বিষয় : নারী

তসলিমা নাসরিন :সব সময় দেখি মেয়েদের বেলায় লেখা হয় মেয়ে দেহ বিলিয়েছে, আর পুরুষের বেলায় লেখা হয় পুরুষ দেহ ভোগ করেছে। একজন বিলিয়ে দেয়, আরেকজন ভোগ করে! এর মানে এক পক্ষ দেয়, আরেক পক্ষ নেয়! মেয়েরা যে পুরুষের দেহ ভোগ করে, তা কেন স্বীকার করা হয় না! সেক্সটা শুধু পুরুষের প্রয়োজন, সেক্সটা পুরুষের জন্য, মেয়েদের শুধু নিজের শরীরটা পুরুষকে উৎসর্গ করতে হয়! এই অদ্ভুত বিশ্বাস আজও সমাজে চলছে! পুরুষ এটাই চায়। আমাকে নিয়ে অশিক্ষিত শয়তানেরা বলে অনেক পুরুষ আমাকে ‘ভোগ’ করেছে। আমি বুঝি না, একবারও কেন ওরা বলে না তসলিমা অনেকগুলো পুরুষকে ভোগ করেছে। এই সমাজে যে ভোগ করে দোষ তার নয়, যাকে ভোগ করা হয়, দোষ তার। আমি তো নিজেকে দোষী মনে করি না। যারা নারী পুরুষের সমান অধিকার চায়, তারা বলতে শুরু করুক, মেয়েরা পুরুষের শরীর ভোগ করে। সত্যি কথা হলো, দু পক্ষই ভোগ করে।

 

ভোগ করা মন্দ নয়, বরং ভালো, শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। যে মেয়েরা পুরুষের ভোগের জন্য শরীর দেয়, কিন্তু নিজেরা ভোগ করে না, তারা নিতান্তই দুর্ভাগা। পুরুষের বেলায়ও একই কথা খাটে। সেক্সটাকে যতদিন শুধু পুরুষের নয়, মেয়েদের ভোগের জন্যও বলে সমাজ স্বীকার না করবে, ততদিন পর্যন্ত মেয়েদের অধিকার বা স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অর্জন হবে না।

যৌনদাসত্ব মেয়েদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। 

২. বহুগামিতা একেবারেই মানতে পারি না।

-মেয়েদের?

-শুধু মেয়েদের হবে কেন, পুরুষদেরও।

-কোনও পুরুষ বহুগামী, এমন খবর শুনলে এমন ছিঃ ছিঃ রব শোনা যায় না তো!

-আলবৎ শোনা যায়।

-একটা উদাহরণ দাও তো।

-এভাবে উদাহরণ দেওয়া যায় না কি?

-খুব যায়। শিল্প সাহিত্য নাটক সিনেমার জগতে যে পুরুষ বহুগামী নয়, এমন কয়েকজনের নাম বলো। অথবা যে কজন বহুগামী, তাদেরই নাম বলো।

-কী বলতে চাইছো?

-বলতে চাইছি, যে পুরুষেরা বহুগামী, তাদের বিরুদ্ধে তুমি কি সরব?

-নিশ্চয়ই।

-তুমি তো উত্তম কুমার বলতে অজ্ঞান। উনি তো গৌরী দেবী এবং সুপ্রিয়া দেবী- দুজনের সঙ্গে থাকতেন। একসময় গৌরী দেবীকে ছেড়ে সুপ্রিয়া দেবীকে বিয়ে না করেই স্বামী স্ত্রীর মতোই থাকা শুরু করলেন। তুমি তো উত্তম কুমারকে গালি দাও না। তুমি তো সমরেশ বসুরও নিন্দে করো না, উনি তো দু’বোনকে বিয়ে করেছিলেন। প্রখ্যাত বহুগামী রবিশংকরকে নিয়েও তো কিছু বলো না!

-একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে নিয়ে থেকেছেন, একে তো বহুগামিতা বলে না।

 

-তাহলে যে মেয়েটির নিন্দে করছো, সেও তো একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে নিয়ে থেকেছে। যা করেছে প্রকাশ্যে, লুকিয়ে নয়, কাউকে ঠকিয়ে নয়। তাহলে তার নিন্দে করছো কেন।

 

-সমরেশ বসু বা উত্তম কুমার বা রবিশংকর অনেক বড়, এত বড়’র সঙ্গে কোথাকার কে, তার তুলনা চলে না।

 

-বড় হলে বুঝি অনৈতিক কাজ করা যায়? আর কোথাকার কে’দের জন্যই নীতি? নাকি শুধু মেয়েদের বেলায় নীতির প্রশ্ন ওঠে?

-বাজে কথা হচ্ছে। আমি নারী-পুরুষকে আলাদা করে দেখি না।

 

-তাহলে শুধু মেয়েদের পতিতালয় কেন, পুরুষদের পতিতলয় কেন নেই- এই প্রশ্ন কোনও দিন করেছ? বাই দ্য ওয়ে, পতিতালয়কে যে আইনত বৈধ করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কিছু বলো না কেন?

 

-কেন বলব, পতিতালয় তো থাকা উচিত। আছে বলেই তো সমাজে ধর্ষণ কম হয়।

-হা হা হা। তাই বুঝি?

-হ্যাঁ তাই।

-তোমাদের বৈধ পতিতালয় তো বিবাহিত, অবিবাহিত সব পুরুষের জন্য। পতিতালয়ের গেটে তো ‘শুধু অবিবাহিত পুরুষ অ্যালাউড’ লেখা সাইনবোর্ড নেই। বিবাহিত পুরুষেরা যারা সেখানে যাচ্ছে, তারা তো বহুগামিতা করছে। করছে না? বৈধভাবেই করছে। সে ক্ষেত্রে তো পুরুষের বহুগামিতা বৈধ।

-শুধু খারাপ লোকেরা যায় ওসব জায়গায়।

-তাহলে বলতে চাইছো খারাপ লোকদের জন্য বহুগামিতা ঠিক, শুধু ভালো লোকদের জন্য ঠিক নয়?

-আমি তা বলতে চাইছি না, বহুগামিতা ব্যাপারটাই খারাপ।

-তাহলে পতিতালয়ে বিবাহিত পুরুষদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার কথা কোথাও মুখ ফুটে বলো না কেন?

-আমি বললে কে শুনবে।

-কিন্তু তুমি যে একটি মেয়ের বহুগামিতার বিরুদ্ধে চিৎকার করছো, ও তো অনেকে শুনছে।

-মেয়েদের এসব সহ্য করা যায় না।

-এই তো আসল কথা পাড়লে। মেয়েদের বহুগামিতা সহ্য করা যায় না, পুরুষদের বহুগামিতা সহ্য করা যায়।

-পুরুষ আর নারীর শরীর তো এক নয়, পার্থক্য আছে। হরমোনের পার্থক্য। পুরুষদের সেক্সটা বেশি দরকার হয়।

-এতক্ষণে অরিন্দম! মনের কথাটি আগে বলে ফেললেই পারতে। বলো যে পুরুষের বহুগামী হওয়ার অধিকার আছে, যেহেতু তাদের হরমোন বেশি সেক্স চায়, এক নারীতে তা মেটে না। কিন্তু নারীর বহুগামী হওয়ার কোনও অধিকার নেই। নারীর হরমোন যতই টগবগ করুক, তাদের একগামী হতেই হবে। বেচারা পুরুষ! পুরুষের বহুগামিতাকে জাস্টিফাই করার জন্য ধর্ম থেকে শুরু করে হরমোনের আশ্রয় পর্যন্ত নিতে হচ্ছে!!

-আমাদের মায়েরা কি কল্পনা করতে পারতো স্বামী ছাড়া অন্য কারও দিকে কোনও দিন তাকাবে?

-তুমি চাইছো দুনিয়ার সব মেয়ে তোমাদের মায়ের মতো হোক।

-তা তো হয়নি, চারদিকে সব চরিত্রহীন বহুগামী মেয়ে।

-চারদিকে কি চরিত্রহীন বহুগামী পুরুষ নেই?

-উফ এসব শুনতে আর ভালো লাগছে না।

৩. অনেকদিন আগে ব্যাঙ্গালোরের একটি ভিডিও দেখেছিলাম, যেখানে একটি মেয়েকে কয়েকটি পুরুষ নৃশংস নির্যাতন করছে। পুরুষের দলে একটি নারীও আছে, যে নারী পুরুষগুলোকে নারীনির্যাতনে, নারীধর্ষণে সাহায্য করছে। এটিই সমাজ আমাদের। পুরুষের কাজ পুরুষ করে। নারীও পুরুষের মতোই বর্বরতায় অংশ নেয়। অনেকে বলে আমি নারীর নৃশংসতা কখনও দেখিনি, তাই নারীর প্রতি আমার ভালোবাসা উথলে ওঠে। আমি কৈশোর থেকে নারীর ওপর নির্যাতন যেমন দেখেছি, নারীর নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, স্বার্থপরতাও দেখেছি। আমার পরিবারেই দেখেছি। আমার স্ত্রৈণ দাদারা যাদের বিয়ে করে ঘরে এনেছিল, তাদের দ্বারা অত্যাচারিত কে হয়নি সংসারে! কিন্তু পরিবারের বাইরে বেরিয়ে পুরো জগত সংসারে দেখেছি নারী যত না অত্যাচার করে, তার চেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়।

ব্যাঙ্গালোরের ভিডিওটি ছড়িয়ে না গেলে আমাদের বোঝা হতো না নারী-পাচারের শিকারদের সঙ্গে কী ব্যবহার করে শিকারীরা। নির্যাতিতা মেয়েটি নারী-পাচারের অন্য এক শিকারকে পালাতে সাহায্য করেছিল, তাই তার ওপর এত রাগ ছিল শিকারীদের। শুনেছি এরা সবাই বাংলাদেশের। এই মেয়েটিকে বাংলাদেশে ‘জাতীয় সম্মান’ দেওয়া উচিত। ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব পাওয়ার যোগ্য মেয়েটি। ধর্ষক আর নির্যাতকদের হাত থেকে মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ সে কম বড় মুক্তিযুদ্ধ নয়।

 

৪. লক্ষ করেছি কোনও বয়স্ক লোকের মৃত্যু হলে তাঁর বয়স্ক জীবিত স্ত্রী নিয়ে মানুষ বেশ দুঃখ করে। এখন খুব একা বোধ করবেন, বড় একা হয়ে গেলেন! তাঁর বেঁচে থাকার উৎসব না করে তাঁর বেঁচে থাকা নিয়ে চুকচুক দুঃখ শুরু হয়ে যায়। জীবন উপভোগ করার জন্য শুভকামনা না জানিয়ে তাঁর একাকীত্বের কথা ভেবে অন্যকে হাহাকারই করতে শুনি।

 

তারপর, লক্ষ করেছি, সেই বয়স্ক মহিলাটির মৃত্যু যদি হয়, স্বামীর মৃত্যু হওয়ার পর পরই, লোকেরা দুঃখ করে না, বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আহ, একা একা তাঁকে আর কষ্ট করতে হলো না। কেউ কেউ বলেন, ওপরে উনি একা ছিলেন, এবার ইনি যাওয়ার পর মিলিত হলেন দুজন। কেউ আর একা নন।

 

মানুষ যতই সহমরণকে ওপরে ওপরে মন্দ বলুক, সহমরণের জন্য নিভৃতে একধরনের পক্ষপাত আছে। বৈধব্যের যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়ে স্বামীর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীও প্রস্থান করুন- মনে মনে মানুষ এমনই চায়।

 

আজও নারীকে মানুষ পৃথক অস্তিত্ব বলে মানতে চায় না। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যে স্বামীর অনুপস্থিতিতেও মূল্যবান, তা মানতে চায় না। স্বামীকে ভালোবাসলেও স্বামীর মৃত্যুর পরও যে একজন নারী চমৎকার উপভোগ করতে পারেন জীবন, তা মানুষ আজও মানতে চায় না।

 

৫. ইরানের সচেতন কিছু পুরুষ হিজাব এবং বোরখা প’রে মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক হিজাব বা বোরখা পরার আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। মেয়েদের হিজাব বা বোরখা পরতে হয় ইরানে, কারণ মেয়েদের মনে করা হয় হিজাব বা বোরখা ছাড়া দেখলে পুরুষদের যৌনাকাক্সক্ষা জাগে। একই কারণে পুরুষদেরও তো বোরখা পরা উচিত, কারণ পুরুষদের দেখলে মেয়েদের যৌনাকাক্সক্ষা জাগে। যৌনাকাক্সক্ষা জাগলে কার কী ক্ষতি হয় আমি জানি না। অচেনা অপরিচিত কাউকে দেখে যৌনাকাক্সক্ষা জাগলে আমরা মেয়েরা তো সংবরণ করতে পারি, পুরুষরা কেন পারে না? আসলে তারাও পারে। যারা ধর্ষক, তাদের কাছে মেয়েরা বিকিনি পরলেও যা, বোরখা পরলেও তা। তারা পেশির আর পুরুষের ক্ষমতা দেখায় ‘যৌনবস্তু’র ওপর। যে মেয়েরা স্বেচ্ছায় বোরখা পরে, বা যারা মেয়েদের বোরখা পরার পক্ষে, তারা মেয়েদের যৌনবস্তু আর পুরুষদের ধর্ষক ছাড়া আর কিছু মনে করে না।

 

৬. মেয়েদের কোনও পরিচয় নেই। তারা পুরুষের কন্যা, পুরুষের বোন, পুরুষের স্ত্রী, পুরুষের মা ইত্যাদি। এ-ই তাদের পরিচয়। এর বেশি কিছু তারা নয়। নিজের যদি কোনও পরিচয় না থাকে, তাহলে তাদের সন্তানদের পরিচয়ও থাকে না। সন্তান মায়েদের সন্তান হিসেবে চিহ্নিত হয় একমাত্র নিষিদ্ধ এলাকায়। মূলস্রোতের সমাজে সন্তান পিতার পরিচয়ে বড় হয়। মূলস্রোতে বাস করে নিষিদ্ধ এলাকার মতো মায়ের পরিচয়ে সন্তান পরিচিত হতে পারে না। সে কারণেই পিতার নাম জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সমাজ।

 

পিতৃতন্ত্র একসময় মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হতে দিত না। বাল্যবিবাহে, সতীচ্ছদে, সতীত্বে, কুমারীত্বে এর গভীর বিশ্বাস। মেয়েদের পড়ালেখা করা, ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি বাকরি করা, টাকা পয়সা রোজগার করার ঘোর বিরোধী ছিল সমাজ। একসময় পুরুষতন্ত্রের কর্তারা যখন শিক্ষিতা শয্যাসঙ্গী কামনা করলো, তখন ইস্কুল কলেজে যাওয়াটা মেয়েদের জন্য বৈধ করা হলো।

 

কিন্তু কতদূর পড়ালেখা করতে পারবে, তার একটি সীমা বেঁধে দিল। এর আরও অনেক পরে এলো কাজ করার অনুমতি। সব কাজ নয় অবশ্য, শিক্ষিকা বা সেবিকার কাজ। সাংস্কৃতিক জগতেও মেয়েদের প্রবেশের অধিকার ছিল না, সে কারণে পুরুষই মেয়েদের পোশাক পরে মেয়েদের অভিনয় করতো। মানুষ বিশ্বাস করতো মেয়েরা ঘরে বসে রান্নাবান্না করবে, ঘরদোর গুছিয়ে রাখবে, সন্তান জন্ম দেবে, সন্তানের লালনপালন করবে, স্বামীর, স্বামীর আত্মীয়দের, সন্তানদের সেবাযত্ন করবে-এই হলো মেয়েদের মূল কাজ এবং কর্তব্য। ওপরে ওপরে যতই আধুনিক বলে দাবি করুক সমাজ, আজও বিয়ের পর সব মেয়েকেই বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যেতে হয়, বাপের পদবি বাদ দিয়ে নামের শেষে স্বামীর পদবি জুড়তে হয়। মেয়েদের নিজের কোনও পরিচয় নেই, তাদের নামও তাদের নয়। মেয়েদের নিজের কোনও ঘর নেই, বাপের বা স্বামীর বা পুত্রের ঘরে তারা বাস করে মাত্র। মেয়েরা এখন অনেকে শিক্ষিত, স্বনির্ভর, কিন্তু পিতৃতন্ত্র আজও বহাল তবিয়তে বজায় আছে।

 

পিতৃতন্ত্র মেয়েদের শিক্ষা অর্জন করার, ঘরের বাইরে বের হওয়ার, চাকরি বাকরি করার, ব্যবসা বাণিজ্য করার স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু যেটা দেয়নি আজও, সেটা যৌন স্বাধীনতা। সেই কারণেই এখনও একটি মেয়ে কার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করছে, জরায়ুতে কার শুক্রাণু ঢুকিয়েছে, তা জানার জন্য সব রকম চেষ্টা করে সমাজ, পান থেকে চুন খসলেই তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলে।

 

যৌন স্বাধীনতা যদি মেয়েরা পেয়ে যায়, তাহলে পিতৃতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। সে কারণেই নিজেদের যৌন স্বাধীনতা সম্পূর্ণ উপভোগ করেও মেয়েদের যৌন স্বাধীনতার বিরোধী পুরুষেরা। সে কারণেই পুরুষের বহু বিবাহ বৈধ, কিন্তু মেয়েদের বহু বিবাহ বৈধ নয়। সে কারণেই পুরুষের ভোগের জন্য পতিতালয় খোলা হয়, মেয়েদের ভোগের জন্য কিছুই খোলা হয় না। মেয়েদের শরীরের মালিক যদি স্বামী না হয়, যদি মেয়েরা হয় মালিক, তাহলেই পুরুষের নারী নির্যাতন বন্ধ হবে, নারীর শরীরকে শস্যখেত হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ হবে, পুরুষের বংশ রক্ষা করার জন্য নারীর জরায়ু ব্যবহারও বন্ধ হবে। মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, তারা যত্রতত্র যৌন সম্পর্ক করবে। মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা মানে তারা তাদের শরীরের ব্যাপারে, যৌনতার ব্যাপারে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেবে। নিজেদের জরায়ুর ওপর থাকবে নিজেদের অধিকার, অন্য কারও নয়। কারও বংশ রক্ষার দায় মেয়েদের থাকবে না।

 

মেয়েদের শরীর এখনও পুরুষের সম্পত্তি, তাই পুরুষেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, মেয়েরা কী পোশাক পরবে, কী পোশাক পরবে না, শরীর নিয়ে কোথায় যাবে, কতদূর যাবে, শরীরের কাছাকাছি কার যাওয়ার অধিকার আছে, কার যাওয়ার নেই। এই শরীর রাত কটার মধ্যে ঘরে ফিরবে-সব সিদ্ধান্তই সমাজের পুরুষের। পুরুষতন্ত্রের আদেশ পালনে পুরুষতান্ত্রিক নারীও সাহায্য করে যেহেতু নারীও পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বিষয় : নারী

তসলিমা নাসরিন :সব সময় দেখি মেয়েদের বেলায় লেখা হয় মেয়ে দেহ বিলিয়েছে, আর পুরুষের বেলায় লেখা হয় পুরুষ দেহ ভোগ করেছে। একজন বিলিয়ে দেয়, আরেকজন ভোগ করে! এর মানে এক পক্ষ দেয়, আরেক পক্ষ নেয়! মেয়েরা যে পুরুষের দেহ ভোগ করে, তা কেন স্বীকার করা হয় না! সেক্সটা শুধু পুরুষের প্রয়োজন, সেক্সটা পুরুষের জন্য, মেয়েদের শুধু নিজের শরীরটা পুরুষকে উৎসর্গ করতে হয়! এই অদ্ভুত বিশ্বাস আজও সমাজে চলছে! পুরুষ এটাই চায়। আমাকে নিয়ে অশিক্ষিত শয়তানেরা বলে অনেক পুরুষ আমাকে ‘ভোগ’ করেছে। আমি বুঝি না, একবারও কেন ওরা বলে না তসলিমা অনেকগুলো পুরুষকে ভোগ করেছে। এই সমাজে যে ভোগ করে দোষ তার নয়, যাকে ভোগ করা হয়, দোষ তার। আমি তো নিজেকে দোষী মনে করি না। যারা নারী পুরুষের সমান অধিকার চায়, তারা বলতে শুরু করুক, মেয়েরা পুরুষের শরীর ভোগ করে। সত্যি কথা হলো, দু পক্ষই ভোগ করে।

 

ভোগ করা মন্দ নয়, বরং ভালো, শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। যে মেয়েরা পুরুষের ভোগের জন্য শরীর দেয়, কিন্তু নিজেরা ভোগ করে না, তারা নিতান্তই দুর্ভাগা। পুরুষের বেলায়ও একই কথা খাটে। সেক্সটাকে যতদিন শুধু পুরুষের নয়, মেয়েদের ভোগের জন্যও বলে সমাজ স্বীকার না করবে, ততদিন পর্যন্ত মেয়েদের অধিকার বা স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অর্জন হবে না।

যৌনদাসত্ব মেয়েদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। 

২. বহুগামিতা একেবারেই মানতে পারি না।

-মেয়েদের?

-শুধু মেয়েদের হবে কেন, পুরুষদেরও।

-কোনও পুরুষ বহুগামী, এমন খবর শুনলে এমন ছিঃ ছিঃ রব শোনা যায় না তো!

-আলবৎ শোনা যায়।

-একটা উদাহরণ দাও তো।

-এভাবে উদাহরণ দেওয়া যায় না কি?

-খুব যায়। শিল্প সাহিত্য নাটক সিনেমার জগতে যে পুরুষ বহুগামী নয়, এমন কয়েকজনের নাম বলো। অথবা যে কজন বহুগামী, তাদেরই নাম বলো।

-কী বলতে চাইছো?

-বলতে চাইছি, যে পুরুষেরা বহুগামী, তাদের বিরুদ্ধে তুমি কি সরব?

-নিশ্চয়ই।

-তুমি তো উত্তম কুমার বলতে অজ্ঞান। উনি তো গৌরী দেবী এবং সুপ্রিয়া দেবী- দুজনের সঙ্গে থাকতেন। একসময় গৌরী দেবীকে ছেড়ে সুপ্রিয়া দেবীকে বিয়ে না করেই স্বামী স্ত্রীর মতোই থাকা শুরু করলেন। তুমি তো উত্তম কুমারকে গালি দাও না। তুমি তো সমরেশ বসুরও নিন্দে করো না, উনি তো দু’বোনকে বিয়ে করেছিলেন। প্রখ্যাত বহুগামী রবিশংকরকে নিয়েও তো কিছু বলো না!

-একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে নিয়ে থেকেছেন, একে তো বহুগামিতা বলে না।

 

-তাহলে যে মেয়েটির নিন্দে করছো, সেও তো একজনকে ছেড়ে আরেকজনকে নিয়ে থেকেছে। যা করেছে প্রকাশ্যে, লুকিয়ে নয়, কাউকে ঠকিয়ে নয়। তাহলে তার নিন্দে করছো কেন।

 

-সমরেশ বসু বা উত্তম কুমার বা রবিশংকর অনেক বড়, এত বড়’র সঙ্গে কোথাকার কে, তার তুলনা চলে না।

 

-বড় হলে বুঝি অনৈতিক কাজ করা যায়? আর কোথাকার কে’দের জন্যই নীতি? নাকি শুধু মেয়েদের বেলায় নীতির প্রশ্ন ওঠে?

-বাজে কথা হচ্ছে। আমি নারী-পুরুষকে আলাদা করে দেখি না।

 

-তাহলে শুধু মেয়েদের পতিতালয় কেন, পুরুষদের পতিতলয় কেন নেই- এই প্রশ্ন কোনও দিন করেছ? বাই দ্য ওয়ে, পতিতালয়কে যে আইনত বৈধ করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কিছু বলো না কেন?

 

-কেন বলব, পতিতালয় তো থাকা উচিত। আছে বলেই তো সমাজে ধর্ষণ কম হয়।

-হা হা হা। তাই বুঝি?

-হ্যাঁ তাই।

-তোমাদের বৈধ পতিতালয় তো বিবাহিত, অবিবাহিত সব পুরুষের জন্য। পতিতালয়ের গেটে তো ‘শুধু অবিবাহিত পুরুষ অ্যালাউড’ লেখা সাইনবোর্ড নেই। বিবাহিত পুরুষেরা যারা সেখানে যাচ্ছে, তারা তো বহুগামিতা করছে। করছে না? বৈধভাবেই করছে। সে ক্ষেত্রে তো পুরুষের বহুগামিতা বৈধ।

-শুধু খারাপ লোকেরা যায় ওসব জায়গায়।

-তাহলে বলতে চাইছো খারাপ লোকদের জন্য বহুগামিতা ঠিক, শুধু ভালো লোকদের জন্য ঠিক নয়?

-আমি তা বলতে চাইছি না, বহুগামিতা ব্যাপারটাই খারাপ।

-তাহলে পতিতালয়ে বিবাহিত পুরুষদের প্রবেশে বাধা দেওয়ার কথা কোথাও মুখ ফুটে বলো না কেন?

-আমি বললে কে শুনবে।

-কিন্তু তুমি যে একটি মেয়ের বহুগামিতার বিরুদ্ধে চিৎকার করছো, ও তো অনেকে শুনছে।

-মেয়েদের এসব সহ্য করা যায় না।

-এই তো আসল কথা পাড়লে। মেয়েদের বহুগামিতা সহ্য করা যায় না, পুরুষদের বহুগামিতা সহ্য করা যায়।

-পুরুষ আর নারীর শরীর তো এক নয়, পার্থক্য আছে। হরমোনের পার্থক্য। পুরুষদের সেক্সটা বেশি দরকার হয়।

-এতক্ষণে অরিন্দম! মনের কথাটি আগে বলে ফেললেই পারতে। বলো যে পুরুষের বহুগামী হওয়ার অধিকার আছে, যেহেতু তাদের হরমোন বেশি সেক্স চায়, এক নারীতে তা মেটে না। কিন্তু নারীর বহুগামী হওয়ার কোনও অধিকার নেই। নারীর হরমোন যতই টগবগ করুক, তাদের একগামী হতেই হবে। বেচারা পুরুষ! পুরুষের বহুগামিতাকে জাস্টিফাই করার জন্য ধর্ম থেকে শুরু করে হরমোনের আশ্রয় পর্যন্ত নিতে হচ্ছে!!

-আমাদের মায়েরা কি কল্পনা করতে পারতো স্বামী ছাড়া অন্য কারও দিকে কোনও দিন তাকাবে?

-তুমি চাইছো দুনিয়ার সব মেয়ে তোমাদের মায়ের মতো হোক।

-তা তো হয়নি, চারদিকে সব চরিত্রহীন বহুগামী মেয়ে।

-চারদিকে কি চরিত্রহীন বহুগামী পুরুষ নেই?

-উফ এসব শুনতে আর ভালো লাগছে না।

৩. অনেকদিন আগে ব্যাঙ্গালোরের একটি ভিডিও দেখেছিলাম, যেখানে একটি মেয়েকে কয়েকটি পুরুষ নৃশংস নির্যাতন করছে। পুরুষের দলে একটি নারীও আছে, যে নারী পুরুষগুলোকে নারীনির্যাতনে, নারীধর্ষণে সাহায্য করছে। এটিই সমাজ আমাদের। পুরুষের কাজ পুরুষ করে। নারীও পুরুষের মতোই বর্বরতায় অংশ নেয়। অনেকে বলে আমি নারীর নৃশংসতা কখনও দেখিনি, তাই নারীর প্রতি আমার ভালোবাসা উথলে ওঠে। আমি কৈশোর থেকে নারীর ওপর নির্যাতন যেমন দেখেছি, নারীর নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, স্বার্থপরতাও দেখেছি। আমার পরিবারেই দেখেছি। আমার স্ত্রৈণ দাদারা যাদের বিয়ে করে ঘরে এনেছিল, তাদের দ্বারা অত্যাচারিত কে হয়নি সংসারে! কিন্তু পরিবারের বাইরে বেরিয়ে পুরো জগত সংসারে দেখেছি নারী যত না অত্যাচার করে, তার চেয়ে বেশি অত্যাচারিত হয়।

ব্যাঙ্গালোরের ভিডিওটি ছড়িয়ে না গেলে আমাদের বোঝা হতো না নারী-পাচারের শিকারদের সঙ্গে কী ব্যবহার করে শিকারীরা। নির্যাতিতা মেয়েটি নারী-পাচারের অন্য এক শিকারকে পালাতে সাহায্য করেছিল, তাই তার ওপর এত রাগ ছিল শিকারীদের। শুনেছি এরা সবাই বাংলাদেশের। এই মেয়েটিকে বাংলাদেশে ‘জাতীয় সম্মান’ দেওয়া উচিত। ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব পাওয়ার যোগ্য মেয়েটি। ধর্ষক আর নির্যাতকদের হাত থেকে মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ সে কম বড় মুক্তিযুদ্ধ নয়।

 

৪. লক্ষ করেছি কোনও বয়স্ক লোকের মৃত্যু হলে তাঁর বয়স্ক জীবিত স্ত্রী নিয়ে মানুষ বেশ দুঃখ করে। এখন খুব একা বোধ করবেন, বড় একা হয়ে গেলেন! তাঁর বেঁচে থাকার উৎসব না করে তাঁর বেঁচে থাকা নিয়ে চুকচুক দুঃখ শুরু হয়ে যায়। জীবন উপভোগ করার জন্য শুভকামনা না জানিয়ে তাঁর একাকীত্বের কথা ভেবে অন্যকে হাহাকারই করতে শুনি।

 

তারপর, লক্ষ করেছি, সেই বয়স্ক মহিলাটির মৃত্যু যদি হয়, স্বামীর মৃত্যু হওয়ার পর পরই, লোকেরা দুঃখ করে না, বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। আহ, একা একা তাঁকে আর কষ্ট করতে হলো না। কেউ কেউ বলেন, ওপরে উনি একা ছিলেন, এবার ইনি যাওয়ার পর মিলিত হলেন দুজন। কেউ আর একা নন।

 

মানুষ যতই সহমরণকে ওপরে ওপরে মন্দ বলুক, সহমরণের জন্য নিভৃতে একধরনের পক্ষপাত আছে। বৈধব্যের যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়ে স্বামীর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীও প্রস্থান করুন- মনে মনে মানুষ এমনই চায়।

 

আজও নারীকে মানুষ পৃথক অস্তিত্ব বলে মানতে চায় না। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যে স্বামীর অনুপস্থিতিতেও মূল্যবান, তা মানতে চায় না। স্বামীকে ভালোবাসলেও স্বামীর মৃত্যুর পরও যে একজন নারী চমৎকার উপভোগ করতে পারেন জীবন, তা মানুষ আজও মানতে চায় না।

 

৫. ইরানের সচেতন কিছু পুরুষ হিজাব এবং বোরখা প’রে মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক হিজাব বা বোরখা পরার আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। মেয়েদের হিজাব বা বোরখা পরতে হয় ইরানে, কারণ মেয়েদের মনে করা হয় হিজাব বা বোরখা ছাড়া দেখলে পুরুষদের যৌনাকাক্সক্ষা জাগে। একই কারণে পুরুষদেরও তো বোরখা পরা উচিত, কারণ পুরুষদের দেখলে মেয়েদের যৌনাকাক্সক্ষা জাগে। যৌনাকাক্সক্ষা জাগলে কার কী ক্ষতি হয় আমি জানি না। অচেনা অপরিচিত কাউকে দেখে যৌনাকাক্সক্ষা জাগলে আমরা মেয়েরা তো সংবরণ করতে পারি, পুরুষরা কেন পারে না? আসলে তারাও পারে। যারা ধর্ষক, তাদের কাছে মেয়েরা বিকিনি পরলেও যা, বোরখা পরলেও তা। তারা পেশির আর পুরুষের ক্ষমতা দেখায় ‘যৌনবস্তু’র ওপর। যে মেয়েরা স্বেচ্ছায় বোরখা পরে, বা যারা মেয়েদের বোরখা পরার পক্ষে, তারা মেয়েদের যৌনবস্তু আর পুরুষদের ধর্ষক ছাড়া আর কিছু মনে করে না।

 

৬. মেয়েদের কোনও পরিচয় নেই। তারা পুরুষের কন্যা, পুরুষের বোন, পুরুষের স্ত্রী, পুরুষের মা ইত্যাদি। এ-ই তাদের পরিচয়। এর বেশি কিছু তারা নয়। নিজের যদি কোনও পরিচয় না থাকে, তাহলে তাদের সন্তানদের পরিচয়ও থাকে না। সন্তান মায়েদের সন্তান হিসেবে চিহ্নিত হয় একমাত্র নিষিদ্ধ এলাকায়। মূলস্রোতের সমাজে সন্তান পিতার পরিচয়ে বড় হয়। মূলস্রোতে বাস করে নিষিদ্ধ এলাকার মতো মায়ের পরিচয়ে সন্তান পরিচিত হতে পারে না। সে কারণেই পিতার নাম জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সমাজ।

 

পিতৃতন্ত্র একসময় মেয়েদের ঘরের বাইরে বের হতে দিত না। বাল্যবিবাহে, সতীচ্ছদে, সতীত্বে, কুমারীত্বে এর গভীর বিশ্বাস। মেয়েদের পড়ালেখা করা, ঘরের বাইরে গিয়ে চাকরি বাকরি করা, টাকা পয়সা রোজগার করার ঘোর বিরোধী ছিল সমাজ। একসময় পুরুষতন্ত্রের কর্তারা যখন শিক্ষিতা শয্যাসঙ্গী কামনা করলো, তখন ইস্কুল কলেজে যাওয়াটা মেয়েদের জন্য বৈধ করা হলো।

 

কিন্তু কতদূর পড়ালেখা করতে পারবে, তার একটি সীমা বেঁধে দিল। এর আরও অনেক পরে এলো কাজ করার অনুমতি। সব কাজ নয় অবশ্য, শিক্ষিকা বা সেবিকার কাজ। সাংস্কৃতিক জগতেও মেয়েদের প্রবেশের অধিকার ছিল না, সে কারণে পুরুষই মেয়েদের পোশাক পরে মেয়েদের অভিনয় করতো। মানুষ বিশ্বাস করতো মেয়েরা ঘরে বসে রান্নাবান্না করবে, ঘরদোর গুছিয়ে রাখবে, সন্তান জন্ম দেবে, সন্তানের লালনপালন করবে, স্বামীর, স্বামীর আত্মীয়দের, সন্তানদের সেবাযত্ন করবে-এই হলো মেয়েদের মূল কাজ এবং কর্তব্য। ওপরে ওপরে যতই আধুনিক বলে দাবি করুক সমাজ, আজও বিয়ের পর সব মেয়েকেই বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যেতে হয়, বাপের পদবি বাদ দিয়ে নামের শেষে স্বামীর পদবি জুড়তে হয়। মেয়েদের নিজের কোনও পরিচয় নেই, তাদের নামও তাদের নয়। মেয়েদের নিজের কোনও ঘর নেই, বাপের বা স্বামীর বা পুত্রের ঘরে তারা বাস করে মাত্র। মেয়েরা এখন অনেকে শিক্ষিত, স্বনির্ভর, কিন্তু পিতৃতন্ত্র আজও বহাল তবিয়তে বজায় আছে।

 

পিতৃতন্ত্র মেয়েদের শিক্ষা অর্জন করার, ঘরের বাইরে বের হওয়ার, চাকরি বাকরি করার, ব্যবসা বাণিজ্য করার স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু যেটা দেয়নি আজও, সেটা যৌন স্বাধীনতা। সেই কারণেই এখনও একটি মেয়ে কার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করছে, জরায়ুতে কার শুক্রাণু ঢুকিয়েছে, তা জানার জন্য সব রকম চেষ্টা করে সমাজ, পান থেকে চুন খসলেই তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলে।

 

যৌন স্বাধীনতা যদি মেয়েরা পেয়ে যায়, তাহলে পিতৃতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়বে। সে কারণেই নিজেদের যৌন স্বাধীনতা সম্পূর্ণ উপভোগ করেও মেয়েদের যৌন স্বাধীনতার বিরোধী পুরুষেরা। সে কারণেই পুরুষের বহু বিবাহ বৈধ, কিন্তু মেয়েদের বহু বিবাহ বৈধ নয়। সে কারণেই পুরুষের ভোগের জন্য পতিতালয় খোলা হয়, মেয়েদের ভোগের জন্য কিছুই খোলা হয় না। মেয়েদের শরীরের মালিক যদি স্বামী না হয়, যদি মেয়েরা হয় মালিক, তাহলেই পুরুষের নারী নির্যাতন বন্ধ হবে, নারীর শরীরকে শস্যখেত হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ হবে, পুরুষের বংশ রক্ষা করার জন্য নারীর জরায়ু ব্যবহারও বন্ধ হবে। মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা মানে এই নয় যে, তারা যত্রতত্র যৌন সম্পর্ক করবে। মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা মানে তারা তাদের শরীরের ব্যাপারে, যৌনতার ব্যাপারে নিজেরা সিদ্ধান্ত নেবে। নিজেদের জরায়ুর ওপর থাকবে নিজেদের অধিকার, অন্য কারও নয়। কারও বংশ রক্ষার দায় মেয়েদের থাকবে না।

 

মেয়েদের শরীর এখনও পুরুষের সম্পত্তি, তাই পুরুষেরাই সিদ্ধান্ত নেয়, মেয়েরা কী পোশাক পরবে, কী পোশাক পরবে না, শরীর নিয়ে কোথায় যাবে, কতদূর যাবে, শরীরের কাছাকাছি কার যাওয়ার অধিকার আছে, কার যাওয়ার নেই। এই শরীর রাত কটার মধ্যে ঘরে ফিরবে-সব সিদ্ধান্তই সমাজের পুরুষের। পুরুষতন্ত্রের আদেশ পালনে পুরুষতান্ত্রিক নারীও সাহায্য করে যেহেতু নারীও পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।  সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com