ডা. জাকি রেজওয়ানা আনোয়ার (এফআরএসএ) : বৃটিশ রাজনীতিবিদ, লেখক ও চিন্তাবিদ ইনক পাওয়েল বলেছিলেন, ‘সব রাজনীতিকদেরই ক্যারিয়ার শেষ হয় ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে যদি তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকার সময় বিদায় না নেন। কারণ এটাই রাজনীতির ধর্ম।’ হয়তো কালের প্রভাবে ইতিহাস তাঁদের কাজের সুব্যাখ্যা দেয় তবে বিদায়কালে তাঁদেরকে দেওয়া হয় ব্যর্থতার টিকেট – এটাই আমরা দেখতে পাই।
১৯৭৯ সালের পরে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বে ২০১৯ সালে কনজারভেটিভ বিপুল পরিমাণে ভোটে জিতার পরেও আড়াই বছরের মাথায় বরিস জনসন নিজ দলের এমপিদের চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। বরিস জনসনের প্রেমিয়ারশীপের পুরো সময়টাতেই যে ভুলটা তিনি করেছিলেন বা যে ঘোরের মধ্যে তিনি ছিলেন তা হচ্ছে, তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে কোটি কোটি ভোটার যেখানে তাঁকে এবং তাঁর দলকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে সেখানে এক দল এমপি তাঁকে উৎখাত করতে পারবে না অর্থাৎ বরিস জনসন একটা ‘প্রেসিডেনশিয়াল মডেল’ মাথার মধ্যে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করে আসছিলেন এবং ধরে নিয়েছিলেন তিনিই হচ্ছেন কেন্দ্র বিন্দু – তাঁকে ঘিরে বাকীদের অস্তিত্ব টিকে আছে। তবে এটা সত্যি যে তাঁর কারণেই কনজারভেটিভের বহু এমপি নির্বাচিত হয়ে সরকার দলে আসতে পেরেছিলেন; তাঁর কারণেই এবং তাঁর নেতৃত্বেই কনজারভেটিভ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল এবং ব্র্যাক্সিট সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু বৃটেন চলছে ‘পার্লামেন্টরী ডেমোক্রেসি’ তে, প্রেসিডেনশিয়াল ডেমোক্রসিতে নয় – কথাটা বরিস জনসন ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন।
গত কয়েক দশকে কনজারভেটিভ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার, ডেভিড ক্যামেরন ও টেরিসা মে পদত্যাগ করেছিলেন। তবে তাঁদের সবার ক্ষেত্রেই পদত্যাগের মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক ইস্যু, কিন্তু বরিস জনসনের ক্ষেত্রে পদত্যাগের কারণ ছিল মূলত তাঁর ধারাবাহিকভাবে মিথ্যাচার ও সততার অভাব যা তাঁর ভাল কাজগুলোকেও ম্লান করে দিয়েছে। এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, ‘বরিসের পদত্যাগ – এরপর কি?’
কনজারভেটিভের ভাবী নেতৃত্বের আলাপ উঠলেই সাজিদ জাভেদ, ঋষি সুনাক লিজ ট্রাস, জেরেমি হান্ট এবং নাডিম জাহাওই এর নাম শোনা যায়। কিন্তু ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, কনজারভেটিভের নেতৃত্বের লড়াইয়ে আমরা সব সময় দেখেছি শুরুতে দলের হেভি ওয়েটদের কথাই আলোচিত হয় বেশী। কে ভেবেছিল মার্গারেট থ্যাচারের মত একজন পেছনের সারির এমপি একদিন কনজারভেটিভের নেত্রী হবেন? কে ভেবেছিল জন মেজর কনজারভেটিভের নেতা হবেন? সবাই ভেবেছিল মাইকেল হ্যাসেলটাইনের মত হেভিওয়েটই হবেন কনজারভেটিভের দলনেতা। এটাই হচ্ছে কনজারভেটিভের নেতৃত্বের লড়াইয়ের ধরন।
কনজারভেটিভের নেতৃত্ব লড়াইয়ে একজন হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বি হলে তাঁকে ধরাশায়ী করার জন্যে অন্য ঘরানার একজন সেই হেভিওয়েট প্রার্থীকে নামিয়ে ফেলে। এর মধ্যে আবির্ভূত হয় মাঝারী বা লঘু ওয়েটের প্রার্থী। অর্থাৎ কনজারভেটিভের নেতৃত্বের লড়াই শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় কার কত বেশী সমর্থক আছে তার উপর নয়, কার কত কম শত্রু আছে তার উপর। দু’দিন আগেও বেন ওয়ালেস, ষ্টীভ বেকার ও পেনি মরডেন্টের কথা কেউ বলত না , তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদের মত একজন প্রতিযোগীর জেতার সম্ভাবনাই হয়তো অনেক বেশি।
আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একজন কনজারভেটিভ নেতা আমরা পেয়ে যাব ঠিকই। তবে তারপর সামনে এসে দাঁড়াবে মূল সমস্যা। এতদিন কনজারভেটিভ ও লেবার উভয় দলেরই আলোচনার কেন্দ্র ছিল বরিস জনসন। মুদ্রাস্ফীতি কিভাবে মোকাবেলা করা হবে, এই যে আয়কর কমানোর মূলা দেখানো হচ্ছে সেটির বাস্তবায়ন করতে হলে কোন খাতে খরচ কমাতে হবে – ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে কোনো আলোচনাই হচ্ছিল না।
বরিস জনসনের বিদায়ের পর কনজারভেটিভ ও লেবার উভয় দলের জন্যেই বরিসকে ঘিরে কিছুটা মুখরোচক ও প্রকারান্তরে সুবিধেজনক তর্ক বিতর্কের আর সুযোগ থাকবে না। তখন এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো অর্থপূর্ণভাবে সামাল দিতে হবে এবং লেবার ও কনজারভেটিভ উভয় দলেরই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর সমাধানে লাগসই নীতিমালা নির্ধারণ করতে হবে। তা যদি তারা না করতে পারে তাহলে বৃটিশ জনগণ ভাববে, ‘রাজা মারা হল, আর তো কিছু হল না।’
লেখক: চিকিৎসক, কলামিস্ট ও সংবাদ পাঠক।
সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন