প্রবাসীদের ভাবনায় বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও নির্বাচন

ছবি:সংগৃহীত

 

হাসিনা আকতার নিগার :বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা আর বাংলা মায়ের মাটির টান কতটা প্রবল- তা বোধ করি প্রতিটা বাঙালি প্রবাসী বুঝেন প্রতিনিয়ত। উন্নত দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি যতই চাকচিক্যময় হোক না কেন, নিজের দেশের হাজারো সমস্যার কাছে তা অনেক সময় ম্লান হয়ে যায়। কারণ নিজের দেশ নিজেরই। এ ভাবনা বিদেশে অবস্থানকারী শুধু বাঙালি নয় অন্যদেশের নাগরিকদের মাঝেও দেখা যায়। পরিবার পরিজনের পরেও দেশের জন্য যে ভালোবাসা তার পরিধি কতটা বিস্তৃত তা বোধ করি কোন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। উন্নত দেশের জীবন ব্যবস্থা একটা নিয়মের ছকে বাঁধা। এখানে সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এতটাই নিয়মতান্ত্রিক সুনিশ্চিত যে তার কারণে মানুষ দেশের প্রতি ভালোবাসাকে অবদমিত করে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয় প্রবাসী হয়ে। প্রবাসে বেড়ে ওঠা সন্তানদের নিশ্চয়তার জীবনকে শ্রেয় মনে করে তাদের আইন ও সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর জন্য। অন্যদিকে, বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি পরিবেশ পরিস্থিতি, সামাজিক নিরাপত্তা, অনিয়ম, দুর্নীতি  নিয়ে মিডিয়া বা আত্মীয়-স্বজন থেকে যতটা জানে তাতে স্বস্তিবোধ করে না। তারা দেশের এসব অনিয়ম, রাজনৈতিক অস্বাভাবিকতাকে কল্পনাও করতে পারে না তাদের বিদেশের জন্ম নেয়া ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে। এখানকার ছেলে-মেয়েরা একটা নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে বড় হয়। রাজনৈতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা এখানে নেই। যা বাংলাদেশ দেখা দিয়েছে বিশেষভাবে।

 

বর্তমানে এ সমস্যাটা প্রকট হবার কারণ হল, দীর্ঘ সময় ধরে যারা বিদেশে থাকেন তারা কিংবা তাদের সন্তানদের কাছে বাংলাদেশের  চিত্রটা বরাবরই আশাহীন অনিশ্চিত জীবন হিসেবে তুলে ধরা হয়। দেশের খবর জানতে চাইলে আত্মীয় পরিজন বা বন্ধুদের মুখে হাতাশা আর শঙ্কার কথাই শোনা যায়। তার উপরে বিদেশের যারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি করেন তাদের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কর্মকাণ্ডকে কোনো যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না। অন্যের দেশে বসে যখন নিজের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আগমনে বা অবস্থানকালীন সময়ে প্রতিবাদের নামে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তা বিশ্বের কাছে জাতিকে লজ্জিত করে। তারা ভুলে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশসমূহের দৃষ্টি রয়েছে। এসব প্রবাসীরা নিজেরদের সহবত থাকার শিষ্টাচারও মনে রাখে না।

 

আর এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় সাধারণ প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবনাটা তথৈবচ। আওয়ামী সরকারের দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা থাকার কারণে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখন অনেকটাই দৃশ্যত। তবে করোনার আপদকালীন সময় আর রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অর্থনৈতিক বাজারে সারা বিশ্বে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তার প্রভাব বাংলাদেশেও চলমান তা শতভাগ সত্য। তবে উন্নত বিশ্বের সরকার এ সমস্যার সমাধানের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাদের  জনগণ যেন স্বাভাবিকভাবে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারে তার জন্য। যার ফলে এসব দেশের সাধারণ জনগণ রাজনীতির নানা মেরুকরণ নিয়ে ততটা ভাবেন না- কারণ তারা জানে সংকটকালীন সময়কে সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

 

কারণ বাংলাদেশে বাজার সিন্ডিকেটের কাছে সরকার জিম্মী। এতে করে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা যে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে তা মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমেই বোধগম্য হয়। সরকার থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হলেও তা দিয়ে বাজার সিন্ডিকেটকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্তরালের কারণ হল অনিয়ম ও দুর্নীতি। প্রাত্যহিক জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। ফলশ্রুতিতে এখন মানুষের কাছে জীবন ও জীবিকাই বেশি  প্রাধান্য পায়। সরকার, ভোট বা  রাজনীতি নয়। তারা নির্বাচন, ভোট নিয়ে কথা বলতে নারাজ। কোন সরকারই জনগণের কথা শুনতে চায় না বলে তার ভোট দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে ভাবে না। তারা জানে তারা ভোট না দিলেও ভোট দেওয়া হয়ে যায়। আর যার পেশিশক্তিসহ নানা কারিশমা আছে সে সরকার হবে। এটা এখন কোন আজব বিষয় নয়।

 

জনগণের রাজনৈতিক চিন্তা ধারণাতে এ উন্নাসিকতা ভাব দেশের উন্নয়নে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তা দৃশ্যত না হলেও এর ক্ষতিকর দিকটা বুঝতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো সময়ের প্রবাহে। এর পাশাপাশি জনগণের ভোট বিমুখ হবার কারণ হলো ভোট প্রদান যে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার তা ছিনিয়ে নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো ১/১১  নির্বাচনের পরবর্তী সময় থেকে। অন্যদিকে, দীর্ঘ সময় ধরে এক দলের ক্ষমতায় থাকাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে বটে তবে সে উন্নয়নকে মানবিক উন্নয়নে উত্তরণ করা সম্ভব হয়নি সরকারের নাম ব্যবহারকারী আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনিয়ম ও দুর্নীতিবাজদের কারণে।

 

প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চাটা অনেকটা পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তা বলে প্রতীয়মান হয়। যা তারা এদেশের রাজনৈতিক চিন্তার সাথে মেলাতে পারেন না। উন্নত দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনগতভাবে জনগণের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ শতভাগ নিশ্চিত। এখানে কেউ কারো ভোট দিয়ে দেবে এমন চিন্তা করা অকল্পনীয়। রাতের ভোট তো হাস্যকর বিষয়। একজন বা একটি দল বছরের পর বছর ক্ষমতা থাকার বিধানও নেই এখানে। সংবিধানকে তারা অনুসরণ করে প্রতিটি পর্যায়ে। প্রতিটি দেশে উন্নয়ন একটি প্রক্রিয়াগত কার্যক্রম। এক সরকার চলে গেলে উন্নয়ন হবে না তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। বাংলাদেশের মত এখানে এক সরকার চলে গেলে তার নেয়া প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায় না। এমন কাজ জনগণের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। আসলে গণতন্ত্র আর উন্নয়নের নামে রাজনৈতিকভাবে সরকারের আসনকে কুক্ষিগত করার চিন্তা কোন রাজনৈতিক দলের জন্য সুফল বয়ে আনে না।

 

বাংলাদেশের নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রবাসীদের অনেকেই দেশে বেড়াতে যেতেও ভয় পায়। কারণ স্বাভাবিক নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে তারা শংকিত। বাংলাদেশের নির্বাচন মানে মামলা-হামলা। জীবনের নিরাপত্তা খুঁজে পায় না সাধারণ প্রবাসীরা। আর আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন বর্হিবিশ্বে নানা ধরনের স্যাংশন দিয়ে আরও বেশি ভীতকর পরিবেশ তৈরি করেছে প্রবাসীদের মনে। তারা দেশে থাকা আপনজনদের নিয়ে চিন্তিত। নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণে হবে কিনা কিংবা জনগণ ভোট দিতে আগ্রহী হবে কিনা তা নিয়ে  বাঙালিদের চিন্তা নয়। বরং তারা ভাবছে বিনা কারণে কোন ধরনের হামলা-মামলা শিকার হয়ে পড়ে কিনা তাদের আত্মীয়-পরিজন। প্রকৃত পক্ষে একটি দেশে কেবল কাগজে কলমে গণতন্ত্র থাকা আর বাস্তবে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার ফল কি হতে পারে তা বর্তমান বাংলাদেশ বুঝতে পারছে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বহির্বিশ্বের নানামুখি কার্যকলাপের মাধ্যম।

 

বর্তমান সরকার প্রধান তার এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘দেশে এখন ১৯৭৫ সালের পূর্ববতী অবস্থা চলছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে আসুক তা অনেকে চায় না। এ অবস্থায় এখন দল যাকে মনোনয়ন দিবে সে যেন নিজের যোগ্যতায় জয়ী হয় তা চেষ্টা করতে হবে।” এ কথার প্রতি উত্তরে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীদের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই বললে চলে। এ কথার প্রমাণ মিলে বিভিন্ন এলাকার জনগণের কথায়। অন্যদিকে, বিএনপি মামলা-হামলায় জর্জরিত একটা দল। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছে বহির্বিশ্বের নজরদারির কারণে। তাদের নেতাকর্মীদের নামে যে হারে মামলা রয়েছে তা নির্বাচনের পথে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

 

মোট কথায় বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন এখন বহির্বিশ্ব নির্ভর হয়ে পড়েছে অনেকটাই। এর কারণ হলো গণতন্ত্রের নামে দীর্ঘকালীন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ও শক্তিশালী  বিরোধ দলের অনুপস্থিতি। একই সাথে বাংলাদেশে রাজনীতির অপচর্চার কারণে বেড়েছে অন্যায়, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। আর এ কারণে বহির্বিশ্ব তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে হস্তক্ষেপ করছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে। এসব কারণে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমের সংবাদ দেখে প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামগ্রিক অবস্থা হতাশাজনক। সব কিছু বিবেচনা করে তারা দেশপ্রেমের আবেগের কাছে পরাজিত। তারা মনে করে নিজের বুকে লালন করা লাল-সবুজ পতাকাটি প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি বলে তারা তাদের সন্তানদের বলতে পারে না ‘চলো বাংলাদেশে যাই’।

লেখক : কলামিস্ট।

সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ভাষা সৈনিক আজিজুল জলিল আর নেই

» লেবানন থেকে ফিরলেন আরও ৮২ বাংলাদেশি

» ভারত থেকে ফেরার পথে বাংলাদেশি দুই তরুণী আটক

» বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে মাছ, স্থিতিশীল গরু-খাসি-মুরগি

» ফেসবুকে দোয়া চাওয়া যাবে কি?

» ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি গ্রেপ্তার

» আইসিসির পরোয়ানা এখানে এলে গ্রেপ্তার হবেন নেতানিয়াহু : ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী

» নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনাররা শপথ নেবেন রোববার

» বিশাল স্বর্ণখনির সন্ধান পেলো চীন

» সরকার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

প্রবাসীদের ভাবনায় বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতি ও নির্বাচন

ছবি:সংগৃহীত

 

হাসিনা আকতার নিগার :বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা আর বাংলা মায়ের মাটির টান কতটা প্রবল- তা বোধ করি প্রতিটা বাঙালি প্রবাসী বুঝেন প্রতিনিয়ত। উন্নত দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি যতই চাকচিক্যময় হোক না কেন, নিজের দেশের হাজারো সমস্যার কাছে তা অনেক সময় ম্লান হয়ে যায়। কারণ নিজের দেশ নিজেরই। এ ভাবনা বিদেশে অবস্থানকারী শুধু বাঙালি নয় অন্যদেশের নাগরিকদের মাঝেও দেখা যায়। পরিবার পরিজনের পরেও দেশের জন্য যে ভালোবাসা তার পরিধি কতটা বিস্তৃত তা বোধ করি কোন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। উন্নত দেশের জীবন ব্যবস্থা একটা নিয়মের ছকে বাঁধা। এখানে সামাজিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এতটাই নিয়মতান্ত্রিক সুনিশ্চিত যে তার কারণে মানুষ দেশের প্রতি ভালোবাসাকে অবদমিত করে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেয় প্রবাসী হয়ে। প্রবাসে বেড়ে ওঠা সন্তানদের নিশ্চয়তার জীবনকে শ্রেয় মনে করে তাদের আইন ও সামাজিক নিরাপত্তার বেষ্টনীর জন্য। অন্যদিকে, বিদেশে বসে দেশের রাজনীতি পরিবেশ পরিস্থিতি, সামাজিক নিরাপত্তা, অনিয়ম, দুর্নীতি  নিয়ে মিডিয়া বা আত্মীয়-স্বজন থেকে যতটা জানে তাতে স্বস্তিবোধ করে না। তারা দেশের এসব অনিয়ম, রাজনৈতিক অস্বাভাবিকতাকে কল্পনাও করতে পারে না তাদের বিদেশের জন্ম নেয়া ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে। এখানকার ছেলে-মেয়েরা একটা নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশে বড় হয়। রাজনৈতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা এখানে নেই। যা বাংলাদেশ দেখা দিয়েছে বিশেষভাবে।

 

বর্তমানে এ সমস্যাটা প্রকট হবার কারণ হল, দীর্ঘ সময় ধরে যারা বিদেশে থাকেন তারা কিংবা তাদের সন্তানদের কাছে বাংলাদেশের  চিত্রটা বরাবরই আশাহীন অনিশ্চিত জীবন হিসেবে তুলে ধরা হয়। দেশের খবর জানতে চাইলে আত্মীয় পরিজন বা বন্ধুদের মুখে হাতাশা আর শঙ্কার কথাই শোনা যায়। তার উপরে বিদেশের যারা আওয়ামী লীগ বা বিএনপি করেন তাদের সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কর্মকাণ্ডকে কোনো যুক্তি দিয়ে বিচার করা যায় না। অন্যের দেশে বসে যখন নিজের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আগমনে বা অবস্থানকালীন সময়ে প্রতিবাদের নামে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে তা বিশ্বের কাছে জাতিকে লজ্জিত করে। তারা ভুলে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশসমূহের দৃষ্টি রয়েছে। এসব প্রবাসীরা নিজেরদের সহবত থাকার শিষ্টাচারও মনে রাখে না।

 

আর এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় সাধারণ প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভাবনাটা তথৈবচ। আওয়ামী সরকারের দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা থাকার কারণে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখন অনেকটাই দৃশ্যত। তবে করোনার আপদকালীন সময় আর রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অর্থনৈতিক বাজারে সারা বিশ্বে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তার প্রভাব বাংলাদেশেও চলমান তা শতভাগ সত্য। তবে উন্নত বিশ্বের সরকার এ সমস্যার সমাধানের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাদের  জনগণ যেন স্বাভাবিকভাবে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করতে পারে তার জন্য। যার ফলে এসব দেশের সাধারণ জনগণ রাজনীতির নানা মেরুকরণ নিয়ে ততটা ভাবেন না- কারণ তারা জানে সংকটকালীন সময়কে সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

 

কারণ বাংলাদেশে বাজার সিন্ডিকেটের কাছে সরকার জিম্মী। এতে করে নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা যে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে তা মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যমেই বোধগম্য হয়। সরকার থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হলেও তা দিয়ে বাজার সিন্ডিকেটকারীদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর অন্তরালের কারণ হল অনিয়ম ও দুর্নীতি। প্রাত্যহিক জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। ফলশ্রুতিতে এখন মানুষের কাছে জীবন ও জীবিকাই বেশি  প্রাধান্য পায়। সরকার, ভোট বা  রাজনীতি নয়। তারা নির্বাচন, ভোট নিয়ে কথা বলতে নারাজ। কোন সরকারই জনগণের কথা শুনতে চায় না বলে তার ভোট দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে ভাবে না। তারা জানে তারা ভোট না দিলেও ভোট দেওয়া হয়ে যায়। আর যার পেশিশক্তিসহ নানা কারিশমা আছে সে সরকার হবে। এটা এখন কোন আজব বিষয় নয়।

 

জনগণের রাজনৈতিক চিন্তা ধারণাতে এ উন্নাসিকতা ভাব দেশের উন্নয়নে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তা দৃশ্যত না হলেও এর ক্ষতিকর দিকটা বুঝতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো সময়ের প্রবাহে। এর পাশাপাশি জনগণের ভোট বিমুখ হবার কারণ হলো ভোট প্রদান যে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার তা ছিনিয়ে নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো ১/১১  নির্বাচনের পরবর্তী সময় থেকে। অন্যদিকে, দীর্ঘ সময় ধরে এক দলের ক্ষমতায় থাকাতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে বটে তবে সে উন্নয়নকে মানবিক উন্নয়নে উত্তরণ করা সম্ভব হয়নি সরকারের নাম ব্যবহারকারী আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অনিয়ম ও দুর্নীতিবাজদের কারণে।

 

প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতির গণতান্ত্রিক চর্চাটা অনেকটা পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক চিন্তা বলে প্রতীয়মান হয়। যা তারা এদেশের রাজনৈতিক চিন্তার সাথে মেলাতে পারেন না। উন্নত দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আইনগতভাবে জনগণের ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ শতভাগ নিশ্চিত। এখানে কেউ কারো ভোট দিয়ে দেবে এমন চিন্তা করা অকল্পনীয়। রাতের ভোট তো হাস্যকর বিষয়। একজন বা একটি দল বছরের পর বছর ক্ষমতা থাকার বিধানও নেই এখানে। সংবিধানকে তারা অনুসরণ করে প্রতিটি পর্যায়ে। প্রতিটি দেশে উন্নয়ন একটি প্রক্রিয়াগত কার্যক্রম। এক সরকার চলে গেলে উন্নয়ন হবে না তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। বাংলাদেশের মত এখানে এক সরকার চলে গেলে তার নেয়া প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায় না। এমন কাজ জনগণের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। আসলে গণতন্ত্র আর উন্নয়নের নামে রাজনৈতিকভাবে সরকারের আসনকে কুক্ষিগত করার চিন্তা কোন রাজনৈতিক দলের জন্য সুফল বয়ে আনে না।

 

বাংলাদেশের নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনকালীন সময়ে প্রবাসীদের অনেকেই দেশে বেড়াতে যেতেও ভয় পায়। কারণ স্বাভাবিক নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে তারা শংকিত। বাংলাদেশের নির্বাচন মানে মামলা-হামলা। জীবনের নিরাপত্তা খুঁজে পায় না সাধারণ প্রবাসীরা। আর আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন বর্হিবিশ্বে নানা ধরনের স্যাংশন দিয়ে আরও বেশি ভীতকর পরিবেশ তৈরি করেছে প্রবাসীদের মনে। তারা দেশে থাকা আপনজনদের নিয়ে চিন্তিত। নির্বাচন সকল দলের অংশগ্রহণে হবে কিনা কিংবা জনগণ ভোট দিতে আগ্রহী হবে কিনা তা নিয়ে  বাঙালিদের চিন্তা নয়। বরং তারা ভাবছে বিনা কারণে কোন ধরনের হামলা-মামলা শিকার হয়ে পড়ে কিনা তাদের আত্মীয়-পরিজন। প্রকৃত পক্ষে একটি দেশে কেবল কাগজে কলমে গণতন্ত্র থাকা আর বাস্তবে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকার ফল কি হতে পারে তা বর্তমান বাংলাদেশ বুঝতে পারছে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বহির্বিশ্বের নানামুখি কার্যকলাপের মাধ্যম।

 

বর্তমান সরকার প্রধান তার এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘দেশে এখন ১৯৭৫ সালের পূর্ববতী অবস্থা চলছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে আসুক তা অনেকে চায় না। এ অবস্থায় এখন দল যাকে মনোনয়ন দিবে সে যেন নিজের যোগ্যতায় জয়ী হয় তা চেষ্টা করতে হবে।” এ কথার প্রতি উত্তরে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীদের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই বললে চলে। এ কথার প্রমাণ মিলে বিভিন্ন এলাকার জনগণের কথায়। অন্যদিকে, বিএনপি মামলা-হামলায় জর্জরিত একটা দল। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তারা নিজেদের অবস্থান তৈরি করার চেষ্টা করছে বহির্বিশ্বের নজরদারির কারণে। তাদের নেতাকর্মীদের নামে যে হারে মামলা রয়েছে তা নির্বাচনের পথে যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

 

মোট কথায় বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন এখন বহির্বিশ্ব নির্ভর হয়ে পড়েছে অনেকটাই। এর কারণ হলো গণতন্ত্রের নামে দীর্ঘকালীন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ও শক্তিশালী  বিরোধ দলের অনুপস্থিতি। একই সাথে বাংলাদেশে রাজনীতির অপচর্চার কারণে বেড়েছে অন্যায়, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। আর এ কারণে বহির্বিশ্ব তাদের নিজস্ব এজেন্ডা নিয়ে হস্তক্ষেপ করছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে। এসব কারণে সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমের সংবাদ দেখে প্রবাসীদের কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সামগ্রিক অবস্থা হতাশাজনক। সব কিছু বিবেচনা করে তারা দেশপ্রেমের আবেগের কাছে পরাজিত। তারা মনে করে নিজের বুকে লালন করা লাল-সবুজ পতাকাটি প্রকৃত স্বাধীনতা পায়নি বলে তারা তাদের সন্তানদের বলতে পারে না ‘চলো বাংলাদেশে যাই’।

লেখক : কলামিস্ট।

সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com