ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টির ১৫ বছরের আমলনামা

সংগৃহীত ছবি

 

অনলাইন ডেস্ক : শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হওয়ার পেছনে জাতীয় পার্টিরও অন্যতম দায় রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তথাকথিত তিনটি নির্বাচনে এ দলটির অংশগ্রহণ শেখ হাসিনার সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দলটি। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থেকে দলটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

 

ক্ষমতার অংশীদার হয়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন জাতীয় পার্টির নেতারা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের মতো জাতীয় পার্টি শেখ হাসিনার অধীনের নির্বাচন বর্জন করলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারত। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ না নিলে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না বলে তারা মনে করেন।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সঙ্গী ছিল এই জাতীয় পার্টি। ফ্যাসিবাদের জন্য আওয়ামী লীগের মতো তাদেরও সমান দায় রয়েছে উল্লেখ করে দলটিকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত বলে তারা মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি নিষিদ্ধের দাবিও তোলা হয়েছে।

 

জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, দলীয় অনুগতদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচনের আগে দলদাস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজানোর প্রেক্ষাপটে বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। কেবল আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত কয়েকটি দল দলীয় সরকারের অধীনের ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্জনের ঘোষণা দিলেও তার দলের একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়।

 

শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় এ দলটি। ওই সময় সরকারের অংশীদার হলেও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক ছিল। পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভোট বর্জনের পক্ষে ছিলেন। তবে ওই সময় শেখ হাসিনার দাবার ঘুঁটি হয়েছিলেন এরশাদের স্ত্রী ও পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ। তার নেতৃত্বে দলের একটি অংশ শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করে ভোটে অংশ নেয়। জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মশিউর রহমান রাঙ্গা ও মুজিবুল হক চুন্নু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে দফারফা করে জাতীয় পার্টিকে ভোটে যেতে বাধ্য করে।

 

সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও নির্বাচনে অংশ নিতে জাতীয় পার্টির ওপর চাপ দেওয়া হয়। ওই সময় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ‘অসুস্থ’ দেখিয়ে সিএমএইচে ভর্তিও করা হয়। গ্রেপ্তারের চেষ্টা হলে এরশাদ আত্মহত্যা করবেন বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দলটির ওপর চাপ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এরশাদ যখন নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন, তখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে তার সঙ্গে বৈঠক করেন। সুজাতা সিং এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তখন খবর প্রকাশিত হয়।

 

তিনি ওই সময় ‘জঙ্গি উত্থান’সহ নানা জুজুর ভয়ও এরশাদকে দেখিয়েছিলেন বলে জানা যায়। নানামুখী চাপের মধ্যেও এরশাদ শেষ সময় পর্যন্ত নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও তার দলের একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। এরশাদ তার দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশ দিলেও একটি অংশ তা অমান্য করে ভোটে থেকে যায়। এরশাদ তার লালমনিরহাট-১, রংপুর-৩ ও ঢাকা-১৭ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন করলেও ‘বিধিসম্মত’ হয়নি উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা লালমনিরহাট-১ ও রংপুর-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন গ্রহণ করেননি। এরশাদের পাশাপাশি তার ভাই ও পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও নির্বাচন বর্জন করেন।

 

দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা যে তথাকথিত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করেছিলেন, সেখানেও জাতীয় পার্টিকে জায়গা দেওয়া হয়। ওই সরকারে রওশন এরশাদ, এবিএম রহুল আমীন হাওলাদার, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সালমা ইসলাম ও মুজিবুল হক চুন্নুকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। আর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়।

 

এর আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের শরিক হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৭টি আসনে জয়লাভ করে। ওই সময় জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়।

 

জানা গেছে, বিএনপিসহ দেশের বেশিরভাগ দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয় ১২টি দল। এর মধ্যে ৫টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আসন ভাগাভাগি করে। আওয়ামী লীগ ২৪৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৫৩টি আসন ছেড়ে দেয়। জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয় ৪১টি আসন। এর মধ্যে তাদের ২০ জন প্রার্থী বিনাভোটে নির্বাচিত হন। এছাড়া ভোটে জেতে ১৩টি আসনে। আওয়ামী লীগসহ ওই ৬টি দলের প্রতিনিধিত্বই সংসদে ছিল।

 

নির্বাচনে ৩৪টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরশাদ দলটির প্রধান হলেও শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রওশন এরশাদকে করা হয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। পাশাপাশি জাতীয় পার্টি নজিরবিহীনভাবে সরকারের অংশীদার হয়। দলটির একজনকে মন্ত্রী ও দুজনকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। পরে এরশাদকেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়েছিল। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা সমালোচনা হয়। ওই সময় দলটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ তকমাও পায়। দলটির নেতারা সংসদেও এ বিষয়টি একাধিকবার স্বীকার করেন। একই সঙ্গে দ্বিমুখী ভূমিকায় থাকার কারণে দেশবাসী ‘তাদের বিশ্বাস করেন না’ বলেও দলটির নেতারা সংসদে একাধিকবার স্বীকার করেছেন।

 

২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তথাকথিত সমঝোতার বিষয়টি দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু একপর্যায়ে স্বীকারও করেছেন। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি সংসদে দেওয়া এক বক্তৃতায় চুন্নু বলেন, এরশাদ না চাইলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল জাতীয় পার্টি। বেগম রওশন এরশাদ এবং আমরা কয়েকজন দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বেঈমানি ও বিদ্রোহ করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা সেই নির্বাচনে না এলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতো। শুধু লিগ্যাসির জন্য সেদিন আমরা কষ্ট করে এরশাদকে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করেছিলাম। এরশাদের সঙ্গে বেঈমানি করার সাথে চুন্নু নিজেও জড়িত ছিলেন বলে সেদিন স্বীকার করেন।

 

সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির পক্ষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করার ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সব সময় আলোচিত ছিলেন। তারা দুজন জাতীয় পার্টিতে ‘আওয়ামীপন্থি’ হিসেবে পরিচিত। ওয়ান ইলেভেনের আগে-পরে এই দুই নেতা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সম্পর্কের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তাদের সঙ্গে মুজিবুল হক চুন্নু, রুহুল আমীন হাওলাদারসহ কয়েকজন যুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের শ্যালক পরিচয়ে চুন্নু এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন বলে জানা গেছে।

 

এদিকে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নেয়। এরশাদের ভাই ও পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় থাকলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। তিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হন। নির্বাচনের পর এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হন।

 

এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা ও জিএম কাদের উপনেতা হন। জাপার চেয়ারম্যান হন জিএম কাদের। এরই ধারাবাহিকতায় জিএম কাদের সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন। অবশ্য নির্বাচনের আগে তিনি নির্বাচনে ‘না যাওয়ার’ ঘোষণাসহ সরকারের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ভারত সফরের পর মুখে কুলুপ আঁটেন।

 

সফর শেষে দেশে ফিরে তিনি বলেন, সেখানে কার কার সঙ্গে এবং কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সে ব্যাপারে অনুমতি ছাড়া তিনি কিছু বলতে পারবেন না। ভারত বাংলাদেশে একটি সুন্দর নির্বাচন দেখতে চায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। পরে আগের দুটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনেও জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপা অংশ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিরোধী দলের আসনে বসে। রওশন এরশাদ ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রধান সিপাহসালার হলেও ২০২৪ সালের নির্বাচন থেকে তিনি ছিটকে পড়েন। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার কাছে তদবির করেও আশানুরূপ সাড়া পাননি।

জাপা নিষিদ্ধের দাবি

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার পর এখন তার প্রধান দোসর জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধসহ তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে। গত মে মাসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের রংপুর সফরকে কেন্দ্র করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম এ দাবির বিষয়টি সামনে আনেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দোসর আখ্যায়িত করে বলেন, বিরোধী দলের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করে আওয়ামী লীগকে সরকারি দলের বৈধতা দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। তারা অবৈধ সরকারি দলের বিরোধিতার নামে ভণ্ডামি করত।

 

তারপর নির্বাচনের ঠিক কয়েকদিন আগে জিএম কাদের ভারতে গিয়ে নেগোসিয়েশন করে ডামি বিরোধী দল সেজে বসে থাকতেন। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে যে কনসিক্যুয়েন্স (পরিণতি) হয়েছে তা জাতীয় পার্টিরও হওয়া উচিত। এর আগে গণঅধিকার পরিষদ জাতীয় পার্টির নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়ে ইসিতে আবেদন দিয়েছিল। এদিকে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুটি বৈঠকে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেও ছাত্র-জনতার দাবির মুখে ওই দলটিকে প্রধান উপদেষ্টার আর কোনো কর্মসূচিতে ডাকা হয়নি। সংস্কার প্রক্রিয়া থেকেও দলটিকে বাইরে রাখা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যায়িত করে ছাত্র-জনতা দলটির কার্যালয়েও অগ্নিসংযোগ করেছে।

বিশেষজ্ঞ মত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ বলেন, জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদের দোসর এবং সুবিধাভোগী এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে। তাদের দায় এড়ানোর কোনো ‍সুযোগ নেই। বরং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার। অন্য দলগুলোর মতো জাতীয় পার্টিও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করলে ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভিন্ন হতো কি না জানি না। তবে নিঃসন্দেহে জনতার শক্তি বৃদ্ধি পেত।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ যতটুকু দায়ী, জাতীয় পার্টির দায় তার তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে গত তিনটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা তারা করেছে। তারা সরকারকে সহযোগিতা করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করেছে। জাতীয় পার্টিকে আইনি ও বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার আওতায় নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

জাতীয় পার্টির নেতাদের অভিযোগ খণ্ড

মনোনয়ন, পদ-বাণিজ্য ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে। মনোনয়ন-বাণিজ্যে তার দলের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নাজমিন সুলতানা তুলি এ মামলা করেন। জিএম কাদের ছাড়াও তার স্ত্রী শেরিফা কাদের ও মহাসচিব চুন্নুসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়। জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে সংরক্ষিত আসনের এমপি পদ বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তিনি প্রভাব খাটিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদে স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি করেন।

 

দলের অন্যদের মতামত উপেক্ষা করে ২০২৪ সালের দ্বাদশ নির্বাচনে স্ত্রীকে ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে মনোনয়নও দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে। দুদক সূত্র জানায়, জিএম কাদের নামে-বেনামে সিঙ্গাপুর, লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির এক পোলিং এজেন্টকে মারধর করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে জিএম কাদের এবং তার স্ত্রীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে গত মাসের শুরুতে একটি মামলা হয়। প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগের ঘটনায় লালমনিরহাট সদর থানায় এ মামলাটি করেন খলিলুর রহমান নামের ওই পোলিং এজেন্ট। কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলীর আবেদনে ২০২২ সালেও দলীয় মনোনয়ন-বাণিজ্য করে অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগ তদন্ত ক‌রে জিএম কা‌দেরের বিরু‌দ্ধে ব‌্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আদেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত।

 

রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাড়ে ১৫ বছর রাজনীতির মাঠে খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমপি থেকে শুরু করে মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত সব স্বাদই নিয়েছেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনে মুজিবুল হক চুন্নু তার নির্বাচনি পোস্টারে নিজেকে ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হন।

 

গত বছরের ৬ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় মুজিবুল হক চুন্নুকে আসামি করা হয়। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বাড়ি দখল ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। পার্টির সাবেক মহাসচিব তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রত্নার বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, কলাপাড়া, দুমকি, বেতাগীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি দখলের অভিযোগ রয়েছে। এই অবৈধ দখল পোক্ত করতে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ ভাণ্ডারে বড় অঙ্কের ডোনেশন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অবৈধ জমি দেখিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সূএ:বার্তাবাজার ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ইসলাম প্রচারে কেউ বাধা দিলে প্রতিরোধ করা হবে : মাসুদ সাঈদী

» সীমান্তে আগ্রাসন চালানো হলে আমরা সীমান্তে লং মার্চ ঘোষণা করব: নাহিদ ইসলাম

» ইসলামিক এনজিওগুলোকে সামাজিক ব্যবসায় এগিয়ে আসার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

» উপাচার্যদের হাতে-পায়ে ধরে দায়িত্ব দিয়েছি, কেউ স্বেচ্ছায় নেননি : শিক্ষা উপদেষ্টা

» এই বিপ্লব সফল হয়েছে মানুষের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে : আসিফ মাহমুদ

» ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিই জিতবে : মাহমুদুর রহমান মান্না

» স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে তরুণীকে শ্বাসরোধে হত্যা

» আবারও ইয়েমেনি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বন্ধ ইসরায়েলি বিমানবন্দর

» দুর্বৃত্তের গুলিতে যুবদলকর্মী নিহত

» ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে দুটি যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষে ৮ জন আহত

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ফ্যাসিবাদের দোসর জাতীয় পার্টির ১৫ বছরের আমলনামা

সংগৃহীত ছবি

 

অনলাইন ডেস্ক : শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হওয়ার পেছনে জাতীয় পার্টিরও অন্যতম দায় রয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তথাকথিত তিনটি নির্বাচনে এ দলটির অংশগ্রহণ শেখ হাসিনার সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দলটি। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থেকে দলটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

 

ক্ষমতার অংশীদার হয়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন জাতীয় পার্টির নেতারা। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের মতো জাতীয় পার্টি শেখ হাসিনার অধীনের নির্বাচন বর্জন করলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারত। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ না নিলে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না বলে তারা মনে করেন।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সঙ্গী ছিল এই জাতীয় পার্টি। ফ্যাসিবাদের জন্য আওয়ামী লীগের মতো তাদেরও সমান দায় রয়েছে উল্লেখ করে দলটিকে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত বলে তারা মন্তব্য করেছেন। কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টিকে বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি নিষিদ্ধের দাবিও তোলা হয়েছে।

 

জানা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, দলীয় অনুগতদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচনের আগে দলদাস কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজানোর প্রেক্ষাপটে বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। কেবল আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত কয়েকটি দল দলীয় সরকারের অধীনের ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বর্জনের ঘোষণা দিলেও তার দলের একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়।

 

শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনেও জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় এ দলটি। ওই সময় সরকারের অংশীদার হলেও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক ছিল। পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভোট বর্জনের পক্ষে ছিলেন। তবে ওই সময় শেখ হাসিনার দাবার ঘুঁটি হয়েছিলেন এরশাদের স্ত্রী ও পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদ। তার নেতৃত্বে দলের একটি অংশ শেখ হাসিনার সঙ্গে আঁতাত করে ভোটে অংশ নেয়। জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, মশিউর রহমান রাঙ্গা ও মুজিবুল হক চুন্নু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে দফারফা করে জাতীয় পার্টিকে ভোটে যেতে বাধ্য করে।

 

সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও নির্বাচনে অংশ নিতে জাতীয় পার্টির ওপর চাপ দেওয়া হয়। ওই সময় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে ‘অসুস্থ’ দেখিয়ে সিএমএইচে ভর্তিও করা হয়। গ্রেপ্তারের চেষ্টা হলে এরশাদ আত্মহত্যা করবেন বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য দলটির ওপর চাপ ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এরশাদ যখন নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন, তখন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে এসে তার সঙ্গে বৈঠক করেন। সুজাতা সিং এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তখন খবর প্রকাশিত হয়।

 

তিনি ওই সময় ‘জঙ্গি উত্থান’সহ নানা জুজুর ভয়ও এরশাদকে দেখিয়েছিলেন বলে জানা যায়। নানামুখী চাপের মধ্যেও এরশাদ শেষ সময় পর্যন্ত নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেও তার দলের একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। এরশাদ তার দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশ দিলেও একটি অংশ তা অমান্য করে ভোটে থেকে যায়। এরশাদ তার লালমনিরহাট-১, রংপুর-৩ ও ঢাকা-১৭ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন করলেও ‘বিধিসম্মত’ হয়নি উল্লেখ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা লালমনিরহাট-১ ও রংপুর-৩ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আবেদন গ্রহণ করেননি। এরশাদের পাশাপাশি তার ভাই ও পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও নির্বাচন বর্জন করেন।

 

দশম জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা যে তথাকথিত ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ গঠন করেছিলেন, সেখানেও জাতীয় পার্টিকে জায়গা দেওয়া হয়। ওই সরকারে রওশন এরশাদ, এবিএম রহুল আমীন হাওলাদার, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, সালমা ইসলাম ও মুজিবুল হক চুন্নুকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়। আর জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়।

 

এর আগে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের শরিক হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৭টি আসনে জয়লাভ করে। ওই সময় জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়।

 

জানা গেছে, বিএনপিসহ দেশের বেশিরভাগ দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয় ১২টি দল। এর মধ্যে ৫টির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আসন ভাগাভাগি করে। আওয়ামী লীগ ২৪৭টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৫৩টি আসন ছেড়ে দেয়। জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয় ৪১টি আসন। এর মধ্যে তাদের ২০ জন প্রার্থী বিনাভোটে নির্বাচিত হন। এছাড়া ভোটে জেতে ১৩টি আসনে। আওয়ামী লীগসহ ওই ৬টি দলের প্রতিনিধিত্বই সংসদে ছিল।

 

নির্বাচনে ৩৪টি আসন পেয়ে জাতীয় পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরশাদ দলটির প্রধান হলেও শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রওশন এরশাদকে করা হয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। পাশাপাশি জাতীয় পার্টি নজিরবিহীনভাবে সরকারের অংশীদার হয়। দলটির একজনকে মন্ত্রী ও দুজনকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। পরে এরশাদকেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত করা হয়েছিল। একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দলে থাকার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা সমালোচনা হয়। ওই সময় দলটি ‘গৃহপালিত বিরোধী দলের’ তকমাও পায়। দলটির নেতারা সংসদেও এ বিষয়টি একাধিকবার স্বীকার করেন। একই সঙ্গে দ্বিমুখী ভূমিকায় থাকার কারণে দেশবাসী ‘তাদের বিশ্বাস করেন না’ বলেও দলটির নেতারা সংসদে একাধিকবার স্বীকার করেছেন।

 

২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তথাকথিত সমঝোতার বিষয়টি দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু একপর্যায়ে স্বীকারও করেছেন। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি সংসদে দেওয়া এক বক্তৃতায় চুন্নু বলেন, এরশাদ না চাইলেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল জাতীয় পার্টি। বেগম রওশন এরশাদ এবং আমরা কয়েকজন দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বেঈমানি ও বিদ্রোহ করে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা সেই নির্বাচনে না এলে দেশে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হতো। শুধু লিগ্যাসির জন্য সেদিন আমরা কষ্ট করে এরশাদকে নির্বাচন করার ব্যবস্থা করেছিলাম। এরশাদের সঙ্গে বেঈমানি করার সাথে চুন্নু নিজেও জড়িত ছিলেন বলে সেদিন স্বীকার করেন।

 

সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় পার্টির পক্ষে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করার ক্ষেত্রে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সব সময় আলোচিত ছিলেন। তারা দুজন জাতীয় পার্টিতে ‘আওয়ামীপন্থি’ হিসেবে পরিচিত। ওয়ান ইলেভেনের আগে-পরে এই দুই নেতা আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সম্পর্কের অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে তাদের সঙ্গে মুজিবুল হক চুন্নু, রুহুল আমীন হাওলাদারসহ কয়েকজন যুক্ত হয়েছিলেন বলে জানা গেছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের শ্যালক পরিচয়ে চুন্নু এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন বলে জানা গেছে।

 

এদিকে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নেয়। এরশাদের ভাই ও পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচকের ভূমিকায় থাকলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে। তিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হন। নির্বাচনের পর এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা হন।

 

এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন এরশাদ বিরোধীদলীয় নেতা ও জিএম কাদের উপনেতা হন। জাপার চেয়ারম্যান হন জিএম কাদের। এরই ধারাবাহিকতায় জিএম কাদের সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন। অবশ্য নির্বাচনের আগে তিনি নির্বাচনে ‘না যাওয়ার’ ঘোষণাসহ সরকারের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ভারত সফরের পর মুখে কুলুপ আঁটেন।

 

সফর শেষে দেশে ফিরে তিনি বলেন, সেখানে কার কার সঙ্গে এবং কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সে ব্যাপারে অনুমতি ছাড়া তিনি কিছু বলতে পারবেন না। ভারত বাংলাদেশে একটি সুন্দর নির্বাচন দেখতে চায় বলে তিনি মন্তব্য করেন। পরে আগের দুটি নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনেও জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাপা অংশ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিরোধী দলের আসনে বসে। রওশন এরশাদ ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রধান সিপাহসালার হলেও ২০২৪ সালের নির্বাচন থেকে তিনি ছিটকে পড়েন। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার কাছে তদবির করেও আশানুরূপ সাড়া পাননি।

জাপা নিষিদ্ধের দাবি

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার পর এখন তার প্রধান দোসর জাতীয় পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধসহ তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে। গত মে মাসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের রংপুর সফরকে কেন্দ্র করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম এ দাবির বিষয়টি সামনে আনেন। ওই সময় তিনি জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দোসর আখ্যায়িত করে বলেন, বিরোধী দলের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করে আওয়ামী লীগকে সরকারি দলের বৈধতা দিয়েছিল জাতীয় পার্টি। তারা অবৈধ সরকারি দলের বিরোধিতার নামে ভণ্ডামি করত।

 

তারপর নির্বাচনের ঠিক কয়েকদিন আগে জিএম কাদের ভারতে গিয়ে নেগোসিয়েশন করে ডামি বিরোধী দল সেজে বসে থাকতেন। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে যে কনসিক্যুয়েন্স (পরিণতি) হয়েছে তা জাতীয় পার্টিরও হওয়া উচিত। এর আগে গণঅধিকার পরিষদ জাতীয় পার্টির নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়ে ইসিতে আবেদন দিয়েছিল। এদিকে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দুটি বৈঠকে জাতীয় পার্টি অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেও ছাত্র-জনতার দাবির মুখে ওই দলটিকে প্রধান উপদেষ্টার আর কোনো কর্মসূচিতে ডাকা হয়নি। সংস্কার প্রক্রিয়া থেকেও দলটিকে বাইরে রাখা হয়েছে। ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যায়িত করে ছাত্র-জনতা দলটির কার্যালয়েও অগ্নিসংযোগ করেছে।

বিশেষজ্ঞ মত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ বলেন, জাতীয় পার্টি ফ্যাসিবাদের দোসর এবং সুবিধাভোগী এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে দীর্ঘায়িত করতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছে। তাদের দায় এড়ানোর কোনো ‍সুযোগ নেই। বরং ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে তাদেরও আইনের আওতায় আনা দরকার। অন্য দলগুলোর মতো জাতীয় পার্টিও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করলে ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভিন্ন হতো কি না জানি না। তবে নিঃসন্দেহে জনতার শক্তি বৃদ্ধি পেত।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ যতটুকু দায়ী, জাতীয় পার্টির দায় তার তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে গত তিনটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে সরকারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা তারা করেছে। তারা সরকারকে সহযোগিতা করে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করেছে। জাতীয় পার্টিকে আইনি ও বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার আওতায় নেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

জাতীয় পার্টির নেতাদের অভিযোগ খণ্ড

মনোনয়ন, পদ-বাণিজ্য ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে। মনোনয়ন-বাণিজ্যে তার দলের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নাজমিন সুলতানা তুলি এ মামলা করেন। জিএম কাদের ছাড়াও তার স্ত্রী শেরিফা কাদের ও মহাসচিব চুন্নুসহ ১০ জনকে আসামি করা হয়। জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে সংরক্ষিত আসনের এমপি পদ বিপুল অর্থের বিনিময়ে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তিনি প্রভাব খাটিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদে স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি করেন।

 

দলের অন্যদের মতামত উপেক্ষা করে ২০২৪ সালের দ্বাদশ নির্বাচনে স্ত্রীকে ঢাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে মনোনয়নও দেন। দুর্নীতি দমন কমিশন জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে। দুদক সূত্র জানায়, জিএম কাদের নামে-বেনামে সিঙ্গাপুর, লন্ডন ও অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির এক পোলিং এজেন্টকে মারধর করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগে জিএম কাদের এবং তার স্ত্রীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে গত মাসের শুরুতে একটি মামলা হয়। প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগের ঘটনায় লালমনিরহাট সদর থানায় এ মামলাটি করেন খলিলুর রহমান নামের ওই পোলিং এজেন্ট। কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মো. ইদ্রিস আলীর আবেদনে ২০২২ সালেও দলীয় মনোনয়ন-বাণিজ্য করে অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগ তদন্ত ক‌রে জিএম কা‌দেরের বিরু‌দ্ধে ব‌্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আদেশ দিয়েছিল উচ্চ আদালত।

 

রাজনীতিতে আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সাড়ে ১৫ বছর রাজনীতির মাঠে খলনায়কের ভূমিকায় ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমপি থেকে শুরু করে মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত সব স্বাদই নিয়েছেন। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনে মুজিবুল হক চুন্নু তার নির্বাচনি পোস্টারে নিজেকে ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত হন।

 

গত বছরের ৬ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় মুজিবুল হক চুন্নুকে আসামি করা হয়। জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বাড়ি দখল ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। পার্টির সাবেক মহাসচিব তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রত্নার বিরুদ্ধে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, কলাপাড়া, দুমকি, বেতাগীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরকারি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি দখলের অভিযোগ রয়েছে। এই অবৈধ দখল পোক্ত করতে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ত্রাণ ভাণ্ডারে বড় অঙ্কের ডোনেশন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অবৈধ জমি দেখিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সূএ:বার্তাবাজার ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com