বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক : সম্প্রতি একজন সচিব এবং তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা গণমাধ্যমে সুনামি তুলে দিয়েছে, যেন এমন ঘটনা আগে আর ঘটেনি। বহু টকশোয় এমন অনেকেই কথা বলছেন, যাদের বেশির ভাগ কথাই অজ্ঞতাপূর্ণ। এমনকি এক টকশোয় উপস্থাপিকা এও বলে ফেললেন যে, বর্তমান সরকারের সময় নাকি বিএনপির তুলনায় এ ঘটনা বেশি হচ্ছে। মহিলা নিশ্চয়ই অজ্ঞতাবশত কথাটি বলেছেন, এটি না জেনে যে বিএনপির সময় যে হারে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, সে তুলনায় এ সরকারের সময় পাঠানোর ঘটনা অতি নগণ্য। মহিলার উচিত ছিল জেনে নিয়ে কথা বলা। কেননা এ ধরনের উদ্ভট সংবাদ জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
দুটি বাধ্যতামূলক অবসরের ঘটনায় আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে, একটিতে বিচারপতি এবং অন্যটিতে একজন আইনজ্ঞ হিসেবে আমাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। যে ঘটনায় আমি বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলাম, সেটি ছিল পুলিশের একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে বিএনপি সরকার কর্তৃক অবসরে পাঠানোর। উনি আমার নেতৃত্বের বেঞ্চে রিট মামলা করলে আমি তার পক্ষে রায় দিয়েছিলাম দুটি কারণে। প্রথমত সরকার এটি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছিল যে তাকে জনস্বার্থে অবসর দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত এটি যে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে করা হয়েছিল, তার পক্ষে অজস্র প্রমাণ। আমার নির্দেশে সরকার তার চাকরি ফেরত দিয়ে অতিরিক্ত সচিব মর্যাদায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি দিয়েছিল। অতিরিক্ত আইজি হিসেবেও তিনি অতিরিক্ত সচিবের মর্যাদায় ছিলেন। অন্য ঘটনাটি ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ সাহেবের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোসংক্রান্ত। মহিউদ্দিন সাহেব তখন আমাদের জাতিসংঘ মিশনে উপপ্রতিনিধি। জাতিসংঘ অধিবেশনে যাওয়া কয়েকজন বিএনপি এমপি মহিউদ্দিন সাহেবের অফিসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জানালে তিনি মহিউদ্দিন সাহেবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠান। বিরলধর্মী সততার অধিকারী ছিলেন বলে চাকরি হারিয়ে তিনি চরম অর্থকষ্টে পতিত হয়ে একটি বেসরকারি বীমা কোম্পানিতে চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন জীবিকার তাগিদে। তিনি মামলা করেছিলেন প্রশাসনিক আদালতে, চাকরিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যে আদালতের হাই কোর্টের অনুরূপ রিট ক্ষমতা রয়েছে। মহিউদ্দিন সাহেবের মুখ্য আইনজ্ঞ বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষাসৈনিক গাজিউল হক সাহেব আমাকে বললেন এ মামলায় তাঁর সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে। আমি তা-ই করেছিলাম। সে মামলায় প্রশাসনিক আদালত মহিউদ্দিন সাহেবের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, কেননা সরকার জনস্বার্থের সংশ্লিষ্টতা দেখাতে পারেনি। তা ছাড়া এটা যে প্রতিহিংসামূলক ছিল তা-ও প্রমাণিত। মহিউদ্দিন সাহেব আদালতের নির্দেশে চাকরি পেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একজন সচিবের পদে স্থান পেয়েছিলেন। বাধ্যতামূলক অবসরের সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাটি ছিল সর্বজনপূজনীয় ডা. বিধান রায়ের মতো একজন ধন্বন্তরি চিকিৎসক হিসেবে খ্যাত, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. নুরুল ইসলাম। বিএনপি ক্ষমতা পেয়েই তাঁকে অবসরে পাঠায় জিঘাংসা বাস্তবায়নের জন্য। তিনি রিট মামলায় শুধু তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াকেই চ্যালেঞ্জ করেননি, চ্যালেঞ্জ করেছিলেন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আইনের বৈধতাও। আপিল বিভাগ ডা. নুরুল ইসলামের যুক্তি মেনে নিয়ে আদেশ দিয়েছিলেন বাধ্যতামূলক অবসরের আইনটি ছিল অবৈধ, যা ১৯৭৪ সালের ৯(২) ধারায় লিখিত ছিল। সে সময়ের আইনে ক্ষমতা ছিল নিরঙ্কুশ, বলা হয়েছিল ২৫ বছর চাকরি করেছেন এমন কাউকে সরকার চাইলেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারবেন। অর্থাৎ কোনো গাইডলাইন ছিল না। পরবর্তীতে সরকার (পার্লামেন্ট) এ বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়ন করে, ‘জনস্বার্থে’ শব্দটি সংযোজন করেছিল বিধায় নতুন আইনটি গাইডলাইন থাকায় বৈধতাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমান অর্থাৎ সর্বশেষে প্রণীত ২০১৮ সালের আইনেও ‘জনস্বার্থে’ কথাটি সংযোজিত থাকায় সরকারের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ নয়, বরং ‘জনস্বার্থের’ প্রয়োজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, বিধায় এটি বৈধতার মাপকাঠিতে উত্তরণ পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা লাভের পর বহু কর্মকর্তাকেই অবসরে পাঠানো উচিত ছিল, যা তারা করেনি, যার উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ বিমানের সাবেক প্রধান ড. মোমেন, যিনি উত্তরা ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকাকালে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন। বহু বছর পরে অবশ্য তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছিল। যে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হলো, দেখা যায় বিএনপির শাসনামলে তারা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এসপি পদে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য, গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এসপি পদে তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হয় যারা সরকারের অতি বাধ্য। এটা কারোরই অজানা নয় যে, বিএনপি রাজত্বকালে বিভিন্ন জেলার এসপিরা কী ধরনের অরাজকতা চালিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে কোহিনুর নামক সাবেক এসপি অন্যতম।
অনেকে মনে করেন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা সরকারের থাকা উচিত নয়। যারা বলেন সরকারি চাকরিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তারা বিস্ময়করভাবে ভুলে যান যে সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করাই চাকরিজীবীদের দায়িত্ব, তারা নীতি প্রণয়নকারী নন। সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের বিকল্প তাদের নেই। তাই সরকারের হাতে এহেন ক্ষমতা অপরিহার্য, যাতে সরকারি চাকরিজীবীরা সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধ্য থাকে। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের হাতে একই ক্ষমতা রয়েছে। যুক্তরাজ্যে এ ক্ষমতা আরও কঠোর, যেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরিসংশ্লিষ্ট স্টেচুটারি বিধান সাপেক্ষে, সরকারি চাকরি রানির প্রোগেটিভ, যা সরকার প্রয়োগ করে থাকেন, ক্ষমতাধীন, যাকে বলা হয়- ‘প্রিন্সিপাল অব সেটিসফেকশন’ভিত্তিক। অর্থাৎ সরকার চাইলেই, স্টেটুচারি বিধানের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে, কোনো চাকরিজীবীকে অপসারণ করতে পারে, যদিও এ ধরনের ঘটনা যুক্তরাজ্যে খুবই বিরল, কেননা সেখানকার সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকেন। ভারতেও একই ধরনের আইন রয়েছে, পাকিস্তান এবং ব্রিটিশ যুগেও এ ধরনের আইন ছিল। এ ব্যাপারে আমাদের আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘এটা ঠিক যে আপিলকারীর (মানে সরকারের) ক্ষমতা থাকা উচিত কোনো অবাঞ্ছনীয়, অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ, বেআদব এবং অবাধ্য সরকারি কর্মকর্তাদের অপসারণের। তবে সে ক্ষমতা ন্যায়সংগতভাবে ব্যবহার করতে হবে’ (বিএডিসি বনাম শামসুল হক, ৬০ নম্বর ডিএলআর)। অনেকে বলছেন, কোনো সরকারি চাকরিজীবী বিধান ভঙ্গ করলে তাকে তো আইন মোতাবেকই প্রয়োজনে চাকরিচ্যুত করা যায়। কথাটি আক্ষরিক অর্থে ঠিক হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অত সহজ নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী, জটিল প্রক্রিয়া, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হলে সেই দীর্ঘস্থায়ী জটিল প্রক্রিয়া অচল। তদুপরি পুরো প্রক্রিয়ার সময়ই সংশ্লিষ্টকে অবশ্য বেতন দিতে হয় এবং ওএসডি করা হলে তার জন্য দফতরে স্থান রাখতে হয়, সহকারী কর্মচারী রাখতে হয় ইত্যাদি। বাধ্যতামূলক অবসরের পন্থা চাকরিজীবীর জন্যও মঙ্গলকর, কেননা তিনি তার পেনশন সুবিধা পুরো পেয়ে থাকেন, যা চাকরিচ্যুত হলে পাবেন না। মকবুল সাহেব একজন বহু বছর চাকরি করা সরকারি কর্মকর্তা হয়েও একটি অর্বাচীনসুলভ কথা বলে নিজের প্রজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন ফাঁসির আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়, যা তাকে দেওয়া হয়নি।
এক টকশোয় সেই অতি পরিচিত সাবেক সচিব সাহেবও একই কথা বলেছেন। একজন সচিব হিসেবে তার জানা উচিত ছিল বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয় বলে আমাদের উচ্চ আদালত বহুবার রায় দিয়েছেন। জনস্বার্থে কোনো চাকরিজীবীকে অপসারণের জন্য সরকারের হাতে এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় বিশেষ ক্ষমতা, যার জন্য কোনো কারণ দেখাতে হয় না। তবে সরকারকে এ ক্ষমতা ন্যায্যভাবে প্রয়োগ করতে হয়। রিট মামলা হলে চাকরিজীবী তবেই সফল হন, যদি সরকার জনস্বার্থে বিষয়টি প্রমাণে ব্যর্থ হয়।
অথবা দেখা যায় জিঘাংসামূলক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকার তার ডিক্রেশন প্রয়োগ না করে বরং ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’ নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তা না হলে চাকরিজীবী রিট করে কোনো ফল পাবেন না। এক টকশোয় প্রশ্ন করা হয়েছে- এ অবসরে পাঠানোর ঘটনাগুলো প্রশাসনে কী বার্তা দেবে? অনেকেরই ধারণা, এটি প্রশাসনে এমন প্রয়োজনীয় বার্তা দেবে যাতে বিপথগামীরা সতর্ক হয়ে বিধিবহির্র্ভূত বা অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকেন।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন