বহু দিনের পিরিত গো বন্ধু ভেঙে দিও না

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.) : এমন বাঙালি খুব কম পাওয়া যাবে যারা আজকের শিরোনামে লেখা লাইনটির সঙ্গে পরিচিত নন। আবদুল আলিমের দরাজ গলায় গাওয়া একটি গানের অংশবিশেষ। গানের ব্যাখ্যা বা অন্তর্নিহিত বার্তা একেকজনের কাছে একেক রকম হয়ে থাকে। আজকে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে গানের লাইনটি মনে পড়েছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের  সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘ মধুর সম্পর্কের জায়গাটিতে ভাঙনের সুর এ সময়ে এসে যেরকম প্রবলভাবে বেজে উঠেছে তা নিয়ে লিখতে বসে উপরোক্ত শিরোনামটিই আমার কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে। ধর্মতন্ত্র আর মিলিটারিতন্ত্রের কবলে পড়ে একটি বিপুল সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র কীভাবে ভেঙে পড়তে পারে তার এক বড় উদাহরণ এখন পাকিস্তান। পাকিস্তানি শাসকদের দৃষ্টিতে এক সময়ের ভালো তালেবান আর মন্দ তালেবান আজ মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়ায় সবাই এখন পাকিস্তানের কাছে মন্দ তালেবান। নিজেরা যে সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করেছে তারাই আজ আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অন্য সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ল। ২০১১ সালের মে মাসে আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন পাকিস্তান সফরের সময় পাকিস্তানের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনা রব্বানি খাঁকে বলেছিলেন, বাড়ির পেছনের বাগানে বিষধর সাপ লালন-পালন করলে সে সাপ শুধু প্রতিবেশী নয়, এক সময় বাড়ির মালিককেও দংশন করতে ছাড়বে না। আজকে এই সময়ে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), আফগানে ক্ষমতাসীন তালেবান, হাক্কানি গ্রুপ, দয়েশ, ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান (আইএমইউ), ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম), পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-জাঙ্গভি এবং আল-কায়েদা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে নেমেছে। পাকিস্তানি থিঙ্ক ট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিসের তথ্যমতে, ২০২২ সালে প্রধানত টিটিপি এবং তার সঙ্গে অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের আক্রমণে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ২৮২ জন শুধু নিহত হয়েছে, আহত হওয়ার সংখ্যা আরও অনেক। ২০২১ সালে টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ২৮২টি আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে আত্মঘাতী অভিযানও ছিল। তাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ মোট ৯৭২ জন আহত নিহত হয়। ইউকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে, এক দশকের মধ্যে গত ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ মরণফাঁদের মাস। যেখানে টিটিপির নেতৃত্বে পরিচালিত বালুচ লিবারেশন আর্মি ও দয়েশের যৌথ অভিযানে ডিসেম্বর মাসেই পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হন। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেলুুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী বালুচ লিবারেশন আর্মি কর্তৃক মাটিতে পুঁতে রাখা বিস্ফোরণে একজন ক্যাপ্টেন পদবির অফিসারসহ বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য নিহত হন। এই বিস্ফোরণের লাইভ ভিডিও বাজারে ছেড়ে দিয়েছে বালুচ লিবারেশন আর্মি। নিহত ক্যাপ্টেনের কফিন বহন করতে দেখা গেছে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনির ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল জামশেদকে, যার সচিত্র খবর প্রচার করেছে পাকিস্তানের সব মিডিয়া। এই চিত্র দেখে সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন, দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রতীকী হিসেবে যেন মৃত পাকিস্তানের লাশ বহন করছে। আফগানিস্তানে এখন টিটিপির অবাধ ঘাঁটি। ২০২২ সালে শুধু পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর টিটিপি ১৪৮ বার আক্রমণ চালিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেছেন, প্রয়োজন হলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত টিটিপির ঘাঁটির ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অভিযান চালাবে। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে আফগান তালেবানের একজন সিনিয়র সদস্য আহমদ ইয়াসির ঐতিহাসিক লিগোসির উদাহরণ উল্লেখ করে টুইট বার্তায় লিখেছেন, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে পাকিস্তান যদি সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে তাদের পুনরায় ১৯৭১ সালের মতো সারেন্ডার করতে হবে। বার্তার সঙ্গে তিনি ঢাকায় সারেন্ডারের একটা ছবিও সেঁটে দিয়েছেন। বহু দিনের প্রেম-পিরিতের সম্পর্ককে রক্ষা করার মিশন নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হেনা রব্বানি খাঁ গত ৩০ নভেম্বর এক দিনের ঝটিকা সফরে আফগানিস্তানে যান। তিনি তালেবান সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তাতে তালেবান নেতাদের মান ভেঙেছে বলে মনে হয় না। নারীদের ঘরে বন্দি ও কালো কাপড়ে ঢেকে রাখার নীতিতে অটল আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক এই সফরকে নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেকে প্রশংসা করলেও তালেবান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে ও প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আবদুল গনি ব্রাদার ও ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের সুপ্রিম লিডার হিবাতুল্লাহ আখুঞ্জিও হেনা রব্বানির সঙ্গে দেখা করেননি। কেন করেননি তার কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা নেই। তবে সামাজিক মাধ্যমে কিছু লোকজন মন্তব্য করেছেন, ইসলামী শরিয়া অনুমতি দেয় না বিধায় এমন নারীর সঙ্গে সুপ্রিম কমান্ড দেখা করবে না। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুলে ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী আশরাফ ঘানি সরকার কর্তৃক গ্রেফতারকৃত সব টিটিপি সদস্যকে তালেবান সরকার মুক্ত করে দেয়। আজকে শুধু টিটিপি নয়, আল-কায়েদা, আইএস, আইএমইউ, ইটিআইএস-সহ সবাই আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছে এবং অবাধে চলাফেরা করছে। টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেসহুদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, আফগান তালেবান হচ্ছে সশস্ত্র ইসলামিক জিহাদের মডেল এবং ইসলামিক আন্দোলনের মাতা। নূর ওয়ালি মেসহুদ সুপ্রিমো হিবাতুল্লাহ আখুঞ্জির প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে বলেছেন, আফগান তালেবানের শাখা হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কাজ করবে টিটিপি। টিটিপির বৃহৎ লক্ষ্য ও দাবি হচ্ছে, রাষ্ট্রকে ইসলামিক খিলাফত অব পাকিস্তান ঘোষণা করতে হবে এবং আফগান তালেবানি শাসনের মতো একই রকম শরিয়া আইন মতে সবকিছু পরিচালিত হবে। তবে তাদের আপাত লক্ষ্য ও দাবি হচ্ছে, পশতুন জাতি অধ্যুষিত উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরস্তানকে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ থেকে আলাদা করে আগের মতো স্বশাসিত অঞ্চল করতে হবে এবং সেখানে শরিয়া আইন অনুযায়ী সবকিছু চলবে, সেখান থেকে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। টিটিপির ধারণা, আপত লক্ষ্য অর্জিত হলে সেটা বৃহৎ লক্ষ্য অর্জনের পথকে সুগম করবে। ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মতন্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়ায় এবং তার সঙ্গে ভালো তালেবান, মন্দ তালেবান তত্ত্ব ও সুবিধামতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গি সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি এবং জিহাদিতন্ত্র লালন-পালন করায় ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের প্রতিপত্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি জনগণ, প্রশাসনসহ সামরিক বাহিনীর র‌্যাঙ্ক ও ফাইলের মধ্যে বড় একাংশ ধর্মবাদী শরিয়াতন্ত্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি মতাদর্শগতভাবে ঝুঁকে পড়েছে। এসব পক্ষের মানুষ আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়ে ভীষণভাবে উৎসাহিত এবং উজ্জীবিত। টিটিপিসহ এদের ধারণা, আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীকে যখন পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে তখন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারলে পাকিস্তানেও তাদের বিজয় হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব হবে কি হবে না, সেটা আবার অন্য এক বড় বিশ্লেষণের বিষয়। তবে পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের র‌্যাঙ্ক ও ফাইলের ভিতর তালেবানি শরিয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন যে বাড়ছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০১২ সালে খাইবার পাখতুনখোয়ার বান্নু জেলখানায় আক্রমণ চালিয়ে টিটিপি তাদের ৩৮৪ জন যোদ্ধাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। ওই আক্রমণের সময় দেখা গেছে, জেলখানার নিরাপত্তাকর্মীরা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় শুধু নয়, তারা টিটিপিকে সমর্থন জানিয়ে স্লোগান দিয়েছে এবং দাবি জানিয়েছে, পাকিস্তানেও শরিয়া আইন হতে হবে। বান্নু জেলখানার মতো ২০১৩ সালের ২০ জুলাই ডেরা ইসমাইল খাঁ জেলখানায় আক্রমণ চালিয়ে হাইপ্রোফাইল জঙ্গিসহ টিটিপি তাদের ২৪০ জনকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। ২০১৪ সালের ৮ জুন টিটিপি ও ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তানের সশস্ত্র যোদ্ধারা করাচি বিমানবন্দরে আক্রমণ চালায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে সে বছর ১৫ জুন উত্তর ওয়াজিরস্তানে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী সর্বাত্মক সামরিক অভিযানে নামে। সেই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘জার্ব-ই-আজব’। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ওই অপারেশনে ওয়াজিরস্তানের প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয় এবং ২৭৬৩ জন জঙ্গি ও একই সঙ্গে পাকিস্তানের অফিসারসহ ৩৪৭ জন সেনা সদস্য নিহত হয়। এত বড় অপারেশনের পরে টিটিপিকে নির্মূল করা যায়নি। কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে, ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে যত যুদ্ধ এবং তাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যত অফিসার ও জওয়ান আহত-নিহত হয়েছে, তার থেকে বেশি আহত-নিহত হয়েছে জঙ্গিদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে। আফগানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন উদ্যোগে অভিযানে নেমেছে টিটিপি। তবে আজকে বড় প্রশ্ন যেটি সামনে এসেছে তা হলো- আফগানিস্তানের তালেবান সরকার আজকে কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এটা তো সবাই জানে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরাসরি সমর্থন, অর্থায়ন ও অস্ত্রবলে প্রতিবেশী ওই দেশে তালেবান বাহিনীর উত্থান ঘটেছে এবং ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০১ সালে আমেরিকার সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিলেও এটা এখন বিশ্ব অঙ্গনে ওপেন সিক্রেট যে, আফগানিস্তান থেকে উৎখাত হওয়ার পর তালেবানের টপ নেতৃত্বের প্রায় সবাই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আশ্রয় পেয়েছে এবং থেকেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০ বছর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে তালেবান বাহিনীকে পাকিস্তান সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুলে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বত্র সবাই বিজয় উল্লাস করেছে। এটিকে ইসলামের বিজয় ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রধান সে বিজয় উদযাপনের জন্য কাবুলে গিয়েছে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আফগান তালেবান সরকার এখন জাতীয় ও মতাদর্শগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক খামখেয়ালিভাবে পাশতুন জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে যে সীমান্ত রেখা টেনে দিয়েছে, যেটি এখন ডুরাল্ট লাইন নামে পরিচিত, সেটি আফগানিস্তানের কোনো সরকারই কখনো মেনে নেয়নি, স্বীকৃতিও দেয়নি। এ বিষয়ে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে উচ্চবাচ্য না করলেও এবার ক্ষমতায় এসে তালেবান সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা পাশতুন জনগোষ্ঠীর বিভক্তিকে কখনো মেনে নেবে না। এটাই এখন পাকিস্তানের বড় মাথাব্যথা। ২৬৭০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে পাকিস্তান অনেক উঁচু কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। তাতে আরও ক্ষেপেছে তালেবান সরকার। তারা হয়তো মনে করছে, দুই পাশের পাশতুন জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করতে পারলে সেটা হবে আফগানিস্তানের জন্য শত বছরের শ্রেষ্ঠ বিজয়।

 

দ্বিতীয়ত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে তাতে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে। এত দিন পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল-আফগানিস্তান হবে পাকিস্তানের কৌশলগত পশ্চাৎভূমি এবং পারমাণবিক অস্ত্র ভান্ডারের নিরাপদ জায়গা। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আফগানিস্তান যুদ্ধক্ষেত্র হোক তা তালেবান সরকার কিছুতেই হতে দেবে না, এটিও এখন স্পষ্ট। এখানে শেষ নয়। মতাদর্শগতভাবে সব মুসলিম প্রধান দেশ নিয়ে বৃহত্তর ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তার জন্য আফগান তালেবানের সামনে এখন পাকিস্তানই সবচেয়ে উর্বর ও উপযুক্ত স্থান। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এখন বিপজ্জনক ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে। শুধু শত্রু নয়, বিপদের সময় বন্ধুরাও কিছু হাতিয়ে নিতে চায়, রাজনীতিতে এটি এক চিরন্তন বাস্তবতা। সুতরাং প্রচুর তোশামোদি করেও এত দিনের প্রিয় ভালো তালেবানকে বাগে আনা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে একটা কৌতুকপূর্ণ ভিডিও আমার নজরে আসে। তাতে দেখা যায়, একদল আফগান তালেবান যোদ্ধা আনন্দ মনে সীমান্তের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। অন্য একজন তাদের জিজ্ঞাসা করছে, আপনারা কি পাকিস্তান দখল করতে যাচ্ছেন। উত্তরে তারা বলেন, ‘না। কারণ পাকিস্তান দখল করলে তাদের বিশাল দায়-দেনার ভার আমাদের নিতে হবে।’  বিশাল ঋণের ভার ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ, দুই পক্ষই দিশাহারা। সুতরাং শত্রু-বন্ধু, সবাই সুযোগ নিতে চাইছে। এটা হঠাৎ করে হয়নি।  দীর্ঘদিনের সামরিকতন্ত্র এবং ধর্মতন্ত্রের অন্ধত্বই আজ পাকিস্তানকে এখানে নিয়ে এসেছে। আজকে লেখার শিরোনাম ও শুরুতে যে গানটির কথা উল্লেখ করেছি, তার মধ্যভাগের দুটি লাইন এ রকম-

‘আমি কি দোষ দিব পরের পুতের গো/নিজের কর্ম ভালো না।’

 

-মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]      সূূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুই-এক বছর দেখতে চাই : নুর

» চোখের সেবা সম্প্রসারণে অরবিসের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ আগ্রহী : ইউনূস

» ভারতে বসে হাসিনা ষড়যন্ত্র করছেন : এ্যানি

» স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ২০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দে ইইউর সমর্থন চাইল বাংলাদেশ

» ধাপে ধাপে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে সরকার : হাসান আরিফ

» বিমান বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা

» অনলাইনে আয়কর পরিশোধ সহজ করতে এনবিআর-এর সাথে পার্টনারশিপ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

» বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষায় অশনি সংকেত অটোমেশন; ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা

» ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি খালেদা জিয়াকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি আলালের

» থানায় এসে কেউ যেন সেবা বঞ্চিত না হয়: ডিএমপি কমিশনার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

বহু দিনের পিরিত গো বন্ধু ভেঙে দিও না

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.) : এমন বাঙালি খুব কম পাওয়া যাবে যারা আজকের শিরোনামে লেখা লাইনটির সঙ্গে পরিচিত নন। আবদুল আলিমের দরাজ গলায় গাওয়া একটি গানের অংশবিশেষ। গানের ব্যাখ্যা বা অন্তর্নিহিত বার্তা একেকজনের কাছে একেক রকম হয়ে থাকে। আজকে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করে গানের লাইনটি মনে পড়েছে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের  সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘ মধুর সম্পর্কের জায়গাটিতে ভাঙনের সুর এ সময়ে এসে যেরকম প্রবলভাবে বেজে উঠেছে তা নিয়ে লিখতে বসে উপরোক্ত শিরোনামটিই আমার কাছে উপযুক্ত মনে হয়েছে। ধর্মতন্ত্র আর মিলিটারিতন্ত্রের কবলে পড়ে একটি বিপুল সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র কীভাবে ভেঙে পড়তে পারে তার এক বড় উদাহরণ এখন পাকিস্তান। পাকিস্তানি শাসকদের দৃষ্টিতে এক সময়ের ভালো তালেবান আর মন্দ তালেবান আজ মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়ায় সবাই এখন পাকিস্তানের কাছে মন্দ তালেবান। নিজেরা যে সন্ত্রাসীদের লালন-পালন করেছে তারাই আজ আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অন্য সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ল। ২০১১ সালের মে মাসে আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন পাকিস্তান সফরের সময় পাকিস্তানের সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনা রব্বানি খাঁকে বলেছিলেন, বাড়ির পেছনের বাগানে বিষধর সাপ লালন-পালন করলে সে সাপ শুধু প্রতিবেশী নয়, এক সময় বাড়ির মালিককেও দংশন করতে ছাড়বে না। আজকে এই সময়ে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), আফগানে ক্ষমতাসীন তালেবান, হাক্কানি গ্রুপ, দয়েশ, ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তান (আইএমইউ), ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম), পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-জাঙ্গভি এবং আল-কায়েদা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানে নেমেছে। পাকিস্তানি থিঙ্ক ট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিসের তথ্যমতে, ২০২২ সালে প্রধানত টিটিপি এবং তার সঙ্গে অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠনের আক্রমণে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ২৮২ জন শুধু নিহত হয়েছে, আহত হওয়ার সংখ্যা আরও অনেক। ২০২১ সালে টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ২৮২টি আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে আত্মঘাতী অভিযানও ছিল। তাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ মোট ৯৭২ জন আহত নিহত হয়। ইউকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে, এক দশকের মধ্যে গত ডিসেম্বর ছিল পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ মরণফাঁদের মাস। যেখানে টিটিপির নেতৃত্বে পরিচালিত বালুচ লিবারেশন আর্মি ও দয়েশের যৌথ অভিযানে ডিসেম্বর মাসেই পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হন। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে বেলুুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী বালুচ লিবারেশন আর্মি কর্তৃক মাটিতে পুঁতে রাখা বিস্ফোরণে একজন ক্যাপ্টেন পদবির অফিসারসহ বেশ কয়েকজন সেনা সদস্য নিহত হন। এই বিস্ফোরণের লাইভ ভিডিও বাজারে ছেড়ে দিয়েছে বালুচ লিবারেশন আর্মি। নিহত ক্যাপ্টেনের কফিন বহন করতে দেখা গেছে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিফ মুনির ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল জামশেদকে, যার সচিত্র খবর প্রচার করেছে পাকিস্তানের সব মিডিয়া। এই চিত্র দেখে সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন, দুই ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রতীকী হিসেবে যেন মৃত পাকিস্তানের লাশ বহন করছে। আফগানিস্তানে এখন টিটিপির অবাধ ঘাঁটি। ২০২২ সালে শুধু পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর টিটিপি ১৪৮ বার আক্রমণ চালিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেছেন, প্রয়োজন হলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত টিটিপির ঘাঁটির ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী অভিযান চালাবে। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে আফগান তালেবানের একজন সিনিয়র সদস্য আহমদ ইয়াসির ঐতিহাসিক লিগোসির উদাহরণ উল্লেখ করে টুইট বার্তায় লিখেছেন, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে পাকিস্তান যদি সামরিক অভিযান চালায়, তাহলে তাদের পুনরায় ১৯৭১ সালের মতো সারেন্ডার করতে হবে। বার্তার সঙ্গে তিনি ঢাকায় সারেন্ডারের একটা ছবিও সেঁটে দিয়েছেন। বহু দিনের প্রেম-পিরিতের সম্পর্ককে রক্ষা করার মিশন নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হেনা রব্বানি খাঁ গত ৩০ নভেম্বর এক দিনের ঝটিকা সফরে আফগানিস্তানে যান। তিনি তালেবান সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। তাতে তালেবান নেতাদের মান ভেঙেছে বলে মনে হয় না। নারীদের ঘরে বন্দি ও কালো কাপড়ে ঢেকে রাখার নীতিতে অটল আফগানিস্তানে সাম্প্রতিক এই সফরকে নারী স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেকে প্রশংসা করলেও তালেবান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে ও প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোল্লা ইয়াকুব, ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী আবদুল গনি ব্রাদার ও ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের সুপ্রিম লিডার হিবাতুল্লাহ আখুঞ্জিও হেনা রব্বানির সঙ্গে দেখা করেননি। কেন করেননি তার কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা নেই। তবে সামাজিক মাধ্যমে কিছু লোকজন মন্তব্য করেছেন, ইসলামী শরিয়া অনুমতি দেয় না বিধায় এমন নারীর সঙ্গে সুপ্রিম কমান্ড দেখা করবে না। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুলে ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী আশরাফ ঘানি সরকার কর্তৃক গ্রেফতারকৃত সব টিটিপি সদস্যকে তালেবান সরকার মুক্ত করে দেয়। আজকে শুধু টিটিপি নয়, আল-কায়েদা, আইএস, আইএমইউ, ইটিআইএস-সহ সবাই আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছে এবং অবাধে চলাফেরা করছে। টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেসহুদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, আফগান তালেবান হচ্ছে সশস্ত্র ইসলামিক জিহাদের মডেল এবং ইসলামিক আন্দোলনের মাতা। নূর ওয়ালি মেসহুদ সুপ্রিমো হিবাতুল্লাহ আখুঞ্জির প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে বলেছেন, আফগান তালেবানের শাখা হিসেবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কাজ করবে টিটিপি। টিটিপির বৃহৎ লক্ষ্য ও দাবি হচ্ছে, রাষ্ট্রকে ইসলামিক খিলাফত অব পাকিস্তান ঘোষণা করতে হবে এবং আফগান তালেবানি শাসনের মতো একই রকম শরিয়া আইন মতে সবকিছু পরিচালিত হবে। তবে তাদের আপাত লক্ষ্য ও দাবি হচ্ছে, পশতুন জাতি অধ্যুষিত উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরস্তানকে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ থেকে আলাদা করে আগের মতো স্বশাসিত অঞ্চল করতে হবে এবং সেখানে শরিয়া আইন অনুযায়ী সবকিছু চলবে, সেখান থেকে সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে। টিটিপির ধারণা, আপত লক্ষ্য অর্জিত হলে সেটা বৃহৎ লক্ষ্য অর্জনের পথকে সুগম করবে। ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মতন্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়ায় এবং তার সঙ্গে ভালো তালেবান, মন্দ তালেবান তত্ত্ব ও সুবিধামতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গি সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি এবং জিহাদিতন্ত্র লালন-পালন করায় ধর্মীয় উগ্রবাদী রাজনৈতিক দলের প্রতিপত্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি জনগণ, প্রশাসনসহ সামরিক বাহিনীর র‌্যাঙ্ক ও ফাইলের মধ্যে বড় একাংশ ধর্মবাদী শরিয়াতন্ত্রের রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি মতাদর্শগতভাবে ঝুঁকে পড়েছে। এসব পক্ষের মানুষ আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়ে ভীষণভাবে উৎসাহিত এবং উজ্জীবিত। টিটিপিসহ এদের ধারণা, আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীকে যখন পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে তখন দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারলে পাকিস্তানেও তাদের বিজয় হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব হবে কি হবে না, সেটা আবার অন্য এক বড় বিশ্লেষণের বিষয়। তবে পাকিস্তানের সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের র‌্যাঙ্ক ও ফাইলের ভিতর তালেবানি শরিয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন যে বাড়ছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০১২ সালে খাইবার পাখতুনখোয়ার বান্নু জেলখানায় আক্রমণ চালিয়ে টিটিপি তাদের ৩৮৪ জন যোদ্ধাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। ওই আক্রমণের সময় দেখা গেছে, জেলখানার নিরাপত্তাকর্মীরা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় শুধু নয়, তারা টিটিপিকে সমর্থন জানিয়ে স্লোগান দিয়েছে এবং দাবি জানিয়েছে, পাকিস্তানেও শরিয়া আইন হতে হবে। বান্নু জেলখানার মতো ২০১৩ সালের ২০ জুলাই ডেরা ইসমাইল খাঁ জেলখানায় আক্রমণ চালিয়ে হাইপ্রোফাইল জঙ্গিসহ টিটিপি তাদের ২৪০ জনকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। ২০১৪ সালের ৮ জুন টিটিপি ও ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তানের সশস্ত্র যোদ্ধারা করাচি বিমানবন্দরে আক্রমণ চালায়। তার পরিপ্রেক্ষিতে সে বছর ১৫ জুন উত্তর ওয়াজিরস্তানে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী সর্বাত্মক সামরিক অভিযানে নামে। সেই অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল ‘জার্ব-ই-আজব’। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ওই অপারেশনে ওয়াজিরস্তানের প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয় এবং ২৭৬৩ জন জঙ্গি ও একই সঙ্গে পাকিস্তানের অফিসারসহ ৩৪৭ জন সেনা সদস্য নিহত হয়। এত বড় অপারেশনের পরে টিটিপিকে নির্মূল করা যায়নি। কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে, ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে যত যুদ্ধ এবং তাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যত অফিসার ও জওয়ান আহত-নিহত হয়েছে, তার থেকে বেশি আহত-নিহত হয়েছে জঙ্গিদের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে। আফগানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন উদ্যোগে অভিযানে নেমেছে টিটিপি। তবে আজকে বড় প্রশ্ন যেটি সামনে এসেছে তা হলো- আফগানিস্তানের তালেবান সরকার আজকে কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এটা তো সবাই জানে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরাসরি সমর্থন, অর্থায়ন ও অস্ত্রবলে প্রতিবেশী ওই দেশে তালেবান বাহিনীর উত্থান ঘটেছে এবং ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০১ সালে আমেরিকার সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিলেও এটা এখন বিশ্ব অঙ্গনে ওপেন সিক্রেট যে, আফগানিস্তান থেকে উৎখাত হওয়ার পর তালেবানের টপ নেতৃত্বের প্রায় সবাই পাকিস্তানের অভ্যন্তরে আশ্রয় পেয়েছে এবং থেকেছে। ২০০১ সাল থেকে ২০ বছর আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে তালেবান বাহিনীকে পাকিস্তান সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুলে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর প্রধানমন্ত্রীসহ সর্বত্র সবাই বিজয় উল্লাস করেছে। এটিকে ইসলামের বিজয় ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর প্রধান সে বিজয় উদযাপনের জন্য কাবুলে গিয়েছে। কিন্তু আজকের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আফগান তালেবান সরকার এখন জাতীয় ও মতাদর্শগত স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। ব্রিটিশ শাসক কর্তৃক খামখেয়ালিভাবে পাশতুন জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত এবং পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে যে সীমান্ত রেখা টেনে দিয়েছে, যেটি এখন ডুরাল্ট লাইন নামে পরিচিত, সেটি আফগানিস্তানের কোনো সরকারই কখনো মেনে নেয়নি, স্বীকৃতিও দেয়নি। এ বিষয়ে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে উচ্চবাচ্য না করলেও এবার ক্ষমতায় এসে তালেবান সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা পাশতুন জনগোষ্ঠীর বিভক্তিকে কখনো মেনে নেবে না। এটাই এখন পাকিস্তানের বড় মাথাব্যথা। ২৬৭০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে পাকিস্তান অনেক উঁচু কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। তাতে আরও ক্ষেপেছে তালেবান সরকার। তারা হয়তো মনে করছে, দুই পাশের পাশতুন জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করতে পারলে সেটা হবে আফগানিস্তানের জন্য শত বছরের শ্রেষ্ঠ বিজয়।

 

দ্বিতীয়ত, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে তাতে পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি রয়েছে। এত দিন পাকিস্তানের লক্ষ্য ছিল-আফগানিস্তান হবে পাকিস্তানের কৌশলগত পশ্চাৎভূমি এবং পারমাণবিক অস্ত্র ভান্ডারের নিরাপদ জায়গা। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে আফগানিস্তান যুদ্ধক্ষেত্র হোক তা তালেবান সরকার কিছুতেই হতে দেবে না, এটিও এখন স্পষ্ট। এখানে শেষ নয়। মতাদর্শগতভাবে সব মুসলিম প্রধান দেশ নিয়ে বৃহত্তর ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন তার জন্য আফগান তালেবানের সামনে এখন পাকিস্তানই সবচেয়ে উর্বর ও উপযুক্ত স্থান। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এখন বিপজ্জনক ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে। শুধু শত্রু নয়, বিপদের সময় বন্ধুরাও কিছু হাতিয়ে নিতে চায়, রাজনীতিতে এটি এক চিরন্তন বাস্তবতা। সুতরাং প্রচুর তোশামোদি করেও এত দিনের প্রিয় ভালো তালেবানকে বাগে আনা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগে একটা কৌতুকপূর্ণ ভিডিও আমার নজরে আসে। তাতে দেখা যায়, একদল আফগান তালেবান যোদ্ধা আনন্দ মনে সীমান্তের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। অন্য একজন তাদের জিজ্ঞাসা করছে, আপনারা কি পাকিস্তান দখল করতে যাচ্ছেন। উত্তরে তারা বলেন, ‘না। কারণ পাকিস্তান দখল করলে তাদের বিশাল দায়-দেনার ভার আমাদের নিতে হবে।’  বিশাল ঋণের ভার ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণ, দুই পক্ষই দিশাহারা। সুতরাং শত্রু-বন্ধু, সবাই সুযোগ নিতে চাইছে। এটা হঠাৎ করে হয়নি।  দীর্ঘদিনের সামরিকতন্ত্র এবং ধর্মতন্ত্রের অন্ধত্বই আজ পাকিস্তানকে এখানে নিয়ে এসেছে। আজকে লেখার শিরোনাম ও শুরুতে যে গানটির কথা উল্লেখ করেছি, তার মধ্যভাগের দুটি লাইন এ রকম-

‘আমি কি দোষ দিব পরের পুতের গো/নিজের কর্ম ভালো না।’

 

-মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]      সূূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com