বাংলাদেশ প্রতিদিনের শুভ জন্মদিন ও পীর হাবিব

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম: শুভ শুভ শুভ দিন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্মদিন। দেশে অনেক পত্রিকা আছে, আগেও ছিল। কিন্তু এভাবে পুরো সময়টা কোনো পত্রিকার সঙ্গে এতটা লাগালাগি ছিলাম না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের শুরুতে অফিস ছিল মগবাজারে রেললাইনের পাশে। একদিন নঈম নিজামের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম। তখন সম্পাদক ছিলেন শাহজাহান সরদার। নঈম নিজাম ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। আলাপ-আলোচনার এক ফাঁকে নঈম বলেছিল, ‘দাদা, আপনি এ পত্রিকায় দু-এক কলম লিখুন।’ আমার তখন লিখতে কিছুটা অসুবিধা হতো, ভালো লাগত না। এক যুগ পর বরং এখন না লিখলেই অসুবিধা হয়, খারাপ লাগে। নঈমের বাড়ি লাঙ্গলকোট। সেই লাঙ্গলকোটও গিয়েছিলাম। সেদিনের কথা আজও আমার মনে পড়ে। লাঙ্গলকোট থেকে ঢাকা ফিরতে শেষ রাত হয়ে গিয়েছিল। নঈমের স্ত্রী ফরিদা বেশ চিন্তায় ছিল। নঈম নিজাম এখনো বাংলাদেশ প্রতিদিনে আছে। মূলত ওর জন্যই পত্রিকাটি এতটা সাফল্য পেয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে। একসময় ২ টাকা দাম বলে বেশি পাঠক বা বিক্রি মনে করতাম। কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয় না। পত্রিকাটি তার আপন শক্তিতেই এতটা সাফল্য পেয়েছে। রাস্তাঘাটে যানবাহনে যেখানে সেখানে যখন বাংলাদেশ প্রতিদিন পড়তে দেখি তখন বেশ ভালো লাগে। মনে হয় বাংলাদেশে আর কোনো পত্রিকার উপসম্পাদকীয়ের এত বেশি পাঠক নেই। নিত্যদিনের সংবাদের মতো বাংলাদেশ প্রতিদিনের উপসম্পাদকীয় পাঠক। অন্য পত্রিকার সংবাদের প্রতি পাঠকের যেমন আকর্ষণ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের উপসম্পাদকীয় তত আকর্ষণীয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রিয় সম্পাদক নঈম নিজাম একসময় এটিএন বাংলায় যোগদান করেছিল। ইরাকের যুদ্ধের সময় চ্যানেলটি ঘণ্টায় ঘণ্টায় যুদ্ধের খবর প্রচার করত। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের কপাল খুলে যায়। বিজ্ঞাপন বেড়ে যায় শতগুণ। সেই এটিএন বাংলা থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিনে আসা, সম্পাদকের পদ সামলানো এক বিশাল ব্যাপার। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সাধারণত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যাওয়ার ঝোঁক থাকে বেশি। কিন্তু নঈম নিজাম তার বিপরীত। নঈম নিজাম ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক সফলতা পেয়েও প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়েনি। আমিও তাকে অনেকবার বলেছি, প্রিন্ট মিডিয়া অনেক বেশি সম্মানের, অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ যেখানে যত কাজই করে থাকুক যত সাফল্যই পেয়ে থাকুক তাদের গ্রুপে বাংলাদেশ প্রতিদিন হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আহরণের সাফল্যের মতো। আল্লাহর কি অপার মহিমা, বছরের পর বছর যে পত্রিকায় লিখছি সেই পত্রিকার শুভ জন্মদিনে আমার পর্ব পড়েছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি বাংলাদেশ প্রতিদিন মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সাথী হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুক। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমার শুভ কামনা এবং মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাঁর সুশীতল ছায়াতলে রাখুন।

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক, নঈম নিজামের বন্ধু, আমার অত্যন্ত প্রিয় পীর হাবিবুর রহমান ইহলোক ত্যাগ করেছে। তার আত্মার শান্তি কামনায় জল-জোছনার শহর সুনামগঞ্জের শোকসভায় গিয়েছিলাম। শোকসভার বিষয় আগামী পর্বে বিস্তারিত লিখব। পরম করুণাময় দয়াময় আল্লাহ পীর হাবিবকে বেহেশতবাসী করুন এবং তার পরিবার-পরিজনদের এ শোক সইবার শক্তি দিন এবং নিরাপদে রাখুন।

 

অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে এলাম জল-জোছনার শহর সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জে প্রথম গিয়েছিলাম আমাদের নেতা আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে ১৯৭২ সালের এই মাসে। তখন রাস্তাঘাট দালানকোঠা কিছুই ছিল না। সঙ্গে ছিল অনেক নেতা-কর্মী- শাহ আজিজ, বাবরুল হোসেন বাবুল, লালা, তোহা, লেইস, কয়েস আরও অনেকে। সেই ১৯৭২ সাল থেকে আজবধি সিলেটের লাখো মানুষ আমাকে ‘বাঘা ভাই’ বলে জানে। তাদের অনেকেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম হিসেবে এখনো চেনে না বা জানে না। সেবার অকাল বন্যায় সিলেটের বিয়ানীবাজার, করিমগঞ্জ আরও অনেক জায়গা ভেসেছিল। কিছু ত্রাণসামগ্রীসহ অর্ধশত সহকর্মী নিয়ে সিলেট গিয়েছিলাম। রাস্তা ভাঙা ছিল, এখনকার বাইপাস তখন ছিল না। তাই চা বাগানের ভিতর দিয়ে যেতে হতো। তাতে চুনারুঘাট বা শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত ৭০-৮০ কিলোমিটার রাস্তা বেশি হতো। আমাদের ত্রাণসামগ্রী হেলিকপ্টারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন চাঁদপুরের একসময়ের মুকুটহীন সম্রাট মিজানুর রহমান চেধুরী। তিনি তখন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী। প্রথম সফরেই সিলেট আমার বড় বেশি ভালো লেগেছিল। তখন বৃহত্তর সিলেটের নেতা ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, লালা, তোহা, বাবরুল হোসেন বাবুল, শাহ আজিজ, ক্যাপ্টেন জলিল এমনি আরও অনেকে তখন যুবনেতা। কামরান, মানিকরা তখনো নেতা হয়ে ওঠেনি। সিলেটের সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সেই থেকে আমাকে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসা এখনো অটুট আছে। কয়েকদিন আগে পাবনার এক আওয়ামী লীগ নেতা মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন ফোনে সময় ঠিক করে মোহাম্মদপুরের বাসায় এসেছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। তার কথা শুনে আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা প্রতিদিনই শুনি। তার কাছে আরও গভীরের কথা শুনলাম। স্বাভাবিক কারণেই মন কিছুটা ভারাক্রান্ত। ঠিক সেই সময় আলমগীর এসে জানায় পীর হাবিবের ভাই মাননীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এসেছে। বলেছিলাম, নিয়ে এসো। আমি তাকে প্রথম পীর হাবিবের বড় ভাই মনে করেছিলাম। ওরা পাঁচ ভাই, তিন বোন- হিফজুর রহমান পীর (মৃত), হিফজুন্নেছা খানম জুঁই (শিক্ষক), ছাবিত আহমদ পীর (মৃত), রওশন আরা খানম (মৃত), অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর (’৭৫-পরবর্তী সুনামগঞ্জ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, পরে দুবার জেলা সভাপতি। বর্তমানে সিনিয়র আইনজীবী, সুনামগঞ্জ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সেক্রেটারি), জেব-উন-নেছা খানম পুষ্প, পীর হাবিবুর রহমান (মৃত), পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এমপি (বিরোধীদলীয় হুইপ ও জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান)। আমি মিসবাহকে বড় ভাই অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর ভেবেছিলাম। মিসবাহ এসেই বলল, ‘দাদা, আমি পীরের ছোট ভাই।’ আমার হৃদয় জুড়ে পীর হাবিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর আমি যখন নির্বাসনে তখন ওরা বড় হয়েছে। পীর হাবিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। পীর হাবিবের কারণে নাকি অন্য কিছুর জন্য সিলেট-সুনামগঞ্জের অনেক ছেলেমেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, হয়তো এখনো পড়ে। পীর হাবিব রাজশাহীতেই বিয়ে করেছে। ছেলে আহনাফ ফাহমিন অন্তর, মেয়ে রাইসা নাজ চন্দ্রস্মিতা। সংসদ সদস্য মিসবাহ বসতে বসতেই বলল, ‘দাদা, ১১ মার্চ সুনামগঞ্জে ভাইয়ের জন্য একটা শোকসভার ব্যবস্থা করেছি। আপনি গেলে খুব খুশি হব।’ সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম, নিশ্চয়ই যাব। পৃথিবীতে করোনার আবির্ভাবের পর গত প্রায় দুই বছর প্রকাশ্য কোনো সভা-সমাবেশে যাইনি। খুব সম্ভবত দুই বা তিনবার পতাকা উত্তোলক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আ স ম আবদুর রবের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। সেগুলো ছিল ঘরোয়া অনুষ্ঠান। পীর হাবিবের স্মরণসভা সুনামগঞ্জের সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে (বালুর মাঠ)। শোকসভার আহ্বান জানিয়ে টাঙ্গাইলের চমচম ও চা পান করে মিসবাহ চলে যেতেই পাবনার ইসমাইল হোসেনের অনেক দুঃখের কথা শুনলাম। তারপর তিনিও চলে গেলেন। পরদিন টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ফোন করেছিলাম রেলের ডিজি জনাব ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে। পরদিন ডিজির পিএর ফোন, ‘স্যার, আপনার টিকিট কমলাপুরের ৫ নম্বর কাউন্টার থেকে নিয়ে নেবেন।’ তারেক গিয়ে টিকিট নিয়ে আসে। আবার পিএকে জিজ্ঞেস করি, সিলেট থেকে ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা কী? তিনি একটু পরে ফোন করে জানান, সিলেট স্টেশনেই ফেরার টিকিট পেয়ে যাবেন। স্টেশনে গিয়েছিলাম ১০ তারিখ রাত ৮টায়। মোহাম্মদপুরের বাবর রোড থেকে কমলাপুর যেতে লেগেছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা। পরদিন সকাল পৌনে ৭টায় কমলাপুর থেকে বাবর রোডে ফিরতে লেগেছিল ১৩ মিনিট। স্টেশনে গিয়েই স্টেশন মাস্টার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা। তিনিই নিয়ে ভিআইপি রেস্ট রুমে বসান। একটু পরই হাই কোর্টের একজন বিচারপতি আসেন। তিনিও সিলেট যাবেন। কয়েক মিনিট বসতেই স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার এলেন আমাদের নিয়ে যেতে। মালয়েশিয়ার তৈরি নতুন গাড়ি, ভিতরটা বেশ ঝকঝকে তকতকে। আমার জন্য দুই বেডের সিঙ্গেল বাথ, মাননীয় বিচারপতির জন্য চার বেডের ডাবল বাথ। আমাকে দেখে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার খুব খুশি হয়েছিলেন। বিচারপতিকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় ছোটখাটো আলোচনা হয়। তাই কথাবার্তা না হলেও তাকে আগে থেকেই চিনতাম। ছেলে আকিব নজরুল, মেয়ে শায়লা শবনম এবং স্ত্রী শাহনাজ বাবলিসহ সিলেট চলেছেন ছুটি কাটাতে। বড় ছেলে আসির ইন্তিসার যায়নি। দু-তিন দিন তারা সিলেটে থাকবেন। মেয়েটিকে আমার এইট-নাইনের ছাত্রী মনে হচ্ছিল। মামণি আপনি কোন ক্লাসে পড়েন- এ রকম জিজ্ঞেস করব, কিন্তু মেয়েকে জিজ্ঞেস না করে ছেলেকে করেছিলাম, বাবা, আপনি কোথায় পড়েন? বলল, ‘আমি সিক্সে পড়ি’। মেয়েটিকে জিজ্ঞেসের আগেই সে বলল, ‘আমি ব্যারিস্টারি পড়ি’। বয়স কত হবে- ২০-২২-এর বেশি না। ভেবেছিলাম ১২-১৪, বড়জোর ১৫ বছর। বড় অমায়িক ছেলেমেয়ে। বিচারপতির কামরায় প্রায় আধাঘণ্টা ছিলাম। তার স্ত্রীকেও আমার বেশ ভালো লেগেছে। সরল সোজা অমায়িক মানুষ। সিলেটেও মা-মেয়ের দেখা পেয়েছিলাম হজরত শাহ পরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে নেমে আসার পথে। মেয়েদের সারির সামনেই মা-মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাহ পরান (রহ.)-এর মাজারে তাদের দুজনকে দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। তখন শায়লাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি এখানে! ‘ভাই এবং আব্বু মাজার জিয়ারতে ওপরে গেছেন। তাই আম্মু আর আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’ যাওয়ার পথে ট্রেনের কামরায় বাচ্চা দুটির মুখ খুব শুকনো লাগছিল। বিচারপতি ক্যাটারিংয়ের লোকজনকে খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলেন। ভারতের মতো বাংলাদেশের রেলে উন্নতমানের কোনো খাবার পাওয়া যায় না। বিস্কিট, চিপস, কাটলেট এসব পাওয়া যায়। রেলের ক্যাটারিংয়ের বিস্কিট খেলে কী হয় বলতে পারব না, কিন্তু কাটলেট খেলে অবশ্যই পেটে যন্ত্রণা হয়, কষ্ট বাড়ে। সাড়ে ৮টায় ট্রেন ছিল বলে আমার স্ত্রী চারটি ছোট রুটি, এক বাটি সবজি, এক বাটি ডাল আর ডালের মধ্যে দুটি ডিম দিয়েছিলেন। আমার কাছে খেজুর, কিশমিশ, এপ্রিকট, কাজুবাদাম, অ্যালামন্ডা, আখরোট বারো মাসই থাকে। ট্রেনযাত্রায়ও ওসব ছিল। আলমগীরকে প্লেট আনতে বলেছিলাম। দুটি রুটি, সবজি একটি প্লেটে যখন দুটি বাচ্চার সামনে দেওয়া হলো ওরা বেশ তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছিল। আমার মনে হয়েছিল ওদের আরেকটু খাওয়া দরকার। ব্যক্তিগত সহকারী আলমগীর আরও একটি রুটি আর সবজি-ডাল তুলে দেয়। আমার কাছে মনে হচ্ছিল রুটি খাবার পরও কিছু সবজি প্লেটে থেকে যাবে। তাই একটি ছোট চামচ দিতে বলেছিলাম। কিন্তু মেয়েটি বলেছিল, আঙ্কেল, ‘চামচের কোনো দরকার নেই। রুটি দিয়েই আমরা সবটুকু খেয়ে ফেলতে পারব।’ শেষের রুটিটি যখন ভাইবোন ভাগ করে খাচ্ছিল তখন আমার ছেলেবেলার গ্রামের বাড়িতে মায়ের পরিবেশন করা খাবারের কথা মনে পড়ছিল। আমার ছেলেমেয়ে দীপ-কুঁড়ি-কুশি যখন খায় তখন আমার হৃদয় যেভাবে জুড়িয়ে যায় বিচারপতির দুই সন্তান যখন খাচ্ছিল তখন সেরকমই লাগছিল। খাওয়ার একেবারে শেষ পর্যায়ে শায়লার মা বলছিলেন, ‘একেই বলে রিজিক। এক মুহূর্ত আগেও মানুষ জানে না কার রিজিক কোথায়।’ খাবার শেষে খেজুর, এপ্রিকট, বেকারির বিস্কিট তাদের সামনে দেওয়া হয়েছিল। মা-বাবা, ভাই-বোন চারজনেই সেগুলো খেয়েছিলেন। বহুদিন পর আমার শুষ্ক হৃদয় মহানন্দে কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। আমার আরও ভালো লাগছিল। আমি আমার কুপে এসে যখন খাচ্ছিলাম তখন দেখলাম একটি রুটি, পর্যাপ্ত সবজি, ডাল রয়েছে। ডালের মধ্যে যে ডিম ছিল তার বিন্দুবিসর্গও জানা ছিল না। আমি সাধারণত দুই অথবা তিনটি রুটি খাই। সেদিন ট্রেনে একটি রুটি, প্রচুর সবজি, একটি ডিম, একটি খেজুর, একটি এপ্রিকট খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। গত ১০-১৫ বছরে তিনটি রুটির জায়গায় একটি রুটি খেয়ে সে যে কি স্বস্তিবোধ করেছিলাম কাউকে লিখে বোঝাতে পারব না। অত স্বস্তি অত আরাম ১৫ বছরে পাইনি। ট্রেন পৌঁছেছিল ভোর সাড়ে ৪টায়। বিচারপতির গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে নেওয়ার জন্য যাদের আসার কথা তারা সবাই এসেছিলেন। ৫টায় গাড়ি পৌঁছবে মনে করে তখনো আমাকে নিতে কেউ আসেনি। বিচারপতি চলে যাওয়ার পর ভিআইপি রুমে বসে ছিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে ত্রাণকর্তার মতো এমপি মিসবাহর দায়িত্ব দেওয়া রেজোয়ান এসে হাজির। এসেই বলল, পীর হাবিব আমার ভাই। 

উঠে বসলাম গাড়িতে। আমরা ছয়জন- আমি, ফরিদ, আলমগীর, সোহেল, দীপ ও তারেক। তাই রেজোয়ান দুটি গাড়ি নিয়ে এসেছিল। একটি তার, অন্যটি তার বন্ধু আমার প্রিয় লেইসের মেয়ের জামাই তারেকের।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বাংলাদেশ প্রতিদিনের শুভ জন্মদিন ও পীর হাবিব

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম: শুভ শুভ শুভ দিন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের জন্মদিন। দেশে অনেক পত্রিকা আছে, আগেও ছিল। কিন্তু এভাবে পুরো সময়টা কোনো পত্রিকার সঙ্গে এতটা লাগালাগি ছিলাম না। বাংলাদেশ প্রতিদিনের শুরুতে অফিস ছিল মগবাজারে রেললাইনের পাশে। একদিন নঈম নিজামের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছিলাম। তখন সম্পাদক ছিলেন শাহজাহান সরদার। নঈম নিজাম ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। আলাপ-আলোচনার এক ফাঁকে নঈম বলেছিল, ‘দাদা, আপনি এ পত্রিকায় দু-এক কলম লিখুন।’ আমার তখন লিখতে কিছুটা অসুবিধা হতো, ভালো লাগত না। এক যুগ পর বরং এখন না লিখলেই অসুবিধা হয়, খারাপ লাগে। নঈমের বাড়ি লাঙ্গলকোট। সেই লাঙ্গলকোটও গিয়েছিলাম। সেদিনের কথা আজও আমার মনে পড়ে। লাঙ্গলকোট থেকে ঢাকা ফিরতে শেষ রাত হয়ে গিয়েছিল। নঈমের স্ত্রী ফরিদা বেশ চিন্তায় ছিল। নঈম নিজাম এখনো বাংলাদেশ প্রতিদিনে আছে। মূলত ওর জন্যই পত্রিকাটি এতটা সাফল্য পেয়েছে, শক্তিশালী হয়েছে। একসময় ২ টাকা দাম বলে বেশি পাঠক বা বিক্রি মনে করতাম। কিন্তু এখন আর তেমন মনে হয় না। পত্রিকাটি তার আপন শক্তিতেই এতটা সাফল্য পেয়েছে। রাস্তাঘাটে যানবাহনে যেখানে সেখানে যখন বাংলাদেশ প্রতিদিন পড়তে দেখি তখন বেশ ভালো লাগে। মনে হয় বাংলাদেশে আর কোনো পত্রিকার উপসম্পাদকীয়ের এত বেশি পাঠক নেই। নিত্যদিনের সংবাদের মতো বাংলাদেশ প্রতিদিনের উপসম্পাদকীয় পাঠক। অন্য পত্রিকার সংবাদের প্রতি পাঠকের যেমন আকর্ষণ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের উপসম্পাদকীয় তত আকর্ষণীয়। বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রিয় সম্পাদক নঈম নিজাম একসময় এটিএন বাংলায় যোগদান করেছিল। ইরাকের যুদ্ধের সময় চ্যানেলটি ঘণ্টায় ঘণ্টায় যুদ্ধের খবর প্রচার করত। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাদের কপাল খুলে যায়। বিজ্ঞাপন বেড়ে যায় শতগুণ। সেই এটিএন বাংলা থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিনে আসা, সম্পাদকের পদ সামলানো এক বিশাল ব্যাপার। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সাধারণত ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যাওয়ার ঝোঁক থাকে বেশি। কিন্তু নঈম নিজাম তার বিপরীত। নঈম নিজাম ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক সফলতা পেয়েও প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়েনি। আমিও তাকে অনেকবার বলেছি, প্রিন্ট মিডিয়া অনেক বেশি সম্মানের, অনেক বেশি কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপ যেখানে যত কাজই করে থাকুক যত সাফল্যই পেয়ে থাকুক তাদের গ্রুপে বাংলাদেশ প্রতিদিন হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আহরণের সাফল্যের মতো। আল্লাহর কি অপার মহিমা, বছরের পর বছর যে পত্রিকায় লিখছি সেই পত্রিকার শুভ জন্মদিনে আমার পর্ব পড়েছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি বাংলাদেশ প্রতিদিন মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সাথী হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুক। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আমার শুভ কামনা এবং মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা করি সংশ্লিষ্ট সবাইকে তাঁর সুশীতল ছায়াতলে রাখুন।

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক, নঈম নিজামের বন্ধু, আমার অত্যন্ত প্রিয় পীর হাবিবুর রহমান ইহলোক ত্যাগ করেছে। তার আত্মার শান্তি কামনায় জল-জোছনার শহর সুনামগঞ্জের শোকসভায় গিয়েছিলাম। শোকসভার বিষয় আগামী পর্বে বিস্তারিত লিখব। পরম করুণাময় দয়াময় আল্লাহ পীর হাবিবকে বেহেশতবাসী করুন এবং তার পরিবার-পরিজনদের এ শোক সইবার শক্তি দিন এবং নিরাপদে রাখুন।

 

অপ্রত্যাশিতভাবে ঘুরে এলাম জল-জোছনার শহর সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জে প্রথম গিয়েছিলাম আমাদের নেতা আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে ১৯৭২ সালের এই মাসে। তখন রাস্তাঘাট দালানকোঠা কিছুই ছিল না। সঙ্গে ছিল অনেক নেতা-কর্মী- শাহ আজিজ, বাবরুল হোসেন বাবুল, লালা, তোহা, লেইস, কয়েস আরও অনেকে। সেই ১৯৭২ সাল থেকে আজবধি সিলেটের লাখো মানুষ আমাকে ‘বাঘা ভাই’ বলে জানে। তাদের অনেকেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম হিসেবে এখনো চেনে না বা জানে না। সেবার অকাল বন্যায় সিলেটের বিয়ানীবাজার, করিমগঞ্জ আরও অনেক জায়গা ভেসেছিল। কিছু ত্রাণসামগ্রীসহ অর্ধশত সহকর্মী নিয়ে সিলেট গিয়েছিলাম। রাস্তা ভাঙা ছিল, এখনকার বাইপাস তখন ছিল না। তাই চা বাগানের ভিতর দিয়ে যেতে হতো। তাতে চুনারুঘাট বা শায়েস্তাগঞ্জ পর্যন্ত ৭০-৮০ কিলোমিটার রাস্তা বেশি হতো। আমাদের ত্রাণসামগ্রী হেলিকপ্টারে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন চাঁদপুরের একসময়ের মুকুটহীন সম্রাট মিজানুর রহমান চেধুরী। তিনি তখন সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী। প্রথম সফরেই সিলেট আমার বড় বেশি ভালো লেগেছিল। তখন বৃহত্তর সিলেটের নেতা ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী, দেওয়ান ফরিদ গাজী, লালা, তোহা, বাবরুল হোসেন বাবুল, শাহ আজিজ, ক্যাপ্টেন জলিল এমনি আরও অনেকে তখন যুবনেতা। কামরান, মানিকরা তখনো নেতা হয়ে ওঠেনি। সিলেটের সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সেই থেকে আমাকে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসা এখনো অটুট আছে। কয়েকদিন আগে পাবনার এক আওয়ামী লীগ নেতা মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন ফোনে সময় ঠিক করে মোহাম্মদপুরের বাসায় এসেছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন। তার কথা শুনে আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা প্রতিদিনই শুনি। তার কাছে আরও গভীরের কথা শুনলাম। স্বাভাবিক কারণেই মন কিছুটা ভারাক্রান্ত। ঠিক সেই সময় আলমগীর এসে জানায় পীর হাবিবের ভাই মাননীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এসেছে। বলেছিলাম, নিয়ে এসো। আমি তাকে প্রথম পীর হাবিবের বড় ভাই মনে করেছিলাম। ওরা পাঁচ ভাই, তিন বোন- হিফজুর রহমান পীর (মৃত), হিফজুন্নেছা খানম জুঁই (শিক্ষক), ছাবিত আহমদ পীর (মৃত), রওশন আরা খানম (মৃত), অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর (’৭৫-পরবর্তী সুনামগঞ্জ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, পরে দুবার জেলা সভাপতি। বর্তমানে সিনিয়র আইনজীবী, সুনামগঞ্জ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সেক্রেটারি), জেব-উন-নেছা খানম পুষ্প, পীর হাবিবুর রহমান (মৃত), পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এমপি (বিরোধীদলীয় হুইপ ও জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান)। আমি মিসবাহকে বড় ভাই অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর ভেবেছিলাম। মিসবাহ এসেই বলল, ‘দাদা, আমি পীরের ছোট ভাই।’ আমার হৃদয় জুড়ে পীর হাবিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর আমি যখন নির্বাসনে তখন ওরা বড় হয়েছে। পীর হাবিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। পীর হাবিবের কারণে নাকি অন্য কিছুর জন্য সিলেট-সুনামগঞ্জের অনেক ছেলেমেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, হয়তো এখনো পড়ে। পীর হাবিব রাজশাহীতেই বিয়ে করেছে। ছেলে আহনাফ ফাহমিন অন্তর, মেয়ে রাইসা নাজ চন্দ্রস্মিতা। সংসদ সদস্য মিসবাহ বসতে বসতেই বলল, ‘দাদা, ১১ মার্চ সুনামগঞ্জে ভাইয়ের জন্য একটা শোকসভার ব্যবস্থা করেছি। আপনি গেলে খুব খুশি হব।’ সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম, নিশ্চয়ই যাব। পৃথিবীতে করোনার আবির্ভাবের পর গত প্রায় দুই বছর প্রকাশ্য কোনো সভা-সমাবেশে যাইনি। খুব সম্ভবত দুই বা তিনবার পতাকা উত্তোলক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আ স ম আবদুর রবের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। সেগুলো ছিল ঘরোয়া অনুষ্ঠান। পীর হাবিবের স্মরণসভা সুনামগঞ্জের সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে (বালুর মাঠ)। শোকসভার আহ্বান জানিয়ে টাঙ্গাইলের চমচম ও চা পান করে মিসবাহ চলে যেতেই পাবনার ইসমাইল হোসেনের অনেক দুঃখের কথা শুনলাম। তারপর তিনিও চলে গেলেন। পরদিন টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই ফোন করেছিলাম রেলের ডিজি জনাব ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে। পরদিন ডিজির পিএর ফোন, ‘স্যার, আপনার টিকিট কমলাপুরের ৫ নম্বর কাউন্টার থেকে নিয়ে নেবেন।’ তারেক গিয়ে টিকিট নিয়ে আসে। আবার পিএকে জিজ্ঞেস করি, সিলেট থেকে ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা কী? তিনি একটু পরে ফোন করে জানান, সিলেট স্টেশনেই ফেরার টিকিট পেয়ে যাবেন। স্টেশনে গিয়েছিলাম ১০ তারিখ রাত ৮টায়। মোহাম্মদপুরের বাবর রোড থেকে কমলাপুর যেতে লেগেছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা। পরদিন সকাল পৌনে ৭টায় কমলাপুর থেকে বাবর রোডে ফিরতে লেগেছিল ১৩ মিনিট। স্টেশনে গিয়েই স্টেশন মাস্টার আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা। তিনিই নিয়ে ভিআইপি রেস্ট রুমে বসান। একটু পরই হাই কোর্টের একজন বিচারপতি আসেন। তিনিও সিলেট যাবেন। কয়েক মিনিট বসতেই স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারোয়ার এলেন আমাদের নিয়ে যেতে। মালয়েশিয়ার তৈরি নতুন গাড়ি, ভিতরটা বেশ ঝকঝকে তকতকে। আমার জন্য দুই বেডের সিঙ্গেল বাথ, মাননীয় বিচারপতির জন্য চার বেডের ডাবল বাথ। আমাকে দেখে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার খুব খুশি হয়েছিলেন। বিচারপতিকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় ছোটখাটো আলোচনা হয়। তাই কথাবার্তা না হলেও তাকে আগে থেকেই চিনতাম। ছেলে আকিব নজরুল, মেয়ে শায়লা শবনম এবং স্ত্রী শাহনাজ বাবলিসহ সিলেট চলেছেন ছুটি কাটাতে। বড় ছেলে আসির ইন্তিসার যায়নি। দু-তিন দিন তারা সিলেটে থাকবেন। মেয়েটিকে আমার এইট-নাইনের ছাত্রী মনে হচ্ছিল। মামণি আপনি কোন ক্লাসে পড়েন- এ রকম জিজ্ঞেস করব, কিন্তু মেয়েকে জিজ্ঞেস না করে ছেলেকে করেছিলাম, বাবা, আপনি কোথায় পড়েন? বলল, ‘আমি সিক্সে পড়ি’। মেয়েটিকে জিজ্ঞেসের আগেই সে বলল, ‘আমি ব্যারিস্টারি পড়ি’। বয়স কত হবে- ২০-২২-এর বেশি না। ভেবেছিলাম ১২-১৪, বড়জোর ১৫ বছর। বড় অমায়িক ছেলেমেয়ে। বিচারপতির কামরায় প্রায় আধাঘণ্টা ছিলাম। তার স্ত্রীকেও আমার বেশ ভালো লেগেছে। সরল সোজা অমায়িক মানুষ। সিলেটেও মা-মেয়ের দেখা পেয়েছিলাম হজরত শাহ পরান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে নেমে আসার পথে। মেয়েদের সারির সামনেই মা-মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাহ পরান (রহ.)-এর মাজারে তাদের দুজনকে দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। তখন শায়লাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি এখানে! ‘ভাই এবং আব্বু মাজার জিয়ারতে ওপরে গেছেন। তাই আম্মু আর আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’ যাওয়ার পথে ট্রেনের কামরায় বাচ্চা দুটির মুখ খুব শুকনো লাগছিল। বিচারপতি ক্যাটারিংয়ের লোকজনকে খাবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিলেন। ভারতের মতো বাংলাদেশের রেলে উন্নতমানের কোনো খাবার পাওয়া যায় না। বিস্কিট, চিপস, কাটলেট এসব পাওয়া যায়। রেলের ক্যাটারিংয়ের বিস্কিট খেলে কী হয় বলতে পারব না, কিন্তু কাটলেট খেলে অবশ্যই পেটে যন্ত্রণা হয়, কষ্ট বাড়ে। সাড়ে ৮টায় ট্রেন ছিল বলে আমার স্ত্রী চারটি ছোট রুটি, এক বাটি সবজি, এক বাটি ডাল আর ডালের মধ্যে দুটি ডিম দিয়েছিলেন। আমার কাছে খেজুর, কিশমিশ, এপ্রিকট, কাজুবাদাম, অ্যালামন্ডা, আখরোট বারো মাসই থাকে। ট্রেনযাত্রায়ও ওসব ছিল। আলমগীরকে প্লেট আনতে বলেছিলাম। দুটি রুটি, সবজি একটি প্লেটে যখন দুটি বাচ্চার সামনে দেওয়া হলো ওরা বেশ তৃপ্তিসহকারে খাচ্ছিল। আমার মনে হয়েছিল ওদের আরেকটু খাওয়া দরকার। ব্যক্তিগত সহকারী আলমগীর আরও একটি রুটি আর সবজি-ডাল তুলে দেয়। আমার কাছে মনে হচ্ছিল রুটি খাবার পরও কিছু সবজি প্লেটে থেকে যাবে। তাই একটি ছোট চামচ দিতে বলেছিলাম। কিন্তু মেয়েটি বলেছিল, আঙ্কেল, ‘চামচের কোনো দরকার নেই। রুটি দিয়েই আমরা সবটুকু খেয়ে ফেলতে পারব।’ শেষের রুটিটি যখন ভাইবোন ভাগ করে খাচ্ছিল তখন আমার ছেলেবেলার গ্রামের বাড়িতে মায়ের পরিবেশন করা খাবারের কথা মনে পড়ছিল। আমার ছেলেমেয়ে দীপ-কুঁড়ি-কুশি যখন খায় তখন আমার হৃদয় যেভাবে জুড়িয়ে যায় বিচারপতির দুই সন্তান যখন খাচ্ছিল তখন সেরকমই লাগছিল। খাওয়ার একেবারে শেষ পর্যায়ে শায়লার মা বলছিলেন, ‘একেই বলে রিজিক। এক মুহূর্ত আগেও মানুষ জানে না কার রিজিক কোথায়।’ খাবার শেষে খেজুর, এপ্রিকট, বেকারির বিস্কিট তাদের সামনে দেওয়া হয়েছিল। মা-বাবা, ভাই-বোন চারজনেই সেগুলো খেয়েছিলেন। বহুদিন পর আমার শুষ্ক হৃদয় মহানন্দে কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। আমার আরও ভালো লাগছিল। আমি আমার কুপে এসে যখন খাচ্ছিলাম তখন দেখলাম একটি রুটি, পর্যাপ্ত সবজি, ডাল রয়েছে। ডালের মধ্যে যে ডিম ছিল তার বিন্দুবিসর্গও জানা ছিল না। আমি সাধারণত দুই অথবা তিনটি রুটি খাই। সেদিন ট্রেনে একটি রুটি, প্রচুর সবজি, একটি ডিম, একটি খেজুর, একটি এপ্রিকট খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। গত ১০-১৫ বছরে তিনটি রুটির জায়গায় একটি রুটি খেয়ে সে যে কি স্বস্তিবোধ করেছিলাম কাউকে লিখে বোঝাতে পারব না। অত স্বস্তি অত আরাম ১৫ বছরে পাইনি। ট্রেন পৌঁছেছিল ভোর সাড়ে ৪টায়। বিচারপতির গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে নেওয়ার জন্য যাদের আসার কথা তারা সবাই এসেছিলেন। ৫টায় গাড়ি পৌঁছবে মনে করে তখনো আমাকে নিতে কেউ আসেনি। বিচারপতি চলে যাওয়ার পর ভিআইপি রুমে বসে ছিলাম। ১০ মিনিটের মধ্যে ত্রাণকর্তার মতো এমপি মিসবাহর দায়িত্ব দেওয়া রেজোয়ান এসে হাজির। এসেই বলল, পীর হাবিব আমার ভাই। 

উঠে বসলাম গাড়িতে। আমরা ছয়জন- আমি, ফরিদ, আলমগীর, সোহেল, দীপ ও তারেক। তাই রেজোয়ান দুটি গাড়ি নিয়ে এসেছিল। একটি তার, অন্যটি তার বন্ধু আমার প্রিয় লেইসের মেয়ের জামাই তারেকের।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com