ভয়ংকর কিডনি কারবার

ছবি সংগৃহীত

 

রাজধানীতে চিকিৎসা নিতে এসে কিডনি ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়েন এক রোগী। ওই রোগীকে এক চিকিৎসক পরিচয় করিয়ে দেন কিডনি কেনাবেচার দালালের সঙ্গে। চক্রটি বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ওই রোগীকে পাচার করে ভারতের উত্তর প্রদেশে। ওই রোগীর নাম কবির হোসেন। সেখানেই বিনা চিকিৎসায় একটি রেস্ট হাউসে রেখে দেওয়া হয় কবিরকে। পরে তার মৃত্যু হয়। তার প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এ ঘটনায় ২০২১ সালের ২৪ মে রাজধানীর পল্টন থানায় কবিরের ভাই জাকির হোসেন ওই চক্রের ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। মামলাটির তদন্তভার নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে গ্রেফতার হন চক্রের সদস্য আবদুুল মান্নান ও মাসুদ রানা।

 

যা আছে ডিবির তদন্তে : মামলাটির তদন্ত করেন ডিবির মতিঝিল বিভাগের এসআই স্বপন মিয়া। গত বছর ১৩ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি অভিযোগপত্রে বলেছেন, কবির হোসেনের দুটি কিডনি নষ্ট হলে তিনি ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যান। সেখানে  ডা. এ বি এম মাহবুব উল আলম ও ডা. শোহানী তাকে ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। হাসপাতালে অবস্থানরত কিডনি দালাল আবদুল মান্নানের সঙ্গে কবিরের পরিচয় হয়। ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর মান্নানের সঙ্গে দেখা করে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিস্তারিত আলোচনা করেন কবির ও তার স্বজনরা। আলোচনার একপর্যায়ে চক্রের আরেক সদস্য মাসুদ রানা কিডনি প্রতিস্থাপনে ১৯ লাখ টাকা দাবি করেন। ওই দিনই মান্নান তাদের কাছ থেকে ৫৩ হাজার টাকার চেক নেন। ডোনার হিসেবে আহমেদ শরীফ নামে এক ব্যক্তিকে উপস্থাপন করেন মান্নান। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি কবির হোসেনকে ভারতের ফোরিস হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। কবিরের সঙ্গে গিয়েছিলেন তার আরেক ভাই সগির হোসেন। কবিরের কাছ থেকে পাওয়া টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে চক্রটির মধ্যে সমঝোতা হলেও ডোনার আহমেদ শরীফ ভাগে কম পাওয়ায় কিডনি দিতে গড়িমসি করেন। এরই মধ্যে ভারতীয় পুলিশ গোপন তথ্যে আহমেদ শরীফ, ওয়াজুল ও কবিরের ভাই সগিরকে গ্রেফতার করে। পরে ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি চক্রের সদস্য মাসুদ রানা বাংলাদেশে চলে আসেন। ওই সময় ভারতীয় পুলিশ আইনি পদক্ষেপের কারণে কবিরকে ফোরিস হাসপাতাল থেকে নয়াদিল্লির সফদারজং হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না হওয়ায় ওই বছর ১২ ফেব্রুয়ারি কবিরের মৃত্যু হয়। পরে স্বজনরা ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ২৫ ফেব্রুয়ারি লাশ দেশে এনে দাফন করেন।

 

হোতাদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র : ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলে তাতে নারাজি দেন মামলার বাদী জাকির হোসেন। তার ভাষ্য, অভিযোগপত্রে কিডনি বাণিজ্যের হোতাদের অভিযুক্ত করা হয়নি।

 

এরপর মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠান আদালত। মামলায় আসামি করা হয়েছিল মাসুদ রানা, তার স্ত্রী সাহিনা, আবদুল মান্নান, আহমেদ শরীফ, তার ভাই কুতুব শরীফ, মিজানুর রহমান, ওয়াজুল হক, শাহিন ওয়াসিম, ইন্ডিয়ান ছালাম ও আইয়ুব আলীকে।

 

ভারতে চিকিৎসার জন্য কবিরের সঙ্গে যাওয়া তার ভাই সগির হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সগির হোসেন জানান, চক্রের দালাল মান্নানের সঙ্গে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ডা. এ বি এম মাহবুব উল আলম। তিনিও ওই চক্রের অন্যতম। অথচ তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি। ভারতের উত্তর প্রদেশে থাকেন মাসুদের স্ত্রী সাহিনা। তিনি বাংলাদেশের নেফ্রোলজি বিভাগের ডাক্তারদের নাম ও ফোন নম্বর সংগ্রহে রাখেন। তারা যখন রোগী পাঠান তাদের কমিশনের হিসাব সাহিনার কাছে থাকে। আর বাংলাদেশে যেসব রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ্রহ দেখান তাদের জন্য সাহিনা সেখানকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সংগ্রহ করে দেন। এরপর সেগুলো দিয়ে প্রসেস করে ভিসা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেন। সেখানে যাওয়ার পরই তারা বুঝতে পারেন আহমেদ শরীফ ছিলেন একজন ভুয়া ডোনার। যাদের অ্যাকাউন্টে চক্রটি লেনদেন করেছে এবং হুন্ডির টাকা জমা করেছে তাদেরও অভিযুক্ত থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সগির বলছেন, ‘আমরা যাওয়ার পর আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেন মাসুদ। এরপর তারা আমার ভাইকে চিকিৎসার কথা বলে বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর প্রায় তিন দিন তার কোনো খোঁজ পাইনি। নদিয়া গেস্টহাউস থেকে ভাইকে খুঁজতে বের হই। তখন আমার পাসপোর্ট না পেয়ে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। বলা হচ্ছে আমি শরীফ ও ওয়াজুলের সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছি। তা সঠিক নয়।’ তিনি জানান, শুধু তারা নন, আরও অনেকে ওই চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন। পুরো টাকাটা নেওয়া হয়েছে ঝিনাইদহের একটি হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে। ডিবিতে যখন তার মামলাটি তদন্তাধীন ছিল, তখন ঝিনাইদহ জেলার এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে কর্মরত ছিলেন। হয়তো তারই মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তদন্ত কর্মকর্তা হুন্ডি সিন্ডিকেটের সদস্যদের অভিযুক্ত করেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের এসআই স্বপন মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, যাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদেরই আসামি করা হয়েছে। আর যারা অভিযুক্ত হননি তাদের যৌক্তিক কারণেই করা হয়নি। তবে মামলাটির তদারকিতে থাকা ডিবির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রফিকুল ইসলামের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ডা. এ বি এম মাহবুব উল আলম বলেন, ‘আমার নিজেরও কিডনি প্রতিস্থাপন করা। ওই রোগী আমার পিয়নের রেফারেন্সে এসেছিল কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য। আমি পরামর্শ দিয়েছি উপকারের জন?্য। কোনো দালালের সঙ্গে আমি পরিচয় করিয়ে দিইনি। যিনি অভিযোগ করেছেন তিনি ভুল ব?্যাখ?্যা দিয়েছেন।’ মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আকতার হোসেন জানান, কোনো মামলার অধিকতর তদন্ত তাদের কাছে গেলে তাদের আরও শক্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়। ১৫ জুন মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে আদালতে তার হাজির হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর তারা মামলাটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে পারবেন।

 

হুন্ডিতে যেভাবে লেনদেন : সগির হোসেন জানান, ভারতে থাকাবস্থায় মাসুদ ও তার স্ত্রী সাহিনা ইসলামী ব্যাংকের গোল্ড কার্ডের মাধ্যমে নগদ ৪ হাজার ডলার নেন। এরপর ইসলামী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন। বাংলাদেশে তাদের স্বজনদের ওই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে বলেন মাসুদ। এমএস ফার্মেসির নামে থাকা ওই অ্যাকাউন্টটি হলো ২০৫০৭৭৭০১০১৯২৪৯১৪। এ অ্যাকাউন্টে তারা সাড়ে ৮ লাখ টাকা জমা করেন। ওই অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে জানা যায়, এমএস ফার্মেসির ওই অ্যাকাউন্টটি পরিচালিত হয় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কোলাবাজার থেকে। ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি ওই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেন কবিরের স্বজনরা। ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই দিন একই অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। প্রতি মাসে ৩ কোটির ওপর লেনদেন হয় ওই অ্যাকাউন্টে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়ে হুন্ডি করে ভারতে নেওয়া হয়। ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া কিডনি রোগী ইফতেখার, কুমিল্লার আরেক রোগী বেলায়েত এবং পরান নামে আরও অনেকে টাকা জমা দিয়েছেন ওই অ্যাকাউন্টে। জানা গেছে, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বাসিন্দা কবির হোসেন। ভারতে পুলিশের হাতে আটক হয়ে চার মাস জেল খাটেন কবিরের ভাই সগির। পরে কলকাতা হয়ে লালমনিরহাটের সীমান্ত দিয়ে দেশে আসেন তিনি। কবির হোসেন তার পরিবার নিয়ে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বরইতলা শুভাঢ্যার চরকালীগঞ্জে থাকতেন। সেখানে তিনি তাকওয়া ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকান পরিচালনা করতেন। মহামারি করোনার শুরুতে ২০২০ সালের মার্চে কবির ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি যান। সেখানে গিয়ে বুকে ব্যথা অনুভব করেন। কাঁঠালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বরিশালের আবদুুল্লাহ ক্লিনিকে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষানিরীক্ষার পর কবিরের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।  সূএ : বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» দাবি পূরণ করেই ছাত্ররা ক্লাসরুমে ফিরবে নওগাঁর পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা

» সুন্দরবনের উপকূলে খাদ্যের সন্ধানে জনপদে লোকালয়ে কালোমুখো হনুমান

» বিশ্বের ঐতিহ্য সুন্দরবনে অজগর অবমুক্ত শরণখোলায় লোকালয় উদ্ধার

» বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে থামছে না হরিণ শিকার মূল শিকারিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে ১২ মণ হরিণের মাংস সহ ৯শিকারি আটক

» বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে ৫ দিনব্যাপী ভর্তি মেলা শুরু

» বাংলাদেশের বাজারে শীঘ্রই আসছে ৫১২ জিবির বিশাল স্টোরেজ সহ স্টাইলিশ অনার এক্স৮সি ফোন

» বড়াইগ্রামে চাঞ্চল্যকর জুঁই হত্যার ঘটনায় ৫ কিশোর গ্রেফতার

» স্বচ্ছ রাজনীতি চর্চা ও দূর্গম চরাঞ্চল উন্নয়নে আলোচনা সভা

» নতুন নামে পুরাতন ফ্যাসিবাদ ফিরে এসেছে: ছাত্রদল সভাপতি

» মালিকানা দেশের মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই আমরা দীর্ঘদিন লড়াই করছি

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ভয়ংকর কিডনি কারবার

ছবি সংগৃহীত

 

রাজধানীতে চিকিৎসা নিতে এসে কিডনি ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়েন এক রোগী। ওই রোগীকে এক চিকিৎসক পরিচয় করিয়ে দেন কিডনি কেনাবেচার দালালের সঙ্গে। চক্রটি বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ওই রোগীকে পাচার করে ভারতের উত্তর প্রদেশে। ওই রোগীর নাম কবির হোসেন। সেখানেই বিনা চিকিৎসায় একটি রেস্ট হাউসে রেখে দেওয়া হয় কবিরকে। পরে তার মৃত্যু হয়। তার প্রায় ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এ ঘটনায় ২০২১ সালের ২৪ মে রাজধানীর পল্টন থানায় কবিরের ভাই জাকির হোসেন ওই চক্রের ১০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। মামলাটির তদন্তভার নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে গ্রেফতার হন চক্রের সদস্য আবদুুল মান্নান ও মাসুদ রানা।

 

যা আছে ডিবির তদন্তে : মামলাটির তদন্ত করেন ডিবির মতিঝিল বিভাগের এসআই স্বপন মিয়া। গত বছর ১৩ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি অভিযোগপত্রে বলেছেন, কবির হোসেনের দুটি কিডনি নষ্ট হলে তিনি ঢাকা ন্যাশনাল হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যান। সেখানে  ডা. এ বি এম মাহবুব উল আলম ও ডা. শোহানী তাকে ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। হাসপাতালে অবস্থানরত কিডনি দালাল আবদুল মান্নানের সঙ্গে কবিরের পরিচয় হয়। ২০২০ সালের ১৪ নভেম্বর মান্নানের সঙ্গে দেখা করে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিস্তারিত আলোচনা করেন কবির ও তার স্বজনরা। আলোচনার একপর্যায়ে চক্রের আরেক সদস্য মাসুদ রানা কিডনি প্রতিস্থাপনে ১৯ লাখ টাকা দাবি করেন। ওই দিনই মান্নান তাদের কাছ থেকে ৫৩ হাজার টাকার চেক নেন। ডোনার হিসেবে আহমেদ শরীফ নামে এক ব্যক্তিকে উপস্থাপন করেন মান্নান। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি কবির হোসেনকে ভারতের ফোরিস হাসপাতালে নিয়ে যান তারা। কবিরের সঙ্গে গিয়েছিলেন তার আরেক ভাই সগির হোসেন। কবিরের কাছ থেকে পাওয়া টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে চক্রটির মধ্যে সমঝোতা হলেও ডোনার আহমেদ শরীফ ভাগে কম পাওয়ায় কিডনি দিতে গড়িমসি করেন। এরই মধ্যে ভারতীয় পুলিশ গোপন তথ্যে আহমেদ শরীফ, ওয়াজুল ও কবিরের ভাই সগিরকে গ্রেফতার করে। পরে ২০২১ সালের ২২ জানুয়ারি চক্রের সদস্য মাসুদ রানা বাংলাদেশে চলে আসেন। ওই সময় ভারতীয় পুলিশ আইনি পদক্ষেপের কারণে কবিরকে ফোরিস হাসপাতাল থেকে নয়াদিল্লির সফদারজং হাসপাতালে পাঠায়। সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না হওয়ায় ওই বছর ১২ ফেব্রুয়ারি কবিরের মৃত্যু হয়। পরে স্বজনরা ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ২৫ ফেব্রুয়ারি লাশ দেশে এনে দাফন করেন।

 

হোতাদের বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র : ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলে তাতে নারাজি দেন মামলার বাদী জাকির হোসেন। তার ভাষ্য, অভিযোগপত্রে কিডনি বাণিজ্যের হোতাদের অভিযুক্ত করা হয়নি।

 

এরপর মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠান আদালত। মামলায় আসামি করা হয়েছিল মাসুদ রানা, তার স্ত্রী সাহিনা, আবদুল মান্নান, আহমেদ শরীফ, তার ভাই কুতুব শরীফ, মিজানুর রহমান, ওয়াজুল হক, শাহিন ওয়াসিম, ইন্ডিয়ান ছালাম ও আইয়ুব আলীকে।

 

ভারতে চিকিৎসার জন্য কবিরের সঙ্গে যাওয়া তার ভাই সগির হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সগির হোসেন জানান, চক্রের দালাল মান্নানের সঙ্গে কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ডা. এ বি এম মাহবুব উল আলম। তিনিও ওই চক্রের অন্যতম। অথচ তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি। ভারতের উত্তর প্রদেশে থাকেন মাসুদের স্ত্রী সাহিনা। তিনি বাংলাদেশের নেফ্রোলজি বিভাগের ডাক্তারদের নাম ও ফোন নম্বর সংগ্রহে রাখেন। তারা যখন রোগী পাঠান তাদের কমিশনের হিসাব সাহিনার কাছে থাকে। আর বাংলাদেশে যেসব রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের আগ্রহ দেখান তাদের জন্য সাহিনা সেখানকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সংগ্রহ করে দেন। এরপর সেগুলো দিয়ে প্রসেস করে ভিসা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করেন। সেখানে যাওয়ার পরই তারা বুঝতে পারেন আহমেদ শরীফ ছিলেন একজন ভুয়া ডোনার। যাদের অ্যাকাউন্টে চক্রটি লেনদেন করেছে এবং হুন্ডির টাকা জমা করেছে তাদেরও অভিযুক্ত থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সগির বলছেন, ‘আমরা যাওয়ার পর আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেন মাসুদ। এরপর তারা আমার ভাইকে চিকিৎসার কথা বলে বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর প্রায় তিন দিন তার কোনো খোঁজ পাইনি। নদিয়া গেস্টহাউস থেকে ভাইকে খুঁজতে বের হই। তখন আমার পাসপোর্ট না পেয়ে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে। বলা হচ্ছে আমি শরীফ ও ওয়াজুলের সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছি। তা সঠিক নয়।’ তিনি জানান, শুধু তারা নন, আরও অনেকে ওই চক্রের খপ্পরে পড়ে লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন। পুরো টাকাটা নেওয়া হয়েছে ঝিনাইদহের একটি হুন্ডি চক্রের মাধ্যমে। ডিবিতে যখন তার মামলাটি তদন্তাধীন ছিল, তখন ঝিনাইদহ জেলার এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সেখানে কর্মরত ছিলেন। হয়তো তারই মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে তদন্ত কর্মকর্তা হুন্ডি সিন্ডিকেটের সদস্যদের অভিযুক্ত করেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির মতিঝিল বিভাগের এসআই স্বপন মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, যাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদেরই আসামি করা হয়েছে। আর যারা অভিযুক্ত হননি তাদের যৌক্তিক কারণেই করা হয়নি। তবে মামলাটির তদারকিতে থাকা ডিবির মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রফিকুল ইসলামের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে ডা. এ বি এম মাহবুব উল আলম বলেন, ‘আমার নিজেরও কিডনি প্রতিস্থাপন করা। ওই রোগী আমার পিয়নের রেফারেন্সে এসেছিল কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য। আমি পরামর্শ দিয়েছি উপকারের জন?্য। কোনো দালালের সঙ্গে আমি পরিচয় করিয়ে দিইনি। যিনি অভিযোগ করেছেন তিনি ভুল ব?্যাখ?্যা দিয়েছেন।’ মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আকতার হোসেন জানান, কোনো মামলার অধিকতর তদন্ত তাদের কাছে গেলে তাদের আরও শক্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়। ১৫ জুন মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে আদালতে তার হাজির হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর তারা মামলাটির অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে পারবেন।

 

হুন্ডিতে যেভাবে লেনদেন : সগির হোসেন জানান, ভারতে থাকাবস্থায় মাসুদ ও তার স্ত্রী সাহিনা ইসলামী ব্যাংকের গোল্ড কার্ডের মাধ্যমে নগদ ৪ হাজার ডলার নেন। এরপর ইসলামী ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দেন। বাংলাদেশে তাদের স্বজনদের ওই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে বলেন মাসুদ। এমএস ফার্মেসির নামে থাকা ওই অ্যাকাউন্টটি হলো ২০৫০৭৭৭০১০১৯২৪৯১৪। এ অ্যাকাউন্টে তারা সাড়ে ৮ লাখ টাকা জমা করেন। ওই অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে জানা যায়, এমএস ফার্মেসির ওই অ্যাকাউন্টটি পরিচালিত হয় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার কোলাবাজার থেকে। ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি ওই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেন কবিরের স্বজনরা। ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই দিন একই অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। প্রতি মাসে ৩ কোটির ওপর লেনদেন হয় ওই অ্যাকাউন্টে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিয়ে হুন্ডি করে ভারতে নেওয়া হয়। ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া কিডনি রোগী ইফতেখার, কুমিল্লার আরেক রোগী বেলায়েত এবং পরান নামে আরও অনেকে টাকা জমা দিয়েছেন ওই অ্যাকাউন্টে। জানা গেছে, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বাসিন্দা কবির হোসেন। ভারতে পুলিশের হাতে আটক হয়ে চার মাস জেল খাটেন কবিরের ভাই সগির। পরে কলকাতা হয়ে লালমনিরহাটের সীমান্ত দিয়ে দেশে আসেন তিনি। কবির হোসেন তার পরিবার নিয়ে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের বরইতলা শুভাঢ্যার চরকালীগঞ্জে থাকতেন। সেখানে তিনি তাকওয়া ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকান পরিচালনা করতেন। মহামারি করোনার শুরুতে ২০২০ সালের মার্চে কবির ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি যান। সেখানে গিয়ে বুকে ব্যথা অনুভব করেন। কাঁঠালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বরিশালের আবদুুল্লাহ ক্লিনিকে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষানিরীক্ষার পর কবিরের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।  সূএ : বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com