সম্প্রতি ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফিরেছেন রাজধানীর বাসিন্দা রিয়াজ হোসেন (৫০)। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘প্রায় পাঁচ মাস আগে হঠাৎ আমার গলার স্বর বসে যায়। গলায় ব্যথাসহ নানা সমস্যা হতে থাকে। আমি একজন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাই। তিনি বেশ কিছু টেস্ট করিয়ে জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের একজন চিকিৎসককে দেখাতে বলেন। তাঁর রেফার করা চিকিৎসককে সেই রিপোর্ট দেখালে তিনি জানান আমার গলায় ক্যান্সার হয়েছে, কেমো শুরু করতে হবে। আমি ভীষণ ঘাবড়ে যাই। পরিবারের সঙ্গে পরামর্শ করে ভারতে গিয়ে ডাক্তার দেখাই। তারা পুনরায় সব টেস্ট করিয়ে জানান আমার গলায় ক্যান্সারের কোনো জীবাণু নেই, তাই কেমো দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু ওষুধ দিয়েছেন, ছয় মাস পর ফলোআপের জন্য যেতে বলেছেন। ওষুধ খাওয়ার পর থেকে গলায় আর সে রকম অসুবিধা বোধ করছি না। অথচ এখানে আমাকে কেমো দিয়ে তো মেরেই ফেলত!’
প্রায় দিনই ভুল রিপোর্টে বলির পাঁঠা হচ্ছেন রোগী। রিপোর্টের ভুল কিংবা চিকিৎসকের ভুল সিদ্ধান্তে সর্বনাশ হচ্ছে রোগীর। গতকাল ভুল চিকিৎসার অভিযোগে গাজীপুরের কালীগঞ্জে এক প্রসূতি নারীর মৃত্যুর ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি আ ন ম ইমরান খান জানান, এক প্রসূতি নারীর মৃত্যুর ঘটনায় ‘জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ নামে বেসরকারি হাসপাতালের পরিচালক বন্যা আক্তার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দেশের স্বাস্থ্যসেবায় আস্থাহীনতার কারণে বিদেশগামী রোগীর ভিড় বাড়ছে। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দূতাবাসে মেডিকেল ভিসার জন্য যাওয়া মানুষের ভিড় ঊর্ধ্বমুখী। দেশের সরকারি হাসপাতালে রয়েছে অব্যবস্থাপনা, সংকট, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা। বেসরকারিতে রয়েছে আস্থার সংকট, প্রতারণার ফাঁদ। উচ্চবিত্তের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে এসব কারণ আরও উসকে দিচ্ছে। ভালো সেবার আশায় মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্তরাও ছুটছেন বিদেশে।
জানা যায়, উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। গত দুই বছর কভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে বিদেশযাত্রায় ছিল নানা বিধিনিষেধ। ভারতের সঙ্গে স্থলপথে সীমান্ত দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় যেতে পারেননি রোগীরা। সীমান্ত খুলতেই মেডিকেল ভিসা নেওয়ার ভিড় বেড়ে গেছে ভিসা সেন্টারগুলোয়। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে যাওয়া রোগীর ভিড়ও ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক রিপোর্টে বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশিরা বিদেশে চিকিৎসা করতে গিয়ে গড়ে ২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন টাকা খরচ করে থাকেন। এ অর্থ বাংলাদেশের মোট আয়ের ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই চিকিৎসা বাংলাদেশে করতে যে ব্যয় হয়, তা করতে ভারতে খরচ প্রায় দ্বিগুণ। থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে ৩ থেকে ১০ গুণ বেশি। তবে স্থানীয় হাসপাতালের বিল, কেবিন খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসাব করলে খরচ প্রায় দেশ আর বিদেশের কাছাকাছি হয়ে আসে। আর এ কারণে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর প্রতি অনীহা বেড়েই চলেছে দিন দিন। ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতে এক বছরে প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি ভ্রমণ করেছেন। এর বড় অংশ চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন।
রাজশাহীর কুমারপাড়ার বাসিন্দা সীমা দাস (৪৫)। পেটে ব্যথা ও অনিয়মিত মাসিক সমস্যায় নগরীর একটি ক্লিনিকে গাইনি চিকিৎসক দেখান। চিকিৎসক তাঁকে এফটি-থ্রি, এফটি-ফোর, টিএসএইচ ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে দেন। নগরীর লক্ষ্মীপুরের একটি ক্লিনিকে টেস্ট করান তিনি। রিপোর্ট নিয়ে চিকিৎসকের কাছে গেলে আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে জরায়ুর পাশে টিউমার রয়েছে বলে জানান চিকিৎসক। একই সঙ্গে জানান, সেটি দ্রুত অপসারণের জন্য অপারেশন প্রয়োজন। পরিবারের সদস্যরা পুনরায় টেস্টের জন্য ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সীমা দাসের ছেলে অসীম দাস বলেন, ‘কলকাতা গিয়ে মায়ের টেস্ট করালে দেখা যায় টিউমারের কোনো অস্তিত্ব নেই। এরপর চেন্নাইয়ে আরও একটি হাসপাতালে চিকিৎসক দেখিয়ে টেস্ট করাই। সেখানেও টিউমার কিংবা সিস্ট কিছুই পাওয়া যায়নি বলে জানান চিকিৎসক। দেশের এ রিপোর্টের ভিত্তিতে মায়ের অপারেশন করা হলে কত বড় ক্ষতি যে হয়ে যেত তা চিন্তাই করতে পারি না। কোন ভরসায় দেশে চিকিৎসা করাব!’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘দেশের মানুষ নানা কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। এর মধ্যে মানসিক আস্থার সংকট অন্যতম। আবার ১৬ কোটি মানুষের জন্য যত ভালো মানের হাসপাতাল থাকার কথা, সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে তা নেই। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেকে প্রতিবেশী দেশে যান।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশে মানুষ বেড়াতেও যান। আবার অনেকে চিকিৎসাও করিয়ে আসেন। আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় প্রযুক্তির উন্নয়ন তেমন ঘটেনি। কাজেই রোগীরা বিদেশমুখী হন। কারণ শরীরটা তার নিজের। রোগী যদি মনে করেন এখানকার চিকিৎসা ভালো না, তাহলে তিনি বিদেশ যাবেনই। আসলে এটা রোগীর চিন্তাভাবনার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের রোগীরা বেশি ভারতে যান। কারণ ভারতে অনেক নামকরা ভালো হাসপাতাল আছে, যা আমাদের দেশে নেই। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা যখন আরও উন্নত হবে, তখন রোগীরা বিদেশমুখী হবেন না। সবাই যে বিদেশ গিয়ে ভালো চিকিৎসা পান তা-ও কিন্তু নয়। ওখানে গিয়েও রোগীরা অনেক সময় প্রতারিত হন।’
বাথরুমে পিছলে পড়ে হাত ভেঙে গিয়েছিল ব্যবসায়ী সমীর সাহার (৫২)। ভারত থেকে চিকিৎসা করিয়ে ফিরেছেন তিনি। সমীর সাহা বলেন, ‘পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলে এক্স-রে করিয়ে উত্তরায় একজন সার্জনের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি এক্স-রে দেখে বললেন আমার হাতে অপারেশন করে স্টিলের পাত বসাতে হবে। চার দিন কেবিনে থাকাসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার ফর্দ ধরিয়ে দিলেন। আমি আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ভিসা করিয়ে থাইল্যান্ড যাই। আমার এই বন্ধুও থাইল্যান্ডে এর আগে চিকিৎসা করিয়েছেন। সেখানে হাসপাতালে গেলে তারা আগের ব্যান্ডেজ কেটে প্রযুক্তির সাহায্যে হালকা কিছু চিকিৎসা করে পুনরায় ব্যান্ডেজ করে দেন। মাত্র দুটি ওষুধ দিয়েছিলেন। ব্যান্ডেজ কাটার পর কিছু ব্যায়াম করতে বলেছিলেন। আমার হাত এখন পুরোপুরি ঠিক। আমি সব ধরনের কাজ করতে পারি। অথচ আমার ডান হাতে স্টিলের পাত বসিয়ে দিলে হাতটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে যেত। সেখানে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবহার খুব আন্তরিক। অথচ দেশের হাসপাতালে দায়িত্বরত লোকজনের ব্যবহার দেখলেই ভয় লাগে!’
বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণকারী বেশ কয়েকজন রোগীর সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দেশে চিকিৎসাসেবার ওপর তাদের আস্থা নেই। ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আর চিকিৎসাসেবায় রয়েছে সংকট। চিকিৎসক ও নার্সদের আচরণ রোগীবান্ধব নয়। এ দেশে ক্যান্সার, নিউরো, কিডনি, লিভারসহ কিছু জটিল অসংক্রামক রোগের পূর্ণাঙ্গ বা চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাসেবা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোগীর সর্বোত্তম সেবা ও নিরাপত্তা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার প্রধান কাজ। তবে বাংলাদেশের অনেক হাসপাতালে রোগীদের সেবার চেয়ে ভোগান্তিই পোহাতে হয় বেশি। প্রয়োজন না থাকলেও দীর্ঘ সময় রাখা হয় আইসিইউতে। এর ওপর লাইসেন্সবিহীন নামসর্বস্ব হাসপাতালে অপচিকিৎসা তো রয়েছেই। হৃদরোগের রোগীদের হার্টের রিং পরাতে চলে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মনকষাকষি। কিডনি, লিভার প্রতিস্থাপনে রয়েছে নানা জটিলতা। সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট, বেসরকারি হাসপাতালের লম্বা সিরিয়াল আর অব্যবস্থাপনা রোগীদের বিদেশমুখী হতে বাধ্য করে।
ঢাকার বাইরে সরকারি হাসপাতালগুলোয় নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এসে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায় রোগীদের জন্য। সরকারি হাসপাতালে একটা শয্যার ব্যবস্থা করতে গলদঘর্ম অবস্থায় পড়তে হয় রোগীর স্বজনদের। কেবিনের ব্যবস্থা করা তো রীতিমতো সোনার হরিণ পাওয়া।
সরকারি হাসপাতালে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ আগেও ছিল এখনো আছে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু রোগীর ভোগান্তি কমছে না। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, রোগীর সঙ্গে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের খারাপ আচরণ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে ঘটছে মারধরের ঘটনা। কখনো রোগীর স্বজনরা মেরে আহত করছেন চিকিৎসককে, আবার কখনো ইন্টার্ন চিকিৎসকরা মিলে পিটুনি দিচ্ছেন রোগীর স্বজনদের। প্রায়ই ঘটছে এসব। হাসপাতালে গিয়ে সেবা না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ। রোগীর অনুপাতে দেশে হাসপাতালে শয্যা ও চিকিৎসক সংখ্যায় বিশাল ফারাক। হাসপাতালের মেঝেতে থাকছেন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীরা। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ংয়ের (ইওয়াই) প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া রোগীর ৬২ শতাংশই অসংক্রামক নানা ব্যাধির (এনসিডি) চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। রোগীদের বিদেশমুখী স্রোত শুরু হলেও দেশের সেবার মান উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। করোনাভাইরাস মহামারিতে ফুটে উঠেছে দেশের স্বাস্থ্যসেবার ভঙ্গুর চিত্র।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘দেশেই ভালো মানের চিকিৎসাসেবা আছে। কিন্তু মানুষের আস্থা নেই। দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্যজনক। দেশে ওষুধের দাম বেড়েই চলেছে। নিয়ন্ত্রণে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ। ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগও নেই। সরকার শুধু বড় বড় বিল্ডিং বানাতে ব্যস্ত। কিন্তু এ বিল্ডিংয়ের কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে সে উদ্যোগ নেই। ফলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। মানুষ বিদেশমুখী হচ্ছে।’ সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন