অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী : বর্তমানে বাংলাদেশের যারা সুশীলসমাজের দাবিদার তাদের ব্যাপারে আমার মনে হয় এ কথাটি খুবই প্রযোজ্য যে, ‘পথিক তুমি পথ হারিয়েছ’। এই সুশীলসমাজের আসলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা এই যে, এঁরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শুধু রাষ্ট্রপ্রধানই ভাবেন। তার সঙ্গে তাঁদের বুঝতে হবে যে, তিনি শুধু দেশের রাষ্ট্রপ্রধানই নন, একই সঙ্গে রাষ্ট্রনায়কও। প্রধানমন্ত্রী অনেকে হতে পারেন, কিন্তু সবাই রাষ্ট্রনায়ক হন না। তার সঙ্গে আরও বিষয় যে বিষয়ে আমাদের সুশীলসমাজ একদমই অজ্ঞ তা হচ্ছে, এখানেই প্রধানমন্ত্রী শেষ নন। তিনি দার্শনিকও বটে। কেননা আমার মতে, শেখ হাসিনাকে যদি মূল্যায়ন করতে হয় তাহলে মূল্যায়ন করতে হবে একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেন কতগুলো দর্শন নিয়ে। তাঁর মূল দর্শন হচ্ছে দেশপ্রেম। তিনি দেশে এসে এত কম বয়সে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দলের সভাপতির দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর দেখা গেল যাঁরা তাঁকে দায়িত্বে আনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা তাঁকে ঠিকমতো বুঝতে পারেননি। তাঁরাই তাঁর বিরোধিতা শুরু করলেন। কিন্তু দেখা গেল, তিনি আওয়ামী লীগ প্রধান হয়ে দল পরিচালনার জন্য একটা দার্শনিক ভিত্তি গ্রহণ করলেন। তিনি মনে করলেন, আমার দলকে সঠিকভাবে সুসংগঠিত করে আমাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে আমার এ কাজগুলো করতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে বা তাঁর পরিবারকে সেদিন তারা হত্যা করেনি, হত্যা করেছিল বাংলাদেশকে। এটা বঙ্গবন্ধুকে শুধু হত্যা নয়, এটা তাঁর পরিবারকে হত্যা নয়, হত্যা করা হয়েছে বাংলাদেশকে। তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? তাদের কিন্তু একটি দর্শন ছিল হত্যা নিয়ে। যারা ষড়যন্ত্রকারী দেশি ও বিদেশি, তাদের দর্শন ছিল, বাংলাদেশ পাকিস্তানের একটি অঙ্গ হিসেবে থাকবে। কিন্তু কার্ল মার্কস যেটা বলেছেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়; কিন্তু একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় না। তারা কিন্তু বুঝতে ভুল করেনি। তারা সেভাবেই করেছে যে, এটা আগের মতো পাকিস্তান হবে না, কনফেডারেশন হবে না। কিন্তু পাকিস্তানের আদর্শে এ দেশটা চলবে। সেটা ভেবেই জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ একই কাজ চালিয়েছে। যেজন্য বঙ্গবন্ধুর খুনিদের কিন্তু এরশাদ ক্ষমতায় এসেও ওপরের দিকেই উঠিয়েছেন। এটা বাস্তব সত্য। তেমনিভাবে আমাদের দেশে যাঁরা বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ যাঁরা বুদ্ধিজীবী দাবি করেন, তাঁরা আসলে না বুঝেই দার্শনিকের বিরোধিতা করেন। একজন দার্শনিককে যদি আপনি বিরোধিতা করেন, যে কোনো লোক বিরোধিতা করে তবে তাকে অন্তত দুটি বিষয় বুঝতে হবে। একটি হচ্ছে দার্শনিকের দর্শন কী? তা বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, এ দর্শনের বিপরীতে আপনি কী দর্শন নিয়ে তাকে আক্রমণ করবেন তা-ও ঠিক করতে হবে। এঁরা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দর্শনও বোঝেন না এবং আমার মনে হয় কখনো বোঝার চেষ্টাও করেননি। তাঁরা তাঁকে শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বলেই ফুলস্টপ। সুতরাং তাঁদের এ কারণের জন্যই এ সাম্প্রতিককালে বলতে হয় যে, পদ্মা সেতুর পরে এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং দুটি পত্রিকা মিলে তারা আরেকটি ষড়যন্ত্র করছিল। সে ষড়যন্ত্রটি আমি যেটুকু বুঝি তাতে আমার মনে হয়, মোটামুটি ১৫ আগস্টের মতোই। তাদের প্ল্যানই ছিল। কিন্তু সেই কার্ল মার্কসের মতানুযায়ী একই ১৫ আগস্ট একইভাবে আবার সংগঠন করা যাবে না। কী করতে হবে তাহলে, জনগণ থেকে এ দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে আলাদা করে ফেলতে হবে। এজন্য তারা বিভিন্নভাবে তাদের মিডিয়া ব্যবহার করল, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের ভাড়াটিয়া বুদ্ধিজীবী জোগাড় করল, অপপ্রচার সমানে করা শুরু করল। কিন্তু তারা যে বিষয়টি করতে পারেনি তা হচ্ছে, এই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দর্শনকে যে কাউন্টার করবে, যে বিরোধিতা করবে তা তারা করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে স্বাভাবিক নিয়মে পদ্মা সেতুর ব্যাপারেই বলি, তারা যত রকম ষড়যন্ত্র করেছে কোনোটিই কোনো কাজে লাগল না। কাজে লাগল না শুধু এই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়কের যে সততা, তাঁর দৃঢ়তা, জেদ, ইতোমধ্যেই এর সঙ্গে তাঁর দর্শন। তিনি পদ্মা সেতু করেছেন একটি দর্শনের ভিত্তিতে।
এখন আসি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু এখন হঠাৎ করে ভাবলেন পদ্মা সেতুর পক্ষে প্রশংসা করলেই বোধহয় সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে বুদ্ধি থাকলে তো এসব হতো না। বুদ্ধিজীবীদের একটি বিষয়ের মারাত্মক ঘাটতি, সেটা হচ্ছে বুদ্ধি। যার বুদ্ধি নেই সে-ই হচ্ছেন এখন বুদ্ধিজীবী। কারণ যার জীবিকা অর্জনের জন্য আর কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই তিনি সরকারের বিরোধিতা করে, বিশেষ করে দার্শনিক শেখ হাসিনার বিরোধিতা করে নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলছেন। এখন বুদ্ধিজীবীদের জন্য ঢাকার রাস্তায় বা দেশে যে কোনো জায়গায় চলাচলে অসুবিধা। তারাই এখন একটা প্রবলেম হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এত লোককে সরিয়ে এরাই রাস্তায় ভিড় বাড়িয়েছেন। সাধারণ লোক দার্শনিক শেখ হাসিনাকে চেনে, তারা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই চেনে। তারা তো এসব বুদ্ধিজীবীকে চেনে না। যারা আমরা নিজেরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী মনে করি সেই বুদ্ধিজীবী শুধু নিজেই সন্তুষ্ট; কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে আধা পয়সার দাম নেই। সুতরাং এ বুদ্ধিজীবীদের ১৮০ ডিগ্রি টার্ন নেওয়ায় আমি আরও ভীত। ভীত এজন্য যে, এসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আসলে আরেকটি ষড়যন্ত্র যাতে করতে পারেন সেজন্য সাধারণ লোকের কাছে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর একটি প্রক্রিয়া তৈরি করেছেন। তাঁরা বুঝে ফেলেছেন যে, দার্শনিকের সঙ্গে তাঁরা আসলে বিরোধিতা করে কোনো সুবিধা করতে পারবেন না।
কারণ এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে কোনো দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার মতো আসবেন কি না অন্তত ব্যক্তিগতভাবে আমার এবং আমাদের মতো অনেকের সন্দেহ আছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দার্শনিক, যার জন্য তিনি তাঁর দর্শন দিয়ে আমাদের একটি দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশ গড়ার সুযোগ তিনি পাননি। এই দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক তাঁর দর্শন দিয়ে দেশকে একটা পর্যায়ে এনেছেন এবং যেভাবেই হোক না কেন এর প্রতিপক্ষ তাঁকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। এ কারণের জন্য তাঁরা এখন বিভিন্নভাবে ইনিয়ে-বিনিয়ে পদ্মা সেতুর পক্ষে কথা বলছেন। কিন্তু আসলেই এগুলো কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ। কথায় আছে, একবার যে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে চিরকাল সে স্বাধীনতার বিরোধিতা করবে এবং উল্টো হতে পারে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে টিকে থাকতে হয় তাহলে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের চর্চা নিয়মিত করতে হবে, না হলে তাঁরা পরিবর্তিত হয়ে যাবেন এবং অনেকে হয়েছেনও। তাঁরা একদম হান্ডেটে কার্ড নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে চলে যান। ঠিক আজকের এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা কিন্তু তাই। সুতরাং তাঁরা মিষ্টি কথা যতই বলুন, পত্রিকায় যতই লিখুন, মিডিয়ায় যতই গলা ফাটান, সামান্য বিশ্বাস করারও কোনো কারণ নেই এবং দার্শনিক শেখ হাসিনা যেহেতু দর্শন নিয়ে চলেন সুতরাং এসব দিয়ে তাঁকে খুশি করা যাবে বা কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। জনগণ চায় দেশ চালাক দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এবং তাঁর দর্শনের তারা বেনিফিশিয়ারি।
দেখা গেছে, যারা ক্ষমতায় থাকে, প্রথম তারাই সাধারণত অ্যারেস্ট হয়। তাদেরই প্রথম কারারুদ্ধ করা হয়। কিন্তু এক-এগারোয় অপজিট হলো। প্রথমে তারা শেখ হাসিনাকেই অ্যারেস্ট করল। আর যিনি তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাকে অ্যারেস্ট করল কয়েক মাস পরে। এই জেলে থাকার ফলে একদম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা এত বেড়ে গেল যে, ভয় পেয়ে ওরা তাড়াতাড়ি খালেদা জিয়াকে অ্যারেস্ট করল ব্যালান্স করার জন্য। কিন্তু ওই যে পেছনে পড়ে গেছে ওইটা কভার-আপ করতে পারেনি। যদি তারা প্রথম খালেদা জিয়াকে অ্যারেস্ট করত তাহলে হয়তো তখনকার আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয়তা এত তাড়াতাড়ি বাড়ত না। অন্তত একটু সময় নিত। কিন্তু ওই যে কয়েক মাস দেরি করেছে ওতেই জনগণের মোটামুটি একটা মাইন্ডসেট হয়ে গেছে। মাইন্ডসেটটা হচ্ছে শেখ হাসিনার প্রতি। নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৮ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেন এবং এসেই তিনি ১৯৯৬ সালে যে দর্শনে ছিলেন, তা প্রতিফলিত করার চেষ্টা শুরু করলেন। সেগুলো আবার মাঝখানে সাত বছর পথভ্রষ্ট হয়েছিল। সেজন্য আমি হেডিংয়ে বলেছি, পথিক তুমি পথ হারিয়েছ। তখন কিন্তু একই কথা বলা চলে- দেশ তখন পথ হারিয়েছিল। এ দেশকে আবার সঠিক পথে এনে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করে চলেছেন এবং দার্শনিকের দর্শনটা না বোঝার ফলে যারা বিরোধিতা করে তারা তো ভুল পথে করে। যেমন গোলপোস্ট একদিকে, বল হিট করল অন্যদিকে। তাতে তো কোনো দিন গোল হবে না। গোল করতে হলে গোলপোস্টেই গোল করতে হবে এবং ক্রিকেট খেলার নিয়ম দিয়ে তো ফুটবল খেলা যাবে না। এখানে তো দেশটা আসলে পরিষ্কার দুই ভাগ। একদিকে দার্শনিক শেখ হাসিনা তাঁর দর্শন নিয়েছেন, অন্যদিকে যারা বিরোধিতা করে সবাই মিলে নিজেদের একমাত্র মিডিয়া তাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি মনে করি, এ দেশের বুদ্ধিজীবী এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে কিছু ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া যে এখন পথ হারিয়ে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ককে সমর্থন করছে এটা আসলে বোধোদয় সঠিক মূল্যায়ন হবে না। বরং সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে এরা একটা মতলববাজ। এরা এসেছে আবার কী করে কোন ষড়যন্ত্র করা যায়। সেই ষড়যন্ত্রের পটভূমি তৈরি করার জন্য জনগণের মধ্যে নিজেদের একটু অবস্থান গড়ার চেষ্টা করছে। অতএব সাধু সাবধান!
লেখক : সাবেক উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, বিএমআরসি।
Email : [email protected] সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন