তসলিমা নাসরিন : সালমান রুশদি ইরানে বাস করেননি, যে দেশ থেকে তার মাথার মূল্য ধার্য হয়েছিল। আমি বাংলাদেশে বাস করেছি, এখন বাস করছি ভারতে, এই দুটো দেশেই আমার মাথার মূল্য ধার্য হয়েছে বারবার। এই দুটো দেশ থেকে আমাকে খুন করার হুমকি এসেছে বারবার, আমাকে শারীরিক আক্রমণ করা হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে বারবার, আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে, আমার টিভি সিরিয়াল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সালমান রুশদিই যদি পশ্চিমের পুলিশ প্রহরার মধ্যে বাস করে নিরাপদ নন, আমি তো একেবারেই নই। কিন্তু সে কারণে ভয়ে গুটিয়ে থাকার পক্ষপাতীও আমি নই। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আমি আমার নিজের মত প্রকাশ করি, কেউ সে মত মানুক বা না মানুক। আমার মত মূলত নারীর সমানাধিকারের পক্ষে, মানবতার পক্ষে, যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞান মনস্কতার পক্ষে।
মুসলিম অধ্যুষিত দেশে বাস করুক, কী যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু সেখানে বাস করুক, এমনকী সেক্যুলারিজমের আদর্শ সবচেয়ে উঁচুতে ধরে রাখা দেশ ইউরোপ আমেরিকায় বাস করুক, কিছু মগজধোলাই হওয়া মুসলিম সন্ত্রাসী হিসেবে বেরোচ্ছে। এই ট্রেন্ড বন্ধ করতে হলে পরিবর্তন আনতে হবে, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী হতে হবে, ভায়োলেন্সকে নিষিদ্ধ করতে হবে, মৌলবাদের আঁতুড়ঘর গুটিয়ে ফেলতে হবে, সন্ত্রাসী তৈরির কারখানা চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে। মুশকিল হলো, কট্টররা সমাজের কোনও বিবর্তন চায় না। তারা সব রকম প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে। তারা গোটা পৃথিবীতেই ঐশী আইন চায়, গোটা পৃথিবীকেই বানাতে চায় দারুল ইসলাম, ইসলামের ভূমি, যে ভূমিতে নারীর সমানাধিকার থাকবে না, যে ভূমিতে ইসলামের রিফর্মেশান যারা চায় তাদের এবং অমুসলিমদের বেঁচে থাকার কোনও অধিকার থাকবে না।
ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের কথা উঠলেই ভারতের কিছু লোক তড়িঘড়ি দাভোলকার, গোরী লাংকেশকে নিয়ে আসে আলোচনায়। তারা হিন্দু কট্টরপন্থীদের সঙ্গে মুসলিম কট্টরপন্থীর তুলনা করে দুই দলকে সমান বলে রায় দিতে চায়। নিতান্তই হাস্যকর এই চেষ্টা। বিশ্ব ছেয়ে আছে অগুনতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে, দেশে দেশে সন্ত্রাস চালাচ্ছে তারা, আত্মঘাতী বোমারুরা উড়িয়ে দিচ্ছে কত প্রতিষ্ঠান, মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে ভারতের ভেতরে সন্ত্রাস করা কিছু হিন্দু সন্ত্রাসীর তুলনা চলে না। তুলনা করলে অন্য সন্ত্রাসীদের ভয়াবহতাকে অস্বীকার করা হয়।
কোনও গ্রন্থকে সর্বশক্তিমানের আদেশ হিসেবে মানার দিন, এবং অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করার দিন শেষ হয়েছে। মানুষের এখন বিশ্ব ব্রহ্মা- সৃষ্টির শুরু, বিগ ব্যাংয়ের বিস্ফোরণ দেখতে খুব বেশি দেরি নেই। আজ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তা বলে কোনও বস্তুর প্রমাণ মেলেনি। বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো বারবার প্রমাণ করেছে অলৌকিক গল্পগাছা নিতান্তই রূপকথা ছাড়া কিছু নয়। এই রূপকথাকে বিশ্বাস করে মানুষ কম তো মানুষ হত্যা করেনি, কম তো অনিষ্ট করেনি। এবার থামুক। যে করেই হোক এই রূপকথাবাজদের থামানো হোক। গণতন্ত্রবিরোধী, ব্যক্তিস্বাধীনতা বিরোধী, বাকস্বাধীনতা বিরোধীদের চিহ্নিত করা হোক, এদের হাত থেকে বিশ্বকে, বিশ্বের প্রগতিকে, বিশ্বের ভবিষ্যৎকে, সর্বোপরি মানুষকে বাঁচানো হোক।
জানি এরা যত মানুষ মেরেছে, তার চেয়ে আমেরিকা মেরেছে বেশি, এরা যত ধ্বংস করেছে, তার চেয়ে ইসরায়েল বেশি ধ্বংস করেছে, জানি এদের হাতে তত অস্ত্র নেই, যত অস্ত্র বড় বড় রাষ্ট্রের আছে, সে কারণে এদের সন্ত্রাসকে কি সমর্থন করতে হবে? এদের প্রতি সমব্যথী হতে হবে? এরা যুগে যুগে জন্ম নিচ্ছে। এই অপশক্তি যুবসমাজের মস্তিষ্ক নষ্ট করছে বহুকাল থেকে। আজ এদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে হিন্দু কট্টরপন্থী, তারাও উদারপন্থী হিন্দু ধর্মকে কট্টরপন্থীর ধর্ম হিসেবে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসীদের যে হিন্দুরা ঘৃণা করে, সেই হিন্দুদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম সন্ত্রাসীদের অনুকরণ করছে। এটি খুবই হতাশার কথা।
পৃথিবীকে সন্ত্রাসমুক্ত করা এবং বাসযোগ্য করা ছাড়া উপায় নেই। সবার মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা এবং সবার জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া উপায় নেই। আমরা আমাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্ধকারে ডুবে মরবো। দেশে দেশে যত সরকার আছে, সবারই ত্যাগ করতে হবে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি। বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ধর্মান্ধতা মানুষকে বাঁচায় না, বাঁচায় বিজ্ঞান, বাঁচায় যুক্তিবুদ্ধি।
ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা না করাটা যেমন ভুল সিদ্ধান্ত, রাজনীতিতে একে জড়িয়ে ফেলাও একই রকম ভুল সিদ্ধান্ত। আজ যে ইসলাম ছুরি হাতে নিয়ে মুক্তচিন্তক আর প্রগতিশীল মানুষদের হত্যা করছে, সেই ইসলাম রাজনৈতিক ইসলাম। রাজনৈতিক ইসলাম যতদিন আছে, ততদিন মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী কারও জীবনের নিশ্চয়তা নেই।
রুশদিকে ছুরি হামলা করার পর তেহরিকে লাব্বাইক দলের বিশাল র্যালি হয়েছে পাকিস্তানে। এই দলটি ধর্মীয়-রাজনীতিক দল। এরাই প্রচার করে রাজনৈতিক ইসলাম। চরম ডানপন্থী এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা খাদিম হুসেইন রিজভির একটি ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়, যেখানে তিনি বলেছেন রুশদি এবং আমাকে তিনি সামনে পেলে ‘কতল’ করতেন। এই লোকটি সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের দায়ে পাকিস্তানে একবার ধরা পড়েছিলেন। তাঁর অনুরাগীরা ভিডিও বার্তা পেয়ে এমনই উত্তেজিত যে দলে দলে টুইটারে আমাকে জানাচ্ছে, রুশদির পর এখন নেক্সট আমি, আমাকে হত্যা করবে। এরা হত্যা করার আগে একবার দেখে নিতে চায় না, কেন হত্যা করবে, আমি কী লিখেছি বা বলেছি। যা রটছে তা সত্য কি না। যে লোকটি রুশদিকে আক্রমণ করেছে, সে কি রুশদির কোনও বই পড়েছে? না, পড়েনি। আমাকে যারা হত্যা করতে চাইছে, তারা কি আমার কোনও বই পড়েছে? পড়েনি। এরা এদের গুরুর আদেশ মানে। হিংসে আর ঘৃণার রাজনীতি এদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুবসমাজকে কী করে এইসব সন্ত্রাসী নেতার কবল থেকে রক্ষা করা যায়, সেটার জন্য রাজনীতিকদের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সিরিয়াসলি। এখন যদি সময় নয়, সময় তবে কবে?
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন