ফাইল ছবি
তসলিমা নাসরিন :৯১ সালে আমি চারটি উপন্যাসিকা বা নভেলা লিখেছিলাম। শোধ, নিমন্ত্রণ, অপরপক্ষ, ভ্রমর কইও গিয়া। এই চারটির মধ্যে তিনটিই নারীর অধিকারের গল্প। শুধু নিমন্ত্রণ উপন্যাসিকাতে বর্ণনা করেছি নারী-নির্যাতন আর পুরুষতন্ত্রের ভয়াবহতা। নিমন্ত্রণ লেখার জন্য নিন্দে শুনেছি অনেক। লোকে বলেছে, এ তো আগাগোড়াই পর্নোগ্রাফি, এ তো চটি ছাড়া কিছু নয়, এ তো যৌনতার রগরগে বর্ণনা। চারদিকে আমার দুর্নাম ছড়িয়ে দেওয়া হলো। দুর্নাম আলোর গতিতে চলে। দেশের লোক জানলো আমি পর্নো লিখি। কিন্তু কী ছিল আমার নিমন্ত্রণ উপন্যাসিকাটিতে? একটি অষ্টাদশী তরুণী ভীষণ প্রেমে পড়ে এক সুদর্শন যুবকের। যুবক কিন্তু তরুণীটির নাগালের বাইরে। তরুণী তাকে চিঠি লেখে প্রতিদিন। চিঠিতে প্রেম নিবেদন করে। যুবকের হাতে সেসব চিঠি পৌঁছোয় না। যখন যুবকটি জানতে পারে তরুণীর এমন একতরফা ভালোবাসার কথা, যুবক তার সঙ্গে দুদিন প্রেমের অভিনয় করে তাকে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করে তার বাড়িতে। যুবকের জন্য দামি উপহার কিনে নিয়ে তরুণী সেজেগুজে যায় যুবকের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। বাড়িতে যুবক আর তার সাত বন্ধু ছাড়া কেউ ছিল না। তারপর যুবক তার সাত বন্ধুসহ তরুণীকে ধর্ষণ করে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর বিধ্বস্ত রক্তাক্ত অর্ধনগ্ন তরুণীটি যখন বাড়ির পথে যেতে থাকে, সে মনে মনে বলে বাড়িতে বাবা যখন তাকে জিজ্ঞেস করবে কোথায় গিয়েছিল সে, সে মিথ্যে কথা বলবে না, বলবে তার নিমন্ত্রণ ছিল। এখানেই উপন্যাসিকাটি শেষ হয়। বইটিতে যে ধর্ষণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেটি নারীবিদ্বেষীদের কাছে মনে হয়েছে যৌনতার বর্ণনা। নারীবিদ্বেষীতে সমাজ উপচে উঠলে নারী নির্যাতনকে স্বাভাবিক বলে মনে হয়, ধর্ষণকেও স্বাভাবিক বলে মনে হয়।
নিমন্ত্রণের কাহিনি অবাস্তব কোনও কাহিনি নয়। লোকেরা অস্বীকার করে, এমন ঘটনা নাকি ঘটে না, অথবা স্বীকার করে, বলে এমন ঘটনা ঘটে, তবে মেয়েদের দোষে ঘটে। কী রকম দোষ? দোষ মেয়েরা কেন প্রেমে পড়লো, মেয়েরা কেন গেল পুরুষের কাছে, গেলে তো ধর্ষিতা হবেই। যারা ধর্ষিতার ওপরই ধর্ষণের দোষ চাপায়, তারা চায় মেয়েরা ঘরের বাইরে না যাক, কারও প্রেমে না পড়ুক, কাউকে বিশ্বাস না করুক, কারও নিমন্ত্রণ রক্ষা না করুক। তারা কিন্তু পুরুষের দোষ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে না, বলবে না পুরুষের কোনও অধিকার নেই মেয়েদের যৌন হেনস্তা করার, মেয়েদের ধর্ষণ করার। ধর্ষণের শিকার হওয়ার দোষ যদি মেয়েদেরই, যৌন হেনস্তার শিকার হওয়ার দোষও মেয়েদেরই, অন্যায় অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হওয়ার দোষও মেয়েদেরই। পুরুষের সব অপকর্মের পেছনে যুক্তি বের করা হয়, তাদের সব অন্যায়কে ন্যায্যতা দেওয়া হয়। এই তো আমাদের চেনা সমাজের চেনা চেহারা।
নতুন একটি খবর তুলে ধরছি, “রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি ফ্ল্যাটে ২৫ দিন শেকলে বেঁধে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের পর এক তরুণীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত শনিবার জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী ২৩ বছর বয়সী তরুণী রবিবার বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় প্রেমিকসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। পুলিশ জানায়, টানা ২৫ দিন একটি ফ্ল্যাটে ওই তরুণীকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ করে প্রেমিক ও তার দুই বন্ধু।”
নিমন্ত্রণে ধর্ষক-প্রেমিকের নাম ছিল মনসুর, মোহাম্মদপুরের ধর্ষক-প্রেমিকের নাম সান। নিমন্ত্রণে ছিল সাত বন্ধু নিয়ে প্রেমিকাকে ধর্ষণ করে প্রেমিক, মোহাম্মদপুরে দুই বন্ধু নিয়ে প্রেমিকাকে ধর্ষণ করে প্রেমিক। নিমন্ত্রণে ধর্ষকেরা মেয়েটিকে কয়েক ঘণ্টা বন্দি করেছিল, মোহাম্মদপুরে ধর্ষকেরা মেয়েটিকে ২৫ দিন বন্দি করেছিল। ধর্ষকদের চরিত্রে অবশ্য কোনও পার্থক্য নেই। তারা সকলেই মনে করে মেয়েরা যৌনবস্তু। সেই যৌনবস্তুর ওপর তারা দেখাতে চায় তাদের পৌরুষের জোর। এই পৌরুষ আসলে কোনও সাধারণ পৌরুষ নয়, এ বিষাক্ত পৌরুষ।
সমতার সমাজ গড়তে হলে পুরুষকে তাদের বিষাক্ত পৌরুষ বা টক্সিক মাস্কিউলিনিটি সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হবে। কোনও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন নারীর পক্ষে সম্ভব নয় নিজের বিষাক্ত পৌরুষ নিয়ে অহংকার করা পুরুষের সঙ্গে বসবাস করা। আমি জানি লক্ষ লক্ষ নারী বাধ্য হয়ে নারীবিদ্বেষী পুরুষের সঙ্গে বাস করে। এ যে কত বড় যন্ত্রণার, এ যারা বাস করে, তারাই উপলব্ধি করে।
এখন অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, পুরুষেরা কি সত্যিকার প্রেমিক হতে পারে না? সব প্রেমিকই কি বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রেমিকাকে ধর্ষণ করে? না, মোটেও তা করে না। যে পুরুষ বিশ্বাস করে তার পৌরুষ তাকে মানবসমাজে সবার ওপরে স্থান দিয়েছে, যে পুরুষ বিশ্বাস করে নারীকে দমন করার, দলিত করার, অপমান করার, অপদস্ত করার, নিগৃহীত করার, নির্যাতন করার অধিকার তার আছে, সেই পুরুষ ক্ষতিকর। যে পুরুষ বিশ্বাস করে নারীর সমানাধিকারে, যে পুরুষের পৌরুষ বিষাক্ত হয়ে এখনও যায়নি, সে পুরুষ নারীর জন্য ক্ষতিকর নয়। দিন দিন বিষাক্ত পৌরুষ বাড়ছে। দিন দিন নারীবিদ্বেষ বাড়ছে। দিন দিন পুরুষের শর্তে নারী জীবনযাপন করছে, নারীর শর্তে নয়। পুরুষ যেভাবে নারীকে দেখতে চায়, সেভাবে নারী তাদের তৈরি করছে। প্রতিনিয়ত তৈরি করছে।
নারী কী চায়? আমার মনে হয় নারীর চাওয়া এখনও স্পষ্ট হয়নি। নারী কীভাবে নিজের জীবন নিজের মতো যাপন করতে চায়? এখনও তারা জানে না ‘নিজের মতো’র ব্যাপারটা ঠিক কী। পুরুষ রচিত ধর্ম, পুরুষ রচিত সমাজ, পুরুষ রচিত পুরুষতন্ত্র বা পুরুষ-আধিপত্যবাদ যেভাবে নারীকে পরিচালিত করেছে, নারী সেভাবে পরিচালিত হয়েছে। নারীর সাধ আহলাদ ইচ্ছে স্বপ্ন গড়ে উঠেছে পুরুষের শিখিয়ে দেওয়া সংজ্ঞায়। এই সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা নারীর জন্য এখনও দুরূহ।
নিমন্ত্রণ আমি লিখেছিলাম নারীকে সচেতন করার জন্য। ধর্ষক পুরুষের ফাঁদে যেন নারী পা না দেয়। কিছু নারী সচেতন হয়েছে নিশ্চয়ই। বাকি নারীরা সচেতন হয়নি বলে আজও এমন সংঘবদ্ধ নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে সমাজে। এই কথা অন্যভাবে লিখলে সেটা বেশি যৌক্তিক হয়। যেমন: নিমন্ত্রণ আমি লিখেছিলাম পুরুষকে সচেতন করার জন্য। পুরুষেরা যেন নারীকে ফাঁদে না ফেলে। কিছু পুরুষ সচেতন হয়েছে নিশ্চয়ই। বাকি পুরুষেরা সচেতন হয়নি বলে আজও এমন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে।
যে পুরুষ সত্যিকার শিক্ষিত এবং সভ্য, সে পুরুষ নিজেকে যেমন মানুষের জাত বলে মনে করে, তেমন মেয়েদেরও ওই একই মানুষের জাত বলেই মনে করে, সে পুরুষ বিশ্বাস করে মানুষের জাতের অধিকার আছে শিক্ষার-স্বনির্ভরতার-স্বাধীনতার, অধিকার আছে যেমন ইচ্ছে তেমনভাবে বাঁচার, সে পুরুষ গভীর রাতে নির্জন রাস্তায় একাকী কোনও মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখলেও এক ফোঁটা বিরক্ত করবে না। আর যে পুরুষ মেয়েদের যৌন নির্যাতন করার বস্তু বলে ভাবতে শিখেছে, সে পুরুষ মেয়েরা দিনের বেলায় ভিড়ের রাস্তায় হেঁটে গেলেও তাদের বুক খামচে ধরবে, তাদের নিতম্বে হাত দেবে, ভিড়ের বাসে বা ট্রেনে দাঁড়ালেও তাদের যৌন হেনস্তা করবে। গভীর রাত, নির্জনতা, মেয়েদের ছোট পোশাক, মেয়েদের মধুর চাহনি, বাঁকা হাসি, প্রেমে পড়া, নেশাগ্রস্ত থাকা- এসব কোনও কারণ নয় ধর্ষণ ঘটার। ধর্ষণ ঘটে পুরুষের কারণে, পুরুষ যদি বিশ্বাস করে যেহেতু সে পুরুষ, সেহেতু নারীকে ধর্ষণ করার অধিকার আছে তার, নারীকে অত্যাচার করার, নির্যাতন করার সব রকম অধিকার তার আছে। নারীবিদ্বেষ ধর্ষণ ঘটায়, নারীর প্রতি ঘৃণা ধর্ষণ ঘটায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশের শতকরা ৬০ ভাগ পুরুষ তাদের প্রেমিকা বা স্ত্রীদের শুধু মানসিক নির্যাতন নয়, শারীরিক নির্যাতনও করে। প্রেমিকা বা স্ত্রীদের শারীরিক নির্যাতন বিশ্বের কোন দেশের লোক সবচেয়ে বেশি করে? প্রথম ইথিওপিয়া, দ্বিতীয় বাংলাদেশ। ‘অধিকার’ নামে বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৩ হাজার ৭১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এর মধ্যে ৬ হাজার ৯০০টি প্রাপ্ত বয়স্ক, আর ৭ হাজার ৬৬৪টি শিশু। এ ছাড়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণ বা গণধর্ষণের সংখ্যা ২ হাজার ৮২৩। যদি ‘ম্যারিটাল রেপ’ গোনা হতো অর্থাৎ স্বামী দ্বারা স্ত্রীরা যে ধর্ষিতা হয় তা হিসাব করা হতো, তবে পরিসংখ্যানে দেখা যেত, ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা হাজার নয়, বরং লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও জানিয়েছে যে বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে। বাংলাদেশে ধর্মচর্চা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। ধর্মচর্চা বাড়লে, মানুষ ধারণা করেছিল, দুর্নীতি কমে যাবে, ঘুষ নেওয়া কমে যাবে, অন্যায় অবিচার কমে যাবে, গরিবের ওপর শোষণ কমে যাবে, যৌন হেনস্তা কমে যাবে, ধর্ষণ কমে যাবে। অথচ আশ্চর্য এই যে, যত ধর্মচর্চা বেড়েছে, তত দুর্নীতি বেড়েছে, লোক ঠকানো বেড়েছে, মিথ্যেচার বেড়েছে, ধর্ষণ বেড়েছে। আমরা আশ্চর্যই বা কেন হই, এ কথা তো কারও অজানা নয় যে ধর্মচর্চার পরিণতি যদি ধর্মান্ধতা হয়, তাহলে নারী-পুরুষে বৈষম্য বাড়ে। নারী-পুরুষে বৈষম্য বাড়লে ধর্ষণ বাড়ে। হিসাবটা কঠিন নয়। যত ধর্মের প্রকোপ বাড়বে বা যত ধর্মান্ধতা বাড়বে, তত নারীর মূল্য কমবে। যত নারীর মূল্য কমবে, নারী তত বেশি ধর্ষণের শিকার হবে।
সবশেষে এইটুকুই আশা করবো, নিমন্ত্রণ গল্পের মতো মর্মান্তিক ঘটনা যেন আর কারও জীবনে না ঘটে। একটি মেয়ে বোকা হতেই পারে, প্রেমে পড়তেই পারে, একটি মেয়ে নিমন্ত্রণ পেয়ে সাদাসিধে সরল মানুষের মতো নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতেই পারে, কিন্তু তাই বলে তাকে খাদ্য ভেবে বুভুক্ষুর মতো একপাল পুরুষ তাকে চিবিয়ে খাবে, এ তো হওয়া উচিত নয়, এ তো ভয়ংকর অপরাধ। এমন অপরাধ আর না ঘটুক। আমাদের এই পৃথিবী বাসযোগ্য হোক।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন