ছবি সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক ডেস্ক ; মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ও আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে কাতারে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি হামলার পর এবার নতুন করে তুরস্ককে নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আঙ্কারায় এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য কি তুরস্ক?
সম্প্রতি কাতারে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, যেখানে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ‘মেজর নন-ন্যাটো অ্যালাই’ হিসেবে স্বীকৃত। ওই হামলার রেশ না কাটতেই ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন মহল এখন তুরস্ককে সামনে রেখে মন্তব্য করা শুরু করেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো মাইকেল রুবিন সরাসরি সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলের পরবর্তী টার্গেট হতে পারে তুরস্ক, এবং ন্যাটো সদস্যপদকে নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে ভাবা উচিত হবে না।
ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিশ্লেষক মেয়ির মাসরি সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, ‘আজ কাতার, কাল তুরস্ক’— এই বক্তব্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং আঙ্কারায় কড়া প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের এক শীর্ষ উপদেষ্টা টুইট করে বলেন, জায়নবাদী ইসরায়েল একটি ভয়ঙ্কর প্রাণী, যার দ্রুত মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়া দরকার, তখনই বিশ্বে শান্তি ফিরবে।
গত কয়েক মাস ধরেই ইসরায়েলপন্থী বিভিন্ন গণমাধ্যম তুরস্ককে ইসরায়েলের ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করছে। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের কৌশলগত উপস্থিতি এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সিরিয়ায় দেশটির সক্রিয় ভূমিকাকে ইসরায়েলি বিশ্লেষকরা হুমকি হিসেবে তুলে ধরছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আগস্ট মাসে গাজায় চলমান গণহত্যার প্রতিবাদে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদান ঘোষণা দেন, তুরস্ক ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করছে। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইসরায়েলের আগ্রাসনের কোনো সীমা নেই এবং যুক্তরাষ্ট্র এর পূর্ণ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
কাতারে হামলার পর তুরস্কের মধ্যে গভীরভাবে প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যিই তুরস্কের ওপর হামলাকে নিজেদের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করবে, যদিও তুরস্ক ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য? আঙ্কারার দৃষ্টিতে ইসরায়েলের কার্যক্রম এখন আঞ্চলিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে তিনি ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণায় বিশ্বাসী। এই ধারণা অনুযায়ী, ইসরায়েলের ভৌগোলিক বিস্তার সিরিয়া, লেবানন, মিশর ও জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই ইসরায়েল প্রতিবেশী দেশগুলোকে ধ্বংস, বিভক্ত এবং দুর্বল করার পথে হাঁটছে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গাজায় গণহত্যার পাশাপাশি ইসরায়েল নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে পশ্চিম তীর, ইয়েমেন, সিরিয়া এমনকি তিউনিসিয়াতেও। গাজার জন্য ত্রাণ নিয়ে যাওয়া বহরেও হামলার ঘটনা ঘটেছে।
তুরস্কের অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনী কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল সেম গুরদেনিজ মনে করেন, ইসরায়েল-তুরস্ক সামরিক সংঘাত শুরু হলে সেটি ঘটবে সিরিয়ার আকাশ ও স্থলভূমিতে। তিনি বলেন, সাইপ্রাসে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতিকে আঙ্কারা একটি ‘ঘেরাও কৌশল’ হিসেবে দেখছে, যা তুর্কি সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সাইপ্রাসে বসবাসকারী তুর্কিদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সিরিয়ার ভবিষ্যত নিয়েও ইসরায়েল ও তুরস্কের অবস্থান পুরোপুরি ভিন্ন। ইসরায়েল চাইছে, সিরিয়া একটি ফেডারেল কাঠামোতে বিভক্ত হোক, যেখানে অঞ্চলভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে। বিপরীতে তুরস্ক সমর্থন করছে একটি কেন্দ্রীয়কৃত রাষ্ট্র কাঠামো। সেটার গবেষণা পরিচালক মুরাত ইয়েসিলতাস বলেন, সিরিয়া নিয়ে তুরস্কের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট এবং এটি একটি লাল রেখা। তিনি সতর্ক করেন, যদি ইসরায়েল এই পথে এগোয়, তাহলে আঙ্কারা-তেলআবিব সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে।
তবে, পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা নিয়ে সবাই একমত নন। কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক আন্দ্রেয়াস ক্রিগ মনে করেন, ইসরায়েল সরাসরি তুরস্কের বিরুদ্ধে বড় ধরনের হামলায় যাবে না। বরং ইসরায়েল এমন কৌশল অবলম্বন করবে, যা গোপন থাকে— যেমন গোপন অভিযান, প্রক্সি যুদ্ধ, কিংবা সীমিত বিমান হামলা। তার মতে, ইসরায়েল এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে পূর্ব ভূমধ্যসাগর, সিরিয়া ও দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে তুরস্কের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে।
অধ্যাপক ক্রিগ পরামর্শ দেন, এই পরিস্থিতিতে তুরস্কের উচিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, কাতার, জর্ডান ও ইরাকের সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সংলাপ চালিয়ে যাওয়া, যাতে ভবিষ্যতে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে আঙ্কারা। সূত্র: আল জাজিরা