বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : কয়েক মাস থেকে হুজুর মওলানা ভাসানীর বগুড়ার কাঞ্চনপুর পক্ষের ছেলেমেয়েরা বেশ যোগাযোগ করছে। হুজুর মওলানা ভাসানী পরপর তিনটি বিয়ে করেছিলেন। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, টাঙ্গাইলের দিঘুলিয়া ও বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার কাঞ্চনপুরে। টাঙ্গাইলের স্ত্রী অকালেই মারা যান। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। কিন্তু পাঁচবিবির আলেমা ভাসানী ও বগুড়ার কাঞ্চনপুরের হামিদা খানম ভাসানীর ঘরে ছেলেমেয়ে আছে। হামিদা খানম ভাসানীর দুই মেয়ে- আনোয়ারা, মনোয়ারা এবং এক ছেলে আবু বকর খান ভাসানী। আবু বকর ভাসানী বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছে। সন্তোষেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। ওদের মধ্যে আনোয়ারা প্রায় সময়ই আসা-যাওয়া করত, বাড়িঘর নাচিয়ে তুলত। আমার স্ত্রী আনোয়ারাকে খুবই পছন্দ করতেন। একটা শাড়ি, দু-এক হাজার টাকা, এটাওটা খুব সাধারণ চাহিদা ছিল তার। আল্লাহ তাকে নিয়ে গেছেন, বেহেশত নসিব করুন। আনোয়ারা মারা যাওয়ার পর অনেকটাই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। যোগাযোগ প্রায় ছিলই না বলা চলে। গত বছর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম গলব্লাডারের সমস্যা নিয়ে। অপারেশন করা হবে, দিন-তারিখ ঠিক। সেদিন করোনা ধরা পড়ে। অপারেশন পিছিয়ে যায়। করোনার পর প্রায় তিন-চার মাস গলব্লাডার নিয়ে আর তেমন কথাবার্তা হয়নি। হঠাৎ আবার এক সন্ধ্যায় ব্যথা ওঠে। তীব্র যন্ত্রণায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। এক বা দুই দিন পর ভর্তি হই বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। অপারেশনের দিন-তারিখ ঠিক। খুব সম্ভব আগের দিন বিকালে হঠাৎ ফোন আসে। ফোনটা ফরিদকে দিয়েছিলাম। ফরিদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়। ফরিদ বলে হুজুর মওলানা ভাসানীর মেয়ে মনোয়ারা ভাসানী ফোন করেছিল। সঙ্গে সঙ্গে আবার তাকে ফোন করতে বলি। ফোন ধরতেই বলে, ‘ভাই, আমি ভাসানী হুজুরের মেয়ে মনোয়ারা ভাসানী বলছি।’ মনোয়ারার নাম জানতাম। কিন্তু কখনো কথা বা দেখা হয়নি। কী ব্যাপার? খুব করুণ কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমার বড় ছেলে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি। কোনো চিকিৎসা হচ্ছে না। আপনি একটু দেখুন।’ বলেছিলাম, তুমি নাকি ১০ হাজার টাকা চেয়েছ পাঠিয়ে দিচ্ছি। বলল, ‘না ভাই। ১০ হাজার না, সম্ভব হলে আমি ৫০ হাজার টাকার কথা বলেছি।’ বলেছিলাম, আচ্ছা, আমি দেখছি। তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। সঙ্গে সঙ্গে রংপুর মেডিকেলে ফোন করেছিলাম। প্রিন্সিপালকে বলেছিলাম, ডিজি হেলথকে বলেছিলাম। হুজুর মওলানা ভাসানীর নাতিপুতি তাদের প্রতি দেশের একটা দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমার টাঙ্গাইলের মানুষ। আমি ছেলেবেলায় তাদের বাড়ির কাছে বরাটি নরদানা হাইস্কুলে পড়েছি। ব্যাপারটা তাকে বলেছিলাম। নামাজি মানুষ। তার যা করার সঙ্গে সঙ্গে করেছিলেন। হুজুরের নাতি চৌধুরী মাহমুদুল বারী মাশরুমকে শত চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি। ওর পর মনোয়ারা মাঝেমধ্যেই খোঁজখবর করে। মনোয়ারার তিন ছেলে- চৌধুরী মাহমুদুল বারী মাশরুম, চৌধুরী আখতারুজ্জামান, চৌধুরী মেহেবুব হাসান; এক মেয়ে মনিকা। মাস দুই আগে হঠাৎ ফোন করেছিল, ‘ভাই, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি বিনা খরচে চিকিৎসা করে দেবেন। কিন্তু আমাদের ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নেই। থাকার কোনো জায়গা হলে একটু চিকিৎসা করাতে পারতাম।’ ঢাকায় থাকা নিয়ে মনোয়ারা দু-তিন বার ফোন করেছে। বেগম সাহেবার সঙ্গে কথা বলে বাবর রোডের বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. শারফুদ্দিন আহমেদকে বলেছিলাম। বড় ভালো মানুষ শারফুদ্দিন। ভীষণ আগ্রহ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হুজুর মওলানা ভাসানীর মেয়ে, নাতিপুতির চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১০-১২ দিন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোয়ারা ভাসানী, তার মেয়ে মনিকা, ছেলে মেহেবুব হাসান ও নাতি চিকিৎসা নিয়েছে। চোখের কষ্ট বেশি ছিল বলে পবিত্র ঈদুল আজহার আগেই চোখের সফল অপারেশন হয়েছে। গলব্লাডারের অপারেশনের একটা সমস্যা আছে। মাসখানেক পর সেটাও করা যাবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নজরুল ইসলাম খান, অন্যান্য ডাক্তার ও নার্সের হুজুরের স্বজনদের প্রতি অসাধারণ সহমর্মিতায় আমি দারুণ অভিভূত ও খুবই খুশি হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানটি চিকিৎসাশাস্ত্রে বাংলাদেশ তথা এশিয়ার অন্যতম প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্র হোক কায়মনে এ প্রার্থনাই করি। মনে হয় তিন-চার বছর পর টাঙ্গাইল ঈদগাহ মাঠে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলাম। সব মানুষেরই নাকি কখনোসখনো হাত-পা অচল হয়। ১৯৮৭-’৮৮ সালে আমার ডান হাত কেমন যেন আটকে গিয়েছিল। একটুও নাড়াচাড়া করতে পারতাম না। অমন প্রচন্ড ব্যথা আগে কখনো অনুভব করিনি। সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিলাম কলকাতার পিজি হাসপাতালে। তাঁরা দেখেশুনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছিলেন, এটা ফ্রোজেন শোল্ডার। সবার হয়। এখন ডান হাত হয়েছে দু-চার-১০ বছর পর বাঁ হাতও হবে। কোনো ওষুধ নেই। ব্যায়াম আর ব্যায়াম। ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। ডানে-বাঁয়ে-ওপরে-নিচে নানাভাবে নাড়াচাড়া করাই হচ্ছে একমাত্র চিকিৎসা। দেশে ফিরেছিলাম ১৯৯০ সালের ১৬ ডিসেম্বর। তার আগে অনেকটা ভালো হয়ে গিয়েছিল। ব্যথা-বেদনা তেমন কিছুই ছিল না। প্রায় ৩০-৩২ বছর পর বাঁ হাত আবার সেই একই অবস্থা। ছয়-সাত মাস আগে একদিন হঠাৎ বাঁ হাত নাড়াতে পারি না। চায়ের কাপ তুলতেও অসুবিধা। মুট করতে পারি না। সামনের হাত পেছনে নেওয়া যায় না। সে এক মারাত্মক অস্বস্তি। আবার সেই ব্যায়াম আর ব্যায়াম। আল্লাহর রহমতে পাঁচ-ছয় মাসে হাতের সব ব্যথা-বেদনা চলে গেছে। হাত নাড়াতে, মাথা আঁচড়াতে তেমন কোনো অসুবিধা নেই। তবে একটা অসুবিধা এখনো আছে- গত সাত-আট মাস জায়নামাজে বসে নামাজ পড়তে পারি না, চেয়ারে বসে পড়তে হয়। হাঁটুতে প্রচন্ড লাগে। তবে আশার কথা, মাঝেমধ্যে চেষ্টা করছি, অনেকটাই ব্যথা কমে এসেছে। হয়তো এক-দুই মাসের মধ্যে আল্লাহর দয়া হলে আবার মাটিতে বসে নামাজ আদায় করতে পারব। এবার ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করতে টাঙ্গাইল ঈদগাহ ময়দানে গিয়েছিলাম। প্রথম মনে হচ্ছিল হেঁটে যেতে অসুবিধা হবে। কিন্তু কোনো অসুবিধা হয়নি, হেঁটেই গিয়েছিলাম। ঈদের মাঠে পরিবেশ চমৎকার। ঈদুল ফিতরের জামাত হয়নি বৃষ্টির কারণে। আবহাওয়া খারাপ হতে পারে সেই ভয়ে মাঠে তেমন শামিয়ানা টানানো হয়নি। আগে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র ছিলেন জামিলুর রহমান মিরন। এখন সিরাজুল হক আলমগীর। ছাত্রকর্মীদের মধ্যে আলমগীর অন্যতম। ১৯৬৭-’৬৮ সালে ফারুক, মতি, স্মৃতি, আলমগীর ওরা ছিল এক অভিন্ন সত্তা। পৌর মেয়র হিসেবে আলমগীর তার কথা শেষ করেছিল। কিন্তু জেলা প্রশাসক শেষ করতে পারেননি। জেলা প্রশাসক ড. মো. আতাউল গনি বেশ ম্যাচুয়ুর মানুষ। যতবার কথাবার্তা বলেছি কখনো হতাশ হইনি। বরং ভালো লেগেছে। ঈদের মাঠে জেলা প্রশাসকের যেভাবে যা বলা উচিত তা তিনি সুন্দরভাবেই বলেন। এবারও বলছিলেন। তার কথায় তেমন কোনো ত্রুটি ছিল না। বড়জোর দুবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এক বা দুবার বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে সরকারের উন্নয়নমূলক গঠনমূলক দু-চারটি কথা বলছিলেন। তা আর কতক্ষণ হবে। বড়জোর ৩-৪ মিনিট। হঠাৎ মাঠের মধ্যে এমন একটা গর্জন উঠেছিল যা আমি স্বাধীনতার পর কখনো শুনিনি। ১৫-২০ সেকেন্ডের গর্জন। তারপর হয়তো আরও ২০ সেকেন্ড ডিসির কথা। সঙ্গে সঙ্গে নামাজ শুরু। আমি কেমন যেন কিছুটা স্তম্ভিত হয়েছিলাম। মানুষ কিছু শুনতে চায় না, মনে হয় সরকারের কথা একেবারেই না। এমন হলো কেন! এখনো এ ভাবনা থেকে দূরে আসতে পারিনি। বারবার মনে হয় কেন এমন হলো, কেউ কথা শুনতে চায় না। বিশেষ করে সরকারের কোনো কাজের কথা।
www.ksjleague.com সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন