তারেক রহমান : দীর্ঘ সংগ্রামের অপ্রতিরোধ্য আলোকবর্তিকা

ছবি সংগৃহীত

 

আতিকুর রহমান রুমন :বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁরা দীর্ঘ নির্বাসনেও জনতার হৃদয়ে থেকেছেন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। তারেক রহমান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। শুধু রাজনৈতিক উত্তরাধিকারেই নয়, নিজের যোগ্যতা ও দৃঢ়তায় আজ দেশের আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জাতীয় মর্যাদা রক্ষা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় আশ্বাস।

 

দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসে থেকেও তিনি হার মানেননি রাজপথে না থেকেও রাজপথের প্রতিটি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়েছেন। তাঁর ডাকেই সংগঠিত হয়েছে লাখো কর্মী, জেগে উঠেছে ছাত্রসমাজ, তীব্র প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে স্বৈরাচারের ভিত।

অন্যদিকে, গত দেড় দশক বাংলাদেশ ছিল ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি ও বিদেশি স্বার্থরক্ষার এক দীর্ঘ অন্ধকারে নিমজ্জিত যেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতার লোভে জাতির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করেছেন। ঠিক এই অন্ধকারের মাঝেই তারেক রহমানের দৃঢ় বিশ্বাস, সুদূরদৃষ্টি ও অবিচল সংগ্রাম আজ জাতির জন্য হয়ে উঠেছে মুক্তির একমাত্র অপ্রতিরোধ্য আলোকবর্তিকা।

 

বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে, যখন দেশ নতুন পথের সন্ধানে, তখন জনমানসে একটি প্রত্যাশা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে তারেক রহমানের নেতৃত্বেই শুরু হবে স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাবান বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনকাল ছিল এক গভীর অন্ধকারের সময়, যেখানে জনগণের অধিকারকে নির্মমভাবে পিষে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতার স্টিমরোলারের নিচে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের বন্ধুত্ব।

 

বিনিময়ে ভারতকে দিয়েছেন এমন সব সুবিধা, যা দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সীমান্তে বারবার বাংলাদেশি নাগরিকদের রক্ত ঝরলেও, তিনি নীরব থেকেছেন; বরং নানা চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়েছেন ট্রানজিট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, জলসম্পদে প্রাধান্য, এমনকি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নীতিতেও দিল্লির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ।

 

এ দেশের কৃষক যখন তিস্তা নদীর পানির জন্য হাহাকার করেছে, তখনও শেখ হাসিনা ভারতের মন জোগানোর রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলেন। দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে তিনি শুধু অর্থনীতিকেই দুর্বল করেননি, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রতিটি স্তরে ভারতীয় প্রভাব এমনভাবে প্রবেশ করেছে, যেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয় বরং প্রতিবেশী পরাশক্তির একটি প্রভাবাধীন প্রদেশ।

 

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। তখন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখে মুখে শোনা যেত “ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কিংবা দুবাইয়ের মতো।”

 

কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সতর্ক বার্তাকে উপেক্ষা করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে। ধাপে ধাপে ভারত শুধু সড়ক নয়, রেল ট্রানজিটও আদায় করে নেয়। এর ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্য এখন বাংলাদেশের সড়ক, রেল এবং জলপথ ব্যবহার করে আখাউড়া-আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে পৌঁছাচ্ছে।

 

এখানেই শেষ নয় ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারেরও অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ সরাসরি বাংলাদেশের পূর্ব দিক হয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় এই ট্রানজিট দিয়ে কি বাংলাদেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে? সোজা উত্তর না, হয়নি।

 

ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে ১৬ বছরে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ৩৭ লাখ টাকা, অথচ কেবল ট্রানজিটের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয়েই খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, যে ট্রানজিটকে উন্নয়নের সোনার হরিণ বলা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল আর্থিক ক্ষতির বোঝা এবং জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের প্রতীক।

 

শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে এক বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। ক্ষমতার লোভে আঞ্চলিক শক্তির কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার উপেক্ষা করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য হবে দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের পথ।

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন ছিল এক প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ নারীর যাত্রা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর লন্ডনে প্রথম সফরেই বিবিসির খ্যাতিমান সাংবাদিক জন রেনারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন রাজনীতি তার ভালো লাগে না, কিন্তু পিতা, মাতা ও ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। সেই প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য, আর সেই সঙ্গে তিনি শুরু করেন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যেখানে দেশের স্বার্থ সর্বদা ছিল শেষ প্রাধান্যে, আর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ ছিল সবার ওপর। ভবিষ্যতে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তাহলে বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার পথও তিনি আগেই সুসংহত করে রাখেন। পরিবারের সদস্যদের বিদেশি নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা ছিল সেই দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। আর বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য দেশের সম্পদ লুটপাটে তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা সব সময়ই ছিল সক্রিয়।

 

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পাচার করেছে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা (দৈনিক সমকাল, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪)। শুধু গত পাঁচ বছরের পাচারের অঙ্কই জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। এই অর্থ দিয়ে ৮৭টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল।

 

২০০৯ সালে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের সময় সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ কোটি টাকায়। মাথাপিছু ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকা। এই ঋণের বড় অংশই এসেছে বিদেশি ও দেশি উৎস থেকে, যার বিশাল অংশ লুটপাট হয়েছে মেগা প্রকল্পের নামে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির চিত্র:

পদ্মা সেতু: উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, মাত্র ৬.১৫ কিমি দীর্ঘ পদ্মা সেতু নদীর ওপর নির্মিত, সিঙ্গেল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৬ দিন এবং খরচ ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। সেখানে রাশিয়ার ক্রিমিয়া সেতুর দৈর্ঘ ১৮.১ কিলোমিটার, উত্তাল ব্লাক সির ওপর নির্মিত, ডবল রেল লাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে মাত্র ৩ বছর এবং খরচ ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। এই চিত্রে পদ্মা সেতুতে কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়।

 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে শেখ হাসিনা একাই আত্মসাৎ করেছে ৫৯ হাজার কোটি টাকা। (ঢাকা পোস্ট, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।

 

কর্ণফুলী টানেল: প্রতিদিন গড়ে ২৭ লাখ টাকার লোকসান, যার পেছনে অপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত দায়ী। (ইত্তেফাক, ২৮ অক্টোবর ২০২৪)।

 

সড়ক ও অবকাঠামো খাত: বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তো বটেই, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণের ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। ফলে মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। (প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫)।

 

বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় ভারত ও চীনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতি ও দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব। ফ্লাইওভার নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি বাংলাদেশের ব্যয় বিশ্বের শীর্ষে বিগত ৩১ মে, ২০১৬ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, “বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ভয়াবহভাবে বেশি।

 

বাংলাদেশে কিলোমিটার প্রতি ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয়:

ঢাকা ফ্লাইওভার: ৩১৬ কোটি টাকা, মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভার: ১৩৫ কোটি টাকা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার: ১৮০ কোটি টাকা।

 

অন্যান্য দেশের তুলনা:

মুম্বাইয়ের ইস্টার্ন ফ্রি হাইওয়ে: ৮৮ কোটি টাকা, কলকাতার পরমা ফ্লাইওভার: ৪৮ কোটি টাকা, চীন ও মালয়েশিয়া : ৮০-৯০ কোটি টাকা।

 

এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পগুলো শুধু ব্যয়বহুলই নয়, বরং সীমাহীন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাটের একটি বড় উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ও জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনের গুরুতর অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা।

 

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী, শুধু ‘মুজিব শতবর্ষ’ উদযাপনকে ঘিরেই শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে অপচয় করা হয়েছে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল ও মূর্তি নির্মাণে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়, যা জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রচার ও ব্যক্তিপূজার উদ্দেশ্যে অপব্যবহৃত হয়েছে।

 

গত দেড় দশকে দেশের সর্বাধিক অর্থনৈতিক লুটপাটের কেন্দ্রে ছিল শেখ পরিবার। দেশের প্রতিটি কোণ থেকে জনগণের অর্থ সংগ্রহ ও ব্যক্তিগত স্বার্থে দখল করা হয়েছে। দেশের জনগণের টাকা লুটপাট করে শেখ পরিবার ও দলীয় নেতা-কর্মীরা বিদেশে পাচার করেছেন, অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ও গাড়ি অর্জন করেছেন। পাশাপাশি অনেকেই বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।

 

ব্যাংক খাত আওয়ামী সরকারের আমলে পরিণত হয় লুটপাটের কেন্দ্রবিন্দুতে। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স, খেলাপি ঋণ, হলমার্ক-বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিÑ সবখানেই দুর্নীতি। এছাড়া বিভিন্ন অফশোর অ্যাকাউন্ট, দ্বীপ ক্রয়, এবং বিদেশে সম্পত্তি কেনার মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়।

 

শেখ হাসিনা সরকারের মেগা দুর্নীতি ও অবাধ লুটপাট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। বাজারে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভ্যাট ও করের অতিরিক্ত চাপ এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছে যা আজও অব্যাহত।

 

দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পুরো সময়জুড়ে শেখ হাসিনা ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছেন, বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর চালিয়েছেন গুম, বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি দমনপীড়ন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন, সরকার ঘনিষ্ঠদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থপাচার, সচিবালয় থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ, ভারতের কাছে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি সবকিছু মিলিয়ে জনঅসন্তোষ তুঙ্গে পৌঁছায়।

 

শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতন ঘটায়নি; বরং এই আন্দোলনের সাফল্যের পেছনে ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া।

 

২০২৪-এর গণআন্দোলনের বিজয়ে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। টানা ১৬ বছর শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বিএনপি হয়তো এককভাবে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু রাজপথ সবসময় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত রেখেছিল। সেই প্রস্তুতিই ছাত্রসমাজ ও জনতাকে বিএনপির ছায়াতলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে দাঁড়াতে সাহস জুগিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছে।

 

ফ্যাসিস্ট সরকারের দীর্ঘ দুঃশাসনে সবচেয়ে ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং এর লাখ লাখ নেতা-কর্মী। হামলা-মামলা, খুন-গুমসহ কোনো অত্যাচারই বাদ যায়নি। তবুও বিএনপির নেতা-কর্মী, সাধারণ ছাত্র ও জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে এবং স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অন্যতম ভূমিকা পালন করেন।

 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও তীব্র প্রতিরোধের মুখে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশ স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি পায়। গত ১৬ বছরের শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে মানবাধিকার নামক শব্দটি যেন নির্বাসিত ছিল। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতিতে আসা বিএনপি এবং জিয়া পরিবারকে এই সময়ে দিতে হয়েছে অসীম ত্যাগ ও আত্মদান। বিশেষ করে জিয়া পরিবার ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ছিল সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিপীড়িত।

 

শেখ হাসিনার আমলে বিএনপির ১,৫৫১ নেতা-কর্মীকে বিচার-বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে, গুম হয়েছেন ৪২৩ জন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দেড় লাখেরও বেশি মামলা হয়েছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে, যেখানে আসামির তালিকায় ছিল প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। শুধু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রাণ হারান ৪২২ জন বিএনপি নেতা-কর্মী।

 

নিপীড়নের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে জিয়া পরিবারের ওপর। জনগণের ভোটে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সাজানো মামলায় ফরমায়েশি রায় দিয়ে বছরের পর বছর তাঁকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। নিষ্ঠুর এই নিপীড়নের বোঝা বইতে গিয়ে বেগম জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র মরহুম আরাফাত রহমান কোকো এক বুক অভিমান নিয়ে অকালেই ঝরে পড়েন। বড়ভাই তারেক রহমান ১৭ বছরেরও বেশি সময় প্রবাসে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেনপ্রিয় ছোট ভাইয়ের শেষ মুখটিও তিনি দেখতে পারেননি। গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন, যা তাঁকে জীবন-মৃত্যুর সীমানায় ঠেলে দিয়েছিল।

 

এক কথায়, শেখ হাসিনার শাসন জিয়া পরিবারের পারিবারিক জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং বিএনপিকে করেছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত রাজনৈতিক শক্তি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার ভারতে লজ্জাজনক পলায়নের পর, দেশের ক্ষমতাগ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এই অরাজনৈতিক ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকা সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় দৃঢ় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। অর্থনীতি পুনর্গঠন, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, মব ভায়োলেন্স দমন এবং মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে তাদের অদক্ষতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশব্যাপী বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের ধারণা, সফলতার তুলনায় ব্যর্থতার পাল্লাই প্রকৃষ্টভাবে ভারী।

 

২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার পেছনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য। আজ দেশের আপামর জনসাধারণ মনে করছেন দেশের এই ক্রান্তিকালে অভিজ্ঞ, দূরদর্শী ও ঝানু রাজনীতিবিদ জনাব তারেক রহমানের নেতৃত্বই বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।

 

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জন্মেছেন এক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারে। তাঁর পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা; আর মা বেগম খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন। জন্মসূত্রেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী এই নেতা শৈশব থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কৌশল প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি দেখেছেন কীভাবে দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান বিপর্যস্ত দেশকে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়েছেন।

 

১৯৮৯ সালে বগুড়ায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে তারেক রহমানের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয়। সেখান থেকে শুরু করে তিনি নিরলসভাবে দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে কাজ করে গেছেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেশব্যাপী প্রচারণায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আধুনিক ও কার্যকর প্রচার কৌশল প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখে আলোচনায় আসেন। সেদিনই প্রমাণ হয় তিনি বিএনপির জন্য এক অমিত সম্ভাবনাময় নেতা।

 

তবে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা সহজ ছিল না। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির জরুরি অবস্থার পর ৩ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের কয়েক মাস আগে, ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে তৎকালীন ওয়ান-ইলেভেন সরকার। কারাগারে তাঁকে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর জীবন শেষ করে দেওয়া। কিন্তু ভাগ্য ও কোটি মানুষের দোয়া তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। ৭ মার্চ ২০০৭ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত কারাভোগের পর ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান তারেক রহমান। নির্বাসনেও থেমে থাকেননি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অটল অবস্থান নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং জনতার স্বপ্নকে জীবিত রেখেছেন।

 

তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হলো শিষ্টাচার, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা। মহান নেতাদের এ গুণাবলিই ইতিহাসে তাঁদের অমরত্ব দিয়েছে; আর এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে একজন আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

 

আজ প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে রাজনীতির পঙ্কিল পথে নিজেকে অটল রেখে এগিয়ে চলেছেন তিনি। দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে যখন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও লড়াকু নেতৃত্বের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন বিএনপির নেতা হিসেবে তারেক রহমানই হচ্ছেন সেই আশার প্রতীক, যিনি দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন কথার রাজনীতি নয়, পরিবর্তন চায় আর সেই পরিবর্তন ঘটুক বিএনপির হাত ধরে এই প্রত্যাশাই জনমানসে প্রবল।

 

চলতি বছরে গত ৭ আগস্ট এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তাঁর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির জানান জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। তবে এটি শুধু একজন নেতার দেশে প্রত্যাবর্তন নয়; এটি বাংলাদেশের হারানো সম্ভাবনা ও মর্যাদার পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি। দেশজুড়ে এখন শুরু হয়েছে উত্তেজনার ক্ষণগণনা ২০ কোটি মানুষের আকাক্সক্ষা, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল বিএনপির বিজয় এবং তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাবে তার যোগ্য প্রধানমন্ত্রী।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আহবায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল।

সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» নরসিংদীর পলাশে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ পালিত

» ভ্যানচালকের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার

» সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক নতুন মামলায় গ্রেপ্তার

» চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ প্রকাশ : ইসি সচিব

» মাইটিভির চেয়ারম্যান নাসিরের ৭ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ

» রাষ্ট্রপতির ছবি সরানো নিয়ে যা জানালেন উপ-প্রেস সচিব

» রুক্মিণীর রাজকীয় লুক মন কাড়ল ভক্তদের

» ‘এশিয়া কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যেই যাবে বাংলাদেশ’

» আন্দোলনে ছাত্ররা শুধু নাটকের অভিনেতা, মূল ভ্যানগার্ড জামায়াত: ফজলুর রহমান

» ‘মেধা ও সততায় গড়ব সবার বাংলাদেশ’: ছাত্রশিবির সভাপতি

  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

তারেক রহমান : দীর্ঘ সংগ্রামের অপ্রতিরোধ্য আলোকবর্তিকা

ছবি সংগৃহীত

 

আতিকুর রহমান রুমন :বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁরা দীর্ঘ নির্বাসনেও জনতার হৃদয়ে থেকেছেন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে। তারেক রহমান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সন্তান। শুধু রাজনৈতিক উত্তরাধিকারেই নয়, নিজের যোগ্যতা ও দৃঢ়তায় আজ দেশের আপামর মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, জাতীয় মর্যাদা রক্ষা ও ভবিষ্যতের নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় আশ্বাস।

 

দীর্ঘ ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রবাসে থেকেও তিনি হার মানেননি রাজপথে না থেকেও রাজপথের প্রতিটি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়েছেন। তাঁর ডাকেই সংগঠিত হয়েছে লাখো কর্মী, জেগে উঠেছে ছাত্রসমাজ, তীব্র প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছে স্বৈরাচারের ভিত।

অন্যদিকে, গত দেড় দশক বাংলাদেশ ছিল ফ্যাসিবাদ, দুর্নীতি ও বিদেশি স্বার্থরক্ষার এক দীর্ঘ অন্ধকারে নিমজ্জিত যেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতার লোভে জাতির স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত করেছেন। ঠিক এই অন্ধকারের মাঝেই তারেক রহমানের দৃঢ় বিশ্বাস, সুদূরদৃষ্টি ও অবিচল সংগ্রাম আজ জাতির জন্য হয়ে উঠেছে মুক্তির একমাত্র অপ্রতিরোধ্য আলোকবর্তিকা।

 

বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে, যখন দেশ নতুন পথের সন্ধানে, তখন জনমানসে একটি প্রত্যাশা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে তারেক রহমানের নেতৃত্বেই শুরু হবে স্বাধীন, সমৃদ্ধ ও মর্যাদাবান বাংলাদেশের নতুন অধ্যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার প্রায় ১৬ বছরের শাসনকাল ছিল এক গভীর অন্ধকারের সময়, যেখানে জনগণের অধিকারকে নির্মমভাবে পিষে দেওয়া হয়েছিল ক্ষমতার স্টিমরোলারের নিচে। অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন আঞ্চলিক পরাশক্তি ভারতের বন্ধুত্ব।

 

বিনিময়ে ভারতকে দিয়েছেন এমন সব সুবিধা, যা দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সীমান্তে বারবার বাংলাদেশি নাগরিকদের রক্ত ঝরলেও, তিনি নীরব থেকেছেন; বরং নানা চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ভারতকে একতরফা সুবিধা দিয়েছেন ট্রানজিট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, জলসম্পদে প্রাধান্য, এমনকি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক নীতিতেও দিল্লির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ।

 

এ দেশের কৃষক যখন তিস্তা নদীর পানির জন্য হাহাকার করেছে, তখনও শেখ হাসিনা ভারতের মন জোগানোর রাজনীতিতে ব্যস্ত ছিলেন। দেশের শিল্প, বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে তিনি শুধু অর্থনীতিকেই দুর্বল করেননি, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রতিটি স্তরে ভারতীয় প্রভাব এমনভাবে প্রবেশ করেছে, যেন বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয় বরং প্রতিবেশী পরাশক্তির একটি প্রভাবাধীন প্রদেশ।

 

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পরপরই প্রতিবেশী দেশ ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। তখন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী ও আমলাদের মুখে মুখে শোনা যেত “ভারতকে ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক কিংবা দুবাইয়ের মতো।”

 

কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সতর্ক বার্তাকে উপেক্ষা করে ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে হাসিনা সরকার ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষর করে। ধাপে ধাপে ভারত শুধু সড়ক নয়, রেল ট্রানজিটও আদায় করে নেয়। এর ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য রাজ্যের পণ্য এখন বাংলাদেশের সড়ক, রেল এবং জলপথ ব্যবহার করে আখাউড়া-আশুগঞ্জ হয়ে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে পৌঁছাচ্ছে।

 

এখানেই শেষ নয় ভারতকে বাংলাদেশের চারটি নদীপথ ব্যবহারেরও অনুমতি দেওয়া হয়। এতে কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ সরাসরি বাংলাদেশের পূর্ব দিক হয়ে ভারতের আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায় এই ট্রানজিট দিয়ে কি বাংলাদেশ সত্যিই সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক বা দুবাইয়ের মতো সমৃদ্ধ হয়েছে? সোজা উত্তর না, হয়নি।

 

ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ার ফলে ১৬ বছরে বাংলাদেশ আয় করেছে মাত্র ৩৭ লাখ টাকা, অথচ কেবল ট্রানজিটের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয়েই খরচ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, যে ট্রানজিটকে উন্নয়নের সোনার হরিণ বলা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এক বিশাল আর্থিক ক্ষতির বোঝা এবং জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের প্রতীক।

 

শেখ হাসিনা যেভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষায় নিজ দেশের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে এক বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। ক্ষমতার লোভে আঞ্চলিক শক্তির কাছে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়া এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার উপেক্ষা করার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন, তা থেকে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য হবে দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের পথ।

 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনার আগমন ছিল এক প্রতিশোধের আগুনে দগ্ধ নারীর যাত্রা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর লন্ডনে প্রথম সফরেই বিবিসির খ্যাতিমান সাংবাদিক জন রেনারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন রাজনীতি তার ভালো লাগে না, কিন্তু পিতা, মাতা ও ভাইদের হত্যার প্রতিশোধ নিতেই তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। সেই প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা পরবর্তীতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই ছিল শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য, আর সেই সঙ্গে তিনি শুরু করেন দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যেখানে দেশের স্বার্থ সর্বদা ছিল শেষ প্রাধান্যে, আর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ ছিল সবার ওপর। ভবিষ্যতে যদি ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, তাহলে বিদেশে আশ্রয় নেওয়ার পথও তিনি আগেই সুসংহত করে রাখেন। পরিবারের সদস্যদের বিদেশি নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা ছিল সেই দূরদর্শী পরিকল্পনারই অংশ। আর বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য দেশের সম্পদ লুটপাটে তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা সব সময়ই ছিল সক্রিয়।

 

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে পাচার করেছে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা (দৈনিক সমকাল, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪)। শুধু গত পাঁচ বছরের পাচারের অঙ্কই জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। এই অর্থ দিয়ে ৮৭টি পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল।

 

২০০৯ সালে সরকারের ঋণ স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতনের সময় সেই ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ কোটি টাকায়। মাথাপিছু ঋণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকা। এই ঋণের বড় অংশই এসেছে বিদেশি ও দেশি উৎস থেকে, যার বিশাল অংশ লুটপাট হয়েছে মেগা প্রকল্পের নামে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির চিত্র:

পদ্মা সেতু: উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, মাত্র ৬.১৫ কিমি দীর্ঘ পদ্মা সেতু নদীর ওপর নির্মিত, সিঙ্গেল রেললাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে ৭ বছর ৬ মাস ২৬ দিন এবং খরচ ৩.৬ বিলিয়ন ডলার। সেখানে রাশিয়ার ক্রিমিয়া সেতুর দৈর্ঘ ১৮.১ কিলোমিটার, উত্তাল ব্লাক সির ওপর নির্মিত, ডবল রেল লাইন, তৈরিতে সময় লেগেছে মাত্র ৩ বছর এবং খরচ ৩.৭ বিলিয়ন ডলার। এই চিত্রে পদ্মা সেতুতে কি পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়।

 

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: গ্লোবাল ডিফেন্স কর্পের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে শেখ হাসিনা একাই আত্মসাৎ করেছে ৫৯ হাজার কোটি টাকা। (ঢাকা পোস্ট, ১৮ আগস্ট ২০২৪)।

 

কর্ণফুলী টানেল: প্রতিদিন গড়ে ২৭ লাখ টাকার লোকসান, যার পেছনে অপরিকল্পিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত দায়ী। (ইত্তেফাক, ২৮ অক্টোবর ২০২৪)।

 

সড়ক ও অবকাঠামো খাত: বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত তো বটেই, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায়ও বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণের ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। ফলে মহাসড়ক নির্মাণ ব্যয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। (প্রথম আলো, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫)।

 

বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় ভারত ও চীনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি প্রধান কারণ ছিল দুর্নীতি ও দরপত্রে প্রতিযোগিতার অভাব। ফ্লাইওভার নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি বাংলাদেশের ব্যয় বিশ্বের শীর্ষে বিগত ৩১ মে, ২০১৬ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, “বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয় আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ভয়াবহভাবে বেশি।

 

বাংলাদেশে কিলোমিটার প্রতি ফ্লাইওভার নির্মাণ ব্যয়:

ঢাকা ফ্লাইওভার: ৩১৬ কোটি টাকা, মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভার: ১৩৫ কোটি টাকা, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার: ১৮০ কোটি টাকা।

 

অন্যান্য দেশের তুলনা:

মুম্বাইয়ের ইস্টার্ন ফ্রি হাইওয়ে: ৮৮ কোটি টাকা, কলকাতার পরমা ফ্লাইওভার: ৪৮ কোটি টাকা, চীন ও মালয়েশিয়া : ৮০-৯০ কোটি টাকা।

 

এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পগুলো শুধু ব্যয়বহুলই নয়, বরং সীমাহীন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারি অর্থ লোপাটের একটি বড় উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ও জাতীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনের গুরুতর অভিযোগে বারবার অভিযুক্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা।

 

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী, শুধু ‘মুজিব শতবর্ষ’ উদযাপনকে ঘিরেই শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল নির্মাণে অপচয় করা হয়েছে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা। সারা দেশে ১০ হাজারেরও বেশি ম্যুরাল ও মূর্তি নির্মাণে এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়, যা জনকল্যাণমূলক খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রচার ও ব্যক্তিপূজার উদ্দেশ্যে অপব্যবহৃত হয়েছে।

 

গত দেড় দশকে দেশের সর্বাধিক অর্থনৈতিক লুটপাটের কেন্দ্রে ছিল শেখ পরিবার। দেশের প্রতিটি কোণ থেকে জনগণের অর্থ সংগ্রহ ও ব্যক্তিগত স্বার্থে দখল করা হয়েছে। দেশের জনগণের টাকা লুটপাট করে শেখ পরিবার ও দলীয় নেতা-কর্মীরা বিদেশে পাচার করেছেন, অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি ও গাড়ি অর্জন করেছেন। পাশাপাশি অনেকেই বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।

 

ব্যাংক খাত আওয়ামী সরকারের আমলে পরিণত হয় লুটপাটের কেন্দ্রবিন্দুতে। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স, খেলাপি ঋণ, হলমার্ক-বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিÑ সবখানেই দুর্নীতি। এছাড়া বিভিন্ন অফশোর অ্যাকাউন্ট, দ্বীপ ক্রয়, এবং বিদেশে সম্পত্তি কেনার মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়।

 

শেখ হাসিনা সরকারের মেগা দুর্নীতি ও অবাধ লুটপাট বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে। বাজারে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভ্যাট ও করের অতিরিক্ত চাপ এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তুলেছে যা আজও অব্যাহত।

 

দীর্ঘ স্বৈরশাসনের পুরো সময়জুড়ে শেখ হাসিনা ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছেন, বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর চালিয়েছেন গুম, বিচার-বহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি দমনপীড়ন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন, সরকার ঘনিষ্ঠদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থপাচার, সচিবালয় থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ, ভারতের কাছে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি সবকিছু মিলিয়ে জনঅসন্তোষ তুঙ্গে পৌঁছায়।

 

শুধুমাত্র সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতন ঘটায়নি; বরং এই আন্দোলনের সাফল্যের পেছনে ছিল মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া।

 

২০২৪-এর গণআন্দোলনের বিজয়ে বিএনপির অবদান অনস্বীকার্য। টানা ১৬ বছর শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বিএনপি হয়তো এককভাবে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, কিন্তু রাজপথ সবসময় আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত রেখেছিল। সেই প্রস্তুতিই ছাত্রসমাজ ও জনতাকে বিএনপির ছায়াতলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে দাঁড়াতে সাহস জুগিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয় নিশ্চিত করেছে।

 

ফ্যাসিস্ট সরকারের দীর্ঘ দুঃশাসনে সবচেয়ে ভয়াবহ নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং এর লাখ লাখ নেতা-কর্মী। হামলা-মামলা, খুন-গুমসহ কোনো অত্যাচারই বাদ যায়নি। তবুও বিএনপির নেতা-কর্মী, সাধারণ ছাত্র ও জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে এবং স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অন্যতম ভূমিকা পালন করেন।

 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও তীব্র প্রতিরোধের মুখে ভারতে পালিয়ে যান স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং বাংলাদেশ স্বৈরশাসনের কবল থেকে মুক্তি পায়। গত ১৬ বছরের শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে মানবাধিকার নামক শব্দটি যেন নির্বাসিত ছিল। জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতিতে আসা বিএনপি এবং জিয়া পরিবারকে এই সময়ে দিতে হয়েছে অসীম ত্যাগ ও আত্মদান। বিশেষ করে জিয়া পরিবার ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি ছিল সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিপীড়িত।

 

শেখ হাসিনার আমলে বিএনপির ১,৫৫১ নেতা-কর্মীকে বিচার-বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে, গুম হয়েছেন ৪২৩ জন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দেড় লাখেরও বেশি মামলা হয়েছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে, যেখানে আসামির তালিকায় ছিল প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। শুধু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রাণ হারান ৪২২ জন বিএনপি নেতা-কর্মী।

 

নিপীড়নের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে জিয়া পরিবারের ওপর। জনগণের ভোটে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে স্বামীর স্মৃতিবিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সাজানো মামলায় ফরমায়েশি রায় দিয়ে বছরের পর বছর তাঁকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। নিষ্ঠুর এই নিপীড়নের বোঝা বইতে গিয়ে বেগম জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র মরহুম আরাফাত রহমান কোকো এক বুক অভিমান নিয়ে অকালেই ঝরে পড়েন। বড়ভাই তারেক রহমান ১৭ বছরেরও বেশি সময় প্রবাসে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেনপ্রিয় ছোট ভাইয়ের শেষ মুখটিও তিনি দেখতে পারেননি। গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন, যা তাঁকে জীবন-মৃত্যুর সীমানায় ঠেলে দিয়েছিল।

 

এক কথায়, শেখ হাসিনার শাসন জিয়া পরিবারের পারিবারিক জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে এবং বিএনপিকে করেছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত রাজনৈতিক শক্তি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার ভারতে লজ্জাজনক পলায়নের পর, দেশের ক্ষমতাগ্রহণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এক বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এই অরাজনৈতিক ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকা সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় দৃঢ় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। অর্থনীতি পুনর্গঠন, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, মব ভায়োলেন্স দমন এবং মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের ক্ষেত্রে তাদের অদক্ষতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশব্যাপী বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের ধারণা, সফলতার তুলনায় ব্যর্থতার পাল্লাই প্রকৃষ্টভাবে ভারী।

 

২৪-এর গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার পেছনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনস্বীকার্য। আজ দেশের আপামর জনসাধারণ মনে করছেন দেশের এই ক্রান্তিকালে অভিজ্ঞ, দূরদর্শী ও ঝানু রাজনীতিবিদ জনাব তারেক রহমানের নেতৃত্বই বাংলাদেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে।

 

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জন্মেছেন এক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারে। তাঁর পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা; আর মা বেগম খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন। জন্মসূত্রেই বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী এই নেতা শৈশব থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কৌশল প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি দেখেছেন কীভাবে দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান বিপর্যস্ত দেশকে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়েছেন।

 

১৯৮৯ সালে বগুড়ায় দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে তারেক রহমানের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক পথচলা শুরু হয়। সেখান থেকে শুরু করে তিনি নিরলসভাবে দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে কাজ করে গেছেন। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে দেশব্যাপী প্রচারণায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে আধুনিক ও কার্যকর প্রচার কৌশল প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখে আলোচনায় আসেন। সেদিনই প্রমাণ হয় তিনি বিএনপির জন্য এক অমিত সম্ভাবনাময় নেতা।

 

তবে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা সহজ ছিল না। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির জরুরি অবস্থার পর ৩ সেপ্টেম্বর বেগম খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের কয়েক মাস আগে, ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে তৎকালীন ওয়ান-ইলেভেন সরকার। কারাগারে তাঁকে অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর জীবন শেষ করে দেওয়া। কিন্তু ভাগ্য ও কোটি মানুষের দোয়া তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। ৭ মার্চ ২০০৭ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৮ পর্যন্ত কারাভোগের পর ১১ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্য যান তারেক রহমান। নির্বাসনেও থেমে থাকেননি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অটল অবস্থান নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছেন এবং জনতার স্বপ্নকে জীবিত রেখেছেন।

 

তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম ভিত্তি হলো শিষ্টাচার, প্রতিপক্ষের প্রতি সম্মান এবং ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা। মহান নেতাদের এ গুণাবলিই ইতিহাসে তাঁদের অমরত্ব দিয়েছে; আর এই বৈশিষ্ট্যই তাঁকে একজন আদর্শবান রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

 

আজ প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে রাজনীতির পঙ্কিল পথে নিজেকে অটল রেখে এগিয়ে চলেছেন তিনি। দেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে যখন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও লড়াকু নেতৃত্বের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন বিএনপির নেতা হিসেবে তারেক রহমানই হচ্ছেন সেই আশার প্রতীক, যিনি দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষ এখন কথার রাজনীতি নয়, পরিবর্তন চায় আর সেই পরিবর্তন ঘটুক বিএনপির হাত ধরে এই প্রত্যাশাই জনমানসে প্রবল।

 

চলতি বছরে গত ৭ আগস্ট এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তাঁর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির জানান জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। তবে এটি শুধু একজন নেতার দেশে প্রত্যাবর্তন নয়; এটি বাংলাদেশের হারানো সম্ভাবনা ও মর্যাদার পুনর্জন্মের প্রতিশ্রুতি। দেশজুড়ে এখন শুরু হয়েছে উত্তেজনার ক্ষণগণনা ২০ কোটি মানুষের আকাক্সক্ষা, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল বিএনপির বিজয় এবং তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাবে তার যোগ্য প্রধানমন্ত্রী।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আহবায়ক, আমরা বিএনপি পরিবার ও সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল।

সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Design & Developed BY ThemesBazar.Com