দেশের ৯৪ শতাংশ সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কার বা বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে। একই সঙ্গে উঠে এসেছে, সাংবাদিক নির্যাতন কিংবা হয়রানির ৩০ শতাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা যুক্ত রয়েছেন।
গণমাধ্যম উন্নয়ন সংগঠন ‘সমষ্টি’র ‘সাংবাদিকতা ও নীতি-কাঠামো: প্রবণতা ও সুপারিশ’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক অনুষ্ঠানে এ গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল তুলে ধরেন সমষ্টি’র পরিচালক (গবেষণা) রেজাউল হক। তিনি বলেন, গবেষণার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ছিল দলীয় আলোচনা, মতামত জরিপ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ।
গবেষণা ফলাফলে বলা হয়, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’ এর বিভিন্ন অস্পষ্টতা দূর করে আইনটিকে অধিক গ্রহণযোগ্য করার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে? এর জবাবে ৯৪ শতাংশ সাংবাদিক আইনটি সংস্কার বা বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন। এ প্রশ্নের উত্তরে ৬৫ শতাংশ মনে করেন, আইনটিকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তথ্য ও মতামত প্রকাশ এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য নেতিবাচক উপাদানগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনমাফিক সংস্কার করা প্রয়োজন, ২৯ শতাংশ সাংবাদিক আইনটি সম্পূর্ণ বাতিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন। বাকিরা এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।
দলীয় আলোচনায় উত্থাপিত নির্বাচিত আরও কয়েকটি আইন সম্পর্কে সাংবাদিকদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। কোন কোন আইন বা বিধি-বিধানকে আপনি সাংবাদিকতার জন্য সহায়ক মনে করেন বা সাংবাদিকতার জন্য বাধা হিসেবে বিবেচনা করেন? দেখা যায়, ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকতার জন্য সহায়ক নয়।
উত্তরদাতা ৪৬১ জন সাংবাদিকের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মনে করেন পেশাদার ও স্বাধীন সাংবাদিকতা চর্চার জন্য একজন সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতা বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সংগঠন স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধা বা চাপ সৃষ্টি করে কি না? এ প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৮০ শতাংশ, ‘না’ বলেছেন ১০ শতাংশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ স্থানীয় প্রশাসন স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কোনো চাপ বা বাধা সৃষ্টি করে কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৬১ শতাংশ, ‘না’ উত্তর দিয়েছেন ২৩ শতাংশ। প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধা সৃষ্টি করে কি-না এর উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলেছেন ৭৯ শতাংশ, ‘না’ উত্তর এসেছে ১১ শতাংশের কাছ থেকে।
তিনটি প্রশ্নে উত্তরদানে বাকিরা বিরত ছিলেন।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গবেষণার সময়সীমার মধ্যে ৪৪টি ঘটনায় ৬৭ জন সাংবাদিক আক্রমণ, মামলা, হয়রানি, হুমকি, নাজেহাল ইত্যাদির শিকার হয়েছেন। মোট ২৭টি জেলার পাঁচটি সিটি করপোরেশন ও ৩১টি উপজেলায় এসব ঘটনা সংঘটিত হয়।
ঘটনাগুলোর মধ্যে শারীরিক আক্রমণ ও নির্যাতন ৪৩ শতাংশ, মামলা ৩৬ শতাংশ (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়া), হুমকি ১৪ শতাংশ ও হয়রানি ৫ শতাংশ। একটি ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহের সময় একজন সাংবাদিক নিহত হন (২ শতাংশ)।
ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩০ শতাংশের ক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা যুক্ত ছিলেন। ২৫ শতাংশের ঘটনায় অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষ, যেমন- শিক্ষক, ঠিকাদার, প্রভাবশালী ইত্যাদির সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়। ১১ শতাংশ ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তা, ১১ শতাংশ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ৭ শতাংশ ঘটনায় আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা যুক্ত ছিলেন। প্রকাশিত সংবাদ থেকে ১১টি ঘটনায় (১৬ শতাংশ) সংশ্লিষ্টদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সাংবাদিকতা, তথ্য ও মতামত প্রকাশকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কীভাবে প্রভাবিত করছে তা দেখার জন্য এ আইনের প্রয়োগ সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহের জন্য ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংবাদপত্র ও অনলাইন পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে অন্তত ২৫০টি মামলার সংবাদ সংগ্রহ করা হয়।
সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ঢাকা বিভাগে, ৮২টি। এছাড়া চট্টগ্রামে ৫২, খুলনায় ২৮, সিলেটে ২৫, বরিশালে ২০ এবং রাজশাহীতে ১৫টি মামলা হয়। সবচেয়ে কম ১১টি মামলা হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে।
গবেষণার ফলাফলে সাংবাদিকদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য অনুযায়ী নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাসহ মোট ১৩টি সুপারিশ করা হয়েছে।
সিনিয়র সাংবাদিক মজুরুল আহসান বুলবুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফলের ওপর আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মফিজুর রহমান, নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান।
এছাড়া সমষ্টির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মীর মাসরুর জামান রনি বক্তব্য রাখেন।