মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.) পিএইচডি : খ্রিস্টপূর্ব বিংশ সহস্রাব্দ বা খ্রিস্টবর্ষ শুরুর ২০ মিলেনিয়াম বছর আগে নদী বা জলজ এলাকা পারাপারের জন্য মানুষ গাছের শুকনা কান্ড বা বাঁশের বান্ডেল ব্যবহার করেছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তারই ধারাবাহিকতায় সেই আদিকাল থেকে নৌকার প্রচলন। যুগে যুগে নৌকা কেবল যানবাহনই নয়, পানিসংশ্লিষ্ট দুর্যোগের সময় আশ্রয় ও উদ্ধারের বাহন হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে নৌকার কথা ঠাঁই পেয়েছে উদ্ধারকারী জলযান হিসেবে। পবিত্র কোরআনের ১০ নম্বর সুরা ইউনুসের ২২ নম্বর আয়াতে এবং ২৯ নম্বর সুরা আন কাবুতের ১৫ নম্বর আয়াতে হজরত নুহ (আ.)-এর সময় সৃষ্ট মহাপ্লাবনে নৌকার সাহায্যে মানব ও প্রাণিকুল রক্ষার বর্ণনা রয়েছে। ইহুদি ধর্মমতে, ‘সানহেড্রিন’ নামে পরিচিত ২৩ অথবা ৭১ জন ব্যক্তির বয়ানে ১০৮/বি অধ্যায়েও নৌকার মাধ্যমে হজরত নুহ (আ.) কর্তৃক প্লাবনজনিত বিপদ থেকে মানুষ ও পশুপাখির উদ্ধারের বর্ণনা পাওয়া যায়। খ্রিস্টধর্মগ্রন্থ বাইবেলের জেনেসিস ৬:১৩ থেকে ৯:২৯ পর্যন্ত বাক্যে নৌকার সাহায্যে মহাপ্লাবনকালে হজরত নুহ (আ.) ও তাঁর সঙ্গী এবং পরিবারসহ সৃষ্টিজগতের সব ধরনের নর ও নারী প্রকৃতির জীব, জন্তু ও পাখির জীবন রক্ষার বর্ণনা পাওয়া যায়। হিন্দুধর্মের একাধিক পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থে নৌকাকে মহাপবিত্র বাহন ও ত্রাতা বা উদ্ধারকারী যান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হিন্দুদের দেবতা বিষ্ণু (অন্য নাম হরি বা নারায়ণ)-এর পার্থিব রূপ হলো ‘মৎস্য’ বা মাছ। মহাগ্রন্থ মহাভারতের তৃতীয় গ্রন্থ ‘ভানু প্রভা’র ১২.১৮৭ নম্বর অধ্যায়ে দেবতা ‘মৎস্য’ স্বয়ং নৌকার আকার ধারণ করে মহাপ্লাবনের সময় ‘মানু’ তথা মানব জাতিকে রক্ষা করেছেন বলে উল্লিখিত।
ইতিহাসের পাতার অনেকটা জুড়েই আছে নৌকার অবস্থান। ১৪৯২ সালের ১২ অক্টোবর ইতালির নাবিক, পর্যটক ও অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস নৌকাযোগে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় প্রথম পা রাখেন। প্রতি বছর ১২ অক্টোবর আমেরিকায় ‘কলম্বাস ডে’ পালিত হয় এবং সরকারি ছুটি উপভোগ করা হয়। আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে আলআসকা, ক্যালিফোর্নিয়া, ডেলোয়ার, ফ্লোরিডা, আইওয়া, কানসাস, নেবরাসকা, নিউ হেম্পসশাইর, নিউইয়র্ক, নর্থ ক্যারোলিনা, ওকলাহোমা, অরিগন, পেনসিলভানিয়া, সাউথ ডেকোটা, টেনসেসে ও গুয়াম এ ১৮টি রাজ্যের সরকারি প্রতীক বা সিম্বলে ছোটবড় যান্ত্রিক ও ধোঁয়াযুক্ত নৌকার অস্তিত্ব রয়েছে। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর ১৪৯৮ সালের ২০ মে পর্তুগিজ নাবিক, পর্যটক ও অভিযাত্রী ভাস্কো দা গামা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ভারতের কেরালা রাজ্যের মালাবার উপকূলে পৌঁছেন নৌকাযোগে। ভারতে নৌকার বেশ প্রভাব দেখা যায় নানা কারণে।
সার্কভুক্ত দেশের রাজনীতিতে নৌকা প্রতীক বেশ জনপ্রিয়। শ্রীলঙ্কার তামিল মাক্কাল, ভিদুথালাই পলিকাল, মালদ্বীপের ধিভেহি বাইউইথউনসি পার্টি, পাকিস্তানের অল পাকিস্তান তেহরিক ও ভারতের ভিকাশেল ইনসান পার্টি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। নৌকার আদলে জাহাজ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নামে আসামের আসাম জাতীয় পরিষদ (এজিপি) এবং পাকিস্তানের পাকিস্তান ফালাহ পার্টি (পিএফপি)। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নৌকার অবস্থান অনন্য উচ্চতায়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাশ লেনের ‘রোজগার্ডেনে’ বর্তমান ক্ষমতাসীন ও দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। এ দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে নৌকা প্রতীক নিয়ে দলটি ১৯৭০, ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনী জয়ী হয়। এর মধ্যে ২০০৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত টানা ১৪ বছর দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিপুল ভোটে জয়লাভ এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে দলকে টেনে তুলেছেন এক নতুন উচ্চতায়। এ উচ্চতার কারণে নৌকার পালে লেগেছে প্রবল বাতাস। সে বাতাসে নৌকা আজ নদ-নদী ছেড়ে ঠাঁই করে নিয়েছে নানা স্তরের নানা আকৃতির ও নানা ধান্ধার নেতা, পাতিনেতা, উপনেতা ও হাইব্রিড নেতাদের বুক পকেটে, কোটের বুকে, পোস্টারে, ব্যানারে, শাড়ি, চাদর ও মাফলারের ছাপায়, অফিস-আদালতে এবং ড্রয়িংরুমের শোকেসে। বক্তৃতার মঞ্চ ও রাস্তার তোরণ নির্মাণ হয় নৌকার আদলে। নির্বাচনের আগে গাছের আগায়, সুউচ্চ ভবনে, ভ্যানগাড়ি, পিকআপ এবং ট্রাকে নির্মিত হয় নৌকার অবয়ব, বিজয় দিবস প্যারেডে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সরকারি টাকায় খোলা ট্রাকের ওপর প্রতীকী নৌকা বানিয়ে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রম প্রদর্শনীর প্রতিযোগিতায় নামে। ২৫ জুন, ২০২২ পদ্মা সেতুর উদ্বোধনীর দিন রাস্তায় চলাচল নিষিদ্ধ নসিমনে কাপড় দিয়ে নৌকা বানিয়ে তীব্রগতিতে ছুটে চলেছেন এক ব্যক্তি। মিডিয়ার কল্যাণে যা প্রত্যক্ষ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সমগ্র দেশ তথা বিশ্ববাসী। তবে মিডিয়ার সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও পদ্মা নদীর বুকে কোনো নৌকা খুঁজে পাইনি।
একইভাবে বৃহত্তর সিলেটের বন্যাদুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষ ও গবাদি পশু উদ্ধার এবং ত্রাণ বিতরণের জন্য পর্যাপ্ত নৌকা বা নৌযান নেই বলে মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ১৮ জুন, ২০২২ অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ ২৪ ডটকম সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমানের বক্তব্যের আলোকে জানায়, বন্যাউপদ্রুত এলাকায় অনেকেই পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তাদের জন্য নৌকা এখন অধরা বা দুুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আলীরগাঁওয়ের বানভাসি আজিজ মিয়া ওই নিউজ পোর্টালের প্রতিনিধিকে বলেছেন, বানভাসিরা রিলিফ প্রত্যাশা করে না, তারা শুধু বাঁচতে চায়। অথচ সেখানে তাদের উদ্ধার করার মতো পর্যাপ্ত নৌকা নেই। পরবর্তীতে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীসহ বিভিন্ন বিভাগ, মন্ত্রণালয় ও সংস্থার পাশাপাশি এনজিওসহ সব শ্রেণির মানুষের সহায়তায় পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে থাকে। প্রয়োজনের সময় নৌকা কাছে না পাওয়ার বিষয়টি সত্যিকারের নৌকাভক্ত তথা প্রকৃত আওয়ামীপ্রেমী কিংবা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার আদর্শের কর্মী ও সেবকদের জন্য দুঃখজনক। বহু টাকা ব্যয় ও বহু গবেষণা ও জ্ঞানচর্চা করে বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য করণীয় বিষয় নিয়ে বহু সরকারি দিকনির্দেশনা বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) প্রস্তুত করা হয়েছে। বন্যার আগেই স্থানীয় প্রশাসন, প্রতিরক্ষা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, উদ্ধারকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রস্তুতিমূলক সভা করার নির্দেশনা রয়েছে এই এসওপিতে। সব বাহিনী ও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের বুনিয়াদি বা মৌলিক প্রশিক্ষণসহ বহু প্রশিক্ষণে বিষয়টি শিক্ষা দেওয়া হয়। এসওপি অনুসরণ এবং তাত্ত্বিক জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ ঘটলে বন্যার আগেই প্রয়োজনীয় উদ্ধারকারী নৌযান সুনির্দিষ্ট করা থাকত বা প্রস্তুত থাকত। ‘নোটিস টু মুভ’ (এনটিএম) দেওয়া এসব নৌযান যথাসময়ে প্রশাসনের নির্ধারিত স্থানে আগে থেকেই প্রস্তুত যা থাকাটাই বন্যা মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতির শিক্ষা। বাস্তবে এর প্রয়োগ হলে নৌকা বা নৌযান ঘাটতির বিষয়টি এভাবে দেখা দিত না। ২০০৭ সালে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এরশাদকে তাঁর ক্ষমতাকালে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫২০টি নৌকা ও ১০টি পানি বিশুদ্ধকরণ মেশিন ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগে দুই বছরের জেল দেওয়া হয়। জাপানে নির্মিত এসব উন্নতমানের নৌযান ছিল ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ পরিচালনার জন্য আদর্শ বাহন। সেই ৫২০টি নৌকা আজ কোথায় কী অবস্থায় আছে নাকি কাগজে আছে, বাস্তবে নেই- সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বন্যার পানি হঠাৎ চলে আসার কথা আগে মানা গেলেও বর্তমানে মানা কঠিন। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সময় ঘটা করে জানানো হয়েছিল আমরা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য এখন আর অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকব না। আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইটই এখন আগাম জানাবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস। তাহলে সিলেটের উজানে বিশেষত ভারতীয় অংশে ১২২ বছরের ইতিহাস ভঙ্গকারী মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা প্রশাসনের অজানা থাকার কথা নয়। সময়মতো নৌকা পাওয়া গেল না কেন- এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশে বর্ষাকালের এখনো এক চতুর্থাংশও পার হয়নি। যে কোনো সময় দেশের যে কোনো স্থানে বাড়তে পারে নদ-নদীর পানি। বন্যার পানি নেমে গেলেও নদী ভাঙন, খাদ্য সংকট, রোগ বৃদ্ধিসহ নানা উপসর্গ দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। ভেঙেপড়া বাঁধ, রাস্তাঘাট সংস্কার ও ডুবে যাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবারই প্রস্তুতি প্রয়োজন। নৌকাভক্তদের উচিত বন্যাপ্রবণ এলাকায় বন্যার আগেই প্রস্তুত থাকা। রাজপথে হাইব্রিড নেতা আর চাঁদাবাজদের নামানো আর দুর্গতদের পাশে কাঠের নৌকার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। আজকাল নৌকায় ভাসমান গো-খামার, স্কুল, পাঠাগার, মসজিদ, বসত, রিসোর্টসহ অনেক কিছুই হচ্ছে।
আশা করি নৌকাভক্তরা ভবিষ্যতে কেবল সরকারের দিকে না তাকিয়ে নিজেদের অর্থে প্রতিটি বন্যাপ্রবণ এলাকায় পর্যাপ্ত নৌযান প্রস্তুত রাখবেন, যা কেবল ত্রাণ বিতরণ বা উদ্ধারই নয়, প্রয়োজনে বানভাসি মানুষ ও গবাদি পশুগুলোকে ক্ষণিকের জন্য আশ্রয়ও দেবে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন