নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে কিছু কথা

ড. ছিদ্দিকুর রহমান : শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র, বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তা ছাড়া বর্তমান পরিবর্তনশীল বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এসবের ফলে শিখন চাহিদারও পরিবর্তন হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনীয় পরিমার্জনের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী রাখা অত্যাবশ্যক। ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রম বর্তমানে চালু আছে। শিক্ষাক্রমকে যুগোপযোগী করার জন্য ২০২২ সালে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়, যা ২০২৩ সালের প্রারম্ভে সারা দেশে একযোগে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একক পরামর্শক হিসেবে আমার নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়েছিল। এ নিবন্ধের মাধ্যমে সংক্ষেপে নতুন শিক্ষাক্রমের সবল ও দুর্বল দিকগুলো এবং শিক্ষাক্রমটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। তা ছাড়া ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম ও নতুন শিক্ষাক্রমের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হলো।

 

প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার একটি ভালো দিক হলো পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি শেষের সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করা। এ দুই পরীক্ষা নির্বাহী আদেশে চালু করা হয়েছিল। আগের কোনো শিক্ষাক্রমে ছিল না। পরীক্ষা দুটি চালুর পর থেকেই অনেক লেখালেখি করেছি ও টকশোয় বলাবলি করেছি বাতিল করতে। দেরিতে হলেও একটি ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আরও একটি ভালো উদ্যোগ হলো নবম শ্রেণির পরিবর্তে একাদশ শ্রেণি থেকে বিভাগ বিভাজন। ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি, তখন দশম শ্রেণি শেষে একাদশ শ্রেণি থেকে বিভাজন শুরু হতো। ১৯৬২ সাল থেকে বিভাজন নবম শ্রেণিতে নামিয়ে আনা হয়। এখন ফের ’৬২-এর আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন থেকে বাড়িয়ে দুই দিন করা আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হয়। যেহেতু কভিডের কারণে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, অটোপ্রমোশন, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীদের বড় শিখনশূন্যতা সৃষ্টি হয়ে আছে, এ অবস্থায় এখনই সপ্তাহে দুই দিন ছুটি চালু করা ঠিক হবে না। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো সামষ্টিক মূল্যায়ন থাকবে না, শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকবে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি, নবম ও দশম শ্রেণি এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বেশকিছু বিষয়ে যথাক্রমে ৬০%, ৫০% ও ৪০% নম্বর শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং অন্য বিষয়গুলোয় ১০০% শিখনকালীন মূল্যায়ন চালু করা হবে। উদ্যোগ ভালোই কিন্তু বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জ আছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করে যদি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা যায় তবে সব বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা হতে পারে। শিখনকালীন মূল্যায়ন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন এ দেশে নতুন নয়। তিন দশক আগে থেকে কাগজ-কলমে ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রাথমিক শিক্ষার অবিভক্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে চালু আছে। মূল্যায়নের কলাকৌশল শিক্ষাক্রমে উল্লেখ আছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণও হয়েছিল কিন্তু যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। চলমান শিক্ষাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসিতে ব্যবহারিক পরীক্ষায় শিক্ষক কর্তৃক নম্বর দেওয়ার সুযোগ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা ও গণিত বিষয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষায় ২৫ নম্বরের মধ্যে ২৪ বা ২৫ নম্বর পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় তাদের অনেকে পাসও করতে পারছে না বা ন্যূনতম নম্বর পেয়ে পাস করছে। পরীক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সরকারি সংস্থা ‘বেদু’ গবেষণা করছে, তারাই এসব তথ্য দিচ্ছে। ব্যবহারিকে ইচ্ছামতো বাড়তি নম্বর দেওয়াই তো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ব্যবহারিক পরীক্ষায় নম্বর পেতে বেশির ভাগ স্কুল-কলেজেই শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মাথায় কম বয়সে দুর্নীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা বন্ধ না করে বিষয় ও শ্রেণি ভেদে ৪০, ৫০, ৬০ বা ১০০ শতাংশ নম্বর শিক্ষকের হাতে দেওয়া হচ্ছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করে শিক্ষকদের হাতে নম্বর দেওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পরীক্ষায় তুলনামূলক কম ফল করা স্কুল-কলেজগুলো মনে করবে ফল ভালো না হলে এমপিও বা বেতন বন্ধ হতে পারে। তাই তারা এসব নম্বর বাড়িয়ে দেবেন। শিক্ষকের হাতে নম্বর দেওয়ার সুযোগ থাকলে কোচিং-প্রাইভেট বেড়ে যাবে। শ্রেণিশিক্ষকের কাছে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ার মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি হয়ে পড়ার শঙ্কা থাকবে। তুলনামূলক দরিদ্র শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগ কম দিয়ে প্রাইভেটে নজর দেবেন শিক্ষকরা। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে স্থানীয় মাতবর, রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালীরা শিখনকালীন মূল্যায়নের পূর্ণ নম্বর দিতে শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করবেন। এগুলো মোকাবিলার সক্ষমতা শিক্ষকরা অর্জন করলে শিখনকালীন মূল্যায়নে শতভাগ রাখলেও আপত্তি থাকবে না।

 

নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, কিন্তু নিরাময়মূলক সহায়তার কথা বলা হয়নি। নিরাময়মূলক সহায়তা ছাড়া শিখনকালীন মূল্যায়ন নিরর্থক। শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন-সমস্যা আছে এমন শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে নিরাময়মূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের পারগ করা না হলে শিখনকালীন মূল্যায়নের কোনো অর্থ নেই। এখন যে শিক্ষাক্রম চালু আছে তা ২০১২ সালে উন্নয়ন করা হয়। তখন প্রতি বিষয়ে ২০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়নের জন্য রাখা হয়। ধর্ম শিক্ষাসহ সব বিষয়েই সামষ্টিক মূল্যায়ন ছিল। তখন পরীক্ষার বিষয় বেশির কথা বলে তা কমানোর ব্যাপারে ধুয়া তোলা হলো। কক্সবাজারে একটি অনুষ্ঠান করে চার-পাঁচটি বিষয়কে সামষ্টিক মূল্যায়নের বাইরে রাখা হয়। তার ফলটা কী হলো? সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতি বছর এসব বিষয়ে বই দিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু অধিকাংশ স্কুল (৯০%-এ কম হবে না) এ বিষয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের পড়ায় না। কিন্তু এসব বিষয়ে প্রায় শতভাগ নম্বর দিয়ে শিক্ষা বোর্ডে নম্বর পাঠানো হয়। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। একটি হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে কোনো জ্ঞান লাভ করল না, বিশাল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হলো, অন্যটি হচ্ছে তাদের মনন-মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো যে না পড়েও নম্বর পাওয়া যায়। না পড়িয়ে ফাও নম্বর দেওয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর। কর্মজীবনে অভিপ্রায় হয় কাজ না করে ফল লাভ করা। যেখানে সমস্যা আছে সেখানে সমাধানও আছে। ব্যবহারিক পরীক্ষা বা শিখনকালীন মূল্যায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিজ্ঞানসম্মত কৌশল সম্পর্কে তৎকালীন নীতিনির্ধারকদের বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে। সঠিক কৌশল অবলম্বনে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে শিখনকালীন মূল্যায়ন ও নিরাময়মূলক সহায়তা খুবই ফলপ্রসূ ব্যবস্থা। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আর একটি চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষক প্রশিক্ষণ। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। আর মাত্র পাঁচ দিন প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা যাবে না। এমন চিন্তা অবাস্তব। যারা এমন ভাবছেন তাদের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নেই হয়তো। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বেশকিছু ধাপ রয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন মাস্টার ট্রেইনাররা। আর মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ দেবেন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে জড়িতরা। এই বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কত? বিশেষজ্ঞরা তো এক মাসেও মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারবেন না। আর সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে লাগবে অন্তত এক বছর। অথচ মাত্র পাঁচ দিনে নাকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষ করার পরিকল্পনা করেছেন তারা! এটা অসম্ভব, অবাস্তব। হাতে কলমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে চাইলে পাঁচ দিনে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম করা হলো সে উদ্দেশ্য অর্জন করতে অনেক শিখনসামগ্রী দরকার। এর প্রথমটি হলো পাঠ্যবই। তারপর শিখন উপকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ-সামগ্রী উন্নয়ন। এমন বই লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন লেখকের অভাব রয়েছে দেশে। বই লেখা, শিখন উপকরণ তৈরি, প্রশিক্ষণসামগ্রী তৈরি করাও বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাক্রম পাইলটিংয়ের জন্য যে বই লেখা হয়েছে সেখানে কনসেপ্টের বড় বড় ভুল রয়েছে। অল্প কয়েকটি বইয়েই যদি এত ভুল থাকে আগামীতে এতগুলো বই লিখতে কত ভুল থাকবে? এসব বই দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করবেন শিক্ষক। শ্রেণিশিখনে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতির উল্লেখ আছে কিন্তু এর কলাকৌশল সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত নেই। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন অবশ্যই ভালো পদ্ধতি কিন্তু সব বিষয় এ পদ্ধতিতে শেখা যায় না, যেমন জোয়ার-ভাটার কারণ বা পরমাণুর গঠন- কীভাবে এ পদ্ধতি শিখবে? ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে শিখন শেখানো, কলাকৌশল, শিখন মতবাদ, অনুসন্ধানমূলক প্রজেক্ট পদ্ধতি, শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিত করার কৌশল, মূল্যায়ন কৌশল ইত্যাদি বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। তা সত্ত্বেও ক্লাসরুমে শিক্ষকরা এটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে পুরনো শিক্ষাক্রমের জিনেরিক অংশ (পৃষ্ঠা ১ থকে ১৮) দ্রষ্টব্য। নতুন শিক্ষাক্রম যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। অথচ প্রাথমিক শিক্ষাক্রম তিন যুগ ধরে যোগ্যতাভিত্তিক এবং ২০১২ সালে প্রণীত মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম শিখনফলভিত্তিক। নতুন শিক্ষাক্রমে নতুনত্ব কী? ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় দুটি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। কর্মকেন্দ্রিক করার জন্য পাঠ্যবইয়ের প্রাসঙ্গিক অংশে বক্স করে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ দেওয়া আছে। এ বই এখনো পড়ছে শিক্ষার্থীরা। কাজ করে শেখা বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখা তখনই শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষকরা ক্লাসে এটি করাননি। অনুসন্ধানমূলক প্রজেক্টও ছিল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রমে। তা-ও শিক্ষকরা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমানোর জন্য কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পুরনো শিক্ষাক্রমে ১০টি আবশ্যিক বিষয় রাখা হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমেও ১০টি, নবম ও দশম শ্রেণিতে ১১টি রাখা হয়েছে। আবশ্যিক বিষয়ের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরনো ও নতুন দুই শিক্ষাক্রমের বিষয় তালিকা মোটামুটি একই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয় একই রেখে শুধু বিষয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, যেমন কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষার পরিবর্তে জীবন ও জীবিকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির পরিবর্তে ডিজিটাল প্রযুক্তি ইত্যাদি। শিল্প ও সংস্কৃতি নতুন যোগ করা হয়েছে। পুরনো শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চারু ও কারুকলা আলাদা বিষয় হিসেবে ছিল। শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে নাচ, গান, নাটক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষকরা এসব কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন? নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে রচিত অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তকের আকার পুরনো পাঠ্যপুস্তকের দেড় গুণের বেশি। নতুন শিক্ষাক্রমের বেশিষ্ট্য হিসেবে ‘পেরাডাইম শিফ্ট’-এর কথা বলা আছে। বাস্তবে কোথায়? 

আসলে চলমান সৃজনশীল পদ্ধতিতে গলদ আছে। শ্রেণিকক্ষে বা বাইরে শিখন শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করার সুযোগ না রেখেই শুধু সৃজনশীল পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সৃজনশীলতা মূল্যায়নের জন্য বহুবিধ প্রশ্ন করা যায়, কিন্তু তা না করে শুধু এক ধরনের সৃজনশীল প্রশ্ন ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। তা কোনো অবস্থাতেই সৃজনশীল মূল্যায়ন ব্যবস্থা নয়। নতুন শিক্ষাক্রমে সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দেওয়া হচ্ছে। এটি শিক্ষাক্রমের আরেকটি বড় গলদ। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করে তুলতে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যায়নেও বহুবিধ সৃজনশীল ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল না করা হলে রূপান্তরযোগ্য যোগ্যতা অর্জন সম্ভব নয়। তা ছাড়া সৃজনশীল জনসম্পদ ছাড়া টেকসই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। নতুন শিক্ষাক্রমে এমন অনেক কিছু আছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন এবং এমন কিছু আছে যা বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না, যেমন নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জন করবে এবং দশম শ্রেণি শেষে যে-কোনো একটি বৃত্তিমূলক কাজ করার মতো পেশাদারি দক্ষতা অর্জনের কথা উল্লেখ আছে। পাকিস্তান আমলে এ ধরনের একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল কিন্তু কোনোটাই ফলপ্রসূ হয়নি। বলে রাখা ভালো- বৃত্তিমূলক দক্ষতা এবং পেশাদারি দক্ষতা এক নয়, বৃত্তি হলো Occupation আর পেশা হলো Profession-এর বাংলা প্রতিশব্দ। সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমে বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও ঝোঁক সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকবে যাতে সাধারণ শিক্ষা শেষে অনেকে এসব শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়। শিক্ষার্থী যদি যে-কোনো একটি বৃত্তির বিক্রয় উপযোগী দক্ষতা (Saleable Skill) অর্জন না করে অর্থাৎ তার অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সে যদি কর্মক্ষেত্রে মানসম্মত উৎপাদন ও অর্থ উপার্জন করতে না পারে তা হলে এ শিক্ষা অর্থহীন, সময় ও অর্থ নষ্ট। তা ছাড়া একটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে কোনো অবস্থাতেই একটি বা দুটির বেশি বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারবে না। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে এলাকায় ওইসব বৃত্তিধারী জনবলের আধিক্য দেখা দেবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে। বাস্তবায়নের কলাকৌশল নির্ধারণ না করে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় এমন কিছু বিভাষা বা জাগরণের অবতারণা করা হয়েছে যেগুলোর প্রতিফলন পাঠ্যপুস্তক বা শ্রেণির শিখন শেখানোর পদ্ধতিতে লক্ষ করা যায়নি। এগুলো শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অলংকৃত করেছে। যেমন গভীর শিখন, রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা, বহুমাতৃক শিখন, কল্যাণমুখী শিক্ষা, সংবেদনশীল শিক্ষা ইত্যাদি। একীভূত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে যেখানে ভিন্নভাবে সমর্থক শিশু, তৃতীয় লিঙ্গের শিশু, সাধারণ শিশু, মেধাবী শিশুদের শিক্ষার কথা উল্লেখ আছে। এ কথা সত্য, এসব বাস্তবায়ন করা গেলে জাতি উপকৃত হতো। একই শ্রেণিকক্ষে সব ধরনের শিশুর শিখন চাহিদা পূরণ করার মতো শিক্ষক তৈরির ব্যবস্থা ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ কোথায়? তা ছাড়া শ্রেণিতে যদি ৭০-৮০ শিক্ষার্থী থাকে। মাতৃভাষাভিত্তিক শিখনের প্রসারের কথা উল্লেখ আছে, এর জন্য বিশেষ কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উচ্চাভিলাষী হওয়া ভালো কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাভিলাষ যা বাস্তবায়নযোগ্য নয় তা শুধুই বিলাসিতা। পুরনো শিক্ষাক্রমে সমমানের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জনের লক্ষ্যে সাধারণ, ধর্মীয় (মাদরাসা) এবং ইংরেজি শিক্ষাধারার মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ সব ধারার শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে একই পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে শিখবে। নতুন শিক্ষাক্রমে বিভিন্ন ধারার যৌক্তিক সমন্বয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও মূল শিক্ষাক্রমে সমন্বয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

লেখক : অধ্যাপক (অব.) আই ই আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Email : [email protected]      সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের এসেছে: মাসুদ সাঈদী

» নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান

» অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ চারজন মাদক চোরা কারবারি আটক

» সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব, যা জানালেন বদিউল আলম

» ২ মার্চ ‘জাতীয় পতাকা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান মঈন খানের

» কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়: আইজিপি

» সুন্দর ব্যবহার ও আচরণের বিনিময়ে জান্নাত! হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

» বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পট লোন পেলেন সিলেটের সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা

» ‘ইউসিবি নাইট’ আয়োজনে গ্রাহক ও অংশীদারদের অব্যাহত সহযোগিতার স্বীকৃতি

» ইসলামপুর ওয়ার্ড কৃষক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম নিয়ে কিছু কথা

ড. ছিদ্দিকুর রহমান : শিক্ষাক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজ, রাষ্ট্র, বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। তা ছাড়া বর্তমান পরিবর্তনশীল বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। এসবের ফলে শিখন চাহিদারও পরিবর্তন হচ্ছে। এজন্য প্রয়োজনীয় পরিমার্জনের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী রাখা অত্যাবশ্যক। ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রম বর্তমানে চালু আছে। শিক্ষাক্রমকে যুগোপযোগী করার জন্য ২০২২ সালে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়, যা ২০২৩ সালের প্রারম্ভে সারা দেশে একযোগে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একক পরামর্শক হিসেবে আমার নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন করা হয়েছিল। এ নিবন্ধের মাধ্যমে সংক্ষেপে নতুন শিক্ষাক্রমের সবল ও দুর্বল দিকগুলো এবং শিক্ষাক্রমটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সেগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো। তা ছাড়া ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম ও নতুন শিক্ষাক্রমের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হলো।

 

প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থার একটি ভালো দিক হলো পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি শেষের সমাপনী পরীক্ষা বাতিল করা। এ দুই পরীক্ষা নির্বাহী আদেশে চালু করা হয়েছিল। আগের কোনো শিক্ষাক্রমে ছিল না। পরীক্ষা দুটি চালুর পর থেকেই অনেক লেখালেখি করেছি ও টকশোয় বলাবলি করেছি বাতিল করতে। দেরিতে হলেও একটি ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আরও একটি ভালো উদ্যোগ হলো নবম শ্রেণির পরিবর্তে একাদশ শ্রেণি থেকে বিভাগ বিভাজন। ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি, তখন দশম শ্রেণি শেষে একাদশ শ্রেণি থেকে বিভাজন শুরু হতো। ১৯৬২ সাল থেকে বিভাজন নবম শ্রেণিতে নামিয়ে আনা হয়। এখন ফের ’৬২-এর আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। সাপ্তাহিক ছুটি এক দিন থেকে বাড়িয়ে দুই দিন করা আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হয়। যেহেতু কভিডের কারণে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, অটোপ্রমোশন, সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ইত্যাদি কারণে শিক্ষার্থীদের বড় শিখনশূন্যতা সৃষ্টি হয়ে আছে, এ অবস্থায় এখনই সপ্তাহে দুই দিন ছুটি চালু করা ঠিক হবে না। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো সামষ্টিক মূল্যায়ন থাকবে না, শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকবে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণি, নবম ও দশম শ্রেণি এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে বেশকিছু বিষয়ে যথাক্রমে ৬০%, ৫০% ও ৪০% নম্বর শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং অন্য বিষয়গুলোয় ১০০% শিখনকালীন মূল্যায়ন চালু করা হবে। উদ্যোগ ভালোই কিন্তু বাস্তবায়নে কঠিন চ্যালেঞ্জ আছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করে যদি সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা যায় তবে সব বিষয়ে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা হতে পারে। শিখনকালীন মূল্যায়ন বা ধারাবাহিক মূল্যায়ন এ দেশে নতুন নয়। তিন দশক আগে থেকে কাগজ-কলমে ধারাবাহিক মূল্যায়ন প্রাথমিক শিক্ষার অবিভক্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে চালু আছে। মূল্যায়নের কলাকৌশল শিক্ষাক্রমে উল্লেখ আছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণও হয়েছিল কিন্তু যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। চলমান শিক্ষাক্রমে এসএসসি ও এইচএসসিতে ব্যবহারিক পরীক্ষায় শিক্ষক কর্তৃক নম্বর দেওয়ার সুযোগ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা ও গণিত বিষয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষায় ২৫ নম্বরের মধ্যে ২৪ বা ২৫ নম্বর পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় তাদের অনেকে পাসও করতে পারছে না বা ন্যূনতম নম্বর পেয়ে পাস করছে। পরীক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সরকারি সংস্থা ‘বেদু’ গবেষণা করছে, তারাই এসব তথ্য দিচ্ছে। ব্যবহারিকে ইচ্ছামতো বাড়তি নম্বর দেওয়াই তো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। ব্যবহারিক পরীক্ষায় নম্বর পেতে বেশির ভাগ স্কুল-কলেজেই শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মাথায় কম বয়সে দুর্নীতি ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা বন্ধ না করে বিষয় ও শ্রেণি ভেদে ৪০, ৫০, ৬০ বা ১০০ শতাংশ নম্বর শিক্ষকের হাতে দেওয়া হচ্ছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা না করে শিক্ষকদের হাতে নম্বর দেওয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। পরীক্ষায় তুলনামূলক কম ফল করা স্কুল-কলেজগুলো মনে করবে ফল ভালো না হলে এমপিও বা বেতন বন্ধ হতে পারে। তাই তারা এসব নম্বর বাড়িয়ে দেবেন। শিক্ষকের হাতে নম্বর দেওয়ার সুযোগ থাকলে কোচিং-প্রাইভেট বেড়ে যাবে। শ্রেণিশিক্ষকের কাছে ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ার মাত্রা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি হয়ে পড়ার শঙ্কা থাকবে। তুলনামূলক দরিদ্র শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্লাসে পাঠদানে মনোযোগ কম দিয়ে প্রাইভেটে নজর দেবেন শিক্ষকরা। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে স্থানীয় মাতবর, রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালীরা শিখনকালীন মূল্যায়নের পূর্ণ নম্বর দিতে শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করবেন। এগুলো মোকাবিলার সক্ষমতা শিক্ষকরা অর্জন করলে শিখনকালীন মূল্যায়নে শতভাগ রাখলেও আপত্তি থাকবে না।

 

নতুন শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, কিন্তু নিরাময়মূলক সহায়তার কথা বলা হয়নি। নিরাময়মূলক সহায়তা ছাড়া শিখনকালীন মূল্যায়ন নিরর্থক। শিখনকালীন মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন-সমস্যা আছে এমন শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে নিরাময়মূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের পারগ করা না হলে শিখনকালীন মূল্যায়নের কোনো অর্থ নেই। এখন যে শিক্ষাক্রম চালু আছে তা ২০১২ সালে উন্নয়ন করা হয়। তখন প্রতি বিষয়ে ২০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়নের জন্য রাখা হয়। ধর্ম শিক্ষাসহ সব বিষয়েই সামষ্টিক মূল্যায়ন ছিল। তখন পরীক্ষার বিষয় বেশির কথা বলে তা কমানোর ব্যাপারে ধুয়া তোলা হলো। কক্সবাজারে একটি অনুষ্ঠান করে চার-পাঁচটি বিষয়কে সামষ্টিক মূল্যায়নের বাইরে রাখা হয়। তার ফলটা কী হলো? সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রতি বছর এসব বিষয়ে বই দিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু অধিকাংশ স্কুল (৯০%-এ কম হবে না) এ বিষয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের পড়ায় না। কিন্তু এসব বিষয়ে প্রায় শতভাগ নম্বর দিয়ে শিক্ষা বোর্ডে নম্বর পাঠানো হয়। এতে দুই ধরনের ক্ষতি হচ্ছে। একটি হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা এসব বিষয়ে কোনো জ্ঞান লাভ করল না, বিশাল পরিমাণ সরকারি অর্থের অপচয় হলো, অন্যটি হচ্ছে তাদের মনন-মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো যে না পড়েও নম্বর পাওয়া যায়। না পড়িয়ে ফাও নম্বর দেওয়া শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর। কর্মজীবনে অভিপ্রায় হয় কাজ না করে ফল লাভ করা। যেখানে সমস্যা আছে সেখানে সমাধানও আছে। ব্যবহারিক পরীক্ষা বা শিখনকালীন মূল্যায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিজ্ঞানসম্মত কৌশল সম্পর্কে তৎকালীন নীতিনির্ধারকদের বোঝাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে হয়েছে। সঠিক কৌশল অবলম্বনে সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে শিখনকালীন মূল্যায়ন ও নিরাময়মূলক সহায়তা খুবই ফলপ্রসূ ব্যবস্থা। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আর একটি চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষক প্রশিক্ষণ। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। আর মাত্র পাঁচ দিন প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা যাবে না। এমন চিন্তা অবাস্তব। যারা এমন ভাবছেন তাদের প্রশিক্ষণ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নেই হয়তো। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বেশকিছু ধাপ রয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেবেন মাস্টার ট্রেইনাররা। আর মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ দেবেন শিক্ষাক্রম প্রণয়নে জড়িতরা। এই বিশেষজ্ঞের সংখ্যা কত? বিশেষজ্ঞরা তো এক মাসেও মাস্টার ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারবেন না। আর সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে লাগবে অন্তত এক বছর। অথচ মাত্র পাঁচ দিনে নাকি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষ করার পরিকল্পনা করেছেন তারা! এটা অসম্ভব, অবাস্তব। হাতে কলমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে চাইলে পাঁচ দিনে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম করা হলো সে উদ্দেশ্য অর্জন করতে অনেক শিখনসামগ্রী দরকার। এর প্রথমটি হলো পাঠ্যবই। তারপর শিখন উপকরণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ-সামগ্রী উন্নয়ন। এমন বই লেখার যোগ্যতাসম্পন্ন লেখকের অভাব রয়েছে দেশে। বই লেখা, শিখন উপকরণ তৈরি, প্রশিক্ষণসামগ্রী তৈরি করাও বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাক্রম পাইলটিংয়ের জন্য যে বই লেখা হয়েছে সেখানে কনসেপ্টের বড় বড় ভুল রয়েছে। অল্প কয়েকটি বইয়েই যদি এত ভুল থাকে আগামীতে এতগুলো বই লিখতে কত ভুল থাকবে? এসব বই দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করবেন শিক্ষক। শ্রেণিশিখনে অভিজ্ঞতাভিত্তিক পদ্ধতির উল্লেখ আছে কিন্তু এর কলাকৌশল সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত নেই। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন অবশ্যই ভালো পদ্ধতি কিন্তু সব বিষয় এ পদ্ধতিতে শেখা যায় না, যেমন জোয়ার-ভাটার কারণ বা পরমাণুর গঠন- কীভাবে এ পদ্ধতি শিখবে? ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে শিখন শেখানো, কলাকৌশল, শিখন মতবাদ, অনুসন্ধানমূলক প্রজেক্ট পদ্ধতি, শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিত করার কৌশল, মূল্যায়ন কৌশল ইত্যাদি বিস্তারিত উল্লেখ ছিল। তা সত্ত্বেও ক্লাসরুমে শিক্ষকরা এটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে পুরনো শিক্ষাক্রমের জিনেরিক অংশ (পৃষ্ঠা ১ থকে ১৮) দ্রষ্টব্য। নতুন শিক্ষাক্রম যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। অথচ প্রাথমিক শিক্ষাক্রম তিন যুগ ধরে যোগ্যতাভিত্তিক এবং ২০১২ সালে প্রণীত মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম শিখনফলভিত্তিক। নতুন শিক্ষাক্রমে নতুনত্ব কী? ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় দুটি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছিল। কর্মকেন্দ্রিক করার জন্য পাঠ্যবইয়ের প্রাসঙ্গিক অংশে বক্স করে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ দেওয়া আছে। এ বই এখনো পড়ছে শিক্ষার্থীরা। কাজ করে শেখা বা অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখা তখনই শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষকরা ক্লাসে এটি করাননি। অনুসন্ধানমূলক প্রজেক্টও ছিল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাক্রমে। তা-ও শিক্ষকরা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। নতুন শিক্ষাক্রমে বিষয় ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা ও চাপ কমানোর জন্য কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। পুরনো শিক্ষাক্রমে ১০টি আবশ্যিক বিষয় রাখা হয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমেও ১০টি, নবম ও দশম শ্রেণিতে ১১টি রাখা হয়েছে। আবশ্যিক বিষয়ের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরনো ও নতুন দুই শিক্ষাক্রমের বিষয় তালিকা মোটামুটি একই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিষয় একই রেখে শুধু বিষয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, যেমন কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষার পরিবর্তে জীবন ও জীবিকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির পরিবর্তে ডিজিটাল প্রযুক্তি ইত্যাদি। শিল্প ও সংস্কৃতি নতুন যোগ করা হয়েছে। পুরনো শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ চারু ও কারুকলা আলাদা বিষয় হিসেবে ছিল। শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে নাচ, গান, নাটক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষকরা এসব কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পারবেন? নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে রচিত অধিকাংশ পাঠ্যপুস্তকের আকার পুরনো পাঠ্যপুস্তকের দেড় গুণের বেশি। নতুন শিক্ষাক্রমের বেশিষ্ট্য হিসেবে ‘পেরাডাইম শিফ্ট’-এর কথা বলা আছে। বাস্তবে কোথায়? 

আসলে চলমান সৃজনশীল পদ্ধতিতে গলদ আছে। শ্রেণিকক্ষে বা বাইরে শিখন শেখানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করার সুযোগ না রেখেই শুধু সৃজনশীল পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া সৃজনশীলতা মূল্যায়নের জন্য বহুবিধ প্রশ্ন করা যায়, কিন্তু তা না করে শুধু এক ধরনের সৃজনশীল প্রশ্ন ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে। তা কোনো অবস্থাতেই সৃজনশীল মূল্যায়ন ব্যবস্থা নয়। নতুন শিক্ষাক্রমে সৃজনশীল পদ্ধতি বাদ দেওয়া হচ্ছে। এটি শিক্ষাক্রমের আরেকটি বড় গলদ। ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করে তুলতে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে মূল্যায়নেও বহুবিধ সৃজনশীল ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল না করা হলে রূপান্তরযোগ্য যোগ্যতা অর্জন সম্ভব নয়। তা ছাড়া সৃজনশীল জনসম্পদ ছাড়া টেকসই জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। নতুন শিক্ষাক্রমে এমন অনেক কিছু আছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন এবং এমন কিছু আছে যা বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না, যেমন নবম ও দশম শ্রেণিতে প্রত্যেক শিক্ষার্থী কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি বৃত্তিমূলক দক্ষতা অর্জন করবে এবং দশম শ্রেণি শেষে যে-কোনো একটি বৃত্তিমূলক কাজ করার মতো পেশাদারি দক্ষতা অর্জনের কথা উল্লেখ আছে। পাকিস্তান আমলে এ ধরনের একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল কিন্তু কোনোটাই ফলপ্রসূ হয়নি। বলে রাখা ভালো- বৃত্তিমূলক দক্ষতা এবং পেশাদারি দক্ষতা এক নয়, বৃত্তি হলো Occupation আর পেশা হলো Profession-এর বাংলা প্রতিশব্দ। সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমে বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও ঝোঁক সৃষ্টির ব্যবস্থা থাকবে যাতে সাধারণ শিক্ষা শেষে অনেকে এসব শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়। শিক্ষার্থী যদি যে-কোনো একটি বৃত্তির বিক্রয় উপযোগী দক্ষতা (Saleable Skill) অর্জন না করে অর্থাৎ তার অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সে যদি কর্মক্ষেত্রে মানসম্মত উৎপাদন ও অর্থ উপার্জন করতে না পারে তা হলে এ শিক্ষা অর্থহীন, সময় ও অর্থ নষ্ট। তা ছাড়া একটি সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থ ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে কোনো অবস্থাতেই একটি বা দুটির বেশি বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারবে না। ফলে কয়েক বছরের মধ্যে এলাকায় ওইসব বৃত্তিধারী জনবলের আধিক্য দেখা দেবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমবে। বাস্তবায়নের কলাকৌশল নির্ধারণ না করে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় এমন কিছু বিভাষা বা জাগরণের অবতারণা করা হয়েছে যেগুলোর প্রতিফলন পাঠ্যপুস্তক বা শ্রেণির শিখন শেখানোর পদ্ধতিতে লক্ষ করা যায়নি। এগুলো শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অলংকৃত করেছে। যেমন গভীর শিখন, রূপান্তরযোগ্য দক্ষতা, বহুমাতৃক শিখন, কল্যাণমুখী শিক্ষা, সংবেদনশীল শিক্ষা ইত্যাদি। একীভূত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে যেখানে ভিন্নভাবে সমর্থক শিশু, তৃতীয় লিঙ্গের শিশু, সাধারণ শিশু, মেধাবী শিশুদের শিক্ষার কথা উল্লেখ আছে। এ কথা সত্য, এসব বাস্তবায়ন করা গেলে জাতি উপকৃত হতো। একই শ্রেণিকক্ষে সব ধরনের শিশুর শিখন চাহিদা পূরণ করার মতো শিক্ষক তৈরির ব্যবস্থা ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ কোথায়? তা ছাড়া শ্রেণিতে যদি ৭০-৮০ শিক্ষার্থী থাকে। মাতৃভাষাভিত্তিক শিখনের প্রসারের কথা উল্লেখ আছে, এর জন্য বিশেষ কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। উচ্চাভিলাষী হওয়া ভালো কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত উচ্চাভিলাষ যা বাস্তবায়নযোগ্য নয় তা শুধুই বিলাসিতা। পুরনো শিক্ষাক্রমে সমমানের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অর্জনের লক্ষ্যে সাধারণ, ধর্মীয় (মাদরাসা) এবং ইংরেজি শিক্ষাধারার মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালুর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ সব ধারার শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে একই পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে শিখবে। নতুন শিক্ষাক্রমে বিভিন্ন ধারার যৌক্তিক সমন্বয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও মূল শিক্ষাক্রমে সমন্বয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

লেখক : অধ্যাপক (অব.) আই ই আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Email : [email protected]      সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com