পুলিশকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে

মেজর আখতার (অব.) : পুলিশ যে-কোনো সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজের অতীব প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান যা ছাড়া নাগরিকের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব। স্বাধীন সভ্য রাষ্ট্রে পুলিশ থাকতেই হবে। পুলিশ ছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজ টিকে থাকতে পারবে না। পুলিশ না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্র বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে, মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি লেগেই থাকবে। নাগরিকদের জানমালের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। পুলিশ ছাড়া আমাদেরও একই অবস্থা হবে। কিন্তু তাই বলে পুলিশকে যথেচ্ছাচারের সুযোগ কোনো অবস্থাতেই দেওয়া যেতে পারে না। পুলিশকেও সুশৃঙ্খল হতে হবে, তাদের জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হবে। পুলিশ সরকারের পেটোয়া বাহিনী হতে পারে না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পুলিশ জনগণের সেবক হবে, জনস্বার্থে তাদের সব কাজ পরিচালিত হবে, জনগণের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাই পুলিশের মূল লক্ষ্য হবে। পুলিশের কাছে জনগণের রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনো মূল্য থাকবে না। পুলিশ খুঁজবে অপরাধীকে এবং সেই অপরাধীকে চিহ্নিত করে তার প্রাপ্য সাজা নিশ্চিত করার জন্য আদালতে সোপর্দ করবে। মনে রাখতে হবে, সাজা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার বা ক্ষমতা পুলিশের নেই।

 

পুলিশ নিয়ে আমাদের দেশে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আজকে আমাদের পুলিশ যে আইনের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে সেই ঐতিহাসিক আইন ‘পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১’-এর গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৭৯২ সালে ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসনামলে। তৎকালীন বাংলায় আইনশৃঙ্খলা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ছিল বাংলায় মুঘল শাসনব্যবস্থা থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় উত্তরণের পথে এক চূড়ান্ত পদক্ষেপ। আইন অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতা, নিয়োগবিধি, পদোন্নতি ও বদলি, তদন্ত পদ্ধতি এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন, গোয়েন্দা কার্যক্রম, শৃঙ্খলা রক্ষা ও পুলিশ বাহিনী মোতায়েন-সংক্রান্ত বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়।

 

নব্য ঔপনিবেশিক শাসকদের উপযোগী একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ আইন প্রণীত হয়। ১৭৯২ সালের ডিসেম্বরে প্রণীত ‘রেগুলেশন ফর দ্য পুলিশ অব দ্য কালেক্টরশিপ ইন বেঙ্গল, বিহার অ্যান্ড ওড়িশা’ ছিল এ ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক গৃহীত বড় ধরনের প্রথম পরিবর্তন। কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত এ ব্যবস্থাটি ‘থানাদারি’ পদ্ধতি নামেই বহুল পরিচিত ছিল। এ ব্যবস্থার আওতায় কালেক্টরশিপ বা নবগঠিত জেলাগুলোকে কতিপয় থানা বা পুলিশের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি থানার দায়িত্বে একজন দারোগা বা প্রধান নিযুক্ত হন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা জজ হিসেবে জেলার সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ব্যবস্থা পুলিশ বিভাগে ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাসের সূচনা করে এবং অভ্যন্তরীণ পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেটের সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানে এনে তার নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করে যা আগে জমিদার বা ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে শুরুতেই এ ব্যবস্থার ত্রুটি ধরা পড়ে। কারণ একটি ছোট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও একজন দারোগার অধিভুক্ত এলাকা ছিল প্রায় ৪০০ বর্গমাইল। কিন্তু দারোগাকে দেওয়া হয়েছিল খুবই কমসংখ্যক কর্মচারী। এ ছাড়া কর্নওয়ালিসের ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী নতুন ব্যবস্থায় দেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এত কম বেতন দেওয়া হতো যে, কোনো শিক্ষিত বা পারিবারিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি নতুন পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করত না। যারা এতে যোগ দিত তারা দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন চালিয়ে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে তাদের স্বল্প বেতনের ঘাটতি পূরণ করত। তার ওপর দেশের অভ্যন্তরে অনুরূপ কোনো বাহিনীর সঙ্গে জেলাভিত্তিক সেই পুলিশ বাহিনীর কোনো সম্পর্ক বা সমন্বয় না থাকায় অপরাধীরা সংশ্লিষ্ট জেলার সীমানা অতিক্রম করতে পারলেই শাস্তি বা গ্রেফতার এড়াতে পারত।

 

পুলিশি ব্যবস্থায় কিছুটা সমন্বয় আনার জন্য এবং এর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ১৮০৮ সালে সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সির জন্য সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশের কার্যালয় স্থাপিত হয়। কিন্তু পুলিশের আওতাধীন এলাকা এত বিশাল ছিল যে, একটি মাত্র সুপারিনটেনডেন্টের পদ তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ফলে ১৮৫৩ সালে এ পদ বিলোপ করা হয় এবং ১৮২৯ সালে সৃষ্ট বিভাগীয় কমিশনারদের তাদের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৮৫৪ সালে লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক হ্যালিডে বাংলাকে পুলিশব্যবস্থার জন্য নয়টি কমিশনারের বিভাগ এবং ৩৭টি জেলায় বিভক্ত করে।

 

কিন্তু এসব পরিবর্তন এবং সংস্কার প্রকৃতপক্ষে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মৌলিক স্বভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। কার্যত তারা আগের মতোই অকর্মণ্য, দুর্নীতিপরায়ণ, উৎপীড়নকারী এবং শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অদক্ষ থেকে যায়। এমনকি হ্যালিডেও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, বাংলার পুলিশ সংগঠন ‘বাংলায় ভারতীয় প্রশাসনের এযাবৎকালের সত্যিকারের কলঙ্ক’।

 

পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতির প্রধান কারণ হিসেবে তাদের স্বল্প বেতনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৮৫০-এর দশকে বিষয়টি আলোচনার জন্য উত্থাপিত এবং বাংলা সরকার কয়েকটি সুপারিশ পেশ করলেও তৎকালীন কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেয় এ বিবেচনায় যে, পুলিশের বিষয়টি এককভাবে শুধু বাংলার জন্য না দেখে সমগ্র ভারতের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। এখানে উল্লেখ্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ছিল আজকের মন্ত্রিপরিষদের মতো।

 

যা হোক, ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহি বিপ্লব অদূর ভবিষ্যতে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের সম্ভাবনা স্তিমিত করে দেয়। তথাপি একটি দক্ষ পুলিশ বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৮৬০ সালের আগস্টে লর্ড ক্যানিং একটি পূর্ণাঙ্গ ও মিতব্যয়ী পুলিশ বাহিনী গঠনের নিমিত্ত সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য এইচ এম কোর্টকে চেয়ারম্যান করে একটি পুলিশ কমিশন গঠন করেন। এ কমিশন বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, দেশের পুলিশ বাহিনীকে একক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে একটি সমন্বিত শক্তিতে পরিণত করা প্রয়োজন। কমিশন আইরিশ কনস্টেবুলারি পুলিশব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ঘোষণা দেয় যে, এ ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলিটারি পুলিশের সব গুণাবলি আত্তীভূত করে নেবে। কমিশন আরও গুরুত্ব আরোপ করে যে, পুলিশ বিভাগের প্রতিটি শাখা তার আওতাধীন গোয়েন্দা কিংবা প্রতিরোধমূলক সব দায়িত্ব সম্পর্কে দায়ী থাকবে। প্রতিটি স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে পুলিশের একটি করে স্বতন্ত্র বিভাগ গড়ে তোলার ব্যাপারে কমিশন জোরালো মত প্রকাশ করে।

 

পুলিশ বিভাগকে একজন মহাপুলিশ পরিদর্শক বা আইজি বা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। মহাপুলিশ পরিদর্শকই হবেন পুলিশ বিভাগের প্রধান পরিদর্শক এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারী। এভাবে বিভাগীয় কমিশনারদের নির্বাহী ক্ষমতা লোপ পায়। মহাপুলিশ পরিদর্শককে সহায়তা করার জন্য একজন উপমহাপুলিশ পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করা হয়। জেলা পর্যায়ে রাখা হয় একজন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট যিনি অভ্যন্তরীণ আর্থিক বিষয়, পুলিশ বাহিনীর সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত সব বিষয়ে মহাপুলিশ পরিদর্শকের অধীনে কাজ করবেন। অনুরূপভাবে তিনি জেলা পুলিশ বিভাগে সার্বিক কর্মকান্ডের জন্য মহাপুলিশ পরিদর্শকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। বড় জেলার ক্ষেত্রে একজন সহকারী জেলা পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়।

 

ইন্সপেক্টর, প্রধান কনস্টেবল, সার্জেন্ট ও কনস্টেবলদের সমন্বয়ে অধস্তন বাহিনী গঠিত হবে। প্রধান কনস্টেবল একটি পুলিশ স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন এবং এরূপ কয়েকটি স্টেশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে ইন্সপেক্টরের ওপর। গ্রামপুলিশ থাকবে কিন্তু একে পুলিশ বিভাগের একটি অঙ্গসংগঠনে পরিণত করে সাধারণ কনস্টেবুলারির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত করা হবে। কমিশনের সুপারিশ অনুসারে সব কর্মকর্তা হবেন ইউরোপীয়। তবে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ইউরোপীয়, ইউরেশীয় বা দেশীয় হতে পারবেন। বিভাগীয় কমিশনারদের পুলিশসংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব থাকবে না বলে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিশন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিম্নপদের কোনো ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। জেলার পুলিশের ওপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে। কারণ, তিনি এমন একজন কর্মকর্তা যার ওপর জেলার সার্বিক দায়িত্ব, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বভার ন্যস্ত থাকে।

 

কমিশন তাদের সুপারিশমালার সমন্বয়ে একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করে, যা পরবর্তী পর্যায়ে ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর পুলিশ আইন হিসেবে পাস হয়। এ আইনে পুলিশ বাহিনীর প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও কর্মপরিধি; অপরাধীর শাস্তির মাত্রা; পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পদচ্যুতি ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নিয়মাবলি; তদন্তের ধরন এবং অপরাধী অনুসন্ধান; সাধারণ ডায়েরি (জিডি), এজাহার বা প্রাথমিক অবহিতি (এফআইআর); পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের শৃঙ্খলাবিধান ও মোতায়েন; বিভিন্ন অফিসারের ক্ষমতা ও অধিক্ষেত্র প্রভৃতি বিষয় সংজ্ঞায়িত হয়। বাংলার পুলিশ বিভাগের ব্যয় নির্বাহ বাবদ বার্ষিক ৪০ লাখ রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়। মি. কারনক বাংলার প্রথম মহাপুলিশ পরিদর্শক নিযুক্ত হন।

 

১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ভারতের আধুনিক পুলিশব্যবস্থার মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত এবং এ আইনের অধিকাংশ বিধান এখনো পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর রয়েছে। একটি বিষয়ে এ আইন পুলিশ বিভাগকে দেশের অতি পুরনো ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে আনে। নতুন ব্যবস্থায় সমাজের সঙ্গে পুলিশের কোনো সম্পর্ক থাকল না। এখন তারা হলো সরকারের বেতনভুক কর্মচারী মাত্র। অধিকন্তু এখন মুঘল ফৌজদারের স্থলাভিষিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট তার সব পুলিশি কার্যকলাপ থেকে বঞ্চিত হন। তবে একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অক্ষুণœ থাকে। ফৌজদারি বিচার প্রশাসনে তার বিচার বিভাগীয় ক্ষমতাও বলবৎ থাকে। এ আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- এটি দেশের পুলিশ বিভাগকে একটি স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র বিভাগে পরিণত করে। অধিকন্তু, এ আইন নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের পৃথক্করণ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যে নীতি অপরাধীকে গ্রেফতার করার নির্বাহী ক্ষমতা এবং তার বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা দুটি পৃথক কর্তৃপক্ষের অধীনে ন্যস্ত থাকার বিষয়কে সমর্থন করে।

 

একটি উত্তম, দুর্নীতিমুক্ত এবং দক্ষ পুলিশ বাহিনী গঠনের সম্ভাবনা শুরুতেই তিরোহিত হয়ে যায়। মিতব্যয়িতার নামে প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় বাজেটের চেয়ে কম অর্থ বাংলার পুলিশ বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হয় যাতে কমসংখ্যক পুলিশ নিয়োগ করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, স্বল্প বাজেট বরাদ্দের কারণে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বেতন বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল না। কঠোর অনুশীলন ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে পুলিশ বাহিনীকে সামরিক রূপ দেওয়ার কারণে নতুন পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অনুশীলন এবং নিয়মানুবর্তিতার বিষয়গুলো এত কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতো যে ওই কারণে শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবকরা পুলিশ বাহিনীতে যোগদানে আগ্রহী ছিল না। এর ফলে স্বল্পশিক্ষিত এবং অবাঙালি যুবকরা পুলিশ বাহিনীতে স্থান করে নেয় যা পরিণামে খারাপ ফল বয়ে আনে, অন্যদিকে পুলিশ বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়।

 

এ আইনের বিধানগুলো শুরু থেকেই পুলিশ বাহিনীর ব্যবস্থাপনা ও মোতায়েন প্রশ্নে জেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে। এ বিরোধ অচিরেই প্রশাসনের সব স্তরকে প্রভাবিত করে। এ রকম বৈরিতা স্বভাবতই নতুন পুলিশব্যবস্থার জন্য শুভ ছিল না। এমনকি পুলিশ বাহিনীর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পর্কে সর্বোচ্চ মহল থেকেও সমালোচনা হয়। কারণ যে দেশ সব সময় একক স্বৈরশাসক কর্তৃক শাসিত হয়ে এসেছে সেখানে এ ধরনের পৃথক্করণ ব্যবস্থা মানানসই নয় বলেই মনে করা হয়। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জর্জ ক্যাম্পবেল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, এ নীতি ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণসংক্রান্ত প্রাচ্যদেশীয় ধারণার পরিপন্থী ছিল। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছে জেলার নির্বাহী প্রধান। সে হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ যে পুলিশকে কর্তৃত্বের দৃশ্যমান প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে সেই পুলিশ যদি ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি অনুগত থাকে তাহলে জনগণও ম্যাজিস্ট্রেটকে তাদের স্থানীয় শাসক হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তিনি উপসংহারে বলেন, যদি পুলিশকে পৃথক রাখা হয় তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে জেলার নির্বাহী প্রধান এবং সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে মর্যাদা বজায় রাখা সম্ভব হবে না।

 

এভাবে জর্জ ক্যাম্পবেলের সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে অধিক পুলিশি ক্ষমতা প্রদান বিষয়ে একটি পৃথক নীতি চালু হয়। অর্থাৎ পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তথা পুলিশ প্রশাসনের নিয়মশৃঙ্খলা, পদোন্নতি, নিয়োগ এবং বরখাস্ত বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বিষয়টি এত দূর পর্যন্ত গড়ায় যে, ১৮৭০ সালের মধ্যে মহাপুলিশ পরিদর্শক ইন্সপেক্টর নিয়োগের ব্যাপারে কেবল সম্মতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষে পরিণত হন।

 

১৯০২ সালের দিকে যখন পরবর্তী পুলিশ কমিশন গঠন করা হয়, তখন পুলিশকে আর স্বাধীন বিভাগ হিসেবে রাখা হয়নি এবং ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা হয়। কমিশন অবশ্য পুলিশব্যবস্থাকে ১৮৬১ সালের আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কারণে ক্ষমতা পৃথক্করণের আদর্শ বাস্তবায়ন হতে পারেনি। সেই থেকে পুলিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুগত থেকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের এ স্বেচ্ছাচারিতা ও আইন নিজেদের মতো করে নিজেরাই প্রয়োগ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের শুরুতে তাদের সেই রূপ প্রকট হয়ে জনগণের সামনে একটি ঘৃণিত বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনামলে তৎকালীন পুলিশ পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শাসকদের অত্যাচার চালাতে আরও সহায়তা করে। তবে আমাদের বর্তমান পুলিশের সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো- সব প্রতিকূলতা ও চরম হুমকির মধ্যে থেকেও ১৯৭১ সালে তারা জনগণের পাশে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে মহান দায়িত্ব পালন করে। এর জন্য জনগণ আমাদের পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ।

 

যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশরাজের অধীনে পুলিশ গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সেই লক্ষ্য ও আদর্শ বিন্দুমাত্রও নেই এবং থাকতে পারে না। আমাদের সংবিধান আছে যেখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সংবিধানে প্রাধান্য দিয়ে অনুচ্ছেদ ৭-এর (১)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ একই অনুচ্ছেদের (২)-এ বলা হয়েছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ কাজেই আজকে ১৮৬১ সালের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরাজের আইনে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পুলিশ চলতে পারে না। আমাদের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১৩ থেকে ৪৭(ক) পর্যন্ত জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে সেখানে ১৮৬১ সালের সাম্রাজ্যবাদীদের কোনো শব্দই বাংলাদেশের পুলিশ আইনে থাকতে পারে না। আমাদের পুলিশের জন্য নতুন করে আইন বানাতে হবে এবং সেই আইন মোতাবেক একটি আধুনিক, দক্ষ, চৌকশ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে যে পুলিশ রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে জাতির স্বার্থে জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। কোনো সরকারকে রক্ষা বা ক্ষমতাসীন করা নয়, পুলিশের লক্ষ্য হতে হবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও যথাযথ শাস্তির জন্য অপরাধীকে আইনের কাছে সোপর্দ করার সক্ষমতা অর্জন। আমরা সেই পুলিশ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব। পুলিশকে হতে হবে জনগণের বন্ধু।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ।  সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ডাকাতির প্রস্তুতিকালে চার ডাকাত গ্রেফতার

» শপথ নিলেন নতুন সিইসি ও ৪ নির্বাচন কমিশনার

» দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান ফারুকের

» সেনাবাহিনীর অভিযানে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার

» যেসব এলাকায় আজ রাত ৮টা পর্যন্ত গ্যাস থাকবে না

» অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশি উইমেনস চেম্বার অফ কমার্সের আয়োজন এলান গালা এন্ড চ্যারিটি ইভিনিং অনুষ্ঠিত

» ট্রাক চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত,আহত ২

» পাইরেসির শিকার শাকিব খানের ‘দরদ’

» এশিয়া কাপ জয়ের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ল বাংলাদেশ দল

» পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপির ভরাডুবি

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

পুলিশকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে

মেজর আখতার (অব.) : পুলিশ যে-কোনো সভ্য রাষ্ট্র ও সমাজের অতীব প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান যা ছাড়া নাগরিকের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করা সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব। স্বাধীন সভ্য রাষ্ট্রে পুলিশ থাকতেই হবে। পুলিশ ছাড়া রাষ্ট্র ও সমাজ টিকে থাকতে পারবে না। পুলিশ না থাকলে সমাজ ও রাষ্ট্র বিশৃঙ্খল হয়ে যাবে, মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি লেগেই থাকবে। নাগরিকদের জানমালের কোনো নিরাপত্তা থাকবে না। পুলিশ ছাড়া আমাদেরও একই অবস্থা হবে। কিন্তু তাই বলে পুলিশকে যথেচ্ছাচারের সুযোগ কোনো অবস্থাতেই দেওয়া যেতে পারে না। পুলিশকেও সুশৃঙ্খল হতে হবে, তাদের জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হবে। পুলিশ সরকারের পেটোয়া বাহিনী হতে পারে না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে পুলিশ জনগণের সেবক হবে, জনস্বার্থে তাদের সব কাজ পরিচালিত হবে, জনগণের নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাই পুলিশের মূল লক্ষ্য হবে। পুলিশের কাছে জনগণের রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনো মূল্য থাকবে না। পুলিশ খুঁজবে অপরাধীকে এবং সেই অপরাধীকে চিহ্নিত করে তার প্রাপ্য সাজা নিশ্চিত করার জন্য আদালতে সোপর্দ করবে। মনে রাখতে হবে, সাজা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার বা ক্ষমতা পুলিশের নেই।

 

পুলিশ নিয়ে আমাদের দেশে ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আজকে আমাদের পুলিশ যে আইনের মাধ্যমে গঠন করা হয়েছে সেই ঐতিহাসিক আইন ‘পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১’-এর গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৭৯২ সালে ভারতবর্ষে কোম্পানি শাসনামলে। তৎকালীন বাংলায় আইনশৃঙ্খলা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ছিল বাংলায় মুঘল শাসনব্যবস্থা থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় উত্তরণের পথে এক চূড়ান্ত পদক্ষেপ। আইন অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীর ক্ষমতা, নিয়োগবিধি, পদোন্নতি ও বদলি, তদন্ত পদ্ধতি এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন, গোয়েন্দা কার্যক্রম, শৃঙ্খলা রক্ষা ও পুলিশ বাহিনী মোতায়েন-সংক্রান্ত বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়।

 

নব্য ঔপনিবেশিক শাসকদের উপযোগী একটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এ আইন প্রণীত হয়। ১৭৯২ সালের ডিসেম্বরে প্রণীত ‘রেগুলেশন ফর দ্য পুলিশ অব দ্য কালেক্টরশিপ ইন বেঙ্গল, বিহার অ্যান্ড ওড়িশা’ ছিল এ ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কর্তৃক গৃহীত বড় ধরনের প্রথম পরিবর্তন। কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত এ ব্যবস্থাটি ‘থানাদারি’ পদ্ধতি নামেই বহুল পরিচিত ছিল। এ ব্যবস্থার আওতায় কালেক্টরশিপ বা নবগঠিত জেলাগুলোকে কতিপয় থানা বা পুলিশের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় বিভক্ত করা হয় এবং প্রতিটি থানার দায়িত্বে একজন দারোগা বা প্রধান নিযুক্ত হন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলা জজ হিসেবে জেলার সার্বিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ব্যবস্থা পুলিশ বিভাগে ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিন্যাসের সূচনা করে এবং অভ্যন্তরীণ পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেটের সুষ্ঠু তত্ত্বাবধানে এনে তার নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করে যা আগে জমিদার বা ভূস্বামীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে শুরুতেই এ ব্যবস্থার ত্রুটি ধরা পড়ে। কারণ একটি ছোট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও একজন দারোগার অধিভুক্ত এলাকা ছিল প্রায় ৪০০ বর্গমাইল। কিন্তু দারোগাকে দেওয়া হয়েছিল খুবই কমসংখ্যক কর্মচারী। এ ছাড়া কর্নওয়ালিসের ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যানুযায়ী নতুন ব্যবস্থায় দেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এত কম বেতন দেওয়া হতো যে, কোনো শিক্ষিত বা পারিবারিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি নতুন পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করত না। যারা এতে যোগ দিত তারা দুর্নীতি এবং উৎপীড়ন চালিয়ে অর্থ আদায়ের মাধ্যমে তাদের স্বল্প বেতনের ঘাটতি পূরণ করত। তার ওপর দেশের অভ্যন্তরে অনুরূপ কোনো বাহিনীর সঙ্গে জেলাভিত্তিক সেই পুলিশ বাহিনীর কোনো সম্পর্ক বা সমন্বয় না থাকায় অপরাধীরা সংশ্লিষ্ট জেলার সীমানা অতিক্রম করতে পারলেই শাস্তি বা গ্রেফতার এড়াতে পারত।

 

পুলিশি ব্যবস্থায় কিছুটা সমন্বয় আনার জন্য এবং এর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ১৮০৮ সালে সমগ্র বাংলা প্রেসিডেন্সির জন্য সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশের কার্যালয় স্থাপিত হয়। কিন্তু পুলিশের আওতাধীন এলাকা এত বিশাল ছিল যে, একটি মাত্র সুপারিনটেনডেন্টের পদ তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ফলে ১৮৫৩ সালে এ পদ বিলোপ করা হয় এবং ১৮২৯ সালে সৃষ্ট বিভাগীয় কমিশনারদের তাদের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ১৮৫৪ সালে লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক হ্যালিডে বাংলাকে পুলিশব্যবস্থার জন্য নয়টি কমিশনারের বিভাগ এবং ৩৭টি জেলায় বিভক্ত করে।

 

কিন্তু এসব পরিবর্তন এবং সংস্কার প্রকৃতপক্ষে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মৌলিক স্বভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। কার্যত তারা আগের মতোই অকর্মণ্য, দুর্নীতিপরায়ণ, উৎপীড়নকারী এবং শান্তি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অদক্ষ থেকে যায়। এমনকি হ্যালিডেও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, বাংলার পুলিশ সংগঠন ‘বাংলায় ভারতীয় প্রশাসনের এযাবৎকালের সত্যিকারের কলঙ্ক’।

 

পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দুর্নীতির প্রধান কারণ হিসেবে তাদের স্বল্প বেতনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ১৮৫০-এর দশকে বিষয়টি আলোচনার জন্য উত্থাপিত এবং বাংলা সরকার কয়েকটি সুপারিশ পেশ করলেও তৎকালীন কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে দেয় এ বিবেচনায় যে, পুলিশের বিষয়টি এককভাবে শুধু বাংলার জন্য না দেখে সমগ্র ভারতের প্রেক্ষাপটে দেখা উচিত। এখানে উল্লেখ্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স ছিল আজকের মন্ত্রিপরিষদের মতো।

 

যা হোক, ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহি বিপ্লব অদূর ভবিষ্যতে পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের সম্ভাবনা স্তিমিত করে দেয়। তথাপি একটি দক্ষ পুলিশ বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৮৬০ সালের আগস্টে লর্ড ক্যানিং একটি পূর্ণাঙ্গ ও মিতব্যয়ী পুলিশ বাহিনী গঠনের নিমিত্ত সুপারিশমালা প্রণয়নের জন্য এইচ এম কোর্টকে চেয়ারম্যান করে একটি পুলিশ কমিশন গঠন করেন। এ কমিশন বিস্তারিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অবশেষে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, দেশের পুলিশ বাহিনীকে একক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীনে একটি সমন্বিত শক্তিতে পরিণত করা প্রয়োজন। কমিশন আইরিশ কনস্টেবুলারি পুলিশব্যবস্থাকে মডেল হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ঘোষণা দেয় যে, এ ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিলিটারি পুলিশের সব গুণাবলি আত্তীভূত করে নেবে। কমিশন আরও গুরুত্ব আরোপ করে যে, পুলিশ বিভাগের প্রতিটি শাখা তার আওতাধীন গোয়েন্দা কিংবা প্রতিরোধমূলক সব দায়িত্ব সম্পর্কে দায়ী থাকবে। প্রতিটি স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের অধীনে ও নিয়ন্ত্রণে পুলিশের একটি করে স্বতন্ত্র বিভাগ গড়ে তোলার ব্যাপারে কমিশন জোরালো মত প্রকাশ করে।

 

পুলিশ বিভাগকে একজন মহাপুলিশ পরিদর্শক বা আইজি বা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। মহাপুলিশ পরিদর্শকই হবেন পুলিশ বিভাগের প্রধান পরিদর্শক এবং নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকারী। এভাবে বিভাগীয় কমিশনারদের নির্বাহী ক্ষমতা লোপ পায়। মহাপুলিশ পরিদর্শককে সহায়তা করার জন্য একজন উপমহাপুলিশ পরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করা হয়। জেলা পর্যায়ে রাখা হয় একজন পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট যিনি অভ্যন্তরীণ আর্থিক বিষয়, পুলিশ বাহিনীর সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং কর্মদক্ষতা সংক্রান্ত সব বিষয়ে মহাপুলিশ পরিদর্শকের অধীনে কাজ করবেন। অনুরূপভাবে তিনি জেলা পুলিশ বিভাগে সার্বিক কর্মকান্ডের জন্য মহাপুলিশ পরিদর্শকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন। বড় জেলার ক্ষেত্রে একজন সহকারী জেলা পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়।

 

ইন্সপেক্টর, প্রধান কনস্টেবল, সার্জেন্ট ও কনস্টেবলদের সমন্বয়ে অধস্তন বাহিনী গঠিত হবে। প্রধান কনস্টেবল একটি পুলিশ স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন এবং এরূপ কয়েকটি স্টেশনের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে ইন্সপেক্টরের ওপর। গ্রামপুলিশ থাকবে কিন্তু একে পুলিশ বিভাগের একটি অঙ্গসংগঠনে পরিণত করে সাধারণ কনস্টেবুলারির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত করা হবে। কমিশনের সুপারিশ অনুসারে সব কর্মকর্তা হবেন ইউরোপীয়। তবে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ইউরোপীয়, ইউরেশীয় বা দেশীয় হতে পারবেন। বিভাগীয় কমিশনারদের পুলিশসংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব থাকবে না বলে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কমিশন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিম্নপদের কোনো ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। জেলার পুলিশের ওপর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থাকবে। কারণ, তিনি এমন একজন কর্মকর্তা যার ওপর জেলার সার্বিক দায়িত্ব, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বভার ন্যস্ত থাকে।

 

কমিশন তাদের সুপারিশমালার সমন্বয়ে একটি খসড়া বিল প্রস্তুত করে, যা পরবর্তী পর্যায়ে ১৮৬১ সালের ৫ নম্বর পুলিশ আইন হিসেবে পাস হয়। এ আইনে পুলিশ বাহিনীর প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও কর্মপরিধি; অপরাধীর শাস্তির মাত্রা; পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, পদচ্যুতি ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নিয়মাবলি; তদন্তের ধরন এবং অপরাধী অনুসন্ধান; সাধারণ ডায়েরি (জিডি), এজাহার বা প্রাথমিক অবহিতি (এফআইআর); পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের শৃঙ্খলাবিধান ও মোতায়েন; বিভিন্ন অফিসারের ক্ষমতা ও অধিক্ষেত্র প্রভৃতি বিষয় সংজ্ঞায়িত হয়। বাংলার পুলিশ বিভাগের ব্যয় নির্বাহ বাবদ বার্ষিক ৪০ লাখ রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়। মি. কারনক বাংলার প্রথম মহাপুলিশ পরিদর্শক নিযুক্ত হন।

 

১৮৬১ সালের পুলিশ আইন ভারতের আধুনিক পুলিশব্যবস্থার মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত এবং এ আইনের অধিকাংশ বিধান এখনো পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর রয়েছে। একটি বিষয়ে এ আইন পুলিশ বিভাগকে দেশের অতি পুরনো ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে আনে। নতুন ব্যবস্থায় সমাজের সঙ্গে পুলিশের কোনো সম্পর্ক থাকল না। এখন তারা হলো সরকারের বেতনভুক কর্মচারী মাত্র। অধিকন্তু এখন মুঘল ফৌজদারের স্থলাভিষিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট তার সব পুলিশি কার্যকলাপ থেকে বঞ্চিত হন। তবে একজন নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অক্ষুণœ থাকে। ফৌজদারি বিচার প্রশাসনে তার বিচার বিভাগীয় ক্ষমতাও বলবৎ থাকে। এ আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো- এটি দেশের পুলিশ বিভাগকে একটি স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র বিভাগে পরিণত করে। অধিকন্তু, এ আইন নির্বাহী এবং বিচার বিভাগের পৃথক্করণ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যে নীতি অপরাধীকে গ্রেফতার করার নির্বাহী ক্ষমতা এবং তার বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা দুটি পৃথক কর্তৃপক্ষের অধীনে ন্যস্ত থাকার বিষয়কে সমর্থন করে।

 

একটি উত্তম, দুর্নীতিমুক্ত এবং দক্ষ পুলিশ বাহিনী গঠনের সম্ভাবনা শুরুতেই তিরোহিত হয়ে যায়। মিতব্যয়িতার নামে প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় বাজেটের চেয়ে কম অর্থ বাংলার পুলিশ বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হয় যাতে কমসংখ্যক পুলিশ নিয়োগ করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, স্বল্প বাজেট বরাদ্দের কারণে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বেতন বৃদ্ধি করা সম্ভব ছিল না। কঠোর অনুশীলন ও নিয়মানুবর্তিতার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে পুলিশ বাহিনীকে সামরিক রূপ দেওয়ার কারণে নতুন পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অনুশীলন এবং নিয়মানুবর্তিতার বিষয়গুলো এত কঠোরভাবে অনুসরণ করা হতো যে ওই কারণে শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের যুবকরা পুলিশ বাহিনীতে যোগদানে আগ্রহী ছিল না। এর ফলে স্বল্পশিক্ষিত এবং অবাঙালি যুবকরা পুলিশ বাহিনীতে স্থান করে নেয় যা পরিণামে খারাপ ফল বয়ে আনে, অন্যদিকে পুলিশ বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়।

 

এ আইনের বিধানগুলো শুরু থেকেই পুলিশ বাহিনীর ব্যবস্থাপনা ও মোতায়েন প্রশ্নে জেলা পর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে। এ বিরোধ অচিরেই প্রশাসনের সব স্তরকে প্রভাবিত করে। এ রকম বৈরিতা স্বভাবতই নতুন পুলিশব্যবস্থার জন্য শুভ ছিল না। এমনকি পুলিশ বাহিনীর স্বাধীন ও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সম্পর্কে সর্বোচ্চ মহল থেকেও সমালোচনা হয়। কারণ যে দেশ সব সময় একক স্বৈরশাসক কর্তৃক শাসিত হয়ে এসেছে সেখানে এ ধরনের পৃথক্করণ ব্যবস্থা মানানসই নয় বলেই মনে করা হয়। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জর্জ ক্যাম্পবেল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, এ নীতি ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণসংক্রান্ত প্রাচ্যদেশীয় ধারণার পরিপন্থী ছিল। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছে জেলার নির্বাহী প্রধান। সে হিসেবে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ যে পুলিশকে কর্তৃত্বের দৃশ্যমান প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে সেই পুলিশ যদি ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি অনুগত থাকে তাহলে জনগণও ম্যাজিস্ট্রেটকে তাদের স্থানীয় শাসক হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তিনি উপসংহারে বলেন, যদি পুলিশকে পৃথক রাখা হয় তবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে জেলার নির্বাহী প্রধান এবং সরকারের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে মর্যাদা বজায় রাখা সম্ভব হবে না।

 

এভাবে জর্জ ক্যাম্পবেলের সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে অধিক পুলিশি ক্ষমতা প্রদান বিষয়ে একটি পৃথক নীতি চালু হয়। অর্থাৎ পুলিশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তথা পুলিশ প্রশাসনের নিয়মশৃঙ্খলা, পদোন্নতি, নিয়োগ এবং বরখাস্ত বিষয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বিষয়টি এত দূর পর্যন্ত গড়ায় যে, ১৮৭০ সালের মধ্যে মহাপুলিশ পরিদর্শক ইন্সপেক্টর নিয়োগের ব্যাপারে কেবল সম্মতি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষে পরিণত হন।

 

১৯০২ সালের দিকে যখন পরবর্তী পুলিশ কমিশন গঠন করা হয়, তখন পুলিশকে আর স্বাধীন বিভাগ হিসেবে রাখা হয়নি এবং ক্ষমতার পৃথক্করণ নীতি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করা হয়। কমিশন অবশ্য পুলিশব্যবস্থাকে ১৮৬১ সালের আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কারণে ক্ষমতা পৃথক্করণের আদর্শ বাস্তবায়ন হতে পারেনি। সেই থেকে পুলিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুগত থেকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের এ স্বেচ্ছাচারিতা ও আইন নিজেদের মতো করে নিজেরাই প্রয়োগ করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের শুরুতে তাদের সেই রূপ প্রকট হয়ে জনগণের সামনে একটি ঘৃণিত বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনামলে তৎকালীন পুলিশ পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শাসকদের অত্যাচার চালাতে আরও সহায়তা করে। তবে আমাদের বর্তমান পুলিশের সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো- সব প্রতিকূলতা ও চরম হুমকির মধ্যে থেকেও ১৯৭১ সালে তারা জনগণের পাশে এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে মহান দায়িত্ব পালন করে। এর জন্য জনগণ আমাদের পুলিশের কাছে কৃতজ্ঞ।

 

যে লক্ষ্য ও আদর্শ নিয়ে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশরাজের অধীনে পুলিশ গঠন করা হয়েছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সেই লক্ষ্য ও আদর্শ বিন্দুমাত্রও নেই এবং থাকতে পারে না। আমাদের সংবিধান আছে যেখানে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সংবিধানে প্রাধান্য দিয়ে অনুচ্ছেদ ৭-এর (১)-এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ একই অনুচ্ছেদের (২)-এ বলা হয়েছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ কাজেই আজকে ১৮৬১ সালের সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশরাজের আইনে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পুলিশ চলতে পারে না। আমাদের সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১৩ থেকে ৪৭(ক) পর্যন্ত জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে সেখানে ১৮৬১ সালের সাম্রাজ্যবাদীদের কোনো শব্দই বাংলাদেশের পুলিশ আইনে থাকতে পারে না। আমাদের পুলিশের জন্য নতুন করে আইন বানাতে হবে এবং সেই আইন মোতাবেক একটি আধুনিক, দক্ষ, চৌকশ পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে হবে যে পুলিশ রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে জাতির স্বার্থে জনগণের কল্যাণে কাজ করবে। কোনো সরকারকে রক্ষা বা ক্ষমতাসীন করা নয়, পুলিশের লক্ষ্য হতে হবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও যথাযথ শাস্তির জন্য অপরাধীকে আইনের কাছে সোপর্দ করার সক্ষমতা অর্জন। আমরা সেই পুলিশ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব। পুলিশকে হতে হবে জনগণের বন্ধু।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ।  সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com