সংগৃহীত ছবি
মোফাজ্জল করিম :লিখতে বসে ভাবছিলাম কী নিয়ে লিখব, হঠাৎই খেয়াল হলো লেখাটি যেদিন ছাপা হবে, সেদিন ফেব্রুয়ারি মাসের পয়লা তারিখ। ফেব্রুয়ারি মাস—আমাদের ভাষার মাস, আশার মাস, ভালোবাসার মাস। আজ থেকে ৭৩ বছর আগে বাঙালি জাতির যে উজ্জীবন হয়েছিল ১৯৫২-র ফেব্রুয়ারি মাসে, সেটাই আলোকবর্তিকা হয়ে পরবর্তীকালে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে এই জাতিকে মাথা উঁচু করে পথ চলতে শিখিয়েছিল। আজ সারা বিশ্বে ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
কেন? এত মাস, এত দিন থাকতে এই দিনটিকেই বিশ্ববাসী কেন বেছে নিল মাতৃভাষা দিবসের অর্ঘ্যদানের জন্য? এর উত্তর বাংলা ভাষাভাষী সব মানুষেরই জানা আছে। কারণ তারাই ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ বুকের রক্তে রঞ্জিত করেছিল মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য। সেই থেকে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি?’ সেই থেকে ‘ভুলব না, ভুলব না, ভুলব না সেই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই—এই দাবিতে ধর্মঘট/বরকত-সালামের রক্তে লাল ঢাকা রাজপথ।’
সেই ১৯৫২, সেই একুশে ফেব্রুয়ারি। আজ থেকে ৭৩ বছর আগে আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। স্কুলের নাম বগুড়া জিলা স্কুল। যেমন লেখাপড়ায়, তেমনি খেলাধুলা-সংস্কৃতি চর্চায় দারুণ অগ্রসর ছিল এই স্কুল।
আমার আব্বা সরকারি চাকরিজনিত কারণে তখন সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে বদলি হয়ে উত্তরবঙ্গের এই জেলা শহরে এসেছেন। সেই সুবাদে আমি ও আমার অগ্রজ লেখাপড়া-গানবাজনা-নাটক-ডিবেটিং-স্কাউটিং ইত্যাদির পীঠস্থান বগুড়া জিলা স্কুলের ছাত্র। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বগুড়া ছিল সামনের কাতারের সৈনিক। এর একটি অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বোধ হয়, ওই শহর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের শহর। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ঢাকায় ছাত্রদের আত্মাহুতির পর সারা দেশেই লেখাপড়া বলতে গেলে লাটে উঠেছিল।
আমাদের সময় কাটত শহরের কেন্দ্রবিন্দু সাতমাথা ও তার আশপাশের রাজপথে মিটিংয়ে-মিছিলে। তখনকার দু-একটা স্লোগান এখনো মনে আছে : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই/পুলিশি জুলুম চলবে না। (অমুকের) কল্লা চাই। (অমুকের) চামড়া তুলে নেব আমরা ইত্যাদি। একুশের গোলাগুলির পর সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, আন্দোলন এতটাই দুর্বার হয়ে উঠেছিল যে সরকার আর দ্বিতীয়বার গুলিবর্ষণের সাহস পায়নি। তখন দল-মত-নির্বিশেষে সবাই ভাষা আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। হ্যাঁ, ব্যতিক্রম ছিল শুধু সরকারের সুবিধাভোগী উর্দুভাষী মুষ্টিমেয় কিছু পা-চাটার দল। কিন্তু সংখ্যায় তারা ছিল নগণ্য। অবশেষে পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশের) ন্যায্য দাবির কাছে পাকিস্তান সরকার মাথা নত করতে বাধ্য হলো। বছর দুয়েকের মধ্যে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করল। আর পূর্ববঙ্গবাসী সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিল : বাঙালি জাতি মাথা নত করতে জানে না।
১৯৪৭-এ পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে নব্য স্বাধীন দেশটিতে পশ্চিমের সংখ্যালঘিষ্ঠ শাসকরা যে বৈষম্যের বেড়াজালে পূর্ববঙ্গকে বেঁধে রেখেছিল, তার বিরুদ্ধে ধূমায়িত অসন্তোষ এ অঞ্চলের শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে দীর্ঘদিন জমা হতে হতে একাত্তরে তা মুক্তিযুদ্ধের আকারে বিস্ফোরিত হলো, যে যুদ্ধ বহুকাল পর বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। এই ঐক্য ছিল বায়ান্নতে, আবার এই ঐক্য দেখা গেল একাত্তরে। এর ফল ছিল অমোঘ, অনিবার্য। এক দানবীয় পরাশক্তিকে পরাজিত করে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো একাত্তরে।
তারপর? তার পরের ইতিহাস অম্লমধুর। হওয়ার কথা ছিল, শুধুই মধুর। তা না হয়ে এত কষ্টার্জিত স্বাধীনতার স্বাদ তেতো লাগতে শুরু করল অচিরেই। কেন? কার দোষে? এর কারণ হয়তো অনেক। দেশবাসী অনেকের উদগ্র হিংসা, লোভ-লালসা, সর্বোপরি সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। যে ঐক্য এ জাতির অমূল্য সম্পদ ছিল বায়ান্নতে, একাত্তরে, দ্রুতই তা ক্ষীয়মাণ হতে লাগল। তার কারণও বোধ হয় দ্রুত নির্ধন থেকে ধনী হয়ে যাওয়ার দুর্মর আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষমতার মসনদে আরোহণের জায়েজ-নাজায়েজ পন্থা অবলম্বন।
তালিকা দীর্ঘ না করে এটুকু বলা যায়, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে আমরা বলতে গেলে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করিনি। এমনকি যে ভাষার জন্য আমরা বিশ্বসভায় একটি চির উজ্জ্বল, চিরভাস্বর আসন লাভ করেছি, আমাদের সেই চির অভিমানী বাংলা ভাষার জন্যও তো আমাদের যা করা অবশ্য কর্তব্য ছিল, তা আমরা করিনি। বরং বলতে দ্বিধা নেই, পাকিস্তানি আমলে বাংলা ভাষার উত্কর্ষ সাধনের জন্য, মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য যেটুকু করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পর গত অর্ধশতাব্দীতে সেটুকুও আমরা করতে পারিনি। (বলা উচিত, করিনি। কারণ আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের রাষ্ট্রভাষার জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলে কেউ নিশ্চয়ই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।)
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা একটি বিষয়ে অনেক আদেশ-নির্দেশ, অনেক সিদ্ধান্ত, অনেক দাবিদাওয়ার কথা শুনেছি। সেটা কী? সেটা হচ্ছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার সিদ্ধান্ত ও তা বাস্তবায়নের জন্য আদেশ-নির্দেশ, সভা-সমিতি-সেমিনার ইত্যাদি। এতে যে একেবারে কোনো কাজ হয়নি, তা বলা যাবে না। যেমন স্বাধীনতার আগে সরকারি অফিস-আদালতে যেখানে বাংলা ভাষা ছিল অচ্ছুত, অস্পৃশ্য, আজ অর্ধশতাব্দী পর তা নিজ মহিমায় সুপ্রতিষ্ঠিত। এখন কোনো সরকারি অফিসে আপনি বাংলায় একটি দরখাস্ত লিখে দাখিল করলে কেউ সেটা ফেরত দেবেন না। তবে যিনি ওই দরখাস্তের ওপর ব্যবস্থা নেবেন, তাঁর মনমানসিকতা কতটুকু বদলেছে গত ৫০ বছরে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। কারো চলনে-বলনে, আচার-আচরণে সাহেবিয়ানা দেখলে অনেকেই এখনো শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়েন। আর এর উল্টোটা, যেমন বাঙালি পোশাক-আশাক এবং আঞ্চলিক ভাষা বা বাংলা ভাষা দেখলে-শুনলে কেউ কেউ মুখে না বললেও মনে মনে বলেন ‘লোকটা তো আস্ত ক্ষ্যাত’। অবশ্যই এটা হীনম্মন্যতা। এদের প্রতি আমার বিনীত প্রশ্ন : যদি কোনো অদৃশ্য ক্ষমতাবলে আপনার মরহুম দাদাজি বা নানাজি কবর থেকে উঠে এসে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে কুশল জিজ্ঞেস করেন এই বলে : বাই, বালা আছোনি? (ভাই, ভালো আছ নাকি?), তখন তাঁর পরনের লুঙ্গি আর ঘাড়ের গামছা দেখে এবং মুখের জবান শুনে কি আপনার ‘টাসকি’ লেগে যাবে? এবং মুখে বলবেন : ‘হু আর ইউ ম্যান? গেট আউট ফ্রম হিয়ার, অ্যান্ড গেট লস্ট।’
স্বাধীনতার পর কখনো কখনো দেখেছি রাস্তার পাশের দোকানপাটের সাইনবোর্ডের ইংরেজি লেখা পাল্টে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার হিড়িক। এই অভিযানও জোরেশোরে চলল কিছুদিন। তারপর যথা পূর্বং তথা পরং। এখন ঢাকা শহরে ইংরেজি সাইনবোর্ড বেশি, না বাংলা সাইনবোর্ড, বলা মুশকিল। এখন আর কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামান বলে মনে হয় না।
তবে একটা বিষয় নিয়ে অবশ্যই মাথা ঘামাতে হবে। তা হচ্ছে বাংলা বানান। আমাদের শৈশবে-কৈশোরে পাঠশালায় এবং হাই স্কুলের নিচের ক্লাসে বাংলা বানানের জন্য শিক্ষক মহোদয়দের বকুনি-কানমলা এবং কখনো কখনো বেত্রাঘাত সহ্য করে আমরা বাড়ী (বাড়ি নয়) ফিরতাম, আর ভোরবেলা ‘পাখী সব করে রব…’ আমাদের ঘুম ভাঙাত। আর এখন? এখনো শিশু-কিশোররা স্কুল ছুটির পর বাড়ি (বাড়ী নয়) ফেরে, এখনো পাখিরা (আমাদের সময়ের পাখীদের দীর্ঘ ইকার হয়তো সময়ের বিবর্তনে হ্রস্ব হয়ে গেছে, বয়সের ছাপ শুধু মানুষ নয়, পশুপাখিদের ওপরও নিশ্চয়ই পড়ে!) কলরব করে আমাদের ঘুম ভাঙায়।
আমাদের চাকরিজীবনে যখন বাংলায় অফিসের ফাইলে নোট লেখার প্রচলন শুরু হলো, তখন বাংলায় বানানের বেলা শুরু হলো এক ধরনের অরাজকতা। কেউ কেউ রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিত : আরে, দন্ত্য ন মূর্ধন্য ণ একটা হলেই হলো। যেটাই হোক, বাংলা বানানের প্রমিতীকরণের ব্যাপারে তর্ক চলে না। ভাষার কৌলীন্য, সৌন্দর্য ইত্যাদি রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার, যারা ভাষা ব্যবহার করি, তাদের। আর এ বিষয়ে অর্থাৎ প্রমিতীকরণের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিশ্চয়ই তাদের দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। এককথায়, আমরা আমাদের প্রাণের ভাষার মর্যাদাহানিকর কিছু যাতে না ঘটে, সে ব্যাপারে অবশ্যই আমরা সচেতন থাকব।
একটু লঘু সুরে লেখাটি শেষ করতে চাই পাঠকের সানুগ্রহ অনুমতি নিয়ে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আমি তখন সচিবালয়ে নৌপরিবহন ও বিমান মন্ত্রণালয়ের উপসচিব। আমার অধীনে একজন কেরানি ছিলেন, যাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ৩০-৩২ বছর। কাজেকর্মে খুবই নিষ্ঠাবান ও সৎ। এই কর্মচারীটির একটি ‘নোটের’ গল্প আমি অনেকবার অনেকের কাছে করেছি। একদিন ফাইলে তাঁর লেখা একটি মন্তব্য পড়ে আমি একা একাই খুব হেসেছিলাম। তখন আমরা সবাই ইংরেজি বাদ দিয়ে বাংলায় লেখালেখি শুরু করেছি। তা সেদিন আমার ওই সহকর্মী তাঁর একটি ফাইলের নোট লেখা শুরু করেন এভাবে : ‘ভূতপূর্ব পৃষ্ঠায় সচিব মহোদয়ের নির্দেশ দ্রষ্টব্য’।…জানি না ভদ্রলোক কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন। তবে ইহধামেই থাকুন আর ভূতপূর্বই হয়ে গিয়ে থাকুন, দোয়া করি আল্লাহপাক তাঁকে ভালো রাখুন। আরো দোয়া করি সব ভাষাশহীদ, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, চব্বিশের জুলাই-আগস্ট শহীদদের জন্য—আল্লাহপাক তাঁদের সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন!
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim [email protected] সূএ: বাংলাদেশ প্র্রতিদিন