দূষণই যখন ভূষণ

হানিফ সংকেত  : ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’-এ বহু প্রচলিত বচনটি কয়লার জন্য ঠিক হলেও ময়লার জন্য ঠিক নয়। একটু সচেতন হলেই বহু কিছু থেকেই ময়লা দূর করা যায়। আমাদের দেশে আবর্জনা জাতীয় ময়লা ছাড়াও নানান ময়লা রয়েছে। যা পরিবেশ, সমাজ এবং মানুষের চারিত্রিক দূষণের জন্য দায়ী। এসব দূষণ কয়লার মতো কালো দেখা না গেলেও ভয়ংকর ক্ষতিকর। যেমন প্লাস্টিক দূষণ, নদী দূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এসব নানান কারণে হয় পরিবেশ দূষণ।  আবার মাদক দূষণ, মিডিয়ার গালিদূষণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসামাজিক দূষণ আর চারিত্রিক দূষণ তো রয়েছেই। ঘুষ দূষণ, দুর্নীতি দূষণ, পরকীয়া দূষণ, অর্থ আত্মসাৎ দূষণ, পাচার দূষণ, তোষামোদ দূষণসহ নানান দূষণ চারিত্রিক দূষণের মধ্যে পড়ে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দূষণের শ্রেণিবিভাগ করতে গেলে শত শত দূষণ পাওয়া যাবে। এসব দূষণও সামাজিক আবর্জনা বা ময়লা। এগুলো ঝাড়ু কিংবা সাবান দিয়ে পরিষ্কার করা যাবে না। এসব রোধে বোধের দরকার। যেই বোধ সবার নেই। কারণ এ ধরিত্রীতে নানা চরিত্রের মানুষ আছে। তাদের ধরন-ধারণ আর আচরণের জবাব নেই। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অভাবে বা কারও প্রভাবে নয়-স্বভাবের দোষেই খারাপ। আজকাল প্রযুক্তির কল্যাণে বা অকল্যাণে সবখানে অনলাইনেও মানুষের চরিত্রের বিচিত্র সব চিত্র হরহামেশাই দেখা যায়।

 

ইদানীং আরেকটি দূষণের আমদানি হয়েছে- গুজব দূষণ। এ দূষণ প্রক্রিয়ায় সাদাকে কালো আর কালোকে সাদা করা হয়। জীবিত মানুষকেও মেরে ফেলা হয়। ইদানীং আবার অর্থ নিয়ে গুজবেও নানা অনর্থের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ বলেন, কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়ার পথে, কেউ বলেন ব্যাংকের টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে, কেউ বলেন কিছু ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার খোঁজ নিচ্ছেন কোন ব্যাংক নিরাপদ। কদিন আগে কথায় কথায় একজন বললেন, গ্রামের একজন সহজ-সরল বয়স্ক মানুষ এ গুজবে ভীত হয়ে তার ভাতিজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাতিজা আমি একটু ঢাকা যামু।

ভাতিজা জানতে চাইল ঢাকায় কোথায় যাবেন?

 

চাচা বলেন, বিশ্বব্যাংকের অফিসে।

ভাতিজা তো শুনে অবাক, হঠাৎ বিশ্বব্যাংকে কেন?

চাচা সরল মনে উত্তর দিলেন এখন দেশের ব্যাংকে বলে টাকা নেই। তাই ওই বিশ্বব্যাংকেই টাকা রাখুম। ওইখানে বিশ্বের সব টাকা থাকে। নিলেও শেষ অইব না, নিরাপদ। অথচ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ব্যাংক সম্পর্কিত এ ধরনের তথ্য সত্য নয়-গুজব।

এ গুজব দূষণের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের বহু কষ্টে জমানো সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে মানসিক চিন্তায় পড়ে যান।

আবার নানা নামের নানান জাতের প্রচারমাধ্যম আছে। এর মধ্যে কোনোটি উত্তম, কোনোটি মধ্যম, আবার কোনোটি বা অধম। এরাও এক এক সময় এক এক কথা বলে। মানগত কারণে এদের কেউ আলোচিত, কেউ সমালোচিত, কেউবা প্রশংসিত। এসব মাধ্যমের কোথাও কোথাও পরিবার নিয়ে দেখার অযোগ্য গালিসর্বস্ব নাটক প্রচারের কারণে এ প্রচারমাধ্যমটিও দূষণের কবলে পড়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারেও বাড়ছে সামাজিক দূষণ। ইদানীং সামাজিক মাধ্যম হিসেবে অতি আলোচিত একটি অ্যাপস হচ্ছে ‘টিকটক’।

 

চীন থেকে আসা এ অ্যাপ ‘টিকটক’ যেন চীন থেকে আসা করোনার মতোই আমাদের এখানে ‘সমাজদূষণ ভাইরাস’ ছড়াচ্ছে। এ অ্যাপটি প্রতিভাবান ও প্রতিভাহীন যে কাউকে কনটেন্টভেদে খুব সহজেই পরিচিত করতে পারে। পেশাদার ক্যামেরা, শব্দযন্ত্র, কারিগরি দক্ষতা, নির্মাণ ব্যয়, সময় ক্ষেপণ, অভিনয়শৈলী কোনো কিছু ছাড়াই ইন্টারনেটে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের সহজ পথ দেখিয়েছে এ চাইনিজ অ্যাপটি। প্রয়োজন শুধু একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ। টিকটকের একটি তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি মানুষ টিকটক ব্যবহার করছেন। ডাউনলোড চার্টের শীর্ষেও রয়েছে এ টিকটক। সহজ বিনোদনের এ মাধ্যমটিতে অনেকেই নিজ ভাষার বদলে হিন্দি ভাষায় ঠোঁট মেলাচ্ছেন, অভিনয় করছেন। এখানে অধিকাংশ ভিডিওতেই দেখা যায় অশোভন পোশাকে অশালীন ভঙ্গিতে নৃত্য প্রদর্শন কিংবা কোনো ভাইরাল হওয়া ভিডিও বা গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো। কিছু দৃষ্টি শোভন, কিছু দৃষ্টিকটু। কিছু সহনীয়, কিছু অসহনীয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেই কোনো শিক্ষণীয় বার্তা। রাজনৈতিক বক্তৃতা-ওয়াজ অনুকরণ করেও টিকটক করছেন অনেকেই। সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় ইদানীং এসবের সঙ্গে কিছু কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, টিভি-সিনেমার নায়ক-নায়িকাও টিকটক তারকাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেক্ষেত্রে টিকটক তারকাদেরই বিজয়ী বলা যায়। কারণ এদের অনেকের চেয়ে টিকটক শিল্পীদের ফলোয়ার এবং জনপ্রিয়তা বেশি। এদের অনেকেই অন্যের কুরুচিপূর্ণ-স্থূল সংলাপে ঠোঁট মেলাচ্ছেন, করছেন উদ্ভট নৃত্য।

 

আসলে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক কোনো মাধ্যমই খারাপ নয়। খারাপ হয় ব্যবহার দোষে। আর প্রযুক্তির এ অপব্যবহারেই বাড়ছে অপরাধ। বাড়ছে সামাজিক দূষণ। তবে আজকে ওসব দূষণ নয়, আমার প্রধান প্রসঙ্গ পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক দূষণ। বিশেষ করে যেসব প্লাস্টিক সামগ্রী আমরা নিয়মিত ব্যবহার করি তা আমাদের পরিবেশকে কতটা ক্ষতি করছে তা আমরা কেউই গভীরভাবে ভেবে দেখি না।

 

একসময় প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে পেয়েছিলেন কুমিল্লার শালবন বৌদ্ধবিহার (ময়নামতি), পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরের মতো প্রাচীন নিদর্শন। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রাচীন নিদর্শন খুঁজতে গিয়ে মাটি খুঁড়ে পাবে চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল এবং নানান প্লাস্টিক সামগ্রী। কারণ আমাদের নিত্য ব্যবহার্য এসব প্লাস্টিক সামগ্রী মাটির সঙ্গে মেশে না। ঠিক তেমনি, বিজ্ঞানীরা বলছেন ২০৫০ সালের দিকে নাকি সমুদ্রগুলোতে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের বোতল বা অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্য বেশি থাকবে। কী ভয়ংকর! যত দিন যাচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

 

আধুনিক যুগ প্লাস্টিকের যুগ। বিভিন্ন রকম প্লাস্টিকের প্যাকেট, ব্যাগ, বোতল, বালতি, ক্যান, কাপ, মগ, গ্লাস, স্ট্র ইত্যাদি নানান ধরনের ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত।

 

নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে প্লাস্টিকের উৎপাদন ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ টন। ৬৫ বছর পর ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ মিলিয়ন টনে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গ্যাছে, শহরাঞ্চলগুলোতে বছরে সাড়ে ৮ লাখ টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পলিথিন উৎপন্ন হয়। মানুষের অসচেতনতার কারণে এসব পরিত্যক্ত পলিথিনের শেষ ঠাঁই হয় পুকুর, নর্দমা, খাল-বিল, নদী-নালা প্রভৃতি স্থানে এবং টন টন প্লাস্টিক পুঁতে ফেলা হয়। ফলে অপচনশীল প্লাস্টিক মাটিতে থেকে যায় বছরের পর বছর।

 

আবার কভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও বেড়েছে প্লাস্টিকের যথেষ্ট ব্যবহার। পলিথিনের তৈরি পাতলা হ্যান্ড গ্লাভস, পলিথিনের ব্যাগ, দোকান থেকে বাসাবাড়িতে খাবার সরবরাহের জন্য নানা ধরনের মোড়ক।

 

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হয়, এর ৫০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য কাপ, চামচ, প্লেট বা পলিথিন। বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশির ভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যরে আকার নেয়। যেহেতু প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ, তাই সৃষ্টির পর পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে অবস্থান করে পরিবেশের ভারসাম্যকে নষ্ট করছে। মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ। বর্ষার প্রবল বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত পলিব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ ও বোতল শহরের পানি নিষ্কাশন পাইপ, ড্রেন ইত্যাদির মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

 

বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ও সমুদ্রসৈকতে এসব প্লাস্টিক সামগ্রী বিশেষ করে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, পলিথিনের ব্যাগ যেখানে-সেখানে ফেলে রাখার কারণে একসময় এসব প্যাকেট বর্জ্যে রূপান্তরিত হয়। ফলে পরিবেশ হয় দূষিত।

 

সমুদ্রসৈকতের জন্য ফ্লোরিডা রাজ্যের ওয়েস্ট পাম বিচ শহরটি অত্যন্ত বিখ্যাত। বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকত, বিলাসবহুল বিপণিবিতান, উষ্ণ জলবায়ু সবকিছু মিলিয়ে ওয়েস্ট পাম বিচ ফ্লোরিডার একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন নগরী ও আবাসস্থল। আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখানে রয়েছে ২০টিরও বেশি সমুদ্রসৈকত। ওয়েস্ট পাম বিচে পর্যটকদের পাশাপাশি শৌখিন মাছ শিকারিদের ভিড় লেগেই থাকে। মাছ শিকারি এবং পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও সৈকতের সৌন্দর্য কিন্তু একটুও নষ্ট হয়নি, কারণ এখানে শিকারিরা এবং পর্যটকরা সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত সচেতন। এখানে কাউকে বলতে হয় না, ‘আপনারা সৈকতের পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হন’।

 

আবার ২০ শতকের শুরু থেকেই মিয়ামি বিচ আমেরিকার একটি বিখ্যাত বিচ হিসেবে পরিচিতি পায়। বলা হয় দক্ষিণ মিয়ামি বিচ সপরিবারে অবকাশ যাপনের জন্য একটি আদর্শ স্থান। কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম এই সাউথ বিচে। দূর থেকে দেখেই মনে হয় যেন ঝকঝকে-তকতকে একটি সৈকত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি করে সাজানো। সাদা বালুর বিস্তীর্ণ প্রান্তর, তীরে আছড়ে পড়া সৈকতের নীল জলরাশিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে যায় এই পরিচ্ছন্ন সৈকতে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘মিয়ামি ভাইচ’ ছাড়াও ‘মিয়ামি সেভেন’, ‘মিয়ামি অ্যানিমেল পুলিশ’, ‘মিয়ামি ইংক’, ‘মিয়ামি মেডিকেল’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামের টেলিভিশন সিরিজ এবং শতাধিক ছবিও নির্মিত হয়েছে এখানে। এত চমৎকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি সমুদ্রসৈকত দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- কীভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে সমুদ্রসৈকতগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সৌন্দর্য রক্ষা করার জন্য কতগুলো বিষয় মেনে চলা হয়। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান বিষয় হচ্ছে জনসচেতনতা অর্থাৎ সমুদ্র ভ্রমণে যারা আসছেন তারা কেউ যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে সমুদ্র বা এর আশপাশের পরিবেশ দূষিত করেন না এবং দ্বিতীয় কারণটি হলো তিন স্তরের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা। সিটি থেকে জনগণের আয়কর বাবদ যে অর্থ লাভ হয়, তার একটি অংশ এই সমুদ্রসৈকত রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হয়। কাউন্টি থেকেও আর্থিক সহযোগিতা এবং জনবল প্রদান করে বিচ রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তা প্রদান করা হয়। তা ছাড়া প্রতি সপ্তাহে মিয়ামি ফধফব হেলথ ডিপার্টমেন্ট থেকে সমুদ্রের পানি পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয় পানিতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ। পানিতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়া বা জনস্বার্থের হুমকিস্বরূপ জীবাণু পাওয়া গেলে বিচ এলাকাতে অস্থায়ীভাবে জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে সমুদ্রসৈকত রক্ষণাবেক্ষণে জনগণ এবং প্রশাসনের রয়েছে সমন্বিত উদ্যোগ।

 

এবারে আমাদের সমুদ্রসৈকতে আসা যাক। আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত রক্ষণাবেক্ষণে এ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতটি হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। যার দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। বিশেষত্ব হলো পুরো সৈকতটিই বালুকাময় যেখানে কোনো কাদার অস্তিত্ব নেই। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত একটি রূপময়ী সমুদ্রসৈকত। যেখানে প্রতিটি ঋতুতেই দেখা যায় ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন রূপ, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন আবহাওয়া। আর তাই তো পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। আর বঙ্গোপসাগরের বুকেই রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। বালুকাময় সৈকত, সুনীল জলরাশি আর সারি সারি নারিকেল গাছে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সেন্টমার্টিনস দ্বীপ। শীত মৌসুমে এ দ্বীপটিতে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ পর্যটক ভ্রমণ করেন। প্রচুর পর্যটকের ভ্রমণের ফলে অসচেতনতায় প্রবাল দ্বীপটি প্লাস্টিক আবর্জনায় ভরে ওঠে। যার ফলে সমুদ্রের পরিবেশে দূষণ ঝুঁঁকি বাড়ে। প্রকৃতির বিস্ময় এ দ্বীপটি আমাদের পর্যটন সম্পদ। দখল-দূষণের কারণে হুমকির মুখে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। প্রতি শীতেই কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিনে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু পর্যটক আসেন ঘুরতে। যে কারণে পর্যটন মৌসুমে এসব স্থানে পর্যটকদের বিচরণে প্রাণচাঞ্চল্য আসে। তাই প্রয়োজন পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সৈকতের পরিবেশ রক্ষার। কারণ এসব স্থানে পর্যটক যত বাড়ছে অসচেতনতার কারণে তাদের ফেলে রাখা বর্জ্যে তত বেশি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, দূষিত হচ্ছে পানি। বিশেষ করে প্লাস্টিকের বোতল, বাদামের ঠোঙা, চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেটে ভরে গেছে সাগর সৈকত। ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও দর্শনার্থীরা খাবার খেয়ে ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলছেন। একদিকে ময়লা আবর্জনার কারণে নোংরা হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনার কারণে সৈকত হারাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

 

২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেখা গেছে তামিলনাড়ুর সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বোতল, প্লেটসহ অন্যান্য আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। এ সময় তিনি হাতে বড় একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে সৈকতের বালুতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য ও পানির বোতল কুড়িয়ে নেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি টুইট বার্তায় লেখেন, ‘আসুন আমাদের জনসাধারণের জায়গাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করি! আসুন আমরা নিজে সুস্থ থাকি ও অন্যদের সুস্থ থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করি’।

 

প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যেমন ব্যাপক প্রভাব ফেলে, তেমনি সামুদ্রিক প্রাণীর ওপরও এই প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব রয়েছে। মনে রাখতে হবে, প্লাস্টিক মানে বিষ। প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় কার্বনের পলিমার যৌগ দিয়ে। এই ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। জলাশয়ে কোনো ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা যাবে না। যত্রতত্র চিপসের প্যাকেট, কোমল পানীয়র খালি বোতল ফেলা যাবে না। গ্রামাঞ্চলে বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা না পেলে পলিথিন বর্জ্য নিজ দায়িত্বে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্লাস্টিক ব্যবহার ও পণ্য উৎপাদন রোধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারেও মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এখন জলে-স্থলে সব খানেই দূষণ। পানিতে দূষণ, বায়ুতে দূষণ, পরিবেশে দূষণ, সমাজে দূষণ। এ দূষণ যেন আমাদের সর্বাঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। দূষণই যেন এখন আমাদের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে আমাদের রক্ষা পেতে হবে। আর আগামী প্রজন্মকেও রক্ষা করতে হবে।

 

আর সে জন্য প্রয়োজন যে কোনো দূষণ রোধে সচেতনতা। সে জন্যই বলা হয়, দেশের উন্নতির জন্য প্রয়োজন সচেতন জনগোষ্ঠীর। সচেতনতার অভাবেই দেখা যায় আমাদের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের ওপর সুযোগ গ্রহণ করেন অসাধু রাজনীতিবিদ, অসাধু ব্যবসায়ী এবং টাউট শ্রেণির মানুষেরা। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো- যত্রতত্র অতি ব্যবহারের কারণে এ সচেতন শব্দটিও মাঝে মাঝে চেতনা হারিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে। তাই অনুরোধ, আক্ষরিক অর্থেই এসব দূষণ রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে আমাদের প্রয়োজনে।  আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনে। সচেতন শব্দটিও যেন দূষণযুক্ত হয়ে ভূষণ হয়ে না যায়।

 

 লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী।  সূএ: বাংলাদদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের এসেছে: মাসুদ সাঈদী

» নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান

» অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ চারজন মাদক চোরা কারবারি আটক

» সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব, যা জানালেন বদিউল আলম

» ২ মার্চ ‘জাতীয় পতাকা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান মঈন খানের

» কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়: আইজিপি

» সুন্দর ব্যবহার ও আচরণের বিনিময়ে জান্নাত! হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

» বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পট লোন পেলেন সিলেটের সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা

» ‘ইউসিবি নাইট’ আয়োজনে গ্রাহক ও অংশীদারদের অব্যাহত সহযোগিতার স্বীকৃতি

» ইসলামপুর ওয়ার্ড কৃষক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

দূষণই যখন ভূষণ

হানিফ সংকেত  : ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’-এ বহু প্রচলিত বচনটি কয়লার জন্য ঠিক হলেও ময়লার জন্য ঠিক নয়। একটু সচেতন হলেই বহু কিছু থেকেই ময়লা দূর করা যায়। আমাদের দেশে আবর্জনা জাতীয় ময়লা ছাড়াও নানান ময়লা রয়েছে। যা পরিবেশ, সমাজ এবং মানুষের চারিত্রিক দূষণের জন্য দায়ী। এসব দূষণ কয়লার মতো কালো দেখা না গেলেও ভয়ংকর ক্ষতিকর। যেমন প্লাস্টিক দূষণ, নদী দূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ এসব নানান কারণে হয় পরিবেশ দূষণ।  আবার মাদক দূষণ, মিডিয়ার গালিদূষণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসামাজিক দূষণ আর চারিত্রিক দূষণ তো রয়েছেই। ঘুষ দূষণ, দুর্নীতি দূষণ, পরকীয়া দূষণ, অর্থ আত্মসাৎ দূষণ, পাচার দূষণ, তোষামোদ দূষণসহ নানান দূষণ চারিত্রিক দূষণের মধ্যে পড়ে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে দূষণের শ্রেণিবিভাগ করতে গেলে শত শত দূষণ পাওয়া যাবে। এসব দূষণও সামাজিক আবর্জনা বা ময়লা। এগুলো ঝাড়ু কিংবা সাবান দিয়ে পরিষ্কার করা যাবে না। এসব রোধে বোধের দরকার। যেই বোধ সবার নেই। কারণ এ ধরিত্রীতে নানা চরিত্রের মানুষ আছে। তাদের ধরন-ধারণ আর আচরণের জবাব নেই। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা অভাবে বা কারও প্রভাবে নয়-স্বভাবের দোষেই খারাপ। আজকাল প্রযুক্তির কল্যাণে বা অকল্যাণে সবখানে অনলাইনেও মানুষের চরিত্রের বিচিত্র সব চিত্র হরহামেশাই দেখা যায়।

 

ইদানীং আরেকটি দূষণের আমদানি হয়েছে- গুজব দূষণ। এ দূষণ প্রক্রিয়ায় সাদাকে কালো আর কালোকে সাদা করা হয়। জীবিত মানুষকেও মেরে ফেলা হয়। ইদানীং আবার অর্থ নিয়ে গুজবেও নানা অনর্থের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ বলেন, কিছু কিছু ব্যাংক দেউলিয়ার পথে, কেউ বলেন ব্যাংকের টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে, কেউ বলেন কিছু ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার খোঁজ নিচ্ছেন কোন ব্যাংক নিরাপদ। কদিন আগে কথায় কথায় একজন বললেন, গ্রামের একজন সহজ-সরল বয়স্ক মানুষ এ গুজবে ভীত হয়ে তার ভাতিজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাতিজা আমি একটু ঢাকা যামু।

ভাতিজা জানতে চাইল ঢাকায় কোথায় যাবেন?

 

চাচা বলেন, বিশ্বব্যাংকের অফিসে।

ভাতিজা তো শুনে অবাক, হঠাৎ বিশ্বব্যাংকে কেন?

চাচা সরল মনে উত্তর দিলেন এখন দেশের ব্যাংকে বলে টাকা নেই। তাই ওই বিশ্বব্যাংকেই টাকা রাখুম। ওইখানে বিশ্বের সব টাকা থাকে। নিলেও শেষ অইব না, নিরাপদ। অথচ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ব্যাংক সম্পর্কিত এ ধরনের তথ্য সত্য নয়-গুজব।

এ গুজব দূষণের কারণে সাধারণ মানুষ তাদের বহু কষ্টে জমানো সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে মানসিক চিন্তায় পড়ে যান।

আবার নানা নামের নানান জাতের প্রচারমাধ্যম আছে। এর মধ্যে কোনোটি উত্তম, কোনোটি মধ্যম, আবার কোনোটি বা অধম। এরাও এক এক সময় এক এক কথা বলে। মানগত কারণে এদের কেউ আলোচিত, কেউ সমালোচিত, কেউবা প্রশংসিত। এসব মাধ্যমের কোথাও কোথাও পরিবার নিয়ে দেখার অযোগ্য গালিসর্বস্ব নাটক প্রচারের কারণে এ প্রচারমাধ্যমটিও দূষণের কবলে পড়েছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারেও বাড়ছে সামাজিক দূষণ। ইদানীং সামাজিক মাধ্যম হিসেবে অতি আলোচিত একটি অ্যাপস হচ্ছে ‘টিকটক’।

 

চীন থেকে আসা এ অ্যাপ ‘টিকটক’ যেন চীন থেকে আসা করোনার মতোই আমাদের এখানে ‘সমাজদূষণ ভাইরাস’ ছড়াচ্ছে। এ অ্যাপটি প্রতিভাবান ও প্রতিভাহীন যে কাউকে কনটেন্টভেদে খুব সহজেই পরিচিত করতে পারে। পেশাদার ক্যামেরা, শব্দযন্ত্র, কারিগরি দক্ষতা, নির্মাণ ব্যয়, সময় ক্ষেপণ, অভিনয়শৈলী কোনো কিছু ছাড়াই ইন্টারনেটে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের সহজ পথ দেখিয়েছে এ চাইনিজ অ্যাপটি। প্রয়োজন শুধু একটি স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ। টিকটকের একটি তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি মানুষ টিকটক ব্যবহার করছেন। ডাউনলোড চার্টের শীর্ষেও রয়েছে এ টিকটক। সহজ বিনোদনের এ মাধ্যমটিতে অনেকেই নিজ ভাষার বদলে হিন্দি ভাষায় ঠোঁট মেলাচ্ছেন, অভিনয় করছেন। এখানে অধিকাংশ ভিডিওতেই দেখা যায় অশোভন পোশাকে অশালীন ভঙ্গিতে নৃত্য প্রদর্শন কিংবা কোনো ভাইরাল হওয়া ভিডিও বা গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলানো। কিছু দৃষ্টি শোভন, কিছু দৃষ্টিকটু। কিছু সহনীয়, কিছু অসহনীয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেই কোনো শিক্ষণীয় বার্তা। রাজনৈতিক বক্তৃতা-ওয়াজ অনুকরণ করেও টিকটক করছেন অনেকেই। সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের আশায় ইদানীং এসবের সঙ্গে কিছু কিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, টিভি-সিনেমার নায়ক-নায়িকাও টিকটক তারকাদের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেক্ষেত্রে টিকটক তারকাদেরই বিজয়ী বলা যায়। কারণ এদের অনেকের চেয়ে টিকটক শিল্পীদের ফলোয়ার এবং জনপ্রিয়তা বেশি। এদের অনেকেই অন্যের কুরুচিপূর্ণ-স্থূল সংলাপে ঠোঁট মেলাচ্ছেন, করছেন উদ্ভট নৃত্য।

 

আসলে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক কোনো মাধ্যমই খারাপ নয়। খারাপ হয় ব্যবহার দোষে। আর প্রযুক্তির এ অপব্যবহারেই বাড়ছে অপরাধ। বাড়ছে সামাজিক দূষণ। তবে আজকে ওসব দূষণ নয়, আমার প্রধান প্রসঙ্গ পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ প্লাস্টিক দূষণ। বিশেষ করে যেসব প্লাস্টিক সামগ্রী আমরা নিয়মিত ব্যবহার করি তা আমাদের পরিবেশকে কতটা ক্ষতি করছে তা আমরা কেউই গভীরভাবে ভেবে দেখি না।

 

একসময় প্রত্নতত্ত্ববিদরা মাটি খুঁড়ে পেয়েছিলেন কুমিল্লার শালবন বৌদ্ধবিহার (ময়নামতি), পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বরের মতো প্রাচীন নিদর্শন। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রাচীন নিদর্শন খুঁজতে গিয়ে মাটি খুঁড়ে পাবে চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতল এবং নানান প্লাস্টিক সামগ্রী। কারণ আমাদের নিত্য ব্যবহার্য এসব প্লাস্টিক সামগ্রী মাটির সঙ্গে মেশে না। ঠিক তেমনি, বিজ্ঞানীরা বলছেন ২০৫০ সালের দিকে নাকি সমুদ্রগুলোতে মাছের তুলনায় প্লাস্টিকের বোতল বা অন্যান্য প্লাস্টিক বর্জ্য বেশি থাকবে। কী ভয়ংকর! যত দিন যাচ্ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েই চলেছে।

 

আধুনিক যুগ প্লাস্টিকের যুগ। বিভিন্ন রকম প্লাস্টিকের প্যাকেট, ব্যাগ, বোতল, বালতি, ক্যান, কাপ, মগ, গ্লাস, স্ট্র ইত্যাদি নানান ধরনের ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত।

 

নিয়মিত প্লাস্টিক পদার্থের ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে প্লাস্টিকের উৎপাদন ছিল মাত্র ২ দশমিক ২ টন। ৬৫ বছর পর ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে সে পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৮ মিলিয়ন টনে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গ্যাছে, শহরাঞ্চলগুলোতে বছরে সাড়ে ৮ লাখ টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পলিথিন উৎপন্ন হয়। মানুষের অসচেতনতার কারণে এসব পরিত্যক্ত পলিথিনের শেষ ঠাঁই হয় পুকুর, নর্দমা, খাল-বিল, নদী-নালা প্রভৃতি স্থানে এবং টন টন প্লাস্টিক পুঁতে ফেলা হয়। ফলে অপচনশীল প্লাস্টিক মাটিতে থেকে যায় বছরের পর বছর।

 

আবার কভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও বেড়েছে প্লাস্টিকের যথেষ্ট ব্যবহার। পলিথিনের তৈরি পাতলা হ্যান্ড গ্লাভস, পলিথিনের ব্যাগ, দোকান থেকে বাসাবাড়িতে খাবার সরবরাহের জন্য নানা ধরনের মোড়ক।

 

বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্য হয়, এর ৫০ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য কাপ, চামচ, প্লেট বা পলিথিন। বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশির ভাগই পুনঃচক্রায়ন হয় না। এগুলো পরিবেশে থেকে বর্জ্যরে আকার নেয়। যেহেতু প্লাস্টিক অপচ্য পদার্থ, তাই সৃষ্টির পর পুনঃচক্রায়ন না হওয়া পর্যন্ত এটি পরিবেশে অবস্থান করে পরিবেশের ভারসাম্যকে নষ্ট করছে। মানুষের অসচেতনতাই প্লাস্টিক দূষণের প্রধান কারণ। বর্ষার প্রবল বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত পলিব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ ও বোতল শহরের পানি নিষ্কাশন পাইপ, ড্রেন ইত্যাদির মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

 

বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ও সমুদ্রসৈকতে এসব প্লাস্টিক সামগ্রী বিশেষ করে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, পলিথিনের ব্যাগ যেখানে-সেখানে ফেলে রাখার কারণে একসময় এসব প্যাকেট বর্জ্যে রূপান্তরিত হয়। ফলে পরিবেশ হয় দূষিত।

 

সমুদ্রসৈকতের জন্য ফ্লোরিডা রাজ্যের ওয়েস্ট পাম বিচ শহরটি অত্যন্ত বিখ্যাত। বিস্তীর্ণ সমুদ্রসৈকত, বিলাসবহুল বিপণিবিতান, উষ্ণ জলবায়ু সবকিছু মিলিয়ে ওয়েস্ট পাম বিচ ফ্লোরিডার একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন নগরী ও আবাসস্থল। আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখানে রয়েছে ২০টিরও বেশি সমুদ্রসৈকত। ওয়েস্ট পাম বিচে পর্যটকদের পাশাপাশি শৌখিন মাছ শিকারিদের ভিড় লেগেই থাকে। মাছ শিকারি এবং পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও সৈকতের সৌন্দর্য কিন্তু একটুও নষ্ট হয়নি, কারণ এখানে শিকারিরা এবং পর্যটকরা সমুদ্রসৈকতের পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত সচেতন। এখানে কাউকে বলতে হয় না, ‘আপনারা সৈকতের পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হন’।

 

আবার ২০ শতকের শুরু থেকেই মিয়ামি বিচ আমেরিকার একটি বিখ্যাত বিচ হিসেবে পরিচিতি পায়। বলা হয় দক্ষিণ মিয়ামি বিচ সপরিবারে অবকাশ যাপনের জন্য একটি আদর্শ স্থান। কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম এই সাউথ বিচে। দূর থেকে দেখেই মনে হয় যেন ঝকঝকে-তকতকে একটি সৈকত। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি করে সাজানো। সাদা বালুর বিস্তীর্ণ প্রান্তর, তীরে আছড়ে পড়া সৈকতের নীল জলরাশিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ছুটে যায় এই পরিচ্ছন্ন সৈকতে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘মিয়ামি ভাইচ’ ছাড়াও ‘মিয়ামি সেভেন’, ‘মিয়ামি অ্যানিমেল পুলিশ’, ‘মিয়ামি ইংক’, ‘মিয়ামি মেডিকেল’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামের টেলিভিশন সিরিজ এবং শতাধিক ছবিও নির্মিত হয়েছে এখানে। এত চমৎকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটি সমুদ্রসৈকত দেখে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- কীভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। মূলত যুক্তরাষ্ট্রে সমুদ্রসৈকতগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সৌন্দর্য রক্ষা করার জন্য কতগুলো বিষয় মেনে চলা হয়। এর মধ্যে প্রথম এবং প্রধান বিষয় হচ্ছে জনসচেতনতা অর্থাৎ সমুদ্র ভ্রমণে যারা আসছেন তারা কেউ যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলে সমুদ্র বা এর আশপাশের পরিবেশ দূষিত করেন না এবং দ্বিতীয় কারণটি হলো তিন স্তরের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা। সিটি থেকে জনগণের আয়কর বাবদ যে অর্থ লাভ হয়, তার একটি অংশ এই সমুদ্রসৈকত রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় করা হয়। কাউন্টি থেকেও আর্থিক সহযোগিতা এবং জনবল প্রদান করে বিচ রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তা প্রদান করা হয়। তা ছাড়া প্রতি সপ্তাহে মিয়ামি ফধফব হেলথ ডিপার্টমেন্ট থেকে সমুদ্রের পানি পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হয় পানিতে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ। পানিতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যাকটেরিয়া বা জনস্বার্থের হুমকিস্বরূপ জীবাণু পাওয়া গেলে বিচ এলাকাতে অস্থায়ীভাবে জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে সমুদ্রসৈকত রক্ষণাবেক্ষণে জনগণ এবং প্রশাসনের রয়েছে সমন্বিত উদ্যোগ।

 

এবারে আমাদের সমুদ্রসৈকতে আসা যাক। আমাদের কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত রক্ষণাবেক্ষণে এ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতটি হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। যার দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। বিশেষত্ব হলো পুরো সৈকতটিই বালুকাময় যেখানে কোনো কাদার অস্তিত্ব নেই। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত একটি রূপময়ী সমুদ্রসৈকত। যেখানে প্রতিটি ঋতুতেই দেখা যায় ভিন্ন চেহারা, ভিন্ন রূপ, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন আবহাওয়া। আর তাই তো পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। আর বঙ্গোপসাগরের বুকেই রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র সামুদ্রিক প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। বালুকাময় সৈকত, সুনীল জলরাশি আর সারি সারি নারিকেল গাছে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সেন্টমার্টিনস দ্বীপ। শীত মৌসুমে এ দ্বীপটিতে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ পর্যটক ভ্রমণ করেন। প্রচুর পর্যটকের ভ্রমণের ফলে অসচেতনতায় প্রবাল দ্বীপটি প্লাস্টিক আবর্জনায় ভরে ওঠে। যার ফলে সমুদ্রের পরিবেশে দূষণ ঝুঁঁকি বাড়ে। প্রকৃতির বিস্ময় এ দ্বীপটি আমাদের পর্যটন সম্পদ। দখল-দূষণের কারণে হুমকির মুখে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। প্রতি শীতেই কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিনে হাজার হাজার ভ্রমণপিপাসু পর্যটক আসেন ঘুরতে। যে কারণে পর্যটন মৌসুমে এসব স্থানে পর্যটকদের বিচরণে প্রাণচাঞ্চল্য আসে। তাই প্রয়োজন পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সৈকতের পরিবেশ রক্ষার। কারণ এসব স্থানে পর্যটক যত বাড়ছে অসচেতনতার কারণে তাদের ফেলে রাখা বর্জ্যে তত বেশি দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, দূষিত হচ্ছে পানি। বিশেষ করে প্লাস্টিকের বোতল, বাদামের ঠোঙা, চিপস ও বিস্কুটের প্যাকেটে ভরে গেছে সাগর সৈকত। ডাস্টবিন থাকা সত্ত্বেও দর্শনার্থীরা খাবার খেয়ে ময়লা আবর্জনা ডাস্টবিনে না ফেলে যেখানে-সেখানে ফেলছেন। একদিকে ময়লা আবর্জনার কারণে নোংরা হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে সরকারি-বেসরকারি নানা স্থাপনার কারণে সৈকত হারাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

 

২০১৯ সালের ১২ অক্টোবর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দেখা গেছে তামিলনাড়ুর সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বোতল, প্লেটসহ অন্যান্য আবর্জনা পরিষ্কার করছেন। এ সময় তিনি হাতে বড় একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে সৈকতের বালুতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য ও পানির বোতল কুড়িয়ে নেন। এ প্রসঙ্গে তিনি একটি টুইট বার্তায় লেখেন, ‘আসুন আমাদের জনসাধারণের জায়গাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করি! আসুন আমরা নিজে সুস্থ থাকি ও অন্যদের সুস্থ থাকার বিষয়টিও নিশ্চিত করি’।

 

প্লাস্টিক দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর যেমন ব্যাপক প্রভাব ফেলে, তেমনি সামুদ্রিক প্রাণীর ওপরও এই প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব রয়েছে। মনে রাখতে হবে, প্লাস্টিক মানে বিষ। প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় কার্বনের পলিমার যৌগ দিয়ে। এই ভয়াবহ দূষণ থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। জলাশয়ে কোনো ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা যাবে না। যত্রতত্র চিপসের প্যাকেট, কোমল পানীয়র খালি বোতল ফেলা যাবে না। গ্রামাঞ্চলে বর্জ্য ফেলার নির্দিষ্ট জায়গা না পেলে পলিথিন বর্জ্য নিজ দায়িত্বে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। প্লাস্টিক ব্যবহার ও পণ্য উৎপাদন রোধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহারেও মানুষজনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এখন জলে-স্থলে সব খানেই দূষণ। পানিতে দূষণ, বায়ুতে দূষণ, পরিবেশে দূষণ, সমাজে দূষণ। এ দূষণ যেন আমাদের সর্বাঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। দূষণই যেন এখন আমাদের ভূষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে আমাদের রক্ষা পেতে হবে। আর আগামী প্রজন্মকেও রক্ষা করতে হবে।

 

আর সে জন্য প্রয়োজন যে কোনো দূষণ রোধে সচেতনতা। সে জন্যই বলা হয়, দেশের উন্নতির জন্য প্রয়োজন সচেতন জনগোষ্ঠীর। সচেতনতার অভাবেই দেখা যায় আমাদের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের ওপর সুযোগ গ্রহণ করেন অসাধু রাজনীতিবিদ, অসাধু ব্যবসায়ী এবং টাউট শ্রেণির মানুষেরা। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো- যত্রতত্র অতি ব্যবহারের কারণে এ সচেতন শব্দটিও মাঝে মাঝে চেতনা হারিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে। তাই অনুরোধ, আক্ষরিক অর্থেই এসব দূষণ রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে আমাদের প্রয়োজনে।  আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনে। সচেতন শব্দটিও যেন দূষণযুক্ত হয়ে ভূষণ হয়ে না যায়।

 

 লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী।  সূএ: বাংলাদদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com