‘দাম কেন বাড়ছে এইডা আমরা ক্যামনে কমু, সরকাররে জিগান?’

কাজল ঘোষ: সকালের নাস্তায় পরোটা না হলে চলে না। তা যেভাবেই হোক। ভাজি বলুন, চা বলুন, ডিমের অমলেট বলুন, চিকেন স্যুপ বা খাসির পায়া সব কিছুর সঙ্গে চাই পরোটা। আমার এক বন্ধুকে দেখেছি সে কড়া ভাজা পরোটার সঙ্গে এক কাপ গরম চা খাবেই। তার সব নাস্তা শেষে এটা থাকে আবদার। ক্ষেত্র বিশেষে নান রুটি।

 

পুরনো ঢাকার মানুষের এই অভ্যেস দীর্ঘদিনের। অথবা ঘুরিয়ে বলা যায় এ-না হলে চলেই না। বায়ান্ন বাজার তিপান্ন গলির এ-ঢাকায় এখন আর আগের হিসেব চলে না।

কলেবরে ঢাকা বেড়েছে নানা আকারে। মানুষও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। কিন্তু দ্রব্যের মূল্য দশকের পর দশকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বহুগুণ।

আজ থেকে তিন দশক আগের কথা বললে অনেকটা রূপকথার গল্প মনে হবে। চারআনায় ঢাকায় দারুণ ডালপুরি পাওয়া যেতো। স্কুল থেকে কাপ্তান বাজার স্টারে যখন টিফিন খেতাম তখন পাঁচ টাকায় বড় নান রুটি আর বুটের ডালের প্যাকেজ ছিল। বলছি, নব্বই পরবর্তী সময়ের কথা।

আটআনার পুরি আর এক টাকায় পরোটা খেয়েছি এরও অনেক পর পর্যন্ত। পরোটার দাম বাড়তে বাড়তে এখন কোথায় গেছে? ডালপুরির দশাও তাই। ঢাকায় তিন টাকায় এখন ডালপুরি নেই। নিদেন পক্ষে পাঁচ টাকায় মিলবে কিনা তা-ও বর্তমানে চ্যালেঞ্জের মধ্যে।

ছুটির সকালে দুই বন্ধু গেছে হোটেলে নাস্তা করতে। তেজগাঁ এলাকার এই হোটেলে তারা নিয়মিত খান। কিন্তু আজ খেতে গিয়ে তাদের মাথায় হাত। দোকানে কাগজে লিখে টাঙানো হয়েছে পরোটাসহ অন্যান্য খাবারের বাড়তি মূল্যের তালিকা। পাঁচ টাকার পরোটা এখন থেকে দশ টাকা, পনের টাকার ডিম ভাজি বিশ টাকা, ষাট টাকার কোয়ার্টার গ্রিল এখন নব্বই টাকা, সত্তর টাকার শিখ কাবাব এখন একশত টাকা, পুরি প্রতি পিস এখন দশ টাকা।

খাবার টেবিলে বসেই দুই বন্ধুর সকালটাই কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। স্বাদের পরোটার দামও এখন ডাবল। দাম কেন বেড়েছে, হোটেল বয়কে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর রেডি। দ্যাখতাছেন না, টেরম টেরম যুদ্ধ চলতাছে। কোথায় ইউক্রেন আর কোথায় কাওরান বাজার? এমন কথা বলতেই আমরা কি কমু এইডা সরকাররে জিগান। এতকিছু বুঝেন এইডা আফনেরা বুঝতাছেন না স্যার?
এক বন্ধু আরেক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে, কই এর আগে তো কোন যুদ্ধ লাগে নাই, তহন দাম বাড়লে কিসের জন্য? আর যুদ্ধের কারণে আমাদের এখানে এখনই দাম বাড়বে কেন? আমাদের এখানে সেখানকার কোন পণ্য তো এখনও আসেনি। এক বন্ধু ওয়েটারকে বললো, যুদ্ধটুদ্ধ কিছু না মিঞার, তোমরা ছুঁতো পেলেই দাম বাড়াও। সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবের ফর্দ দেখলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, সরকারি সংস্থা টিসিবি’র হিসাবে গত এক মাসের ব্যবধানে অন্তত ৩১টি পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে শতভাগ পর্যন্ত দাম বেড়েছে এমন পণ্যও আছে। বাড়তি দামের কারণে নিম্নআয়ের সুবিধা দিতে সরকারি সংস্থা টিসিবি কম দামে পণ্য বিক্রি করছে। সীমিত পরিসরে এই কার্যক্রম চলায় অল্প সংখ্যক মানুষ এর সেবা পাচ্ছেন। কিন্তু এ নিয়েও চলছে মানুষের লড়াই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। তার ওপর ধাক্কধাক্কি তো আছেই। তাও শেষ পর্যন্ত ঠিক পণ্যটি মিলবে কিনা আগে থেকেই বলা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির হিসেবেই এক মাসের ব্যবধানে অন্তত ৩১টি পণ্যের দাম বেড়েছে সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পিয়াজের দাম। এক মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে মান ভেদে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এছাড়া ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, ডাল, চিনিসহ বেড়েছে অন্তত ৩১টি পণ্যের দাম। তবে টিসিবির দর ও বাজারের বাস্তব চিত্রের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সংস্থাটি বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা বললেও, বাজারে এর দাম ১৮০ থেকে প্রায় ২০০ টাকায় ঠেকেছে।

 

লেখাটি শেষ করতে চাই কৌতুকাভিনেতা কাজলের একটি গানের প্রথম কটি কলি দিয়ে। তিনি বাজারের থলে হাতে নিয়ে বাজারে বাজারে ঘুরে গেয়ে চলেছেন, হাজার টাকায় বাজার করিয়া, বাজান গো পড়ে গেলাম মাথা ঘুরাইয়া, অল্প পয়সায় থলে ভরে নারে, ইবলিশ শয়তানে দিল দাম বাড়াইয়া…।  সূূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

‘দাম কেন বাড়ছে এইডা আমরা ক্যামনে কমু, সরকাররে জিগান?’

কাজল ঘোষ: সকালের নাস্তায় পরোটা না হলে চলে না। তা যেভাবেই হোক। ভাজি বলুন, চা বলুন, ডিমের অমলেট বলুন, চিকেন স্যুপ বা খাসির পায়া সব কিছুর সঙ্গে চাই পরোটা। আমার এক বন্ধুকে দেখেছি সে কড়া ভাজা পরোটার সঙ্গে এক কাপ গরম চা খাবেই। তার সব নাস্তা শেষে এটা থাকে আবদার। ক্ষেত্র বিশেষে নান রুটি।

 

পুরনো ঢাকার মানুষের এই অভ্যেস দীর্ঘদিনের। অথবা ঘুরিয়ে বলা যায় এ-না হলে চলেই না। বায়ান্ন বাজার তিপান্ন গলির এ-ঢাকায় এখন আর আগের হিসেব চলে না।

কলেবরে ঢাকা বেড়েছে নানা আকারে। মানুষও বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। কিন্তু দ্রব্যের মূল্য দশকের পর দশকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে বহুগুণ।

আজ থেকে তিন দশক আগের কথা বললে অনেকটা রূপকথার গল্প মনে হবে। চারআনায় ঢাকায় দারুণ ডালপুরি পাওয়া যেতো। স্কুল থেকে কাপ্তান বাজার স্টারে যখন টিফিন খেতাম তখন পাঁচ টাকায় বড় নান রুটি আর বুটের ডালের প্যাকেজ ছিল। বলছি, নব্বই পরবর্তী সময়ের কথা।

আটআনার পুরি আর এক টাকায় পরোটা খেয়েছি এরও অনেক পর পর্যন্ত। পরোটার দাম বাড়তে বাড়তে এখন কোথায় গেছে? ডালপুরির দশাও তাই। ঢাকায় তিন টাকায় এখন ডালপুরি নেই। নিদেন পক্ষে পাঁচ টাকায় মিলবে কিনা তা-ও বর্তমানে চ্যালেঞ্জের মধ্যে।

ছুটির সকালে দুই বন্ধু গেছে হোটেলে নাস্তা করতে। তেজগাঁ এলাকার এই হোটেলে তারা নিয়মিত খান। কিন্তু আজ খেতে গিয়ে তাদের মাথায় হাত। দোকানে কাগজে লিখে টাঙানো হয়েছে পরোটাসহ অন্যান্য খাবারের বাড়তি মূল্যের তালিকা। পাঁচ টাকার পরোটা এখন থেকে দশ টাকা, পনের টাকার ডিম ভাজি বিশ টাকা, ষাট টাকার কোয়ার্টার গ্রিল এখন নব্বই টাকা, সত্তর টাকার শিখ কাবাব এখন একশত টাকা, পুরি প্রতি পিস এখন দশ টাকা।

খাবার টেবিলে বসেই দুই বন্ধুর সকালটাই কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেল। স্বাদের পরোটার দামও এখন ডাবল। দাম কেন বেড়েছে, হোটেল বয়কে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর রেডি। দ্যাখতাছেন না, টেরম টেরম যুদ্ধ চলতাছে। কোথায় ইউক্রেন আর কোথায় কাওরান বাজার? এমন কথা বলতেই আমরা কি কমু এইডা সরকাররে জিগান। এতকিছু বুঝেন এইডা আফনেরা বুঝতাছেন না স্যার?
এক বন্ধু আরেক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে, কই এর আগে তো কোন যুদ্ধ লাগে নাই, তহন দাম বাড়লে কিসের জন্য? আর যুদ্ধের কারণে আমাদের এখানে এখনই দাম বাড়বে কেন? আমাদের এখানে সেখানকার কোন পণ্য তো এখনও আসেনি। এক বন্ধু ওয়েটারকে বললো, যুদ্ধটুদ্ধ কিছু না মিঞার, তোমরা ছুঁতো পেলেই দাম বাড়াও। সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবের ফর্দ দেখলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, সরকারি সংস্থা টিসিবি’র হিসাবে গত এক মাসের ব্যবধানে অন্তত ৩১টি পণ্যের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে শতভাগ পর্যন্ত দাম বেড়েছে এমন পণ্যও আছে। বাড়তি দামের কারণে নিম্নআয়ের সুবিধা দিতে সরকারি সংস্থা টিসিবি কম দামে পণ্য বিক্রি করছে। সীমিত পরিসরে এই কার্যক্রম চলায় অল্প সংখ্যক মানুষ এর সেবা পাচ্ছেন। কিন্তু এ নিয়েও চলছে মানুষের লড়াই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। তার ওপর ধাক্কধাক্কি তো আছেই। তাও শেষ পর্যন্ত ঠিক পণ্যটি মিলবে কিনা আগে থেকেই বলা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির হিসেবেই এক মাসের ব্যবধানে অন্তত ৩১টি পণ্যের দাম বেড়েছে সর্বনিম্ন ১ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পিয়াজের দাম। এক মাসের ব্যবধানে পণ্যটির দাম বেড়েছে মান ভেদে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। এছাড়া ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, ডাল, চিনিসহ বেড়েছে অন্তত ৩১টি পণ্যের দাম। তবে টিসিবির দর ও বাজারের বাস্তব চিত্রের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সংস্থাটি বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা বললেও, বাজারে এর দাম ১৮০ থেকে প্রায় ২০০ টাকায় ঠেকেছে।

 

লেখাটি শেষ করতে চাই কৌতুকাভিনেতা কাজলের একটি গানের প্রথম কটি কলি দিয়ে। তিনি বাজারের থলে হাতে নিয়ে বাজারে বাজারে ঘুরে গেয়ে চলেছেন, হাজার টাকায় বাজার করিয়া, বাজান গো পড়ে গেলাম মাথা ঘুরাইয়া, অল্প পয়সায় থলে ভরে নারে, ইবলিশ শয়তানে দিল দাম বাড়াইয়া…।  সূূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com