ছবি: সংগৃহীত
নিরাপত্তা-বলয়ের মধ্যে নিয়ে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ডিজিটাল সার্ভিলেন্স সিস্টেমের আওতায় আসছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২৫০ কিলোমিটার রাস্তা। বিশেষ এ সেন্সরযুক্ত ক্যামেরায় যানবাহনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি নির্দিষ্ট গতিসীমা ক্রস করা যানবাহনের নামে ভিডিও মামলা দেওয়ার সুবিধা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭২টি নতুন হাইওয়ে থানার প্রস্তাব করা হয়েছে। মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে এবং শৃঙ্খলা ফেরাতে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একই সঙ্গে জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার যানবাহন বন্ধে জোরালো অভিযানও চালানো হবে। মহাসড়কে কর্মরত হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে ৬১টি বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
হাইওয়ে পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মো. শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। সারা দেশে ৯ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার কিলোমিটার রয়েছে হাইওয়ে পুলিশের আওতায়।’ তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড থেকে চট্টগ্রামের সিটিগেট পর্যন্ত ২৫০ কিমি সিসিটিভি মনিটরিং সিস্টেমের কাজ প্রায় শেষ। ২০১৮ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। ইতোমধ্যে কাজের ৭০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে।
জানা গেছে, দেশে বর্তমান ৯৬টি জাতীয় মহাসড়কের পরিধি ৩ হাজার ৯৯৪ কিলোমিটার ও ১২৬টি আঞ্চলিক মহাসড়কের পরিধি ৪ হাজার ৮৮৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া জেলা সড়ক রয়েছে ১৩ হাজার ৫৯২ কিলোমিটার। এর মধ্যে সব থেকে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে জাতীয় মহাসড়কে। কারণ হিসেবে দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এ সড়কে অবাধে থ্রি-হুইলার যানবাহনের চলাচল, বেপরোয়া গতি ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধ বিচরণ। এ কারণে দেশের মহাসড়কে তথা হাইওয়েতে নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে পুলিশের বিশেষ ইউনিট ‘হাইওয়ে পুলিশ’ বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পাইলট প্রকল্পের আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সেন্সরযুক্ত সিসিটিভি বসানো হচ্ছে। এই ক্যামেরায় এক মাস পর্যন্ত ফুটেজ সংরক্ষণ থাকবে।
এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। পর্যায়ক্রমে বাকি সড়কগুলোতেও কাজ শুরু হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উভয় পাশে ক্যামেরা স্থাপনের কাজ চলছে। যেসব সড়কে সিসি ক্যামেরা থাকবে, সেখানে কোনো গাড়ি আইন অমান্য করলে সেটির নম্বর প্লেট কন্ট্রোল রুমে সিসি ক্যামেরার পর্দায় (স্ক্রিনে) ভেসে উঠবে। ফলে ‘অটোমেটিক ডিটেকশন ব্যবস্থা’য় গাড়িগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলার আওতায় আসবে। এরপর ঠিকানা যাচাই-বাছাই হওয়ার পর মামলার কাগজপত্র চলে যাবে সংশ্লিষ্ট ঠিকানায়। এসব বিষয়ে তদারকির জন্য প্রতিটি জোনে বসানো হবে আলাদা আলাদা কন্ট্রোল রুম। একই সঙ্গে বিষয়গুলো আরও তদারকির জন্য নতুন করে ৭২টি হাইওয়ে থানা স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু হওয়ার পর অটোমেটিক নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ, যানবাহনের গতিপথ নির্ধারণ, হাইস্পিড ডিটেকশন ও ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারী যান দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে। ক্যামেরা স্থাপিত হলে অন্ধকার ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ায়ও রাস্তায় চলাচলরত যানবাহনের নম্বর প্লেটের স্পষ্ট ছবি ধারণ ও সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকবে। কোথাও কোনো ঝামেলা বা অপরাধের কারণে লোকসমাগম বেশি হলে মনিটরিং সেলে আগাম সংকেত চলে আসবে। আইন অমান্য করার পর পুলিশ না ধরলেও সমস্যা নেই। যানবাহনের ঠিকানায় মামলার কাগজপত্র চলে যাবে। মামলার তথ্য চলে যাবে যানবাহনের মালিকের মোবাইলেও। বিভিন্ন উন্নত দেশে এভাবেই যানবাহনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কয়েকটি পুলিশ স্টেশনে সিসিটিভির কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া পুলিশ সদর দফতর ও হাইওয়ে পুলিশের সদর দফতরেও আলাদাভাবে কন্ট্রোল রুম থাকবে। টমটম-নসিমনসহ থ্রি-হুইলার যানবাহন মহাসড়কে উঠলেই তা স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পাবে কন্ট্রোল রুম। এরপর ওই এলাকায় দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হবে। ওই কর্মকর্তা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। এ ধরনের যানবাহনের বিরুদ্ধে ডাম্পিং করার নির্দেশনা থাকবে।
জানা গেছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বসানো সিসি ক্যামেরা কার্যক্রমকে টেস্ট হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এ মহাসড়কে সার্বক্ষণিক নজরদারি বাড়াতে চারটি জোন করা হয়েছে। এগুলো হলো- ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম। এসব জোনের ২৫০ কিলোমিটার জুড়ে সিসি ক্যামেরা বসানোর কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। ৪টি জোনে ১ হাজার ৪২৭টি সিসি ক্যামেরা বসছে। এসবের মধ্যে লং ভিশন পিটিজেড ডোম ক্যামেরা ১৬টি, পিটিজেড ডোম ক্যামেরা ৪৭১টি, বুলেট ক্যামেরা ৯২৪টি ও চেক পয়েন্ট ক্যামেরা ১৬টি। বিদ্যুৎ চলে গেলে ব্যাকআপ পাওয়ার সিস্টেমসহ ৪৯০টি স্থানে ভিডিও সাইটপোল থাকবে। পাশাপাশি একটি সেন্ট্রাল কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার, ৫টি মনিটরিং সেন্টার, ৫ পেটাবাইটের ডেটা সেন্টার, ডেটা সেন্টারের মডিউলার সিস্টেম (এসিসহ), নেটওয়ার্ক সিস্টেম, ভিডিও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ভিপিও অ্যানালাইসিস সিস্টেম ও অটোমেটিক নম্বর প্লেট রিকগনিশন সিস্টেম রয়েছে।
এ ছাড়া হাইওয়েতে সার্বক্ষণিক নজরদারি বৃদ্ধি করে নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। বহির্বিশ্বে রপ্তানি করা পণ্যবাহী যানবাহন থেকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার মালামাল চুরি বা ছিনতাই রোধ করতে এটি সহায়তা করবে। ডিজিটাল অটো ফাইন সিস্টেম, যানবাহনের গতিপথ শনাক্ত, হাইস্পিড ডিটেকশন, ট্রাফিক ফ্লো বিশ্লেষণ, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনকারী যানবাহন শনাক্ত, সন্দেহজনক অনুপ্রবেশ শনাক্ত, গুরুত্বপূর্ণ বস্তু শনাক্ত করার লক্ষ্যে সারা দিনের ভিডিওর সারাংশ তৈরি করে সংক্ষিপ্ত আকারে দেখা, ভিডিও অনুসন্ধান করা, অপরাধ বিশ্লেষণ ও অপরাধীকে শনাক্ত, হাইওয়ের রিয়েল টাইম মনিটরিং, অপরাধী বা সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা বস্তুর আচরণ বিশ্লেষণ এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে নির্দিষ্ট তথ্য মোতাবেক মহাসড়কে ট্রাফিক ও অপরাধ-সংক্রান্ত ঘটমান যে কোনো তথ্য দ্রুততার সঙ্গে পাওয়া যাবে। এ সুবিধাগুলো অন্য মহাসড়কগুলোর সিসি ক্যামেরায়ও রাখা হবে।
হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি (মিডিয়া) মো. শামসুল আলম বলেন, গত সাত মাসে মহাসড়কে আইন অমান্য করায় ১ লাখ ২০ হাজার ১৩টি যানবাহনকে ৩৪ কোটি ৬৭ লাখ ৮৩ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই সময়ে মহাসড়কে ১ হাজার ৪৭৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ১ হাজার ২৪২ জন নিহত এবং ১ হাজার ৪৯৭ জন আহত হয়েছেন। গত সাত মাসে মহাসড়ক থেকে ৪০ হাজার ২০১টি থ্রি-হুইলার জব্দ করাসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন