ছবি সংগৃহীত
ডেস্ক রিপোর্ট : ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ বড়-মাঝারি-ছোট শহরগুলোই ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবিলায় একেবারেই অপ্রস্তুত বলে মনে করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। সংস্থাটি বলছে, শুক্রবারে মিয়ানমারে সংঘটিত ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও আশপাশের দেশ ও অঞ্চলে তার সামগ্রিক প্রভাব আরও একবার বাংলাদেশের নগরগুলোর ভূমিকম্প প্রস্তুতি না থাকা এবং ভবন নির্মাণে ভবনগুলোর বিল্ডিং কোড এবং মহাপরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার জোনিং না মানার প্রবণতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট অনেকগুলো ভূমিকম্প বড় আকারের ভূমিকম্পের আসন্ন পূর্বাভাস দিলেও আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শূন্য। ফলে যেকোনো সময়ে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটার পূর্বেই ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই উদ্যোগের আহ্বান জানায় আইপিডি।
গতকাল শনিবার সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এবং নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন তারা।
তাদের মতে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করলেও দেশের পরিকল্পিত নগরায়ণ, টেকসই আবাসন ও ভবনের নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট বিষয়ক কোনো কমিশন করেনি বিষয়টিকে অনভিপ্রেত বলে মনে করে আইপিডি। অথচ ভূমিকম্প কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় এলাকাভিত্তিক পার্ক-খেলার মাঠ-উদ্যান-উন্মুক্ত স্থান কীভাবে নগরে বাড়ানো যায়, সেই আলোচনা সরকারি মহলে কোথাও শোনা যাচ্ছে না। বরং কাঁঠালবাগান ও তৎসংলগ্ন এলাকার জন্য দুর্যোগের সময়ে ঠাঁই নেওয়ার একমাত্র খোলা জায়গা পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষার্থে ১০০ দিনের সামাজিক আন্দোলনেও সরকার নির্লিপ্ত আচরণ করছে।
আইপিডি আরও মনে করে, ঢাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনায় মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠন ও গুণাগুণকে বিবেচনায় নিয়ে ভূমি ব্যবহার এবং ভবনের আকার-আয়তন নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অথচ ঢাকার নগর পরিকল্পনায় এ বিষয়গুলো সেভাবে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে না। দুর্বল মাটির ওপর গড়ে ওঠা ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। এ ধরনের আত্ম-বিধ্বংসী প্রবণতা থেকে বের না হতে পারলে ঢাকার কাছাকাছি এপিসেন্টারে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমাদের নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের জনবসতির লোকজনের জন্যও এই ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক আকারে হতে পারে, যা হাইতির ভূমিকম্পে দেখা গিয়েছিল।
বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে ঢাকাসহ দেশের নগর এলাকার ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে আইপিডি ১০টি সুপারিশ করছে। সেগুলো হলো নগরে জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ নিতে নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা কমিশন গঠন; বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি (বিবিআরএ) অনতিবিলম্বে গঠন করা; মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠন ও গুণাগুণকে বিবেচনায় নিয়ে নগর এলাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা ও মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন; ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে ভবনের রেট্রোফিট বা শক্তি বৃদ্ধিকরণ ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ভবন পুনর্নির্মাণ; নিম্নবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত এলাকার ভবনগুলোর বৈশিষ্ট্য ও এলাকাভিত্তিক ভিন্নতাকে বিবেচনায় নিয়ে ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ; সরু রাস্তার পাশে এবং জলাশয়-জলাভূমির ওপর বহুতল ভবন নির্মাণের অনুমোদন না দেওয়া এবং গ্যাস-ইলেকট্রিসিটিসহ বিভিন্ন পরিষেবা লাইনগুলার নিয়মিত তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণ; দুর্যোগের সময় আপদকালীন আশ্রয়ের জন্য এলাকাভিত্তিক পার্ক-উদ্যান-খেলার মাঠ-খোলা পরিসর তৈরি ও সংরক্ষণ করা; মহাপরিকল্পনা ও ইমারত বিধিমালা, অগ্নিনিরাপত্তা সম্পর্কিত আইন প্রণয়নে গোষ্ঠীস্বার্থে আপস না করে মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সর্বোচ্চ প্রাধিকার দেওয়া; উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিটি করপোরেশন-পৌরসভার ভবন নির্মাণ ও পরিকল্পনা তদারকি সক্ষমতা বাড়ানো; ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা।
বাংলাদেশেও বড় মাত্রার ভূমিকম্পের শঙ্কা : মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মতো ভয়াবহ ভূমিকম্প বাংলাদেশেও হতে পারে এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। গতকাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া সেল থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এমন বার্তা দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশেও একই মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং ঢাকা অঞ্চল ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’ এমতাবস্থায় ওই বিজ্ঞপ্তিতে ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য সব পর্যায়ে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ ও সচেতনতা তৈরিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর বেশকিছু ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। ফায়ার সর্ভিসের দেওয়া নির্দেশনাগুলো হলো বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী ভূমিকম্প প্রতিরোধী ভবন নির্মাণ করা; ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো ভবনগুলোর সংস্কার ও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা; সব বহুতল ও বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা; ইউটিলিটি সার্ভিসগুলো যথা গ্যাস, পানি ও বিদ্যুতের লাইনের সঠিকতা নিশ্চিত করা; ভূমিকম্প চলাকালে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পর্যায়ে বিভিন্ন করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত মহড়া অনুশীলন ও প্রচারের ব্যবস্থা করা; জরুরি টেলিফোন নম্বর যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ, হাসপাতাল ও অন্যান্য জরুরি নম্বরগুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ের পাশাপাশি সব ভবন বা স্থাপনায় সংরক্ষণ করা এবং তা দৃশ্যমান স্থানে লিখে রাখা; ভলান্টিয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দুর্যোগকালে কার্যকর ভূমিকা রাখা; জরুরি প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য সরঞ্জামাদি যেমন-টর্চলাইট, রেডিও (অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ), বাঁশি, হ্যামার, হেলমেট/কুশন, শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, প্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রী, ফার্স্ট এইড বক্স, শিশু যতেœর সামগ্রী ইত্যাদি বাসা-বাড়িতে নির্ধারিত স্থানে সংরক্ষণ করা, যাতে ভূমিকম্প-পরবর্তীতে আটকা পড়লে তা ব্যবহার করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা যায় এবং সব পর্যায়ে তদারকি সংস্থার কার্যক্রমে সহযোগিতা করা। এ ছাড়া যেকোনো তথ্যের জরুরি প্রয়োজনে ০১৭২২৮৫৬৮৬৭ মোবাইল নম্বর ও ১০২ হটলাইন নম্বরে যোগাযোগের অনুরোধ জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।