বিদেশে কেন বাঙালির হানাহানি জিন্দাবাদ নিন্দাবাদ

নঈম নিজাম : নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের আলোঝলমলে দুপুর। জাতিসংঘ সদর দফতরে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন একজন বিদেশি সাংবাদিক। খেয়াল করলেন দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের দুই দল মানুষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিচ্ছে। তিনি ভাষা বুঝতে পারলেন না তবে অনুধাবন করলেন, পরস্পর আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। একদল স্বাগত জানাচ্ছে তাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, আরেকদল নিন্দাবাদ দিচ্ছে। কৌতূহলী সাংবাদিক চোখ মেলে তাকালেন। জানতে চাইলেন ওরা কারা? এভাবে মারমুখী অঙ্গভঙ্গি করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে কেন? বিশ্ব মানবাধিকার কিংবা যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে কি ওরা স্লোগান দিচ্ছে? তাঁর সঙ্গে থাকা আরেকজন জানালেন, দুই দলের বাড়ি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে। একদল সরকারি দলের সমর্থক, আরেক দল বিরোধী দলের। বাংলাদেশে বাড়ি হলেও সবার বসবাস আধুনিক দুনিয়ার সেরা দেশ আমেরিকায়। সবাই আমেরিকার নাগরিকত্বও নিয়েছেন। নিজের দেশকে ভুলতে পারেননি বলেই এ দেশে ঝড় তুলছেন। পরস্পরকে গালাগাল করছেন। বিস্মিত হলেন সেই সাংবাদিক। খেয়াল করলেন কড়া নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে আমেরিকান পুলিশ। দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক চোখে হাঁটাহাঁটি করছেন। কারও হাতে হ্যান্ডকাফ, কারও হাতে প্রশিক্ষিত কুকুর। মারামারি বাধলে সব কিছু সামাল দেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি। স্লোগানধারীরা বেশ সক্রিয়। তারা মোবাইলে সেলফি তুলছেন। দিচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে। পাঠাচ্ছেন দলের নেতানেত্রীদের কাছেও।

প্রবাসে পরবাসে অন্য কোনো দেশের এভাবে রাজনৈতিক দল নেই। সংগঠন নেই। উপজেলা ও ইউনিয়নের আঞ্চলিক সমিতি নেই। আমাদের আছে। শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, কর্নেল অলির এলডিপি, কমিউনিস্ট পার্টি নয়, রিকশা শ্রমিক লীগ থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের কমিটিও আছে। প্রবাসে কোথায় রিকশা আর কোথায় তাঁত কেউ জানি না। তার পরও কমিটি নিয়ে মারামারি। শাখা-উপশাখা নিয়ে হানাহানি। কষ্টের টাকায় গলা ফাটিয়ে নাম কামানোর প্রতিযোগিতা। লড়াই শুধু অন্য দলের সঙ্গে নয়, নিজেদের ভিতরে বেশি। পরিস্থিতি বেগতিক হলে মাঝেমধ্যে পুলিশ ডাকতে হয়। সবাই নেতা হতে চান। নিজের চেহারা দেখাতে চান। অনেক সময় কেন্দ্রের অনুমোদন নেই তার পরও কমিটি-পাল্টা কমিটি গড়েন। সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটস, ব্রুক লেন, জ্যামাইকায় চায়ের কাপে ঝড় তোলেন। সরকারের মেয়াদ নিয়ে বাজি ধরেন। যারা দল করেন না তারা নিজের এলাকার আঞ্চলিক সমিতি করেন। সেখানেও শান্তি নেই। হানাহানি, দলাদলি, দ্বিধাবিভক্তি আছেই। পরচর্চা, পরনিন্দা বারো মাস চলতেই থাকে। ঝামেলা মেটাতে ঢাকা থেকে জাতীয় নেতারা আসেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ছবি তোলেন। মন্ত্রী আর জাতীয় নেতারা বিরোধ মেটান না। বরং আগুনে আরও ঘি ঢেলে দেন। পরিবেশ করেন আরও উত্তপ্ত। শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপসহ অন্য দেশগুলোয়ও একই চিত্র। প্রবাসীদের কষ্টের টাকায় নেতারা উপহার নেন। সভা করে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেন। সোনার হরিণের আশ্বাস দেন। কি সরকারি কি বিরোধী দল- সবখানে একই দৃশ্য। দেশে ফিরে নেতারা প্রবাসীদের কথা ভুলে যান। কোনো সংকটেরই সমাধান করেন না। এমনকি বিমানবন্দরের হয়রানিটাও থামান না।

 

বাংলাদেশি কমিউনিটির ঠিক বিপরীত অবস্থানে আমাদের আশপাশের দেশগুলো। তারা ব্যস্ত মেইনস্ট্রিমে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিয়ে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ কোনো দেশেরই প্রবাসে রাজনৈতিক সংগঠন নেই। আছে নিজের দেশের সম্মিলিত অ্যাসোসিয়েশন। এ অ্যাসোসিয়েশন সবার স্বার্থ রক্ষা করে। নিজের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এলে সংবর্ধনা দেয়। পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো প্রথমবার দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছিলেন লন্ডনে। তিনি অক্সফোর্ডের ছাত্রী ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লন্ডন যাওয়ার পর পিপলস পার্টির সমর্থকরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একদা তাঁর পিতার মুক্তির জন্য আগে তিনি সবাইকে একত্রিত করেছিলেন। তাঁর দুই ভাই আফগানিস্তান, ফ্রান্সে বসে লড়াই করেছেন। এক ভাইয়ের রহস্যজনক মৃত্যুর পর আরেক ভাই সিরিয়া গিয়েও লড়েছেন। সেই প্রবাসীরা লন্ডনে পিপলস পার্টির কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন বেনজিরকে। তাঁরা বললেন, পাকিস্তান একটি অস্থিতিশীল দেশ। এ দেশের রাজনীতি- অর্থনীতির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। জিয়াউল হক সামরিক শাসন জারি করে আপনার পরিবারের প্রতি সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছেন। আপনার বাবাকে ফাঁসি দিয়েছেন। এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে প্রবাসে। আগামীর কথা বিবেচনা করে রাজনৈতিক সংগঠন রাখুন লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বেনজির সব কথা শুনলেন। তিনি প্রবাস কমিটি গঠনে সম্মতি দেননি। বরং সোজা বলে দিয়েছেন, বিদেশে সবাই পাকিস্তানি। পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগের নামে ভাগাভাগির কোনো প্রয়োজন নেই। সবাইকে বিদেশে মিলেমিশে থাকতে হবে। এতে কমিউনিটি শক্তিশালী হবে। পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হবে। সবাই সবার বিপদে আপদে কাজে লাগবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী এলে খোলা মন নিয়ে তুলে ধরতে পারবে নিজেদের সব সমস্যা। এতে অনেক সুবিধা হবে। সবার সব সংকট দ্রুত সমাধান হবে। দলের প্রতি কারও সমর্থন থাকতেই পারে। ইউরোপ-আমেরিকায় বসে মূলধারার রাজনীতি করলে এখানকার নেতৃত্ব আসবে হাতের মুঠোয়। সবখানে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা। এতে পাকিস্তান উপকৃত হবে। দেশের প্রতি অন্যভাবে অবদানের সুযোগ তৈরি হবে।

 

কয়েক বছর আগের কথা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান নিউইয়র্কে। তাঁকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা। বাইরে কংগ্রেস কর্মীদের কোনো ভিড় ছিল না। দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাঁকে রিসিভ করলেন। বের হয়ে অনুরোধ করলেন তাঁদের গাড়িতে চড়তে। রাহুল তাঁদের গাড়িতে চড়লেন না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলেন হোটেলে। কর্মকর্তাদের বললেন, এক দিন পর আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে অনুষ্ঠানে। রাহুল তাঁর বাবা রাজীব গান্ধী ও দাদি ইন্দিরাকে ফলো করেছেন। ইন্দিরা ও রাজীব প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বিদেশ গেলে ভারতীয় সর্বজনীন কমিউনিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। বিদেশে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সংগঠন নেই। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা একটা রীতিনীতিতে চলেন। কয়েক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শেষ করে তিনি ভারতীয়দের বিশাল সমাবেশে যোগ দেন। পশ্চিমা মিডিয়া থমকে দেখেছিল একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান। রাজপথের সেই সমাবেশে মোদি বক্তৃতা করেছেন প্রবাসী ভারতীয়দের উদ্দেশে। বিত্তশালী প্রবাসীদের অনুরোধ করেছেন দেশে গিয়ে বিনিয়োগ করতে।

 

ভারত পাকিস্তানকে আমরা গালি দিই। কিন্তু কিছু বিষয়ে শেখার আছে। জানারও আছে। প্রবাসে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী গেলে প্রবাসীদের দ্বিধাবিভক্তি দেখলে দুঃখ হয়। কষ্ট হয়। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে। দেশের ভাবমূর্তি শেষ করে নিন্দাবাদের স্লোগান কেন দিতে হবে? নিজের অর্থ ব্যয় করে কেন এভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে হবে? বিদেশিরা আমাদের নিয়ে আলোচনা করবে কেন? অনেকে হয়তো বলবেন আমেরিকায়ও রাজনৈতিক হানাহানি-সংঘাত আছে। ট্রাম্পের ক্ষমতা ছাড়ার মুহূর্তের নোংরামি দেখেছি। ক্যাপিটল হিলে সমর্থকদের বাড়াবাড়ি ছিল নজিরবিহীন। সভ্য দুনিয়ায় এমন কর্মকাণ্ড কাম্য নয়। কিছুদিন আগের কথা। ফ্লোরিডা আর ম্যাসাচুয়েটস দুই রাজ্যের মধ্যে ছোটখাটো রাজনৈতিক লড়াই হয়ে গেল। ফ্লোরিডার গভর্নর ট্রাম্প সমর্থক আর ম্যাসাচুয়েটস ডেমোক্র্যাটের ঘাঁটি। ম্যাসাচুয়েটসের রাজনীতিবিদরা সব সময় মাইগ্র্যান্টদের প্রতি মানবিক আচরণের কথা বলেন। তাঁদের কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে ফ্লোরিডার গভর্নর ভেনেজুয়েলা থেকে আগত ৫০ জনের বেশি শরণার্থীকে বিশেষ ফ্লাইটে ম্যাসাচুয়েটসের মার্থাবেনিয়ার্ড দ্বীপে পাঠিয়ে দেন। এটি বিত্তশালীদের ছুটি কাটানোর দ্বীপ হিসেবে খ্যাত। দ্বীপে বহিরাগত মানুষকে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রেসিডেন্ট ওবামা এখানে আসেন ছুটি কাটাতে। একটা সময় আসতেন জন এফ কেনেডি। ফ্লোরিডার রিপাবলিকান গভর্নর রন ডি সেন্টেস সিদ্ধান্ত নিলেন বস্টনের গভর্নরকে একটা কড়া বার্তা দেবেন মাইগ্র্যান্ট সমস্যা নিয়ে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বিশেষ ফ্লাইটে মাইগ্র্যান্টদের পাঠিয়ে দিলেন। জানালেন এবার তাদের সামাল দাও। মুহূর্তে হুলুস্থুল পড়ে গেল গোটা আমেরিকায়। ছোট দ্বীপে এভাবে অতীতে কেউ আসেনি। তাদের রাখারও ব্যবস্থা নেই। মাইগ্র্যান্টরা হতভম্ব। তারা বুঝতে পারছিল না তাদের নিয়ে কী হচ্ছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা আগতদের নিয়ে গেল একটি চার্চে। রাত কাটানোর ব্যবস্থা করল তারা। ডেমোক্র্যাট সমর্থক মিডিয়া প্রশংসা করে রিপোর্ট প্রকাশ করল। আর রাজনীতিবিদরা ব্যস্ত হলেন বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতিতে। আগত অতিথিদের পরদিন পাঠিয়ে দেওয়া হলো হাইনাস শহরে। তাদের কেউ কেউ এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফ্লোরিডার গভর্নরের বিরুদ্ধে মামলার।

 

রাজনীতি একটা ক্ল্যাসিক বিষয়। রাজনীতি নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি ভালো ফল বয়ে আনে না। বিশ্বের অনেক দেশের মেইনস্ট্রিমে আমাদের কমিউনিটি এখন রাজনীতিতে ভালো করছে। ব্রিটেনে তিন এমপি আছেন পার্লামেন্টে। স্কটল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশে তাঁদের সাফল্য রূপকথার মতো। আমেরিকার মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে আমাদের কমিউনিটি শক্ত অবস্থানে। আমেরিকায় সরকারের ভিতরে তারা গুরুত্বপূর্ণ পদ নিতে শুরু করেছেন। স্টেট সিনেটর, রিপ্রেজেনটেটিভ হয়েছেন অনেকে। ছোট শহরের মেয়র হয়েছেন কেউ কেউ। কাউন্সিলরম্যানের সংখ্যা কম নয়। ড. ওসমান সিদ্দিক আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। আনোয়ার চৌধুরী ব্রিটিশ হাইকমিশনার হয়ে কাজ করেছেন। বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন। এমপি হচ্ছেন। অনেকে জাতীয় ফুটবল, ক্রিকেট টিমে স্থান পেয়েছেন। শিল্প-সংস্কৃতিতে কারও কারও অবস্থান গৌরব করার মতো। উত্তর আমেরিকার সরকার ও বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সিইও থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বাঙালি কাজ করছেন। বাঙালির পথচলায় আশার আলো একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এখন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত পালন করেছেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব। একদিন বাংলাদেশও ইতিহাস তৈরি করবে তাদের মতো। হ্যানসেন ক্লার্ক কংগ্রেসম্যান হয়েছিলেন। ড. নীনা আহমেদ কাজ করেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামার উপদেষ্টা হিসেবে। জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর শেখ রহমান, নিউ হ্যাম্পশায়ারের স্টেট রিপ্রেজেনটেটিভ আবুল খান দেখছেন আরও বড় স্বপ্ন। আমার কাছে মনে হয় সেদিন আর বেশি দূরে নয়।

 

আমেরিকার আলোকিত বাঙালিদের নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজন করে বিশেষ অনুষ্ঠানের। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেইনস্ট্রিম রাজনীতির সফল মানুষদের একটা অনুষ্ঠানে একত্রিত করতে। নিউইয়র্ক ও লন্ডন থেকে সপ্তাহে এক দিন বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্কের দায়িত্বে আছেন প্রবাসের সফল সাংবাদিক লাবলু আনসার। তিনি দীর্ঘদিন উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ঠিকানা’র সম্পাদক ছিলেন। তিনি এবারকার আয়োজনের সমন্বয় করেছেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর শেখ রহমান, নিউ হ্যাম্পশায়ারের স্টেট রিপ্রেজেনটেটিভ আবুল খানসহ বিভিন্ন এলাকার নির্বাচিত বাঙালি মেয়র, ডেপুটি মেয়র ও কাউন্সিলরম্যানরা ছিলেন। অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার তখনকার উপদেষ্টা ড. নীনা আহমেদ। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের থাকার কথা ছিল। তিনি শুরু থেকেই আমাদের উৎসাহিত করেছেন এমন আয়োজনে। অনুষ্ঠানে ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। নির্ধারিত সময়ের আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া প্লাজা হোটেলের হলরুম। আনন্দ উৎসবে পুরো হোটেল পরিণত হয় একখণ্ড বাংলাদেশে। প্রবাসে আমাদের বিজয়ী বীরদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা। আমেরিকা বিজয়ী বীরদের বলেছিলাম, আপনাদের সাফল্যের গল্প আগামীর বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে অনেক দূর। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজ বাংলাদেশের ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। বাবার পথ ধরে তিনি দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। আমেরিকার মতো দেশে প্রবাসীদের মেইনস্ট্রিমে দেখতে চাই আমরা। অর্জন শুরু হয়েছে। গৌরবের আলো ছড়াচ্ছেন আজ অনেকে। এ পথ ধরে প্রজন্ম তৈরি করবে আরও বড় ইতিহাস। আমাদের জীবিতকালে দেখে যেতে পারব কি না জানি না। বাঙালির এ এগিয়ে চলা রুদ্ধ করা যাবে না।

 

প্রবাসী বীরদের যখন সংবর্ধনা দিচ্ছি তখন খবর পাচ্ছি নিউইয়র্কের মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিএনপি শোডাউন করেছে। আওয়ামী লীগ করেছে পাল্টা সমাবেশ। প্রবাসে কেন এসব করতে হবে? নিজ দেশের নিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ স্লোগানে কার লাভ হচ্ছে? ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের। প্রবাসীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে বলছি, এসব বাদ দিন। প্রবাসের মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ে যান। আপনারাও ভালো করবেন হ্যানসেন ক্লার্ক, ড. নীনা আহমেদ, শেখ রহমানদের মতো। হাউস অব কমন্সে তিন বাঙালি এমপি আমাদের আলো জ্বালিয়েছেন। আপনারাও তৈরি করুন নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস। বাংলাদেশ থেকে আমরা ভালো খবরই শুনতে চাই প্রবাসীদের। বুকের ছাতিম বড় করতে চাই রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রূপা হক, ফয়সাল চৌধুরী, শেখ রহমান, আবুল খানদের বিজয়ের খবরে।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন । সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ডাকাতির প্রস্তুতিকালে চার ডাকাত গ্রেফতার

» শপথ নিলেন নতুন সিইসি ও ৪ নির্বাচন কমিশনার

» দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান ফারুকের

» সেনাবাহিনীর অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার

» যেসব এলাকায় আজ রাত ৮টা পর্যন্ত গ্যাস থাকবে না

» অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি উইমেনস চেম্বার অফ কমার্সের আয়োজন এলান গালা এন্ড চ্যারিটি ইভিনিং অনুষ্ঠিত

» ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত,আহত ২

» পাইরেসির শিকার শাকিব খানের ‘দরদ’

» এশিয়া কাপ জয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ল বাংলাদেশ দল

» পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বিদেশে কেন বাঙালির হানাহানি জিন্দাবাদ নিন্দাবাদ

নঈম নিজাম : নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের আলোঝলমলে দুপুর। জাতিসংঘ সদর দফতরে প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন একজন বিদেশি সাংবাদিক। খেয়াল করলেন দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের দুই দল মানুষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিচ্ছে। তিনি ভাষা বুঝতে পারলেন না তবে অনুধাবন করলেন, পরস্পর আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়েছে। একদল স্বাগত জানাচ্ছে তাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে, আরেকদল নিন্দাবাদ দিচ্ছে। কৌতূহলী সাংবাদিক চোখ মেলে তাকালেন। জানতে চাইলেন ওরা কারা? এভাবে মারমুখী অঙ্গভঙ্গি করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে কেন? বিশ্ব মানবাধিকার কিংবা যুদ্ধ বন্ধ নিয়ে কি ওরা স্লোগান দিচ্ছে? তাঁর সঙ্গে থাকা আরেকজন জানালেন, দুই দলের বাড়ি দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশে। একদল সরকারি দলের সমর্থক, আরেক দল বিরোধী দলের। বাংলাদেশে বাড়ি হলেও সবার বসবাস আধুনিক দুনিয়ার সেরা দেশ আমেরিকায়। সবাই আমেরিকার নাগরিকত্বও নিয়েছেন। নিজের দেশকে ভুলতে পারেননি বলেই এ দেশে ঝড় তুলছেন। পরস্পরকে গালাগাল করছেন। বিস্মিত হলেন সেই সাংবাদিক। খেয়াল করলেন কড়া নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে আমেরিকান পুলিশ। দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক চোখে হাঁটাহাঁটি করছেন। কারও হাতে হ্যান্ডকাফ, কারও হাতে প্রশিক্ষিত কুকুর। মারামারি বাধলে সব কিছু সামাল দেওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি। স্লোগানধারীরা বেশ সক্রিয়। তারা মোবাইলে সেলফি তুলছেন। দিচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমে। পাঠাচ্ছেন দলের নেতানেত্রীদের কাছেও।

প্রবাসে পরবাসে অন্য কোনো দেশের এভাবে রাজনৈতিক দল নেই। সংগঠন নেই। উপজেলা ও ইউনিয়নের আঞ্চলিক সমিতি নেই। আমাদের আছে। শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, কর্নেল অলির এলডিপি, কমিউনিস্ট পার্টি নয়, রিকশা শ্রমিক লীগ থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদী তাঁতী দলের কমিটিও আছে। প্রবাসে কোথায় রিকশা আর কোথায় তাঁত কেউ জানি না। তার পরও কমিটি নিয়ে মারামারি। শাখা-উপশাখা নিয়ে হানাহানি। কষ্টের টাকায় গলা ফাটিয়ে নাম কামানোর প্রতিযোগিতা। লড়াই শুধু অন্য দলের সঙ্গে নয়, নিজেদের ভিতরে বেশি। পরিস্থিতি বেগতিক হলে মাঝেমধ্যে পুলিশ ডাকতে হয়। সবাই নেতা হতে চান। নিজের চেহারা দেখাতে চান। অনেক সময় কেন্দ্রের অনুমোদন নেই তার পরও কমিটি-পাল্টা কমিটি গড়েন। সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটস, ব্রুক লেন, জ্যামাইকায় চায়ের কাপে ঝড় তোলেন। সরকারের মেয়াদ নিয়ে বাজি ধরেন। যারা দল করেন না তারা নিজের এলাকার আঞ্চলিক সমিতি করেন। সেখানেও শান্তি নেই। হানাহানি, দলাদলি, দ্বিধাবিভক্তি আছেই। পরচর্চা, পরনিন্দা বারো মাস চলতেই থাকে। ঝামেলা মেটাতে ঢাকা থেকে জাতীয় নেতারা আসেন। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ছবি তোলেন। মন্ত্রী আর জাতীয় নেতারা বিরোধ মেটান না। বরং আগুনে আরও ঘি ঢেলে দেন। পরিবেশ করেন আরও উত্তপ্ত। শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপসহ অন্য দেশগুলোয়ও একই চিত্র। প্রবাসীদের কষ্টের টাকায় নেতারা উপহার নেন। সভা করে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেন। সোনার হরিণের আশ্বাস দেন। কি সরকারি কি বিরোধী দল- সবখানে একই দৃশ্য। দেশে ফিরে নেতারা প্রবাসীদের কথা ভুলে যান। কোনো সংকটেরই সমাধান করেন না। এমনকি বিমানবন্দরের হয়রানিটাও থামান না।

 

বাংলাদেশি কমিউনিটির ঠিক বিপরীত অবস্থানে আমাদের আশপাশের দেশগুলো। তারা ব্যস্ত মেইনস্ট্রিমে নিজেদের শক্ত অবস্থান নিয়ে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ কোনো দেশেরই প্রবাসে রাজনৈতিক সংগঠন নেই। আছে নিজের দেশের সম্মিলিত অ্যাসোসিয়েশন। এ অ্যাসোসিয়েশন সবার স্বার্থ রক্ষা করে। নিজের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এলে সংবর্ধনা দেয়। পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো প্রথমবার দায়িত্ব নিয়ে গিয়েছিলেন লন্ডনে। তিনি অক্সফোর্ডের ছাত্রী ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লন্ডন যাওয়ার পর পিপলস পার্টির সমর্থকরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একদা তাঁর পিতার মুক্তির জন্য আগে তিনি সবাইকে একত্রিত করেছিলেন। তাঁর দুই ভাই আফগানিস্তান, ফ্রান্সে বসে লড়াই করেছেন। এক ভাইয়ের রহস্যজনক মৃত্যুর পর আরেক ভাই সিরিয়া গিয়েও লড়েছেন। সেই প্রবাসীরা লন্ডনে পিপলস পার্টির কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন বেনজিরকে। তাঁরা বললেন, পাকিস্তান একটি অস্থিতিশীল দেশ। এ দেশের রাজনীতি- অর্থনীতির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। জিয়াউল হক সামরিক শাসন জারি করে আপনার পরিবারের প্রতি সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করেছেন। আপনার বাবাকে ফাঁসি দিয়েছেন। এক ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে প্রবাসে। আগামীর কথা বিবেচনা করে রাজনৈতিক সংগঠন রাখুন লন্ডনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বেনজির সব কথা শুনলেন। তিনি প্রবাস কমিটি গঠনে সম্মতি দেননি। বরং সোজা বলে দিয়েছেন, বিদেশে সবাই পাকিস্তানি। পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগের নামে ভাগাভাগির কোনো প্রয়োজন নেই। সবাইকে বিদেশে মিলেমিশে থাকতে হবে। এতে কমিউনিটি শক্তিশালী হবে। পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব তৈরি হবে। সবাই সবার বিপদে আপদে কাজে লাগবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী এলে খোলা মন নিয়ে তুলে ধরতে পারবে নিজেদের সব সমস্যা। এতে অনেক সুবিধা হবে। সবার সব সংকট দ্রুত সমাধান হবে। দলের প্রতি কারও সমর্থন থাকতেই পারে। ইউরোপ-আমেরিকায় বসে মূলধারার রাজনীতি করলে এখানকার নেতৃত্ব আসবে হাতের মুঠোয়। সবখানে তৈরি হবে নতুন সম্ভাবনা। এতে পাকিস্তান উপকৃত হবে। দেশের প্রতি অন্যভাবে অবদানের সুযোগ তৈরি হবে।

 

কয়েক বছর আগের কথা। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান নিউইয়র্কে। তাঁকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা। বাইরে কংগ্রেস কর্মীদের কোনো ভিড় ছিল না। দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাঁকে রিসিভ করলেন। বের হয়ে অনুরোধ করলেন তাঁদের গাড়িতে চড়তে। রাহুল তাঁদের গাড়িতে চড়লেন না। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলেন হোটেলে। কর্মকর্তাদের বললেন, এক দিন পর আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে অনুষ্ঠানে। রাহুল তাঁর বাবা রাজীব গান্ধী ও দাদি ইন্দিরাকে ফলো করেছেন। ইন্দিরা ও রাজীব প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বিদেশ গেলে ভারতীয় সর্বজনীন কমিউনিটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। বিদেশে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সংগঠন নেই। ভারতীয় রাজনীতিবিদরা একটা রীতিনীতিতে চলেন। কয়েক বছর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শেষ করে তিনি ভারতীয়দের বিশাল সমাবেশে যোগ দেন। পশ্চিমা মিডিয়া থমকে দেখেছিল একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান। রাজপথের সেই সমাবেশে মোদি বক্তৃতা করেছেন প্রবাসী ভারতীয়দের উদ্দেশে। বিত্তশালী প্রবাসীদের অনুরোধ করেছেন দেশে গিয়ে বিনিয়োগ করতে।

 

ভারত পাকিস্তানকে আমরা গালি দিই। কিন্তু কিছু বিষয়ে শেখার আছে। জানারও আছে। প্রবাসে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী গেলে প্রবাসীদের দ্বিধাবিভক্তি দেখলে দুঃখ হয়। কষ্ট হয়। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে। দেশের ভাবমূর্তি শেষ করে নিন্দাবাদের স্লোগান কেন দিতে হবে? নিজের অর্থ ব্যয় করে কেন এভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে হবে? বিদেশিরা আমাদের নিয়ে আলোচনা করবে কেন? অনেকে হয়তো বলবেন আমেরিকায়ও রাজনৈতিক হানাহানি-সংঘাত আছে। ট্রাম্পের ক্ষমতা ছাড়ার মুহূর্তের নোংরামি দেখেছি। ক্যাপিটল হিলে সমর্থকদের বাড়াবাড়ি ছিল নজিরবিহীন। সভ্য দুনিয়ায় এমন কর্মকাণ্ড কাম্য নয়। কিছুদিন আগের কথা। ফ্লোরিডা আর ম্যাসাচুয়েটস দুই রাজ্যের মধ্যে ছোটখাটো রাজনৈতিক লড়াই হয়ে গেল। ফ্লোরিডার গভর্নর ট্রাম্প সমর্থক আর ম্যাসাচুয়েটস ডেমোক্র্যাটের ঘাঁটি। ম্যাসাচুয়েটসের রাজনীতিবিদরা সব সময় মাইগ্র্যান্টদের প্রতি মানবিক আচরণের কথা বলেন। তাঁদের কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে ফ্লোরিডার গভর্নর ভেনেজুয়েলা থেকে আগত ৫০ জনের বেশি শরণার্থীকে বিশেষ ফ্লাইটে ম্যাসাচুয়েটসের মার্থাবেনিয়ার্ড দ্বীপে পাঠিয়ে দেন। এটি বিত্তশালীদের ছুটি কাটানোর দ্বীপ হিসেবে খ্যাত। দ্বীপে বহিরাগত মানুষকে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রেসিডেন্ট ওবামা এখানে আসেন ছুটি কাটাতে। একটা সময় আসতেন জন এফ কেনেডি। ফ্লোরিডার রিপাবলিকান গভর্নর রন ডি সেন্টেস সিদ্ধান্ত নিলেন বস্টনের গভর্নরকে একটা কড়া বার্তা দেবেন মাইগ্র্যান্ট সমস্যা নিয়ে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বিশেষ ফ্লাইটে মাইগ্র্যান্টদের পাঠিয়ে দিলেন। জানালেন এবার তাদের সামাল দাও। মুহূর্তে হুলুস্থুল পড়ে গেল গোটা আমেরিকায়। ছোট দ্বীপে এভাবে অতীতে কেউ আসেনি। তাদের রাখারও ব্যবস্থা নেই। মাইগ্র্যান্টরা হতভম্ব। তারা বুঝতে পারছিল না তাদের নিয়ে কী হচ্ছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা আগতদের নিয়ে গেল একটি চার্চে। রাত কাটানোর ব্যবস্থা করল তারা। ডেমোক্র্যাট সমর্থক মিডিয়া প্রশংসা করে রিপোর্ট প্রকাশ করল। আর রাজনীতিবিদরা ব্যস্ত হলেন বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতিতে। আগত অতিথিদের পরদিন পাঠিয়ে দেওয়া হলো হাইনাস শহরে। তাদের কেউ কেউ এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ফ্লোরিডার গভর্নরের বিরুদ্ধে মামলার।

 

রাজনীতি একটা ক্ল্যাসিক বিষয়। রাজনীতি নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি ভালো ফল বয়ে আনে না। বিশ্বের অনেক দেশের মেইনস্ট্রিমে আমাদের কমিউনিটি এখন রাজনীতিতে ভালো করছে। ব্রিটেনে তিন এমপি আছেন পার্লামেন্টে। স্কটল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশে তাঁদের সাফল্য রূপকথার মতো। আমেরিকার মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে আমাদের কমিউনিটি শক্ত অবস্থানে। আমেরিকায় সরকারের ভিতরে তারা গুরুত্বপূর্ণ পদ নিতে শুরু করেছেন। স্টেট সিনেটর, রিপ্রেজেনটেটিভ হয়েছেন অনেকে। ছোট শহরের মেয়র হয়েছেন কেউ কেউ। কাউন্সিলরম্যানের সংখ্যা কম নয়। ড. ওসমান সিদ্দিক আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। আনোয়ার চৌধুরী ব্রিটিশ হাইকমিশনার হয়ে কাজ করেছেন। বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন। এমপি হচ্ছেন। অনেকে জাতীয় ফুটবল, ক্রিকেট টিমে স্থান পেয়েছেন। শিল্প-সংস্কৃতিতে কারও কারও অবস্থান গৌরব করার মতো। উত্তর আমেরিকার সরকার ও বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সিইও থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বাঙালি কাজ করছেন। বাঙালির পথচলায় আশার আলো একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত এখন আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত পালন করেছেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব। একদিন বাংলাদেশও ইতিহাস তৈরি করবে তাদের মতো। হ্যানসেন ক্লার্ক কংগ্রেসম্যান হয়েছিলেন। ড. নীনা আহমেদ কাজ করেছেন প্রেসিডেন্ট ওবামার উপদেষ্টা হিসেবে। জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর শেখ রহমান, নিউ হ্যাম্পশায়ারের স্টেট রিপ্রেজেনটেটিভ আবুল খান দেখছেন আরও বড় স্বপ্ন। আমার কাছে মনে হয় সেদিন আর বেশি দূরে নয়।

 

আমেরিকার আলোকিত বাঙালিদের নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশ প্রতিদিন আয়োজন করে বিশেষ অনুষ্ঠানের। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেইনস্ট্রিম রাজনীতির সফল মানুষদের একটা অনুষ্ঠানে একত্রিত করতে। নিউইয়র্ক ও লন্ডন থেকে সপ্তাহে এক দিন বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্কের দায়িত্বে আছেন প্রবাসের সফল সাংবাদিক লাবলু আনসার। তিনি দীর্ঘদিন উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ঠিকানা’র সম্পাদক ছিলেন। তিনি এবারকার আয়োজনের সমন্বয় করেছেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জর্জিয়ার স্টেট সিনেটর শেখ রহমান, নিউ হ্যাম্পশায়ারের স্টেট রিপ্রেজেনটেটিভ আবুল খানসহ বিভিন্ন এলাকার নির্বাচিত বাঙালি মেয়র, ডেপুটি মেয়র ও কাউন্সিলরম্যানরা ছিলেন। অতিথি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার তখনকার উপদেষ্টা ড. নীনা আহমেদ। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের থাকার কথা ছিল। তিনি শুরু থেকেই আমাদের উৎসাহিত করেছেন এমন আয়োজনে। অনুষ্ঠানে ছিলেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। নির্ধারিত সময়ের আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া প্লাজা হোটেলের হলরুম। আনন্দ উৎসবে পুরো হোটেল পরিণত হয় একখণ্ড বাংলাদেশে। প্রবাসে আমাদের বিজয়ী বীরদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা। আমেরিকা বিজয়ী বীরদের বলেছিলাম, আপনাদের সাফল্যের গল্প আগামীর বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে অনেক দূর। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আজ বাংলাদেশের ক্ষমতায় বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। বাবার পথ ধরে তিনি দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। আমেরিকার মতো দেশে প্রবাসীদের মেইনস্ট্রিমে দেখতে চাই আমরা। অর্জন শুরু হয়েছে। গৌরবের আলো ছড়াচ্ছেন আজ অনেকে। এ পথ ধরে প্রজন্ম তৈরি করবে আরও বড় ইতিহাস। আমাদের জীবিতকালে দেখে যেতে পারব কি না জানি না। বাঙালির এ এগিয়ে চলা রুদ্ধ করা যাবে না।

 

প্রবাসী বীরদের যখন সংবর্ধনা দিচ্ছি তখন খবর পাচ্ছি নিউইয়র্কের মাটিতে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিএনপি শোডাউন করেছে। আওয়ামী লীগ করেছে পাল্টা সমাবেশ। প্রবাসে কেন এসব করতে হবে? নিজ দেশের নিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ স্লোগানে কার লাভ হচ্ছে? ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের। প্রবাসীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে বলছি, এসব বাদ দিন। প্রবাসের মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে নিজেদের নিয়ে যান। আপনারাও ভালো করবেন হ্যানসেন ক্লার্ক, ড. নীনা আহমেদ, শেখ রহমানদের মতো। হাউস অব কমন্সে তিন বাঙালি এমপি আমাদের আলো জ্বালিয়েছেন। আপনারাও তৈরি করুন নতুন প্রজন্মের জন্য ইতিহাস। বাংলাদেশ থেকে আমরা ভালো খবরই শুনতে চাই প্রবাসীদের। বুকের ছাতিম বড় করতে চাই রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রূপা হক, ফয়সাল চৌধুরী, শেখ রহমান, আবুল খানদের বিজয়ের খবরে।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন । সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com