এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির,খাঞ্জেলী মেলা থেকে ফিরে :বাগেরহাটের প্রায় সাড়ে ছয়শ বছরের পুরানো বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী হযরত খানজাহান (রহ.) মাজারে শুক্রবার রাত থেকে তিন দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী ‘খাঞ্জেলী মেলা’ শুরু হয়েছে ভক্তদের ঢল। প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই মেলা শুরু হয়। চলবে তিনদিন ধরে। আগামী রোববার এই মেলা শেষ হবে। শুক্রবার সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খানজাহানের হাজার হাজার ভক্ত আশেকানরা মাজার এলাকায় জড়ো হতে শুরু করেছেন। ভক্তরা এখানে জড়ো হয়ে তাদের মনোবাসনা পূরণের আশায় মিলিত হন। তাদের বিশ্বাস এখানে আসলে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। ভক্তরা খানজাহানের খনন করা দীঘিতে নেমে গোসল এবং মাজার জিয়ারত করেন। এদিকে মেলা প্রাঙ্গণে চলছে ব্যাপক আয়োজন। দরগার বিশাল মাঠে বসবে একশ দোকান। সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, যশোর, নড়াইল, রাজশাহী, পাবনা, ঢাকা থেকে পসরা নিয়ে আসবেন ব্যবসায়ীরা। ঘর সাজানোর হরেক রকম সরঞ্জাম, আধুনিক ডিজাইনের ফার্নিচার, তৈজসপত্র, খেলনা, গেরস্থালি পণ্য যেমন, তালের হাত পাখা, মাটির থালা, পুতুল ইত্যাদি। ফ্যাশন জুয়েলারি, কাঁচের চুড়ি, নানারকম পোশাক, মিষ্টিসহ নানা রকম খাবার দোকানও থাকবে এ মেলায়। এছাড়াও দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে নানা বিনোদনের ব্যবস্থা। দরগার দিঘিতে পুণ্য স্নান, কুমির প্রদর্শনী, শিশুদের বিনোদনে নাগরদোলা, ঘোড়া, টয় ট্রেনসহ রয়েছে নানা আয়োজন। সর্বোপরি দর্শনার্থীদের কাছে মেলাটি উপভোগ্য করে তুলতে ব্যস্ত আয়োজকরা।
সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো নারী পুরুষ আজ শুক্রবার থেকেই মাজারে জড়ো হতে শুরু করেছে। এসব ভক্তরা তিনদিন মাজারে অবস্থান করবেন। অনেকেই নিজের মনোবাসনা পূরণের আশায় স্রষ্টার আরাধনায় মগ্ন থাকবেন। লালন, মুর্শিদী ও ভাটিয়ালী গান পরিবেশন করবেন আরেক দল ভক্ত। রাতভর লোকে লোকারণ্য থাকবে মাজার প্রাঙ্গণ। আগত ভক্তদের বিশ্বাস এখানে এসে দোয়া করলে যে কোনো সমস্যার সমাধান মেলে। আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীদের খরচেই রান্না হবে খিচুড়ি, তেহারি ও বিরিয়ানি। এতিম, মিসকিন, অসহায় ও দুস্থদের মুখে খাবার তুলে দেবেন ভক্তরা।বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ থেকে আসা এস এম রিফাতুল ইসলাম বলেন, ঐতিহ্যবাহী খান জাহানের মেলা দেখার জন্য প্রতিবছর আমি এ মেলাতে আসি। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের কাছে এ মেলা খুবই জনপ্রিয়।গত দু’বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই এবছর মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় বেশ ভালো লাগছে। ভোলা থেকে আগত অ্যাডভোকেট শাহীন বলেন, খানজাহানের মেলা উপলক্ষে আমরা আমাদের মান্নত পালন করতে এসেছি। পরিবারের সকলকে নিয়ে এখানে আসতে পেরে ভালো লাগছে। আগামী তিনদিন আমরা এখানে থাকব।
বরিশাল থেকে আগত কলেজ শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, ঐতিহ্যবাহী খান জাহানের মেলা দেখার জন্য প্রতিবছর আমি এ মেলাতে আসি। দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষের কাছে এ মেলা খুবই জনপ্রিয়। গত দু’বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই এ বছর মেলা অনুষ্ঠিত হবে বলে বেশ ভালো লাগছে।
মাদারীপুর, ঝিনাইদহ, বরিশাল, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী থেকে আসা ভক্তরা বলেন, চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে প্রতি বছর মাজারে মেলা বসে। খানজাহানের সাথে একটি মানুষের আত্মিক প্রেম ভালবাসা আছে। তার ভালোবাসার জন্য এখানে প্রতিবছর আসি। এখানে নামাজ পড়ি, রোজা রাখি। মানত করি। তিনি আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করেন।
হযরত খানজাহান (রহ.) মাজারে প্রধান খাদেম ফকির তারিকুল ইসলাম জানান, চৌদ্দশ খ্রিষ্টাব্দে হযরত খানজাহান (রহ.) পুণ্যভূমি বাগেরহাটে আসেন। পাঁচশ বছর আগে থেকেই চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে দেশবিদেশের হাজার হাজার ভক্ত আশেকানদের মাজারে সমাগম ঘটে। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে এটি চলে আসছে।এই মেলা খানজাহানের মৃত্যু বা জন্ম দিনে হয় না। এখানে চৈত্র মাসের পূর্নিমা তিথিতে ভক্তরা এসে জড় হতো। যেটা পরবর্তীতে মেলায় রূপ নিয়েছে। খানজাহানের হাজার হাজার ভক্ত তাদের নানা মনোবাসনা নিয়ে হাজির হন। তারা বিশ্বাস করেন খানজাহান এখানে কাউকে খালি হাতে ফিরান না। তাদের সব আশা পূরণ করেন খানজাহান। তাই সব সব ধর্মের মানুষ এই সময়ে হযরত খানজাহানের মাজারে মিলিত হন।
তিনি জানান, মেলায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়েছে। দর্শনার্থী ও মেলায় আগত দোকানিদের নিরাপত্তায় পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় তরুণরা স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছেন। তারা এখানে এসে মাজার জিয়ারত ও দীঘিতে গোসল করেন। তারা মনোবাসনা পূর্ণের জন্য আল্লার দরবারে কান্নাকাটি করেন। ভক্তরা এখানে জড়ো হয়ে তাদের মনোবাসনা পূরণের আশায় মিলিত হন। এখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। দক্ষিণাঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। মেলায় যাতে কোন বিশৃঙ্খলা না ঘটে সেজন্য প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।বাগেরহাটের পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ জানান, আগত ভক্ত ও দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় বাগেরহাট থানা পুলিশ, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা পুলিশ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে। মাজার সংলগ্ন হাইওয়ে সড়কে বারো মাসই পুলিশ নিয়মিত টহল দেয়। আর মেলা উপলক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে ।
বাগেরহাট সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহমুদ-উল-হাসান বলেন, কেউ কোন সমস্যায় পড়লে আমাদের ফোন দিলেই পুলিশ সদস্যরা সেখানে পৌঁছে যাবে।