কোর্ট প্রার্থীর পক্ষে রায় দিলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের আপিল করার কোনো এখতিয়ার থাকার কথা নয়। কারণ তারা বাদী-বিবাদী নন। সে যাই হোক সাধারণত প্রার্থী মার্কা পেয়ে যাওয়ার পর নির্বাচন পর্যন্ত আর কোনো আইনি কার্যক্রম চলার কথা না। কিন্তু যেহেতু আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসি, এক কথায় সব অস্ত্র তাঁর পায়ের কাছে বিছিয়ে দিয়েছি সেহেতু আমার ক্ষেত্রে আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে কেন? সেখানে তো প্রভাব খাটাতেই হবে। নির্বাচন কমিশন আপিল করলেন। ৪-৬ মাস মামলা চলল। এই সময় এ জে মোহাম্মদ আলীকে যে সহযোগিতা করতে দেখেছি তার কোনো তুলনা হয় না। দু-একবার সম্মানী দিতে গেছি। পকেটে টাকা নিয়ে যখন কথা হয়েছে একবার তো বলেই বসলেন, আপনার মতো মানুষের কাছ থেকে টাকা নেব তার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। টাকা দিতে চাইলে আপনার মামলায় থাকতে পারব না।’ তার কথা আমাকে স্পর্শ করেছিল। হঠাৎই মানুষটি চলে গেলেন। এখন তো দলাদলির কারবার। গুণের কোনো কদর নেই, মূল্যায়ন নেই। তবু বলছি এ জে মোহাম্মদ আলী বড় ভালো মানুষ ছিলেন, একজন গুণী মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তাকে বেহেশতবাসী করুন। আমিন।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com     সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com