এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে:দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের উপকূল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তালগাছ । তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা ‘তালগাছ’। কবিতাটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ানো হয়। তালগাছ বইয়ের পাতায় দেখলেও মাঠে-ঘাটে কেউ কেউ দেখেছেন আবার অনেকেই দেখেননি। কালের বিবর্তণে তাল গাছ বর্তমানে বিলুপ্তি প্রায়।
বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ এ উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ব্যাপকহারে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তালগাছ জলবায়ুর প্রভাবে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তালগাছ বলে জানিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা । বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বাগেরহাট,সাতক্ষীরা ,খুলনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি ,বরিশাল ,বরগুনা ,পিরোজপুর,ভোলা সহ আরো বেশ কিছু জেলায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে তালগাছ এর একমাত্র কারণ জলবায়ুর প্রভাব ।গ্রাম বাংলার সুপরিচিত ঐতিহ্যবাহী তালগাছ কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। তালগাছে এখন আর দেখা যাচ্ছে না বাবুই পাখির বাসা। বাংলা সাহিত্যে তালগাছ নিয়ে রয়েছে নানা গল্প, কবিতা ও ছাড়া। এক সময় উপকূলীয় গলাচিপার বিভিন্ন বাড়ি ও রাস্তার দুপাশে সারি সারি তালগাছ দেখা যেত। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে টিকে থাকতে পারছে না তালগাছ। বর্তমানে ঢাক ঢোল পিটিয়ে তালগাছ রোপনের জন্য জনে জনে অনুরোধ করলেও সাধারণের মধ্যে সেই আগ্রহ আর দেখা যাচ্ছে না।
তালগাছ পাম গোত্রের অন্যতম একটি দীর্ঘ গাছ। এটি ৩০ থেকে ৪০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। একটি তালগাছ সাধারণত একশ’ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকে। তাল একটি গ্রীষ্মকালীন ফল। তালের বীজ ও ফল দুটোই খাওয়ার উপযোগী। কাঁচা তালের বীজ বা শাঁস খেতে খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। কাঁচা তালের শাঁস মানুষের শরীরের চাহিদা মেটায়। তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, পটাশিয়াম, জিংক ও ক্যালসিয়ামসহ নানা খনিজ উপাদান। তালের রস দিয়ে গুড়, মিছরি ও তাড়ি তৈরি করা হয়। পাকা তালের মিষ্টিগন্ধে মন ভরে ওঠে। পাকা তালের শাঁসও খেতে খুব সুস্বাদু এবং তাতেও অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। গ্রাম বাংলায় পানি দিয়ে গোলানো পাকা তাল আগুনের তাপে ঘন করে তার সাথে দুধ, নারিকেল বাটা ও চিনি বা গুড় মিশিয়ে তালদুধ নামের একটি সুস্বাদু তরল খাবার তৈরি করা হয়। এ তালদুধ এখনো গ্রাম বাংলায় ভাতের সাথে খাওয়ার প্রচলন আছে। পাকা তাল দিয়ে বিভিন্ন রকমারী পিঠা তৈরি করা হয়। তালের পিঠা পছন্দ করেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। গ্রীষ্মের তাপদাহে শীতল পরশ বুলায় তাল পাতার হাত পাখা। তাল গাছের পাতা দিয়ে ঘরের ছাউনী, পাখা ও মাদুরসহ বাচ্চাদের বিভিন্ন খেলনা তৈরি করা যায়। তালগাছের কা- দিয়ে তৈরি হয় ঘর ও নৌকা। এক কথায় তালগাছ একটি উপকারী ও প্রয়োজনীয় গাছ। বিশেষ করে তালগাছ আমাদের বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে বলে প্রচলিত একটি কথা রয়েছে।গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নয়নাভিরাম তাল গাছ ও ফল হারিয়ে যাচ্ছে!! তাল একটি সুপরিচিত ফল। এটি দীর্ঘজীবী বৃক্ষ। তালের আদি নিবাস মধ্য আফ্রিকা হলেও নড়াইলের কিছু কিছু স্থানে ছোট-বড় তালগাছ চোখে পড়ে। গুচ্ছমূলী বৃহৎ অশাখ বৃক্ষ তাল, গাছের গোড়ার দিক মোটা, ওপরের অংশ তুলনামূলক চিকন, কান্ডো মাথায় বোঁটা ও পাতা গুচ্ছভাবে সাজানো থাকে ও বোঁটার দুই ধারে করাতের মতো দাঁত আছে। বোঁটা শক্ত ও পুরু। গাছ উচ্চতায় ২০ থেকে ২৫ মিটার হয়ে থাকে এবং দীর্ঘজীবী উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম তাল। ১৪০ থেকে ১৫০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে এই গাছ।
তুলনামূলকভাবে রোগ-বালাই কম। তাল পুরুষ বা স্ত্রী যে কোনো এক ধরনের হয়। গাছ উভয় লিঙ্গ নয়, একই গাছে দুই রকম ফুল ফোটে না। গাছ প্রতি ৪০০ থেকে ৫০০টি পর্যন্ত ফল ধরে, তবে এর পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। গাছে কাঁদিতে ফল ধরে, একটি গাছে অনেক কাঁদি ধরে, ফলের আকার গোলাকার চ্যাপ্টা, প্রতি ফলের গড় ওজন ১ থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত হয়, ফলের রং প্রথমে হলদে সবুজ, পরিপক্ব ফলের রং হলুদ, খয়েরি কালো রঙের হয়। তাল ফলে এক থেকে দুটি বা তিনটি আঁটির ফল ধরতে দেখা যায়। ফল পাকে ভাদ্র মাসে, তবে কোনো কোনো গাছে বছরের অন্যসময় ফল ধরতে দেখা যায়। পাকা ফলের ঘ্রাণ তীব্র সুগন্ধযুক্ত, স্বাদে মিষ্টি থেকে পানসে মিষ্টি হয়। গাছে পাকা তাল আপনা-আপনি ঝরে পড়ে।
সাধারণত গ্রীষ্মের মৌসুমে ফলে তাল। তালফল ও তালগাছের বহুবিধ ব্যবহার ও পুষ্টি গুণাগুণ বিবেচনায় দেশীয় ফলের মধ্যে তালের অবদান শীর্ষে। তালের পাতা দিয়ে হাতপাখা, মাদুর, টুপি, ঘরের ছাউনি, চাটাই, ছাতা, লাকড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এমনকি তালগাছের কাঠ দিয়ে ঘরের রোয়াও দেওয়া হয়। পুরুষ গাছের ফুল বা জটা থেকে রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড়, পাটালি, ভিনেগার, পিঠা, বড়া, লুচি, সডিনগাছ তৈরি করা হয়। পাকা তালের রস দিয়ে পিঠা, বড়া, ক্ষীর, পায়েস তৈরি করা হয়। কচি ও কাঁচা তালের নরম শাঁস মুখরোচক পুষ্টিকর ও ছোট-বড় সবার প্রিয়। গ্রীষ্মের তৃষ্ণা নিবারণে কাজ করে।
তাল ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার, তালের রস শ্লেস্মানাশক, মূত্র বর্ধক, প্রদাহ ও কোষ্ঠ-কাঠিন্য নিবারণ করে। রস থেকে তৈরি তালমিছরি সর্দি-কাশিতে মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। অজ্ঞতা ও দৈনন্দিন বিভিন্ন চাহিদার কারণে দিন দিন যেভাবে তালগাছ নিধন করা হচ্ছে এতে প্রকৃতি পরিবেশ হারাচ্ছে তার রূপ সৌন্দর্য। নয়নাভিরাম সারি সারি তালগাছ, গাছে গাছে তালফল ও তালগাছে পাখির বাসা আজ তেমন দেখা যায় না।
আমরা একবার ভেবে দেখছি কী? প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ মৌসুমে অন্যান্য বৃক্ষ চারার সঙ্গে যদি তালগাছের বীজ/চারা বেশি বেশি রোপণ করি এবং নির্বিচারে তালগাছ নিধন না করি তবে আমাদের এ দেশে আবারো উপকারী ফল তাল ফিরে পাবে হারানো ঐতিহ্য। উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তালগাছ উঁচু হওয়ায় বজ্রপাত তালগাছের ওপর পড়ে মানুষের জানমাল রক্ষা করে থাকে। এছাড়া তালগাছের শিকড় বেশি থাকায় নদী ভাঙ্গন প্রবন এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তালগাছের গুণাগুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেক গুণ ও প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তালগাছ রোপনের আগ্রহ যেন মানুষের দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাল গাছ রোপনের প্রতি মানুষের আগ্রহ না বাড়লে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ তালগাছ কালের গর্ভে একদিন ঠিকই হারিয়ে যাবে।কালের বিবর্তনে, আবহাওয়ার বিরুপ প্রভাবে ও জনসচেতনতার অভাবে দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তালগাছ।বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে খ্যাত, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগার পোরশা, নিয়াতপুর, আত্রাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মাঠের ভিতরে জমির আইলে, পুকুর পাড়ে, বিভিন্ন রাস্তার ধারে, ও বাড়ির আনাচে কানাচে অসংখ্য পরিমাণে লাইন ধরে সারি সারি তালের গাছ দেখা যেত। দূরদূরান্ত থেকে এসব তালের গাছ দেখে মনে হতো কি এক অপরূপ সৌন্দর্য! চৈত্র ও বৈশাখ মাসে তালপাতার আওয়াজে সঙ্গে তাল মিলিয়ে তালের গাছের নিচে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া কৃষক, কিষানিরা ও রাখাল ছেলেরা গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রকারের গানের সুর তুলে বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে সময় কাটাতো ।এছাড়া ভাদ্র মাসের সময় তাল পাকলে গাছ থেকে পাকা তাল পড়ার দুপ,ধাপ শব্দে শুনে কচিকাঁচা যুবক-যুবতী বয়জেষ্ঠরা ছুটে যেত তালের গাছের গোড়ায়। কিন্তু কালের বিবর্তনে, আবহাওয়া বিরূপ প্রভাবে, জনসচেতনার অভাবে উল্লেখিত বিষয়গুলো এখন সবই স্মৃতি।অনুসন্ধানে জানা যায়, এক একটি তালের গাছ ৩০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হ য়, প্রকারভেদে তালের গাছ দুই প্রকার হয়। পুরুষ তাল গাছ ও মেয়ে তাল গাছ। মেয়ে তালগাছের চাইতে পুরুষ তালগাছের চাহিদা বেশি। তালগাছের কান্ড দ্বারা বাড়িঘর, দোকানপাট, দোচালা খাড়া তিনের ঘর, গরুর গাড়ির ধুরি তৈরিতে পুরুষ তালগাছ বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাল গাছের পাতা দিয়ে বিভিন্ন প্রকারের হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, বাচ্চাদের বিভিন্ন প্রকারের খেলার পুতুল ও হরেক রকমের মালামাল তৈরি করা হয়।এছাড়া তালের ফল এবং বীজ দুটোই বাঙালি খাদ্য। কাঁচা পাকা দুই অবস্থাতেই তালের বীজ খাওয়া হয়। কচি তালের বীজের মধ্যে থাকে জলে ভরা তাল শাস যা চৈত্র মাসের সময় শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।ভাদ্র মাসের শেষের দিকে তাল পাকে। পাকা তাল দিয়ে তাল ফুলোরি, বিভিন্ন পিঠাপুলি তৈরি করা হয়। তালে আছে এক প্রকারের ভিটামিন এ,বি ও সি, জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন ক্যালসিয়াম সহ আরো অনেক পদার্থ। তালের গাছের মোচা থেকে রস সংগ্রহ করে তৈরি করা হয় গুড়, পাটালি, মিছরি। তাল গাছ থেকে টাটকা রস পেড়ে খেলে পায়খানা ক্লিয়ারসহ পেটের কয়েক প্রকারের রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যাই বলে বয়জ্যৈষ্ঠদের অভিমত।এদিকে অভিজ্ঞ মহলের দাবি কৃষি বিভাগ ও বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তালগাছ নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ালে আগের রূপে ফিরে আসবে তাল গাছের পরিবেশ।