ছবি সংগৃহীত
গোলাম মাওলা রনি :আজকের নিবন্ধে রাজনীতি নিয়ে লিখব। ২০০৯ সাল থেকেই নিয়মিত লিখছি- আর বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার শুরু থেকে বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল অবধি যা কিছু লিখেছি তা মুঘল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম- আরব্য রজনীর মহানায়ক কিংবা এমপির কারাদহনসহ নিয়মিত সাপ্তাহিক উপসম্পাদকীয়- সবকিছুতেই রাজনীতির ঘোল মেশানোর চেষ্টা করেছি। লিখতে গিয়ে কোনো দিন কলম কাঁপেনি- বুক ধড়ফড় করেনি। সাবেক সরকারের মন্ত্রী-এমপি ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে নিষ্ঠুর সমালোচনা করেছি। কিন্তু কেউ কোনো দিন একটি উহ্ শব্দও করেনি- ফোনে কোনো হুমকি আসেনি। উল্টো লেখক হিসেবে বিভিন্ন মহল থেকে যে সম্মান-মর্যাদা পেয়েছি, যার কারণে রাজনীতি করা অথবা এমপি-মন্ত্রীর পদ লাভের চেয়ে আমার লেখকসত্তার স্বাধীনতা এবং কথা বলার অবাধ অধিক্ষেত্রকে অধিক মর্যাদাপূর্ণ মনে হয়েছে।
অতীতের মতো আজকের যুগেও আমি লিখে যাচ্ছি এবং সমানতালে বলে যাচ্ছি। রাষ্ট্রক্ষমতার কুশীলবদের হুমকিধমকি যেমন পাইনি তদ্রুপ কারও কাছ থেকে প্রতিক্রিয়াও পাইনি। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার খবরাখবর বা গণমাধ্যমগুলোর টক শো কর্তাব্যক্তিদের কর্ণকুহরে না পৌঁছালেও সাধারণ মানুষ কিন্তু ঠিকই আগের মতোই সবকিছু পড়ে, দেখে এবং শোনে। কিন্তু তারা আগের মতো রেসপন্ড করতে পারে না অর্থাৎ সাড়া দেয় না। উল্টো আমাদের মতো লেখক-বক্তাদের ফোন করে সহানুভূতি জানিয়ে বলে, ভাই! এত সব লিখেন কী করে! এত সাহস কোত্থেকে পান- একটু সাবধানে থাকবেন। বুঝতেই তো পারছেন দিনকাল ভালো না।
পাবলিকের কথাগুলো প্রথম দিকে পাত্তা দিতাম না। কিন্তু ইদানীং লোকজনের সহানুভূতি এত বেড়ে গেছে যে মাঝেমধ্যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। এই তো সেদিন রাস্তায় চলতে গিয়ে মস্ত বড় এক সরকারি কর্তার সঙ্গে দেখা হলো। ভদ্রলোক প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে প্রশংসা করে বিদায়বেলায় আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, ভাই খুব সাবধানে থাকবেন- দিনকাল ভালো না। যেভাবে মব চলছে- আমরা আপনাকে হারাতে চাই না। ভদ্রলোকের শেষ কথাগুলো শুনে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল। বললাম, ভাইসাহেব! আপনি কেন আপনার নিজের অন্তর্নিহিত ভয় আমার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নিজে তো সারাক্ষণ ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন আর এখন আমার মধ্যে সেই ভয় সঞ্চার করে নিজের দল ভারী করার চেষ্টা করছেন।
আমার কথা শুনে ভদ্রলোকের মুখ শুকিয়ে গেল। কিছু না বলে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বিদায় হলেন। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল এক ধর্মীয় নেতার সঙ্গে যাকে আমি সরকারি কর্তাকে যে উত্তর দিয়েছিলাম প্রায় হুবহু কথা বলেছিলাম। তিনি অবশ্য সরকারি কর্তার মতো ভড়কে না গিয়ে স্মার্টলি বলেছিলেন, সুবাহানআল্লাহ : আল্লাহ আপনাকে উত্তম জাজা দান করুন। সাধারণ মানুষের মধ্যে ইদানীংকালে যেসব বিবর্তন ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখিত ভয়ের সংস্কৃতি অন্যতম, যা কিনা আমাদের জাতীয় আয়- জাতীয় উৎপাদন, নতুন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, কর্মসৃজনের মতো বেঁচে থাকার অবলম্বনের ওপর মরণ কামড় বসিয়েছে। ফলে গত আট মাসে সারা দেশে কম করে হলেও ৩৬ লাখ অতিদরিদ্র মানুষ সৃষ্টি হয়ে গেছে, যা চলতে থাকলে বছর শেষে অতিদরিদ্রের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো উল্লেখ করেছে।
মানুষের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থার সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি শেয়ার মার্কেটগুলোতে যে বিক্ষোভ হলো সেখানে বিক্ষোভকারীরা উল্লেখ করেছেন, শেখ হাসিনার পতনের পর বাজারে আস্থা ও বিশ্বাস বেড়েছিল। ফলে প্রথম দুই মাস অর্থাৎ ২০২৪ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের সব স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ারমূল্য বাড়তে থাকে এবং বাজারমূল্যের সঙ্গে এক হাজার পয়েন্ট যুক্ত হয়। কিন্তু এরপর থেকেই ক্রমাগতভাবে প্রতিটি শেয়ারের মূল্য কমতে থাকে। বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেছেন, গত আট মাসে বাজার থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা লোপাট অথবা উধাও হয়ে গেছে। ৭০ ভাগ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়েছেন এবং মোট বিনিয়োগকারীর সংখ্যা যেখানে সাবেক সরকারের আমলে ২০ লাখ ছিল, তা কমে বর্তমানে ৭-৮ লাখে নেমে এসেছে।
শেয়ার মার্কেটের বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন এবং বর্তমান সরকারের নিয়োগ দেওয়া সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যানের অপসারণের জন্য আলটিমেটাম দিয়েছেন। লোকজন বলাবলি করছে- নতুন বন্দোবস্ত অনুযায়ী শেয়ার মার্কেট লোপাটের জন্য নতুন দরবেশের আবির্ভাব হয়েছে। তাদের মতে, নতুন দরদেশের কাছে পুরোনো দরবেশ নিতান্তই শিশু। কারণ মাত্র আট মাসে যদি ৮০ হাজার টাকা কোটি লোপাট হয় তবে আগামী ১৬ বছরে লোপাটের পরিমাণ কত হতে পারে। লোকজনের আশঙ্কা নতুন দরবেশ অথবা গ্যাং অব দরবেশের সিন্ডিকেট সেভাবে লোভের জিহ্বা বের করেছে তা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তবে ঢাকার মতিঝিল এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার ইট, বালু, পাথর থেকে শুরু করে ড্রেনের ময়লা-আবর্জনাও অক্ষত থাকবে না।
শেয়ার মার্কেটের পর সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় হলো ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখল, নিয়োগ-বদলি, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি। ইতোমধ্যে খবর বের হয়েছে যে জনৈক উপদেষ্টার এপিএস গত আট মাসে ৩৭৩ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। লোকজন এখন ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাবে বসেছে এবং নয়া বন্দোবস্তের নয়া দুর্নীতির রাজা-মহারাজারা যদি ১৬ বছর লুটপাটের সুযোগ পায় তবে তার অঙ্ক কত হবে? সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ৪০০ কোটি টাকা লুটপাটকারী পিয়ন নিয়ে যারা ভেংচি কাটতেন তাদের সবার মুখের মাংসপেশি দাঁত জিহ্বায় এক অজানা রোগ ভর করেছে। তারা এখন আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন এবং তারা গুনতে গুনতে ভাবছেন, কিয়্যা হয়্যা! কাইসে হুয়া! কব হুয়া!
মানুষের আস্থার সংকটের কারণে দেশব্যাপী যে অস্থিরতার ঝড় শুরু হয়েছে তার সবচেয়ে বড় ঝাপটা লেগেছে রাজনীতিতে। গত আট মাসে রাজনীতির যে সর্বনাশ ঘটেছে তা আমাদের দেশের অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। রাজনীতির ভাঙাগড়া বিশ্বাস-অবিশ্বাস, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে মানুষ দুই চোখে অন্ধকার দেখছে। রাজনীতির ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, অঙ্ক, জ্যামিতি ইত্যাদি তছনছ হয়ে গেছে। ফলে এই অঙ্গনের আকর্ষণ-বিকর্ষণ-মহাকর্ষণ ইত্যাদি চলে গেছে। ফলে রাজনীতির মাঠে বিড়াল ও বাঘের ওজন একই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এখানে ইঁদুর আর ঘোড়ার লম্ফঝম্ফ দেখে বোঝার উপায় নেই কে বেশি উচ্চতা অতিক্রম করতে পারে। চন্দ্রপৃষ্ঠে যেভাবে সবকিছুর ওজন হ্রাস পায় এবং বাতাস না থাকার কারণে সেভাবে কারও গলার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না তদ্রুপ বাংলার রাজনৈতিক আকাশের সব তারকা নতুন বন্দোবস্তের নভোযানের যাত্রীরূপে চন্দ্রের দেশে পৌঁছে গেছে। ফলে তারা তাদের স্বাভাবিক ওজন, আকৃতি ও শব্দ করার ক্ষমতা হারিয়ে একেকজন নীল আর্মস্ট্রং, এডুইন অলড্রিন, ইউরি গ্যাগারিন ও ভেলেন্তিনা টোরসকোভায় পরিণত হয়েছেন। আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোচনা করে নিবন্ধের ইতি টানব। আমাদের দেশের জনপ্রিয় লোকগীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- বাবা ভাণ্ডারী! লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি। ভক্তিমূলক গানের মাধ্যমে মানুষকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য যেসব সুর ও কথা মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে আজকের শিরোনামটি অন্যতম। জীবনের একটি ধারাবাহিক গতি, ছন্দময় শব্দ এবং গন্তব্য রয়েছে যার সঙ্গে রেল ও রেললাইনের তুলনা করা হয়েছে। কোনো রেলগাড়ি যদি একবার লাইনচ্যুত হয়ে যায়, তবে তা কোনো দিন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। আমাদের রাজনীতির ট্রেনেরও একটি নির্দিষ্ট পথ রয়েছে আর আমরা সেই পথ থেকে ছিটকে পড়ার কারণে গন্তব্যে পৌঁছানো তো দূরের কথা উল্টো চলমান সময়ে যে কী বিপদ-বিপত্তির মধ্যে পড়েছি, তা কি আমাদের নয়া ভাণ্ডারী বাবারা বুঝতে পেরেছেন?
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন