সংগৃহীত ছবি
নঈম নিজাম : বিশ্বজুড়েই একটা কঠিন সময় পার করছে মিডিয়া। প্রিন্ট মিডিয়ার সমস্যা আরও এক ধাপ বেশি। কভিডকালীন পশ্চিমা দুনিয়ার অনেক শক্তিশালী প্রিন্ট মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে চেষ্টা করেছে অনলাইন ভার্সনে টিকে থাকতে। কেউ পেরেছে, আবার কেউ প্রিন্ট, অনলাইন সব বন্ধ করে অফিসে ঝুলিয়েছে তালা। প্রিন্ট মিডিয়ার আগামী নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা। অভিমত দিয়েছিলেন ছাপার অক্ষরে পত্রিকা প্রকাশের দিন শেষ। ছাপার অক্ষরের পত্রিকা হয়ে উঠবে অতীত। সামাজিক মাধ্যমে গুজব আর রটনার শেষ ছিল না। করোনার কঠিনতম ধাক্কার পুরোটাই এসে আঘাত হেনেছিল বাংলাদেশের প্রিন্ট মিডিয়ায়ও। উৎকণ্ঠা-আতঙ্ক নিয়ে লকডাউনের কঠিনতম সময় মোকাবিলা করেছি আমরা। শুধু ঢাকা নয়, লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় বাংলাদেশ প্রতিদিন করোনাকালে এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। বিক্রেতার অভাব ছিল। হকাররা বাসাবাড়িতে যেতে বাধা পেত। ছাপা পত্রিকা স্পর্শ করা নিয়ে অনেকের উৎকণ্ঠা ছিল। সব কিছু উপেক্ষা করে প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছি আমরা। আমাদের ভরসার শেষ জায়গায় ছিলেন পাঠক। তাঁদের দিকে তাকিয়ে বুকভরা সাহস ও শক্তি নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশনা ধরে রেখেছে। কভিডের সেই আড়াই বছরের কষ্টের দিনগুলোসহ বাংলাদেশ প্রতিদিনের টানা সাফল্যের ১৩ বছর শেষ হলো গতকাল। আরও একটি বছর পার করে আগামীর কঠিনতম সময় সামনে রেখে আজ ১৪ বছরে পা রাখল আপনাদের প্রিয় পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিন। জয়ের ধারাবাহিকতার কঠিন অঙ্গীকার নিয়ে শুরু হলো নতুন পথচলা।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসকে নতুন স্বপ্নের দ্বারে এনে জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সাল থেকে টানা সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিক হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিদিন ধরে রেখেছে শীর্ষ অবস্থান। প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইনেও বিশালত্ব তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেট যুগে এক ক্লিকে বিশ্বের ১৮৫টি দেশে বাংলা ভাষার পাঠক পড়ছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন। ডিজিটাল দুনিয়ার কোনো কিছুতে আমরা পিছিয়ে নেই। ইউটিউবেও তৈরি হয়েছে আমাদের নতুন অবস্থান। লন্ডন-নিউইয়র্কের প্রিন্ট ভার্সন তো আছেই। সব কিছু এত সহজ ছিল না। ধারাবাহিকতায় আমরা কঠিনকে জয় করেছি। সত্যের অনুসন্ধানে প্রতি মুহূর্ত মোকাবিলা করছি সব ধরনের চ্যালেঞ্জ। কালের বিচারে বাংলাদেশ প্রতিদিন পেয়েছে সময়ের সাহসী পত্রিকার স্বীকৃতি। বর্তমান তথ্যপ্রবাহের যুগে চাইলেও এখন আর সত্য আড়াল করা যায় না। আমরা চেষ্টা করি মানুষের সামনে সত্যটাই তুলে ধরতে। সোজাসাপটাভাবে সব খবরই মানুষকে জানাতে। কতটুকু পেরেছি, কতটা পারিনি তা বলার সময় এখনো আসেনি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে স্পষ্ট করে বলছি, পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতা টিকবে না। টিকতে পারে না। দুনিয়ার কোথাও টেকেনি। গণতন্ত্রের বিকাশে মিডিয়ার ভূমিকা হতে হবে সাহসী। যা কিছু ঘটনা তা জানাতে হবে পাঠককে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মিডিয়াকে রাখতে হবে ভূমিকা। বাংলাদেশ প্রতিদিন তার দায়িত্বের জায়গায় সব সময় ছিল অবিচল। আমাদের অঙ্গীকার মানুষের প্রতি। হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন আমাদের শক্তি। পাঠকের ভালোবাসায় বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে।
১৪ বছরে প্রবেশের দিনে আবারও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, বিক্রয় প্রতিনিধি, হকার এবং শুভানুধ্যায়ীদের। সবার সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ প্রতিদিন আজকের অবস্থানে আসতে পারত না। কৃতজ্ঞতা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের প্রতি। বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান আধুনিক চিন্তার একজন মানুষ। তাঁর বলিষ্ঠ বিনিয়োগ, মিডিয়া ঘিরে আধুনিক চিন্তাভাবনা, গাইডলাইন আমাদের পথচলার সাহস ও শক্তি। বিশাল সাফল্যের আড়ালের মানুষটি যা ধরেন তা সফল হয়। দেশের সব ধরনের ব্যবসায় তাঁর হিমালয়সম সাফল্য দেশ-বিদেশে প্রশংসিত। তাঁর সঠিক নির্দেশনায় বাংলাদেশ প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে। আগামী দিনে নতুন সাফল্যের পথ ধরে এগিয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে কৃতজ্ঞতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে। সেই প্রথম দিন থেকে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সব সফলতার অগ্রপথিক। তাঁর নেতৃত্বে মিডিয়া গ্রুপ পেয়েছে বিশালত্ব। কৃতজ্ঞতা কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহান এবং ভাইস চেয়ারমান সাফিয়াত সোবহান, সাফওয়ান সোবহানসহ সব পরিচালকের প্রতি।
সংবাদপত্রের পথচলা কখনো মসৃণ ছিল না। সব সময় কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পথ চলতে হয়েছে। আমাদের এ অঞ্চলে ১৭৮০ সালে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির নাম ছিল বেঙ্গল গেজেট। নাম বেঙ্গল গেজেট হলেও ভাষা ছিল ইংরেজি। ইংরেজ মানুষটি পত্রিকা বের করার পর এ উপমহাদেশে আসা স্বজনরা খুশি হয়েছিলেন। তারা আশা করেছিলেন হিকি ইংরেজদের স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন মিডিয়ায়। কিন্তু হিকি তা করেননি। তিনি মানুষের কথা বলেছেন সংবাদপত্রে। ইংরেজদের অপকর্ম তুলে ধরেছেন। প্রশাসনের অনিয়মের খবর ছাপা হতো তাঁর পত্রিকায়। ইংরেজদের লুটপাটের কাহিনিও বাদ যায়নি। এমনকি ইংরেজ সেনাদের ব্যর্থতা ও লোভের খবরও প্রকাশিত হতো। ব্যস, আর যায় কোথায়? সব কিছু তুলে ধরার কঠিন খেসারত হিকিকে দিতে হয়েছিল। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। প্রেস জব্দও হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে আফ্রিকায় দাস পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়েও কলম ধরেছিলেন হিকি। তিনি লিখেছেন, ‘যদি সংবিধান খারিজ হয়, মানুষ দাসত্বে পতিত হয়, একজন সাহসী মানুষ আর একটা স্বাধীন সংবাদপত্র তাদের উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে মস্ত বীরপুরুষও স্বাধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে না।’ ভাবতেও পারছি না সে যুগে এভাবে স্পষ্ট করে কথা বলা আর বলতে পারার বীরত্বটা। সে কারণে কঠিন খেসারতও দিতে হয়েছিল হিকিকে। একদিকে তাঁর বিরুদ্ধে চলেছে অপপ্রচার, অন্যদিকে বরণ করতে হয়েছে কারাবাস। সংবাদপত্র কি হিকির সময়ের চ্যালেঞ্জ থেকে বেরোতে পেরেছে? রবীন্দ্রনাথের একটি কথা মনে পড়ছে। কবিগুরু বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’ কাঠিন্যকে ভালোবেসে এ পেশায় থাকতে হয়। একজন পরিপূর্ণ সংবাদকর্মীই পারেন অনেক কিছুর পরিবর্তন আনতে। আর সে কারণে কাউকে কাউকে কঠিন খেসারতও দিতে হয়।
কেউ বুঝতে চান না স্বাধীন মিডিয়া ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। একটি দেশ উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। মানবাধিকার সংরক্ষিত হতে পারে না। অথচ সারা দুনিয়ার মিডিয়াকে কঠিন সময় পার করতে হয়। আমাদের দেশে অনেকে বলেন, মিডিয়া তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। কেউ বুঝতে চায় না, সব প্রতিষ্ঠান যখন শেষ হয়ে যায়- কীভাবে একা দায়িত্ব পালন করবে মিডিয়া? মিডিয়া এ সমাজের বাইরের নয়। দেশ থেকে সামাজিক, নৈতিক মূল্যবোধ শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পদে পদে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে। নানামুখী মানসিক চাপ নিয়েই কাজ করছে মিডিয়া। কাউকে খুশি করা যায় না। এক কঠিন সংকট মোকাবিলা করছেন মিডিয়া কর্মীরা। সমালোচনা কেউ সহ্য করতে পারে না। এর মাঝে সংকুচিত হচ্ছে বিজ্ঞাপনের বাজার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ইলেকট্রনিক মিডিয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য। কমছে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচার সংখ্যা। আছে অনেক কালাকানুন। কথায় কথায় প্রভাবশালীদের হুমকি। যখন তখন মামলা, হামলা। সারা দুনিয়ায় একই চিত্র। আমেরিকার মতো উন্নত গণতন্ত্রের দেশও এর বাইরে নয়। অনেকে হয়তো বলবেন, হুমকি-সংকট অতীতেও ছিল। আমিও তা মনে করি। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র খবরও সেই যুগে জমিদারদের ভালো লাগেনি। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ কাঙ্গাল হরিনাথ। কুষ্টিয়ার একটি গ্রাম থেকেই পত্রিকা প্রকাশ করে তিনি চাঞ্চল্য তৈরি করেন। জমিদারের অত্যাচার আর ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল তীক্ষè। তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতেন না। একবার জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী হামলা করলে লালন শাহের নেতৃত্বে গ্রামবাসী তাঁকে রক্ষা করেন। আবার তিনিও একাধিকবার লালন শাহকে রক্ষা করেন।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে স্মরণ করছি প্রথম দিন থেকে জড়িত বাংলাদেশ প্রতিদিনের সব সহকর্মীকে- যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আছেন সবাইকে। সবার শ্রম-মেধায় টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাগজটির আজকের অবস্থান। সবার আন্তরিকতায় বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশ-বিদেশে বিশাল অধ্যায় তৈরি করেছে। আগামীতে এ ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে চাই। এগিয়ে নিতে চাই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। বিশ্বাস করি, পাঠকের ভালোবাসা অব্যাহত থাকলে অবশ্যই আমরা এগিয়ে যাব। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কথা দিচ্ছি, বাংলাদেশ প্রতিদিন আপনার কথা বলবে। আপনাদের কথা বলবে। সব অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে থাকবে বলিষ্ঠ অবস্থানে।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন