সুলেখা আক্তার শান্তা :
যেমন কথা তেমন কাজ—কথার সঙ্গে কাজের মিল না পেলে আতিক হাসান ভীষণ ক্ষেপে যান। তিনি গ্রামের মাতবর, বিচার-সালিশ করেন, আর সেই কর্তৃত্ব নিজের সংসারেও বজায় রাখেন। তার মেয়ে, নাফিজা, কলেজে যায়, কিন্তু বাবার কড়া নজরের বাইরে এক পা ফেলা তার জন্য দুঃসাধ্য। আতিক হাসান বলেন মেয়েকে “নিচের দিকে মাথা দিয়ে কলেজে যাবা, নিচের দিকে মাথা দিয়ে বাড়ি ফিরবা। ডানে-বামে তাকানো যাবে না।”—বাবার কড়া নির্দেশে নাফিজা ভয়ে মাথা নিচু করেই চলে। বাবাকে সে ভয় পায় বাঘের মতো।
পাবেল, কলেজের পথে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে শুধুমাত্র নাফিজার এক নজর দেখার জন্য, কখনো কথা বলেনি তার সঙ্গে। একদিন সাহস করে, ফুল হাতে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। “তোমার জন্য!”—পাবেল বলতেই নাফিজা চমকে উঠে, ভয় আর আতঙ্কে বাবার কথা মনে করে। “না, আমি এই ফুল নিতে পারবো না।” বলে দ্রুত চলে যায়। পাবেল বিস্মিত!
নাফিজাদের বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করে পাবেল, নাফিজার সঙ্গে কথা বলার জন্য সুযোগ খোঁজে। একদিন রাতের বেলা, পড়ার টেবিলে বসে থাকা নাফিজাকে জানালার কাছে গিয়ে ইশারা করে। জানালায় শব্দ হলে, আতিক হাসান এগিয়ে আসেন। “কি হলো শব্দ কিসের?” পাবেল দৌড়ে পালাতে গেলে আতিক হাসান দেখতে পান একটা ছায়া। “কে গেল দৌড়ে?”—তিনি গর্জে ওঠেন।
“বাবা, আমি তো কিছু দেখিনি।”—নাফিজার কাঁপা কণ্ঠ।
স্বামীর চেঁচামেচি শুনে রেহেনা ছুটে আসেন। “কি হয়েছে?”
“মেয়ে বড় হয়েছে, সেদিকে খেয়াল রাখছো?”—স্বামীকে সতর্ক করেন রেহেনা। “বাড়িতে বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে, এমন চেঁচামেচি করলে মান-সম্মান থাকবে কিছু?” আতিক হাসান ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন, কিন্তু নাফিজার মনে তখন প্রশ্ন—এই বন্দিদশা কি চিরকালই থাকবে?
নাফিজার জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছেন আতিক হাসান। খুব দ্রুতই একটি সম্ভাব্য পাত্রের পরিবার দেখতে আসবে নাফিজাকে। এই খবর শুনে পাবেলের মনে যেন ঝড় ওঠে। তার বুকের মাঝে এক চাপা কষ্ট আর অস্থিরতা ঘনীভূত হয়। দেরি না করে সে সাহস করে হাজির হয় আতিক হাসানের সামনে, এক অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব নিয়ে। “আমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি, নাফিজাকে আমি ভালোবাসি।” আতিক হাসানের চোখদুটো সংকীর্ণ হয়ে আসে। কড়া গলায় তিনি জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বংশ কী? কর্ম কী?” পাবেল মাথা নিচু করে শান্ত গলায় উত্তর দেয়, “আমার বাবা নেই, আছে শুধু মা। আমাকে নিয়েই তাঁর সমস্ত স্বপ্ন।” পাবেল নিস্তব্ধ। অপেক্ষা, এই কথার পরিণতি কী হবে?
“তোমার সংসারের আয়ের উৎস কী?” আতিক হাসান কড়া গলায় প্রশ্ন করেন।
পাবেল মাথা উঁচু করে বলে— “আপনি হয়তো চমকে যাবেন, কিন্তু আমার মা রাস্তায় মাটি কাটেন। তিনি এই কাজ করেই আমাকে মানুষ করেছেন। আমি আমার মাকে নিয়ে গর্ব করি।” আতিক হাসান ভুরু কুঁচকে বলেন— “না, আমি চমকাইনি! কারণ সেটাও তো কাজ! রাস্তার জন্য মাটি না কাটলে রাস্তা হবে কীভাবে? ঝাড়ুদার যদি না থাকে, তাহলে রাস্তা পরিষ্কার হবে কীভাবে? এতে কোনো দোষ নেই, বরং এটাই ভালো কাজ।” একটু থেমে তিনি আবার বলেন— “তবে, একজনের কর্ম তার জীবনের মান নির্ধারণ করে। যেমন কর্ম, তেমন মানুষের সঙ্গে উঠবস করতে হয়। যদি তার চেয়ে উপরের দিকে হাত বাড়ায়, মানুষ তাকে লোভী বলে। তোমার মা কি তাহলে লোভী?”
পাবেল দৃঢ়ভাবে বলেন— “না! আমার মা লোভী নই। আমি আপনার মেয়েকে ভালোবাসি। তাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।” আতিক হাসান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন— “যাও! আমার মেয়ে পানিতে পড়েনি যে তাকে মাটি কাটে তার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে।”
পাবেলের বুকের ভেতর শূন্যতা তৈরি হয়। মা’র সম্মান যেখানে নেই, সেখানে তিনি হাজারো ভালোবাসার বিসর্জন দিতে পারে। “যেখানে মা’র সম্মান নেই, সেখানে আমি বিয়ে করবো না।” পাবেল চলে যায়।
আতিক হাসান দ্রুত মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। “কীভাবে দ্রুত মেয়েকে বিয়ে দেওয়া যায়?”—এটাই তাঁর একমাত্র ভাবনা। নাফিজা বাবার পরিকল্পনা শুনে চমকে ওঠেন— “বাবা, আমি পড়াশোনা করতে চাই। এখন বিয়ে করতে চাই না।” আতিক হাসান তাচ্ছিল্যভাবে বলেন—“পড়াশোনা করবে, বিয়ে করেও করতে পারবে। আমি চাই না আমার মান-সম্মান নষ্ট হোক। আমি মাতবর, গ্রামের বিচার-সালিশ করি। আমার নিজের ঘরে কোনো ঘটনা ঘটুক তা আমি কখনো ঘটতে দেব না।”
নাফিজা ব্যথিত মনে বলেন— “বাবা, আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আমার সাথে কারো সম্পর্ক নেই। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।” আতিক হাসান চিৎকার করেন— “তুই চুপ থাক! আমায় বেশি জ্ঞান দেবে না। আমি এসব পছন্দ করি না।”
নাফিজার বিয়ে হলো এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। টাকা-পয়সার অভাব নেই, আভিজাত্যের মোড়কও আছে। কিন্তু কিছুদিন পরই স্পষ্ট হলো বাস্তবতা—স্বামী নাহিদ বাবার টাকায় নির্ভরশীল, নিজে কোনো কাজ করে না। শুধু তাই নয়, জানা গেল, সে মাদকাসক্ত।
এই বিষয়টি আতিক হাসানের জন্য কোনো উদ্বেগের কারণ হয়নি। “সোনার আংটি বাঁকাও ভালো,”—তিনি এটাই বিশ্বাস করেন।
নাহিদের বাবা, আকবর আহমেদ, ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, “বাবা, একটা মেয়েকে বিয়ে করিয়ে এনেছি তোমার জন্য। এবার সংসারে মন দাও। আমাদের সুখ দিলি না, অন্তত মেয়েটাকে সুখী করার চেষ্টা করো।” নাহিদের চোখেমুখে বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ে। “আমাকে এসব বলতে আসো না। আমার দ্বারা কিছু হবে না। টাকা চাইছি, টাকা দাও!” বাবা নিঃশ্বাস ফেলে টাকা বের করে দেন। নাফিজা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সে দৃঢ় কণ্ঠে শ্বশুরকে বলে, “বাবা, আপনার ছেলে টাকা চাইলে তাকে টাকা দেবেন না। তার যদি টাকার দরকার হয়, তবে কাজ করে আয় করুক।” আকবর আহমেদ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, “ঠিক বলেছ বৌমা। আমি আর ওকে টাকা দেব না।” নাহিদ রাগত গলায় বলে, “কি! টাকা দেবে না? টাকা কীভাবে নিতে হয়, তা আমি জানি!” কেউ জানে না, সে টাকা নিয়ে কোথায় যায়। কিন্তু টাকা শেষ হলে আবার ফিরে আসে, একই দাবিতে—”বাবা, আমার টাকা লাগবে। আমার টাকা দাও!” এইবার আকবর আহমেদ কঠোর হলেন। “আমি তোমাকে আর কোনো টাকা দিতে পারবো না। তোমাকে খাওয়াচ্ছি, তোমার বউকে খাওয়াচ্ছি। এবার সংসারের দায়িত্ব বুঝে নাও!” নাহিদের মুখে তীব্র অস্বস্তি। সে নেশার ঘোরে বলে ওঠে, “আমি সংসার করতে চাইনি! তোমরা আমাকে বিয়ে করিয়েছ। এখন তোমরা বুঝো!”
নাহিদের বাবা-মা পৃথিবীতে আর নেই। একসময়ের অভিজাত সংসার এখন খালি ঘর। নাহিদ দিন পার করছে জমি বিক্রি করে, সে পুরনো অভ্যাসের জালে আটকে আছে। নাফিজা সেই একই বাড়ির ভেতর, নিঃসঙ্গতা আর স্বপ্নভঙ্গের মাঝে এক নতুন লড়াইয়ের মুখোমুখি। সময়ের সাথে বদলে গেছে সম্পর্কের সমীকরণ, কিন্তু নাহিদের বদল নেই। একদিন নাফিজা স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি কখনও নিজে কিছু করার কথা ভাবো না?” নাহিদ এক গ্লাস পানি পান করে বলল, “আমার জমি আছে, টাকার চিন্তা আমার করতে হয় না। কাজ করে কী হবে?” নাফিজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইল। জীবন তো কেবল টাকার লেনদেন নয়—তাতে দায়িত্ব, স্বপ্ন, স্বাভাবিকতা থাকতে হয়। কিন্তু এসব ভাবা নাহিদের কাছে অর্থহীন।
সংসারের হাল ধরার চেষ্টা করে নাফিজ। সে শান্ত গলায় বলে “নাহিদ, আগে আমার শ্বশুর ছিলেন, তিনি সংসার সামলাতেন। এখন তিনি নেই। তুমি এখন সন্তানের বাবা হয়েছো। সংসারের দায়িত্ব বুঝে নাও।” নাহিদ বিরক্তির স্বরে বলেন— “আমি এসবের মধ্যে নেই।” নাফিজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে— “তোমার বাবা ছিল টাকা, তুমি তা খরচ করেছো। কিন্তু তোমার ছেলে কীভাবে চলবে? তার বাবার তো কিছু নেই।” নাহিদ নির্বিকার থাকেন।
একদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নাহিদ ঘরে ফিরে আসে। “আমার টাকা লাগবে! টাকা দাও!” নাফিজা ধৈর্য ধরে বলে— “আমি কোথায় পাবো টাকা?” “বাবার বাড়ি থেকে এনে দে! নাহিদের অসংলগ্নতা আর সহ্য করতে না পেরে, নাফিজা বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু বাবাকে কিছুই জানায় না। কারণ, তার বাবা তাকে উচ্চ বংশ দেখে বিয়ে দিয়েছেন। তার উচ্চ বংশ নিয়ে পরে থাক। কিন্তু নাফিজা নিজের কথা না ভাবলেও, ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মনে চিন্তার ঝড় ওঠে। নাফিজার ছেলে ছোট্ট রাতুল হাঁটতে শিখছে। একদিন সে পানির কাছে যায়, কচুটি ফুল দেখে তুলে নিতে চায়। পা পিছলে পানিতে পড়ে যায়। সবাই খোঁজে, কিন্তু তাকে পাওয়া যায় না। শেষে পুকুরে ভাসমান অবস্থায় রাতুলের নিথর দেহ পাওয়া যায়। নাফিজার পৃথিবী ভেঙে যায়।
নাহিদ ছুটে আসে— “আমার ছেলেকে খুন করা হয়েছে! আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও!” নাফিজা হতবাক হয়ে যান। সে কেঁদে ওঠে— “কোনো মা কি পারে তার সন্তানকে হত্যা করতে? নাফিজা ছেলের কবরের পাশে বসে ফিসফিস করে বলেন— “বাবা, আমাকে নিয়ে যা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
নাহিদ মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে— “টাকা দিলে, নাফিজা আমার সংসারে ফিরতে পারবে। না দিলে ডিভোর্স।” নাফিজা ভাষাহীন হয়ে যান। সে এখনো সন্তানের শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার উপর স্বামীর এমন শর্ত সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে— “হে আল্লাহ, আমি কীভাবে এই যন্ত্রণা সহ্য করবো?”
এই খবর শুনে পাবেল এগিয়ে আসে। আজ পাবেল একজন সফল ব্যবসায়ী। কিন্তু তার হৃদয়ের গহীনে এখনো নাফিজার জন্য ভালোবাসা রয়ে গেছে। সে চায় না, নাফিজার সংসার ভাঙুক। নাহিদ যত টাকা চাইবে, পাবেল তত টাকা দিতে রাজি। “যদি নাফিজার সংসার বাঁচে, তাহলে আমি তাতেই শান্তি পাবো।” পাবেল এখনো বিয়ে করেনেই। বিয়ের ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা নেই।
অহংকারে পতন ঘটে। তেমন আতিক হাসানের হয়েছে। তিনি ভাবতেন— অহংকারই ক্ষমতার প্রতিচিহ্ন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন— অহংকার মানুষকে ধ্বংস করে।
নাফিজার সংসার টিকে যায়। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাকে এক নতুন উপলব্ধি এনে দেয়—যার সাথে সংসার করেছিলাম, তার কাছ থেকে ভালোবাসা পাইনি। আরেকটা মানুষ দূর থেকে আমাকে ভালোবাসে—একতরফা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। হায়রে ভালোবাসা! তুমি বড়ই অদ্ভুত।
Facebook Comments Box