জীবিকার যুদ্ধই এখন মুখ্য

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: কভিড-১৯ মহামারির দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তা শেষ হয়নি। এখনো প্রতিদিন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সংক্রমণ অবশ্য অনেকটাই কমে এসেছে। ভ্যাকসিনের আওতা ও ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম বেশ জোরালো হয়েছে। তবে মানুষের আয় যে হারে কমেছে তাতে মানুষ প্রচণ্ড রকমের আর্থিক সংকটে পড়েছে। নতুন বাস্তবতা হলো কভিডের শুরুতে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে। এরপর ধার-কর্জ বা ঋণ করেছে। এখন আর সে রাস্তাও নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই খরচ বাড়িয়েছে। বাড়তি খরচ সামলাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। যার ফলে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এজন্য মানুষ এখন কভিডের আতঙ্ক আমলে নিচ্ছে না। বরং জীবিকার যুদ্ধকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

 

এদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন করতে পারি না। আর এসব ক্ষেত্রে জবাবদিহির প্রকট অভাব বিরাজ করছে দীর্ঘদিন থেকেই। এর পরও কভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকটাই দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে। এর কারণ হলো মানুষ জীবন ও জীবিকার বিতর্কে জীবিকাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। একইভাবে দেশের কৃষি খাত কিন্তু একদিনও থেমে থাকেনি। মানুষ নিজের প্রয়োজনে ছুটে বেরিয়েছে। যদিও এখানে সামষ্টিক অর্থনীতি বড় একটা ধাক্কা সামাল দিতে পেরেছে কিন্তু পারিবারিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনো নাজুক পর্যায়ে রয়েছে।

 

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা বেশ জরুরি মনে করি, তা হলো আমরা আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছি। এ অবস্থায় এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দূরই এগিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির বিকাশ সাধনে কয়েকটি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেসব নিয়েই সম্প্রতি আমরা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে অ্যা লুক অ্যাট বাংলাদেশ’স ৫০ ইয়ার্স জার্নি : টার্নিং পয়েন্টস অব দি ইকোনমি’ শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজন করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা দেখেছি আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে কৃষি খাত, বেসরকারি খাত, রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু আমরা এও দেখেছি- অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনাগুলো কীভাবে উল্টোপথে যাচ্ছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুব বেশি এগোতে পারিনি। সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতি এখনো আমাদের বড় বাধা। এখানে আমরা বিশেষত কৃষি ও বেসরকারি খাত- এ দুটি বিষয় দেখব। অর্থনীতির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারলে আমরা আজ আরও অনেক দূর এগোতে পারতাম এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা আমরা করতে পারিনি। এখানে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো, নিজ নিজ অবস্থানে নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করা। আমরা যদি প্রত্যেকেই নিজের কাজটাকে ভালোবেসে দায়িত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে দেখতাম তাহলে আমাদের যে আফসোসগুলো রয়েছে তার সংখ্যা অনেক কম হতো। আর এ দায়িত্ববোধটা বুঝতে না পারার কারণে করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা অনেক অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছি। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী ওই সময়ের পরিস্থিতিকে আরও ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারতাম। কিন্তু সে সময় আমাদের কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ ছিল না।

 

এরই মধ্যে আমাদের জাতীয় আয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার অতিক্রম করেছে। আবার আয় বৈষম্যটাও বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। একটা বিষয় বলতেই হয়, আমাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সরকার দক্ষতা দেখাতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি, সরকার এক ধরনের হাল ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সামাল দিয়েছে সেখানে দুটো ভাগ আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সুযোগগুলো মোটামুটি সামাল দেওয়া গেছে। যেমন তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসী আয় এগুলো কিছুটা হলেও উঠে এসেছে। সরকারের সেই অর্থে কৃষি উৎপাদনও বড় ধরনের ব্যাহত হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি সামাল দেওয়া গেছে। তবে পারিবারিক অর্থনীতি আমরা যেটাকে মাইক্রো বলি সেখানে বহুমুখী সংকটগুলো ব্যাপক আকারে চলমান আছে। বাংলাদেশে যে ৫৫ শতাংশ জিডিপি সেবা খাত থেকে আসে সে খাত কিন্তু করোনায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল। সে জায়গা এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক দিয়ে সার্বিক অর্থনীতির অবস্থাটা আমরা বুঝতে পারব না। এ ছাড়া মানুষের আয় তো কমেছেই। একই সঙ্গে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। জিডিপি যে হারে বেড়েছে সে হারে কর্মসংস্থান হয়নি।

 

দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববাসী এ মহামারি থেকে মুক্তি পায়নি। এরই মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ চললেও মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েই গেছে। এর চেয়ে বেশি সংকট এখন জীবিকা। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা কোথায় আছি? আরেকটা হচ্ছে কভিড না থাকলে আমরা যেভাবে এগোচ্ছিলাম সে অনুপাতে আমরা এখন কোথায় থাকতাম। এখানে প্রথমে বলি, কভিড তো আমাদের একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে। দেশের ভিতরে এবং বিশ্ব অর্থনীতিও অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে। এখানে প্রাথমিক একটা ভয় ছিল কিন্তু এই যে জীবন আর জীবিকা, এ বিতর্কে বাংলাদেশ খুব দ্রুতই জীবিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটা হচ্ছে এক ধরনের প্রয়োজনের তাগিদে রাস্তায় নেমে পড়া। আর অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে আমরা খুব দ্রুতই মাঠে নেমে গিয়েছিলাম। এখানে দুই বছরের ব্যবধানে আমাদের অর্থনীতির কি হলো তার উত্তর খুঁজতে হবে দুই ভাবে। এক. সামষ্টিক অর্থনীতি। অন্যটি পারিবারিক অর্থনীতি। এর ফলে যা হলো তা হচ্ছে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিটা যে ধাক্কা খেয়েছিল তা সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু পারিবারিক অর্থনীতিটা এখনো বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেক মানুষ বেকার হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন করে কেউ কাজ পাচ্ছে না। তবে আমাদের রপ্তানি বা রেমিট্যান্স, কৃষিসহ অভ্যন্তরীণ খাতগুলো আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আমাদের যে সেবা খাত তা কিন্তু এখনো বিপর্যস্ত। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও থেমে গেছে। কিন্তু এখানে আমাদের সার্বিকভাবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ কম। কেননা অনেক খাতই এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। ফলে এখানে উপখাত ধরেই বক্তব্য দিতে বা মূল্যায়ন করতে হবে। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের জায়গাটায় এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও বিশ্বপরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকায় সরবরাহ, বণ্টন ও মূল্য প্রক্রিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।

 

করোনার ধাক্কা দেশের অর্থনীতিতে কয়েকটা ধাপে পড়েছে। একটা হলো যে বিশ্ব অর্থনীতির যে মন্দা এসেছে তার সূত্র ধরে বাংলাদেশে যে রপ্তানিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল তারা ধাক্কা খেয়েছে। তার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতসহ কিছু অংশ ফিরে এসেছে। তার পরও অনেক খাত আছে আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি যেমন সাতক্ষীরা-খুলনার কাঁকড়া রপ্তানি যারা করত তারা কিন্তু উঠে আসতে পারেনি। আরেকটা হলো লকডাউনে তাৎক্ষণিক একটা ধাক্কা এসেছে, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়া হলেও মানুষের সাধারণ অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো এখনো ফিরে আসেনি। যেমন হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এখনো পুরোদমে চালু হয়নি। শিক্ষা কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এর সঙ্গে বড় একটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তা এখনো পরিপূর্ণভাবে চালু হয়নি। জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ৫৫ শতাংশ। অথচ যাদের পকেটে টাকা আছে তারা এখনো কিন্তু খরচ করছে না বা করতে পারছে না। এক কথায় বলা যায় চাহিদার একটা সংকট রয়েছে। করোনার নানামুখী অভিঘাত এখনো চলমান। অভিঘাত মোকাবিলায় সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা দিতে উদ্যোগী হয়েছে।

 

আবার করোনার প্রভাব কাটার আগেই নতুন এক চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তা হলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ। এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু অর্থনীতির উন্নয়নই কিন্তু সব নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানবসম্পদ এসব বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে। এখন তো মানবসম্পদ উন্নয়নটা সবচেয়ে দুশ্চিন্তার জায়গা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেননা করোনার কারণে অন্য খাতগুলো ঘুরে দাঁড়ালেও শিক্ষা খাতকে আগের অবস্থায় নেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রক্রিয়া। ফলে সামনের দিনগুলোয় এ শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর মানবসম্পদ উন্নয়নটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর বাইরে যেসব বিষয় রয়েছে যেমন রপ্তানি, রেমিট্যান্স মানুষের গড় আয় এসবে তো কিছুটা হলেও অগ্রগতি রয়েছে। আর করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারিনি। এখানে সমন্বিতভাবে কী করা যায় বা কী করা যেত সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ফলে করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত মানবসম্পদ ব্যবস্থাকে আবার কীভাবে আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে তা এখনো অনিশ্চিত। আবার এখানে নতুন প্রবৃদ্ধির চালক খুঁজতে গেলে শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে তা ধরা যাবে না। এখানে দক্ষ শ্রমিক দরকার। যার ফলে শিক্ষার মানটাকে উন্নত করতে হবে। স্কুলে ঢোকা মানেই কিন্তু শিক্ষিত হওয়া নয়। স্কুলে যাচ্ছি কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছি কি না, স্কিলড হচ্ছি কি না তা একটা নতুন প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগামীর জন্য কিন্তু এগুলো বেশ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

জীবিকার যুদ্ধই এখন মুখ্য

ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: কভিড-১৯ মহামারির দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তা শেষ হয়নি। এখনো প্রতিদিন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সংক্রমণ অবশ্য অনেকটাই কমে এসেছে। ভ্যাকসিনের আওতা ও ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম বেশ জোরালো হয়েছে। তবে মানুষের আয় যে হারে কমেছে তাতে মানুষ প্রচণ্ড রকমের আর্থিক সংকটে পড়েছে। নতুন বাস্তবতা হলো কভিডের শুরুতে মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে। এরপর ধার-কর্জ বা ঋণ করেছে। এখন আর সে রাস্তাও নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই খরচ বাড়িয়েছে। বাড়তি খরচ সামলাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। যার ফলে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এজন্য মানুষ এখন কভিডের আতঙ্ক আমলে নিচ্ছে না। বরং জীবিকার যুদ্ধকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।

 

এদিকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন করতে পারি না। আর এসব ক্ষেত্রে জবাবদিহির প্রকট অভাব বিরাজ করছে দীর্ঘদিন থেকেই। এর পরও কভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অনেকটাই দ্রুত করা সম্ভব হয়েছে। এর কারণ হলো মানুষ জীবন ও জীবিকার বিতর্কে জীবিকাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। একইভাবে দেশের কৃষি খাত কিন্তু একদিনও থেমে থাকেনি। মানুষ নিজের প্রয়োজনে ছুটে বেরিয়েছে। যদিও এখানে সামষ্টিক অর্থনীতি বড় একটা ধাক্কা সামাল দিতে পেরেছে কিন্তু পারিবারিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখনো নাজুক পর্যায়ে রয়েছে।

 

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা বেশ জরুরি মনে করি, তা হলো আমরা আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করেছি। এ অবস্থায় এসে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক দূরই এগিয়েছে। আমাদের অর্থনীতির বিকাশ সাধনে কয়েকটি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেসব নিয়েই সম্প্রতি আমরা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে অ্যা লুক অ্যাট বাংলাদেশ’স ৫০ ইয়ার্স জার্নি : টার্নিং পয়েন্টস অব দি ইকোনমি’ শীর্ষক একটি ওয়েবিনার আয়োজন করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা দেখেছি আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে কৃষি খাত, বেসরকারি খাত, রেমিট্যান্স, ক্ষুদ্রঋণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু আমরা এও দেখেছি- অনেক ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনাগুলো কীভাবে উল্টোপথে যাচ্ছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্পন্ন শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খুব বেশি এগোতে পারিনি। সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতি এখনো আমাদের বড় বাধা। এখানে আমরা বিশেষত কৃষি ও বেসরকারি খাত- এ দুটি বিষয় দেখব। অর্থনীতির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারলে আমরা আজ আরও অনেক দূর এগোতে পারতাম এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তা আমরা করতে পারিনি। এখানে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো, নিজ নিজ অবস্থানে নিজের দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করা। আমরা যদি প্রত্যেকেই নিজের কাজটাকে ভালোবেসে দায়িত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে দেখতাম তাহলে আমাদের যে আফসোসগুলো রয়েছে তার সংখ্যা অনেক কম হতো। আর এ দায়িত্ববোধটা বুঝতে না পারার কারণে করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা অনেক অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছি। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী ওই সময়ের পরিস্থিতিকে আরও ভালোভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারতাম। কিন্তু সে সময় আমাদের কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ ছিল না।

 

এরই মধ্যে আমাদের জাতীয় আয় বেড়েছে। মাথাপিছু আয় আড়াই হাজার ডলার অতিক্রম করেছে। আবার আয় বৈষম্যটাও বেড়েছে লক্ষণীয়ভাবে। একটা বিষয় বলতেই হয়, আমাদের স্বাস্থ্যের বিষয়ে সরকার দক্ষতা দেখাতে পারেনি। সত্যি কথা বলতে কি, সরকার এক ধরনের হাল ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সামাল দিয়েছে সেখানে দুটো ভাগ আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির সুযোগগুলো মোটামুটি সামাল দেওয়া গেছে। যেমন তৈরি পোশাক খাত, প্রবাসী আয় এগুলো কিছুটা হলেও উঠে এসেছে। সরকারের সেই অর্থে কৃষি উৎপাদনও বড় ধরনের ব্যাহত হয়নি। সামষ্টিক অর্থনীতি মোটামুটি সামাল দেওয়া গেছে। তবে পারিবারিক অর্থনীতি আমরা যেটাকে মাইক্রো বলি সেখানে বহুমুখী সংকটগুলো ব্যাপক আকারে চলমান আছে। বাংলাদেশে যে ৫৫ শতাংশ জিডিপি সেবা খাত থেকে আসে সে খাত কিন্তু করোনায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিল। সে জায়গা এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। সুতরাং সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক দিয়ে সার্বিক অর্থনীতির অবস্থাটা আমরা বুঝতে পারব না। এ ছাড়া মানুষের আয় তো কমেছেই। একই সঙ্গে কর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। জিডিপি যে হারে বেড়েছে সে হারে কর্মসংস্থান হয়নি।

 

দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববাসী এ মহামারি থেকে মুক্তি পায়নি। এরই মধ্যে ভ্যাকসিন প্রয়োগ চললেও মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েই গেছে। এর চেয়ে বেশি সংকট এখন জীবিকা। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা কোথায় আছি? আরেকটা হচ্ছে কভিড না থাকলে আমরা যেভাবে এগোচ্ছিলাম সে অনুপাতে আমরা এখন কোথায় থাকতাম। এখানে প্রথমে বলি, কভিড তো আমাদের একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে। দেশের ভিতরে এবং বিশ্ব অর্থনীতিও অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে। এখানে প্রাথমিক একটা ভয় ছিল কিন্তু এই যে জীবন আর জীবিকা, এ বিতর্কে বাংলাদেশ খুব দ্রুতই জীবিকার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটা হচ্ছে এক ধরনের প্রয়োজনের তাগিদে রাস্তায় নেমে পড়া। আর অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে আমরা খুব দ্রুতই মাঠে নেমে গিয়েছিলাম। এখানে দুই বছরের ব্যবধানে আমাদের অর্থনীতির কি হলো তার উত্তর খুঁজতে হবে দুই ভাবে। এক. সামষ্টিক অর্থনীতি। অন্যটি পারিবারিক অর্থনীতি। এর ফলে যা হলো তা হচ্ছে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিটা যে ধাক্কা খেয়েছিল তা সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু পারিবারিক অর্থনীতিটা এখনো বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেক মানুষ বেকার হয়ে গেছে। বেশির ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। নতুন করে কেউ কাজ পাচ্ছে না। তবে আমাদের রপ্তানি বা রেমিট্যান্স, কৃষিসহ অভ্যন্তরীণ খাতগুলো আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে আমাদের যে সেবা খাত তা কিন্তু এখনো বিপর্যস্ত। দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিও থেমে গেছে। কিন্তু এখানে আমাদের সার্বিকভাবে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ কম। কেননা অনেক খাতই এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। ফলে এখানে উপখাত ধরেই বক্তব্য দিতে বা মূল্যায়ন করতে হবে। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের জায়গাটায় এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। উৎপাদন প্রক্রিয়া মোটামুটি স্বাভাবিক হলেও বিশ্বপরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকায় সরবরাহ, বণ্টন ও মূল্য প্রক্রিয়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।

 

করোনার ধাক্কা দেশের অর্থনীতিতে কয়েকটা ধাপে পড়েছে। একটা হলো যে বিশ্ব অর্থনীতির যে মন্দা এসেছে তার সূত্র ধরে বাংলাদেশে যে রপ্তানিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল তারা ধাক্কা খেয়েছে। তার মধ্যে তৈরি পোশাক খাতসহ কিছু অংশ ফিরে এসেছে। তার পরও অনেক খাত আছে আমি উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি যেমন সাতক্ষীরা-খুলনার কাঁকড়া রপ্তানি যারা করত তারা কিন্তু উঠে আসতে পারেনি। আরেকটা হলো লকডাউনে তাৎক্ষণিক একটা ধাক্কা এসেছে, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সাধারণ ছুটি তুলে নেওয়া হলেও মানুষের সাধারণ অর্থনৈতিক চাহিদাগুলো এখনো ফিরে আসেনি। যেমন হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এখনো পুরোদমে চালু হয়নি। শিক্ষা কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, এর সঙ্গে বড় একটা অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, তা এখনো পরিপূর্ণভাবে চালু হয়নি। জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ৫৫ শতাংশ। অথচ যাদের পকেটে টাকা আছে তারা এখনো কিন্তু খরচ করছে না বা করতে পারছে না। এক কথায় বলা যায় চাহিদার একটা সংকট রয়েছে। করোনার নানামুখী অভিঘাত এখনো চলমান। অভিঘাত মোকাবিলায় সরকার নানা ধরনের প্রণোদনা দিতে উদ্যোগী হয়েছে।

 

আবার করোনার প্রভাব কাটার আগেই নতুন এক চ্যালেঞ্জ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তা হলো স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় প্রবেশ। এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শুধু অর্থনীতির উন্নয়নই কিন্তু সব নয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানবসম্পদ এসব বিষয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে। এখন তো মানবসম্পদ উন্নয়নটা সবচেয়ে দুশ্চিন্তার জায়গা হিসেবে দেখা দিয়েছে। কেননা করোনার কারণে অন্য খাতগুলো ঘুরে দাঁড়ালেও শিক্ষা খাতকে আগের অবস্থায় নেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রক্রিয়া। ফলে সামনের দিনগুলোয় এ শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর মানবসম্পদ উন্নয়নটা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর বাইরে যেসব বিষয় রয়েছে যেমন রপ্তানি, রেমিট্যান্স মানুষের গড় আয় এসবে তো কিছুটা হলেও অগ্রগতি রয়েছে। আর করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারিনি। এখানে সমন্বিতভাবে কী করা যায় বা কী করা যেত সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। ফলে করোনার ধাক্কায় বিপর্যস্ত মানবসম্পদ ব্যবস্থাকে আবার কীভাবে আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে তা এখনো অনিশ্চিত। আবার এখানে নতুন প্রবৃদ্ধির চালক খুঁজতে গেলে শুধু সস্তা শ্রম দিয়ে তা ধরা যাবে না। এখানে দক্ষ শ্রমিক দরকার। যার ফলে শিক্ষার মানটাকে উন্নত করতে হবে। স্কুলে ঢোকা মানেই কিন্তু শিক্ষিত হওয়া নয়। স্কুলে যাচ্ছি কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছি কি না, স্কিলড হচ্ছি কি না তা একটা নতুন প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগামীর জন্য কিন্তু এগুলো বেশ বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।

লেখক : সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং ব্র্যাকের চেয়ারম্যান। সূএ: বাংলাদেশ  প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com