ছবি সংগৃহীত
অনলাইন ডেস্ক :প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের জীবন আরও বেশি যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। সবসময় প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকে মানুষ। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিশুদের স্কুলজীবনও এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পড়াশুনার চেয়ে শিশুদের সময় এখন বেশি কাটে প্রযুক্তির সঙ্গে। ভিডিও গেমস থেকে শুরু নানা ধরনের কার্টুন দেখে সময় কাটে তাদের। এতে শিশুরা দিন দিন অন্তর্মুখী হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ ও কার্যকলাপ থেকে ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে তারা। তাই মা-বাবার উচিত সন্তানের সঙ্গে তথ্যবহুল কথোপকথন করা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা, যা শিশুদের মন খুলে কথা বলতে সাহায্য করবে। তবে মা-বাবার যোগাযোগের ধরন পাল্টাতে হবে। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর ‘তোমার দিনটি কেমন গেল?- এমন জাতীয় গতানুগতিক প্রশ্ন থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, শিশুরা এ জাতীয় প্রশ্ন একেবারেই পছন্দ করে না।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ করা যায়, যা তাদের বহির্মুখী হতে সাহায্য করবে।
প্রথমে জানতে হবে বাচ্চারা কেন কথা বলতে পছন্দ করে না?
স্কুলজীবন শিশুদের কাছে একঘেয়েমি হয়ে থাকে। পড়াশুনাসহ বিভিন্ন কারণে তাদের মাঝে এক ধরনের বিরক্তি চলে আসে। এমতাবস্থায় ‘আজ দিনটি কেমন কাটল? এমন প্রশ্নের উত্তরের জন্য ব্যস্ত দিনের বিভিন্ন তথ্য সংশ্লেষণ করার জন্য যথেষ্ট প্রচেষ্টা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। যদি শিশু মনে করে যে, তার উত্তরে বাবা-মায়ের রাগ, উদ্বেগ বা বিভ্রান্তি হতে পারে, তবে সে উত্তর দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হতে পারে।
স্কুলের পরপরই শিশুরা ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। স্কুল থেকে ফিরে তারা কথা বলার আগে কিছু খাবার খেতে পছন্দ করে। যদি আপনি মনোবিজ্ঞানী আব্রাহাম মাসলোর ‘প্রয়োজনের শ্রেণিবিন্যাস’ সম্পর্কে তার বিখ্যাত তত্ত্বের কথা মনে করেন, তাহলে ক্ষুধার মতো বেঁচে থাকার চাহিদাগুলো যোগাযোগ এবং সংযোগের আগে আদর্শভাবে পূরণ করা দরকার।
শিশুদের মনের তত্ত্ব (অন্য ব্যক্তির মনে কী ঘটছে তা কল্পনা করার ক্ষমতা) এখনও সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। তাই তারা বুঝতে পারে না কেন তাদের বাবা-মা স্কুল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছেন বা তারা কী জানতে চান।
শিশুর সঙ্গে কথা বলার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
সন্তানকে তথ্যবহুল কথোপকথনে উৎসাহিত করার জন্য কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।
১. আগে উদ্দেশ্য জানুন: প্রথমে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন আপনি শিশুর কাছে কী তথ্য জানতে চান, নাকি কেবলই সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে চান। এ জন্য তার সঙ্গে সংযোগের একটি ভাল মুহূর্ত হতে পারে স্কুলের গেট। সেখানে আপনি তাকে বলতে পারেন- আপনি তাকে দেখে খুব খুশি।
এখানে ‘আজ তুমি কী কী শিখলে?’ এ ধরনের প্রশ্নের পরিবর্তে তাকে বলতে পারেন, আজ কি তোমার বানান চেক করেছো?
২. যথোপযুক্ত সময় নির্ধারণ: স্কুলের ঠিক পরেই সন্তানকে কিছু জিজ্ঞাসা না করাই ভাল। বরং এর পরিবর্তে কিছুটা সময় অপেক্ষা করুন। পরে একটি উপযুক্ত সময়ে তার কাছে আপনি যা জানতে চান, তা জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এ জন্য একটি উপযুক্ত সময় হতে পারে শিশুটি যখন তার পছন্দের খেলা খেলবে, কিংবা নাস্তা খাওয়ার যখন সে একটু শান্ত হয় অথবা যখন রাতের খাবার খায় তখন। এমনকি পরের দিন সকালে স্কুলে যাওয়ার পথেও তাকে আপনার সেই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
প্রতিদিন ডিনারের সময় তার সঙ্গে এমনভাবে কথোপকথন করুন, যা তাকে আপনার বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তর প্রস্তুত করতে সাহায্য করবে। মানুষ রাতের খাবারের টেবিলে দিনের কঠিন বা বিরক্তিকর ও আনন্দদায়ক কিছু, যা তার সঙ্গে সারা দিন ঘটেছে তা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে পছন্দ করে।
৩. অবকাশ দেওয়া: মুখোমুখি কথোপকথন শিশুর জন্য চাপ তৈরি করতে পারে। এটি তার কাছে জেরা করার মতো লাগতে পারে। এ কারণেই মনোবিজ্ঞানীরা থেরাপি চেয়ারগুলো সামান্য কোণাকোণি করে স্থাপন করেন, যাতে একটি শান্ত, স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশ তৈরি হয়। এতে কঠিন বিষয়গুলোও প্রকাশ করা সহজ হয়।
তাই মুখোমুখি কথা বলা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। বরং বিভিন্ন কাজের সময় তাকে পাশে রাখুন। যেমন- হাঁটা বা গাড়ি চালানো, কারুশিল্প করা, বিভিন্ন খেলাধুলা কিংবা রান্না করা ইত্যাদি। অথবা আপনি প্রথমে আপনার সম্পর্কে কথা বলে কথোপকথনের একটি সুযোগ তৈরি করতে পারেন।
কথোপনের উপযুক্ত সময়
কথোপকথনের সময় সন্তানের জন্য একটি স্বস্তিদায়ক ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।
১. মনোযোগ দিয়ে শুনুন: যদি আপনার সন্তান কোনও কিছু বলতে শুরু করে, তাহলে আপনি তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিন। তাকে উৎসাহ দিন কথা বলতে। এ সময় অবশ্যই ফোন দূরে রাখবেন। সে যেন বুঝতে পারে আপনি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আপনার এই আচরণ তাকে এমন অনুভূতি দিতে সাহায্য করবে যে, আপনি তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছেন এবং বোঝার চেষ্টা করছেন।
যদি আপনার সন্তান গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে শুরু করে। আর সে যদি বুঝতে পারে যে, আপনি তাকে সমর্থন করছেন না বা তার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন না, তাহলে পরবর্তীতে সে আপনার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলতে আগ্রহী হবে না।
২. সহানুভূতিশীল এবং কৌতূহলী হোন: সন্তান যখন কথা বলে তখন তাদের বিভিন্ন সমস্যা খুঁজে বের করে সেগুলোর ‘সমাধান’ বা ‘শিক্ষা’ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। সেই সঙ্গে তাদের কৌতুহলী প্রশ্নে ভয় পাবেন না। এ সময় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকবেন না। বরং তাকে উৎসাহ দিন কথোপকথন এগিয়ে নিতে। এভাবে শিশুকে তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং প্রতিক্রিয়াগুলোর মালিক হতে দিন।
৩. অন্তর্নিহিত শক্তি উদযাপন করুন: যখন আপনার সন্তান কথা বলছে, তখন আপনার সন্তান যা ভাগ করে নিয়েছে তার অন্তর্নিহিত শক্তি এবং মূল্যবোধগুলো শুনুন ও বোঝার চেষ্টা করুন। একজন অভিভাবক যখন সন্তানের শক্তি বা দক্ষতার ক্ষেত্র তুলে ধরে তখন শিশু নিজেকে আরও বেশি বলিষ্ঠ ও আত্মবিশ্বাসী মনে করে।
৪. ফলোআপ: যদি আপনার সন্তান সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে কথা বলে, তাহলে তাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করুন। যেমন বলতে পারেন, গত সপ্তাহে তুমি বলেছিলে স্কুলে বড়দের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে একটু নার্ভাস ছিলে, এখন কেমন লাগছে?। তখন সে বুঝবে যে আপনি তার প্রতি মনোযোগী। তথ্যসূত্র: দ্য স্ট্রেইটস টাইমস