ছবি সংগৃহীত
গোলাম মাওলা রনি :দেশে যে কী হচ্ছে তা আপনারা কতজন বুঝতে পারছেন, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে আমার মতো গণ্ডমূর্খের দল দেশের হালচাল কিছুই অনুধাবন করতে পারছে না। দেশের চলমান সমস্যাগুলো কী- সমাধানের পথ কী অথবা আমাদের গন্তব্য কোথায়, তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা না হওয়ার দরুন সর্বত্র এক ধরনের অন্ধকার সব সম্ভাবনাকে গ্রাস করে ফেলেছে। মানুষ কাজকর্ম বাদ দিয়ে কল্পনার ফানুস ওড়াচ্ছে। রাজনীতির মতো জটিল একটি বিষয়কে ছেলের হাতের মোয়া অথবা অবোধ শিশুদের লেবেনচুস অথবা চুসনি মনে করে ধনী-গরিব-আমির-ওমরাহ, ছেলে-বুড়ো সবাই রাজনীতি নিয়ে নিদারুণ চর্চা শুরু করে দিয়েছেন। ফলে সারা দেশে এমন সব সমস্যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, যা ইতোপূর্বে বাঙালি কল্পনাও করেনি।
বাঙালি এখন দিল্লি জয়ের জন্য ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, কবচ, বাটি চালানের মতো আদিম পদ্ধতির চর্চা শুরু করে দিয়েছে। তারা নিজেরা লুটপাট, চুরি-ডাকাতি, চাঁদাবাজি-রাহাজানি ইত্যাদির পক্ষে হাজার হাজার যুক্তি দাঁড় করিয়ে মনে মনে স্বপ্নবাসর রচনা করছে যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা এ দেশে এসে বিজ্ঞানচর্চা করবেন। ডাক্তাররা লন্ডন-আমেরিকা ছেড়ে চিকিৎসা পেশার সুধারস আস্বাদনের জন্য বাংলার আনাচকানাচে বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে তুলবে। আর ইলন মাস্ক, বিল গেটস, জাকারবার্গ, জেফ বেফোর্জ, হিন্দুজা পরিবার, রকফেলার পরিবার এবং জ্যাক ম্যারা নিজ নিজ দেশের বিনিয়োগ এবং শিল্প কলকারখানাগুলো সব বাংলাদেশে স্থাপন করবে। কারণ আমাদের দেশ এখন ফ্যাসিবাদমুক্ত হয়েছে এবং দেশে মহামানব-অতিমানব বিস্ময়বালকদের যে নেতৃত্ব পয়দা হয়েছে তার ফলে বাংলাদেশ থেকে ভবিষ্যতে যত সহজে চাঁদের দেশে যাওয়া যাবে, তা অন্য কোনো দেশ থেকে সম্ভব হবে না।
এমনিতেই বাঙালি তার কল্পনাশক্তির জন্য বিশ্বখ্যাত। আমাদের শিশুরা শৈশব থেকেই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। বালকেরা স্বপ্ন দেখে তাদের জন্য পরিস্থান থেকে রাজকন্যা আসবে এবং তাকে উড়িয়ে পরিস্থানে নিয়ে গিয়ে মহা ধুমধামে বিয়ে করবে। তারপর শ্বশুরের প্রাসাদে সারা জীবন শুয়ে-বসে পরির সঙ্গে ঘরসংসার করবে। কোনো কাজ নেই কর্ম নেই লড়াই-সংগ্রাম জীবনযুদ্ধের বালাই নেই শুধু আরাম-আয়েশের স্বাদ পাওয়ার জন্য একটি অলস ও নিষ্কর্মা জীবন প্রাপ্তির লক্ষ্যে কত বালক যে সন্ধ্যার পর বাঁশঝাড়, বনবাদাড়, পাট খেত অথবা ধান খেতে গিয়ে পরির জন্য অপেক্ষা করেছে, তার হিসাব অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো দপ্তর বা রাজনৈতিক দলের অফিসে নেই।
পরিকে বিয়ে করার স্বপ্ন ছাড়াও বাঙালি বালকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, গুপ্তধনের সন্ধান লাভ। গ্রামের ফসলি মাঠে তিন আইলের সংযোগস্থলে যদি বিন্নাছোবা থাকে এবং সেই বিন্নাছোবার ওপর যদি ঘুঘু পাখির বাসা থাকে তবে সেখানকার মাটি খুঁড়লে নির্ঘাত কলস ভর্তি সোনার মোহর মিলবে। গ্রামের ফাঁকিবাজ অলস চালাকরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে অথবা গৃহকর্ম বাদ দিয়ে সোনার কলসের লোভে বিন্নাছোবার ওপর ঘুঘুর বাসা খুঁজতে যে সময় ব্যয় করে, তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয় কি না, আমি বলতে পারব না।
আমাদের দেশের কবিরাজ, বৈদ্য, ওঝা, পীর-ফকির, সাধু সন্ন্যাসীদের নিয়ে যে অতিমানবীয় গল্পসল্প চালু রয়েছে, যা শুনতে শুনতে শিশুরা যখন বড় হয় কিংবা বিদ্যাবুদ্ধিতে পক্বতা অর্জন করে বড় পদপদবিতে বসে তখনো অকল্পনীয়-অলৌকিক বিষয়াদির ভয়-লোভ-লালসা তাদের তাড়া করে। ফলে রাস্তায় অদ্ভুত কিছু দেখলে তারা কাজকর্ম ফেলে দাঁড়িয়ে যায়। কোনো বুজুর্গের সুরত ধরে যদি কেউ মন্ত্রী, এমপি, সচিব, জেনারেল পদমর্যাদার কাউকে অভিশাপ দেয় তবে সংশ্লিষ্ট লোকটির গায়ে নির্ঘাত জ্বর চলে আসবে এবং অশুভ লক্ষণের ভয়ে থরথর কাঁপতে শুরু করবে। আর ওমন কেউ যদি কোনো সুসংবাদের লোভ দেখিয়ে একটু ঝাড়ফুঁক দিয়ে দেয় তবে মনের আনন্দে-কথিত বুজুর্গের পায়ের ওপর লুটোপুটি খাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আবহমান বাংলার প্রকৃতি পরিবেশ ছাড়াও হাজার বছরের ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় বিদেশিদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হওয়ার কারণে আমাদের শরীর ও মনের যে অবস্থা হয়েছে, তার ফলে আমাদের কোনো জাতীয় চরিত্র তৈরি হয়নি। আমাদের রুচিবোধ, আভিজাত্য, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, যুদ্ধ কিংবা লড়াই-সংগ্রাম করার ধারাবাহিক দৃঢ়তা তৈরি হয়নি। আমরা আরবদের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে শত শত বছর ধরে বংশের মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়াই করতে পারি না। আমরা তাদের মতো ১০০ জন পূর্বপুরুষের নাম মুখস্থ বলা তো দূরের কথা দাদা-নানা বা দাদি-নানির বাবার নাম বলতে পারি না। আমরা পারস্য জাতির মতো নিজের দেশকে ভালোবেসে তাবৎ দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি না। আমরা আফগান জাতির মতো বীরত্ব নিয়ে মহাবীর আলেকজান্ডারকে সন্ধি শর্তে বাধ্য করতে পারি না। তাহলে আমরা কী পারি?
আমরা ক্ষমতার পুজো করতে পারি। সাপের ছোবল খাওয়ার আগে কেবল ফোঁসফাঁস শব্দ শুনে হার্ট অ্যাটাক করে মরে যেতে পারি। আমরা ক্ষমতাধরদের পদলেহন, জুতালেহন এবং ক্ষমতার চেয়ারের কাছে মস্তক অবনত করতে পারি। আমরা প্রচণ্ড টেনশন করতে পারি এবং ভরাপেটে চিন্তা করে পেটের মধ্যে এক গাদা গ্যাস উৎপন্ন করতে পারি। অনিদ্রা অতিভোজন এবং বদচিন্তা দ্বারা আমরা স্থায়ীভাবে কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগীতে পরিণত হতে পারি। আর সবচেয়ে ভালো পারি তেলবাজি করতে। আমরা যা চাই, যা ভয় পাই বা যা পছন্দ করি তার জন্য পরিশ্রম, জ্ঞানগরিমা অর্জন; সাহস শক্তি প্রদর্শন অথবা বিনিয়োগের পরিবর্তে তেল মারা, মাথা নোয়ানো এবং আত্মমর্যাদা বিসর্জন দেওয়াকে লাভজনক বলে মান করি।
উল্লিখিত বিষয়াদি ছাড়া আমাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, অস্থিরতা। আমরা মাছির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভন ভন করি। অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততার কারণে আমাদের মুখে গুটি বসন্তের মতো ব্রণ উঠে যায়। অস্থিরতার কারণে প্রায়ই আমাদের মেজাজ গরম থাকে। ফলে আহার-নিদ্রায় বাঙালির অনিয়ম রীতিমতো বিস্ময়কর। আমাদের পেট খারাপ, বদহজম, মুখে গন্ধ এবং বায়ু ত্যাগে অনিয়মের কারণে অনেক সভা-সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়।
আমরা ছোটকে বড় ভাবি বড়কে ছোট ভাবি। আমরা তেলা পোকা দেখে আঁতকে উঠি এবং জঙ্গলে গিয়ে বাঘের গন্ধ পেয়ে অথবা বাঘের পদচিহ্ন দেখে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকি। কিন্তু চিড়িয়াখানায় বন্দি বাঘ-সিংহকে ঢিল মারা, লেজ ধরে টান দেওয়া এবং বাঘের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বাঘের মতো হুঙ্কার দেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা সম্মানিত লোকের চরিত্র হরণ এবং অভিজাত লোকদের বেইজ্জতি করতে নিদারুণ পুলক অনুভব করি। জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক যেমন আমাদের কাছে শত্রু বলে বিবেচিত হয় ঠিক তেমনি গলাবাজ ভণ্ড মিথ্যাবাদী ও প্রতারকদের আমরা বন্ধু মনে করি।
আমরা বেহেশতে যেতে চাই। এ জন্য ইলম অর্জন এবং পর্যাপ্ত আমলের পরিবর্তে গলাবাজদের ফর্মুলা অনুযায়ী কিচ্ছাকাহিনির চর্চা করে এবং সব সময় নিজেদের সঠিক এবং ভিন্নমতের মানুষকে বেঠিক মনে করি। মানুষকে ঘৃণা করা, সন্দেহ করা এবং তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই কারও বদনাম করা আমাদের জীবনের অন্যতম বিনোদন। আমরা শক্তির পূজারি, দুর্বলের যম এবং নিজের জন্য সবকিছু হালাল মতবাদে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কাজেই বিগত হাজার বছরে যারাই আমাদের শাসন করতে এসেছে তারা আমাদের সম্পর্কে এমন অভিজ্ঞতা নিয়ে গেছে, যা তারা কেয়ামত পর্যন্ত ভুলতে পারবে না। ২০২৫ সালের ১২ এপ্রিল এই নিবন্ধ লিখতে গিয়ে বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম চরিত্রের কথা মনে হওয়ার পেছনে গত ছয়-সাত মাসের ঘটনাবলি, কিছু মানুষের হম্বিতম্বি, কিছু মানুষের আহাজারি এবং আমজনতার ঐতিহাসিক ভূমিকা ও নতুন নেতাদের স্বপ্নবিলাসী ঘুঘুর বাসার নিচে সোনার মোহর খোঁজার কসরত দেখে মনে হলো আমাদের কোনো পরবর্তন সহসা হবেও না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন