জামী

বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী: ট্যারা-বাঁকা ছোট্ট উঠোন থেকে হাত দুই উঁচু মাটির বারান্দা উঠেছে। তার এক কোণে ভাঙা উনুন। গত রাতে হঠাৎ ঝড়ে বারান্দার একটা বাঁশের খুঁটি কাত হয়ে পড়েছিল উনুনের ওপর। উনুনের চারটি উঁচু’র একটা ভেঙে যায়। রাতে আর কী করা, তিন উঁচু’র ওপর হাঁড়ি, আর যে উঁচুটা ভেঙে গেছে, সেখানে একটা ইটের টুকরো গুঁজে হাঁড়িটা কোনোমতে বসিয়ে ভাত রান্না করা হয়েছিল। সেই কাঠের কিছুটা এখনো রয়ে গেছে উনুনের তলায়। তাতে দেশলাইয়ের কাঠি ঢুকে কাঠ উসকিয়ে আগুন পোহাচ্ছে জামী আর কামী; দুই বোন। জামীর বয়স এগারো, আর কামীর নয়।

 

শীতের ভোর। উঠোনের পরেই কাসেমদের আমবাগানে কুয়াশা জড়িয়ে আছে। সেইদিকে এক মনে চেয়ে আছে কামী। মিনিট পাঁচেক হলো তার কাঁপুনি থেমেছে। বাবা বেরিয়ে গেছে ভ্যান নিয়ে, কিন্তু ভুল করে গামছা ফেলে গেছে; কামী সেটা আড়া থেকে পেড়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল, কিন্তু কাঁপুনি তাতে থামেনি, থেমেছে আগুনের আঁচে। জামী আড়া থেকে ভিজে ফ্রকটা পেড়ে উনুনে শুকাবে, উনুনের গড়ানে কঞ্চি পেতে তার ওপর ফ্রকটা রাখবে, যাতে তলার ধুলা না লাগে। বলল, একটু সরে বস না কামী! ফ্রকটা শুকায় কিনা দেখি!

 

কুয়াশায় গাছগুলোকে দেখে কী মনে হলো, কামী সরে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, গাছদের শীত লাগে না আপা?

 

তোর যা কথা! গাছদের কি রক্ত আছে?

হ্যাঁ আছে! ওই তো-মা বলেছিল…। মুখ দিয়ে মা’র কথা বেরুতেই জামীর দিকে কেমন হাউমাউ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়ে কামী, থেমে যায়।

অত মা’র কথা বলিসনে তো, ওরম মা’র মুখে…। বারান্দায় ঝুলে থাকা খড়ের চালের নিচ দিয়ে আকাশে তাকায় জামী।

উঠোনে কুয়াশা পতনের টুপটুপ শব্দ। পেয়ারা গাছটার সামান্য দেখা যায়, সেখানে একটা শালিক ক্যাচম্যাচ করে ডাকে। জামী বলে, ওই তো শালিক ডাকছে, রোদ উঠবে।

শালিক ডাকলে রোদ ওঠে কিনা জানা নেই। তবে জামীর ধারণা ওই রকম।

দে! এই বেলা এক ঘটি পানি এনে দে! সকাল সকাল ভাতটা চাপিয়ে দি, আজ দুপুরে একজনকে পাঁচ কেজি পানিফল দিতে হবে, দেরি করা যাবে না।

কামী বলল, আর একটু বেলা হোক না আপা! গা যে এখনো বরফ!

কল থেকে আসতে আসতে দেখবি রোদ উঠে গেছে, যেতে-আসতে তো কুড়ি মিনিট লাগবে, নাকি? বলতে বলতে জামী কাঁখে বাসনকোসন নিয়ে পুকুরের দিকে চলে গেল।

শীতের ভোরগুলো এভাবে? কাটে ওদের।

ঘরে তিনটে লোক। বাবা, আর এই দুই বোন। মা ছিল, এখনো আছে, তবে এদের কাছে নেই। যতদূর জানা যায়, তার নতুন সংসারে এখনো ছেলেপুলে হয়নি।

দুই

কালীগঞ্জ-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ধারে, গাজীরহাটের কাছে প্রকান্ড একটা বটগাছ চোখে পড়ে। ওই বটগাছতলায় বেঞ্চিতে কেজি কেজি পানিফল সাজিয়ে বিক্রি করে শিবানী আর নারানী। জামীও এখানে বিক্রি করে। তবে তাদের সঙ্গে জামীর পার্থক্য আছে। তারা সব নিজেদের ফল বিক্রি করে, আর জামী নাবিল, নয়তো করিম, নয়তো সোনাগাজীর পানিফল তুলে দিয়ে যে সামান্য টাকার সঙ্গে ঝুড়িপ্রতি আটদশটা করে ফল পায়, তাই বিক্রি করে। কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ঘেঁটে ফল তুললে তার প্রায় পাঁচ কেজি হয়। কিন্তু কয়েকদিন ভীষণ শীত বলে সে যায়নি। জল একেবারে বরফ হয়ে থাকে। অতক্ষণ জলে দাঁড়িয়ে থাকলে হাত-পা হয়ে যায় মমি’র হাত-পা। তবে আজ যেতেই হবে। কারণ আবুল গাজী, অর্থাৎ জামী-কামী’র বাবার জীবনদায়ী ইনহেলারের টাকা জোগাড় করতেই হবে। আবুল গত মাসে পায়ে চোট লাগিয়েছিল, সেই রুগ্নপায়ে তার আয়ও রুগ্ন। তা হোক, তাতেই সংসার কষ্টে-শিষ্টে চলত, কিন্তু সেই রুগ্ন আয়ের ঘাড়ে চেপে বসেছে সমিতির কিস্তির টাকা। একদম অহেতুক। এ দোকান, ও দোকানের পাওনা শোধের কথা বলে মা টাকা তুলিয়ে নিয়েছিল, দেনা শোধ তো পড়ে মরুক, তার বারোয়ানা দিয়ে নাকের নথ তৈরি করল। তাও সঙ্গে করে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল, কিন্তু তার ভারটা রেখে গেল। অল্প অল্প করে দোকানদারদের পাওনা দিলে এমন আর মহাভারত অশুদ্ধ হতো না। খামখা ঋণের বোঝা! আবুলকে চাল-ডালের টাকার সঙ্গে এখন কিস্তির টাকাও জোগাড় করতে হয়। অ্যাজমা আছে, আবার সুস্থ রাখা চাই। ইনহেলারের দায়টা তাই জামী নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। এটা ইচ্ছা করে নিলেও সংসারের সারা কাজ ও আপনি পেয়েছে, অবশ্য তাতে আপত্তি নেই, এগুলো তো আর মা নিয়ে যেতে পারে না, কক্ষনোই না।

দুপুর ২টার পরে শিবানী, নারানীদের ওই বেঞ্চের ধারে কাঁখে করে একঝুড়ি পানিফল নিয়ে দাঁড়াল জামী। তার চেহারাটা যে কেমন? সারা গা ভিজে, দীর্ঘক্ষণ ঠান্ডা জলে থেকে ফ্যাকাশে যেন পচে গেছে, পা থেকে কোমর পর্যন্ত কাদামাখা ভেজা পোশাক লেপ্টে আছে; যেন একটা টাটকা সাদা ফুল কাদাজল থেকে কেউ তুলে এনেছে, কাদার কামড়ে যার নিচেটা থ্যাঁতলানো। চুলগুলো উড়ো উড়ো, কাদার ছিটে লেগেছে, মুখখানার যে কী রং! আতপচালের মতো ময়লাটে সাদা, কিন্তু ফ্যাকাসে নয়। বোধহয় সংসারের মানা-না-মানা চোঙের মধ্যে ঢুকলে, ওমুখ দিয়ে বেরুনোর পর এমন রঙ হয়। শীতে তিরতির করে কাঁপছে।

বটগাছের দুটো ঝুলন্ত ডালের ফাঁক দিয়ে বিকালের এক চিলতে রোদ পড়েছে শিবানীর পাশে। ঝুড়িটা বেঞ্চিতে ঝপ করে রেখে সেই রোদে সরে এসে চোয়াললাগা কণ্ঠে বলল জামী, দেখোতো মাসি পাঁচ কেজি হয়েছে কিনা?

শিবানী হাতের কাজ করছিল, জামীকে এ অবস্থায় দেখে শিউরে ওঠে, আরে! শীতে যে মরে যাচ্ছিস! দাঁড়া! নিজের গায়ের চাদরটা জামীর গায়ে জড়িয়ে দেয় শিবানী।

এই মেয়েটার জন্য শিবানীর একটা মমত্ববোধ আছে। সেটা ঠিক মাতৃত্বের কিনা জানে না। জামীর মা তার সমবয়েসী। এখানে শিবানীর সঙ্গে পানিফলও বেচত মাঝে-মধ্যে। জামী মায়ের আঁচল ধরে আসত তখন। শিবানীর সঙ্গে জামীর মায়ের সখ্য সেসব দিন থেকেই। শিবানী বলল, ঝুড়ির ওজন কত্তা করেছিস সোনা? দুশ গ্রাম, না?

জামীকে সোনা বলে ডাকে সে।

হুঁ, দুশ।

মানে খালি ঝুড়ির ওজন দুশ গ্রাম। শিবানী বাটখারার সঙ্গে দুশ গ্রামের একটা বাটখারা বেশি বসিয়ে ওজন করে দেখে, পাঁচ কেজি পুরতে অল্প বাকি।

দাঁড়িপাল্লার দিকে নজর রেখেছিল জামী। বলল, আর অল্প কয়েকটা দিলে বোধহয় পুরত!

হুঁ, তুই যা! ভিজে কাপড় পাল্টে আয়!

গেলে তো হবে না মাসী, এক খদ্দের আসবে, তাকে পাঁচ কেজিই দিতে হবে, বাবার ইনহেলার কিনতে হবে।

শিবানী বলে, আমারও তো আছে, নাকি? সেখান থেকে পুরণ করব, টাকাও রেখে দেব, তুই যা! ভিজে কাপড়ে আর কাঁপিস নে!…রান্না কে করেছে?

আমি ভাত চাপিয়ে গিয়েছিলাম, তরকারি রান্নার কথা বাবার, তক্ষণ হয়ে গেছে বোধহয়।

জামীর কাঁপুুনি একটু কমেছে। রোদের মতো শিবানীর কথাতেও উত্তাপ পেয়েছে সে।

জামী চলে যাওয়ার পর, সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে ছোট্ট সাদা একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখে শিবানী খপ করে তুলে নিয়ে দেখে একটা রুপার আংটি। এ তো সেই আংটি, জামীর মা একদিন গল্প করতে করতে বলেছিল, বুইছাও দি, আংটি পেয়ে মেয়ে আমার খুব খুশি, পানি-কাদা কিচ্চুতে আর মানাচ্ছে না, সবসময় আঙুলি পুরে থাকে, পড়তি বুসে আঙুলের দিকি হাঁ করে তাকাই থাকে হাহাহা, রাতিও মনে হয় ঘুমুত পারে না, আংটি দেকার জন্যি…হাহাহা। আমি কইছি, তোর বাপ তোরে এই জিনিস দিতে পারত না, ককখনোই না, আমি পানিফল বিচে বিচে দেলাম, যত্ন কুরে রাকিস!

শিবানীর আরও মনে পড়ে, জামীর মা একদিন বলেছিল, পঞ্চাশটা টাকা দাও না দিদি, মেয়েটা আংটি আংটি করে তিষ্টুত দেচ্চে না, এটটু এনে দি, মাসখানিক পরে আবার দিয়ে দেবানে! জামী তখন চার হাত-পায়ে মায়ের গা জড়িয়ে আঁচলের ফাঁক দিয়ে কেমন অনুনয়ের ঢঙে তার দিকে একটানা তাকিয়ে ছিল। তখন ওর মুখখানা দেখেই তো দিয়েছিল পঞ্চাশ টাকা।

তিন

বিকাল আর সন্ধ্যার মধ্যে যখন সময়ের ব্যবধান করা যায় না-ঠিক সেরকম একটা সময়ে শিবানীর কাছে এলো জামী। তখন মাঠের মধ্যে ধোঁয়ার কুন্ডলির মতো কুয়াশা আটকে আছে। ফসলি জমির মাথার কাছে ঘন চুলের মতো অন্ধকার হয়ে পড়েছে বাঁশবাগান। দেরি করার কারণ আর জিজ্ঞেস করল না শিবানী, সে বুঝতে পেরেছে-মেয়েটিকে রান্না করেই তবে দুটো খেতে হয়েছে।

এই নে! তোর বিক্রির একশ কুড়ি টাকা, কুড়িটা ফল কম পড়েছিল, আমি দিয়ে দিয়েছি, আর ফেরত দিতে হবে না।

শিবানী গাঁটি থেকে টাকা বের করে দিল। আংটির কথা তুলল না। আংটি যে হারিয়েছে, মেয়েটি তা জানে কিনা, কিংবা তার কোনো উদ্বেগ মেয়েটির মধ্যে আছে কিনা বুঝতে চায়। কিন্তু উদ্বিগ্নতা যখন শিশুর মধ্যে ঢোকে, বড়রা বড়দের মতো করে তা দেখতে পায় না। শিবানীও পেল না। তাই জামী যখন খালি ঝুড়িটা নিয়ে চলে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ডাক দিল, অ্যাই তোর কিছু হারিয়েছে?

জামী থমকে পিছন ফিরে শিবানীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে হ্যাঁ কি না- কোনো উত্তরের আভাস নেই; যেন সে বুঝতে পারেনি। শিবানী হেসে বলে, কী রে বুঝতে পারছিস না! তোর কি কিছু হারিয়েছে?

জামী সেভাবে চেয়ে থাকে, যেন মুখটা পেতে রেখেছে, মাটির পাত্র যেমন নীরবে বৃষ্টি ধরে, তেমনি। শিবানী হাসে, কী পাগল রে তুই! আংটি হারিয়েছিস, এখনো টের পাসনি! ৫০০ টাকা দাম ওটার! মাথাটা একদম গেছে তোর!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবানী আরেক গাঁটি থেকে আংটিটা খুলে জামীকে দিতে গিয়ে দেখে, সে ছুটে চলে যাচ্ছে।

আরে ! শিবানী চেঁচায়, এটা নিয়ে যা! দাঁড়া!

জামী ছুটতে ছুটতে বলে, আমার দরকার নেই, ওটা তোমার ফলের দাম!

শীতকালের সন্ধ্যেবেলায় ধোঁয়াশা আঁধার ঠেলে মাঠের মধ্যে ছুটে চলছে জামী। শিবানী থ হয়ে দেখে, জামী যাচ্ছে উল্টো দিকে, কিন্তু এগোচ্ছে তার দিকে।…না, এটা শিবানীর মনের ভুল। জামী দূরেই চলে যাচ্ছে। মায়ের দেওয়া আংটিটা বড্ড ভার লাগছিল। ইচ্ছা করেই মায়ের শূন্যতা দিয়েছে মা। ইচ্ছা করেই, অকারণ। তাই মায়ের ভারকে ফেলতে আংটিটা ফেলে দিয়েছিল। শিশু মন, ভেবেছিল এভাবেই মাকে ভোলা যাবে। এখন সে ছোটে আর আঙুলটিতে হাত বোলায়। কিন্তু এতকাল যে আংটিটা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় রাত-দিন আঙুলে জড়িয়ে ছিল, হঠাৎ তার শূন্যতায় কেমন একটা ভার লাগে। মায়ের যে ভার নামাতে আংটিটি ফেলে দেওয়া, আঘাতের দিক থেকে এ ভার তেমন। কিন্তু তা কোনো ঘন-ঘোর বর্ষার সন্ধ্যায় ভিজতে থাকা নিঝুম বনের অন্ধকারের মতো অবোধ্য ও নতুন। আংটি ফেলার আগে সে বোঝেনি। কী আর করা! এই নতুন ভার বয়েই সে ওষুধের দোকানে যাবে, ইনহেলার কিনে ফিরবে বাড়ি, এই নতুন ভার বয়েই শ্বাসকষ্টে জীবন ওষ্ঠাগত বাবার পাশে বসবে। এই নতুন ভার বয়েই নতুন হবে সে, নিত্যনতুন।সূূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» মাদকাসক্ত ভাইয়ের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছোট বোন নিহত

» সিটিটিসি কার্যালয় পরিদর্শন করলেন ডিএমপি কমিশনার

» ১৬টি পয়েন্ট তুলে ধরে দেশবাসীকে সজাগ থাকতে বললেন তারেক রহমান

» সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

» বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন ভারতের উচিত তার দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: তথ্য উপদেষ্টা

» আলেম ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ উপদেষ্টা মাহফুজের

» ব্র্যাক ব্যাংকের এমপ্লয়ি ব্যাংকিং সুবিধা পাবে সিগাল হোটেলস

» কেমন হলো ভিভো ভি৪০ লাইট এর এআই ফিচার

» ইসলামপুরে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের স্মরণ ও চেক বিতরণ

» ইসলামপুরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেফতার ৫

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

জামী

বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী: ট্যারা-বাঁকা ছোট্ট উঠোন থেকে হাত দুই উঁচু মাটির বারান্দা উঠেছে। তার এক কোণে ভাঙা উনুন। গত রাতে হঠাৎ ঝড়ে বারান্দার একটা বাঁশের খুঁটি কাত হয়ে পড়েছিল উনুনের ওপর। উনুনের চারটি উঁচু’র একটা ভেঙে যায়। রাতে আর কী করা, তিন উঁচু’র ওপর হাঁড়ি, আর যে উঁচুটা ভেঙে গেছে, সেখানে একটা ইটের টুকরো গুঁজে হাঁড়িটা কোনোমতে বসিয়ে ভাত রান্না করা হয়েছিল। সেই কাঠের কিছুটা এখনো রয়ে গেছে উনুনের তলায়। তাতে দেশলাইয়ের কাঠি ঢুকে কাঠ উসকিয়ে আগুন পোহাচ্ছে জামী আর কামী; দুই বোন। জামীর বয়স এগারো, আর কামীর নয়।

 

শীতের ভোর। উঠোনের পরেই কাসেমদের আমবাগানে কুয়াশা জড়িয়ে আছে। সেইদিকে এক মনে চেয়ে আছে কামী। মিনিট পাঁচেক হলো তার কাঁপুনি থেমেছে। বাবা বেরিয়ে গেছে ভ্যান নিয়ে, কিন্তু ভুল করে গামছা ফেলে গেছে; কামী সেটা আড়া থেকে পেড়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল, কিন্তু কাঁপুনি তাতে থামেনি, থেমেছে আগুনের আঁচে। জামী আড়া থেকে ভিজে ফ্রকটা পেড়ে উনুনে শুকাবে, উনুনের গড়ানে কঞ্চি পেতে তার ওপর ফ্রকটা রাখবে, যাতে তলার ধুলা না লাগে। বলল, একটু সরে বস না কামী! ফ্রকটা শুকায় কিনা দেখি!

 

কুয়াশায় গাছগুলোকে দেখে কী মনে হলো, কামী সরে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, গাছদের শীত লাগে না আপা?

 

তোর যা কথা! গাছদের কি রক্ত আছে?

হ্যাঁ আছে! ওই তো-মা বলেছিল…। মুখ দিয়ে মা’র কথা বেরুতেই জামীর দিকে কেমন হাউমাউ দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়ে কামী, থেমে যায়।

অত মা’র কথা বলিসনে তো, ওরম মা’র মুখে…। বারান্দায় ঝুলে থাকা খড়ের চালের নিচ দিয়ে আকাশে তাকায় জামী।

উঠোনে কুয়াশা পতনের টুপটুপ শব্দ। পেয়ারা গাছটার সামান্য দেখা যায়, সেখানে একটা শালিক ক্যাচম্যাচ করে ডাকে। জামী বলে, ওই তো শালিক ডাকছে, রোদ উঠবে।

শালিক ডাকলে রোদ ওঠে কিনা জানা নেই। তবে জামীর ধারণা ওই রকম।

দে! এই বেলা এক ঘটি পানি এনে দে! সকাল সকাল ভাতটা চাপিয়ে দি, আজ দুপুরে একজনকে পাঁচ কেজি পানিফল দিতে হবে, দেরি করা যাবে না।

কামী বলল, আর একটু বেলা হোক না আপা! গা যে এখনো বরফ!

কল থেকে আসতে আসতে দেখবি রোদ উঠে গেছে, যেতে-আসতে তো কুড়ি মিনিট লাগবে, নাকি? বলতে বলতে জামী কাঁখে বাসনকোসন নিয়ে পুকুরের দিকে চলে গেল।

শীতের ভোরগুলো এভাবে? কাটে ওদের।

ঘরে তিনটে লোক। বাবা, আর এই দুই বোন। মা ছিল, এখনো আছে, তবে এদের কাছে নেই। যতদূর জানা যায়, তার নতুন সংসারে এখনো ছেলেপুলে হয়নি।

দুই

কালীগঞ্জ-সাতক্ষীরা মহাসড়কের ধারে, গাজীরহাটের কাছে প্রকান্ড একটা বটগাছ চোখে পড়ে। ওই বটগাছতলায় বেঞ্চিতে কেজি কেজি পানিফল সাজিয়ে বিক্রি করে শিবানী আর নারানী। জামীও এখানে বিক্রি করে। তবে তাদের সঙ্গে জামীর পার্থক্য আছে। তারা সব নিজেদের ফল বিক্রি করে, আর জামী নাবিল, নয়তো করিম, নয়তো সোনাগাজীর পানিফল তুলে দিয়ে যে সামান্য টাকার সঙ্গে ঝুড়িপ্রতি আটদশটা করে ফল পায়, তাই বিক্রি করে। কোমর পর্যন্ত জলে নেমে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ঘেঁটে ফল তুললে তার প্রায় পাঁচ কেজি হয়। কিন্তু কয়েকদিন ভীষণ শীত বলে সে যায়নি। জল একেবারে বরফ হয়ে থাকে। অতক্ষণ জলে দাঁড়িয়ে থাকলে হাত-পা হয়ে যায় মমি’র হাত-পা। তবে আজ যেতেই হবে। কারণ আবুল গাজী, অর্থাৎ জামী-কামী’র বাবার জীবনদায়ী ইনহেলারের টাকা জোগাড় করতেই হবে। আবুল গত মাসে পায়ে চোট লাগিয়েছিল, সেই রুগ্নপায়ে তার আয়ও রুগ্ন। তা হোক, তাতেই সংসার কষ্টে-শিষ্টে চলত, কিন্তু সেই রুগ্ন আয়ের ঘাড়ে চেপে বসেছে সমিতির কিস্তির টাকা। একদম অহেতুক। এ দোকান, ও দোকানের পাওনা শোধের কথা বলে মা টাকা তুলিয়ে নিয়েছিল, দেনা শোধ তো পড়ে মরুক, তার বারোয়ানা দিয়ে নাকের নথ তৈরি করল। তাও সঙ্গে করে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল, কিন্তু তার ভারটা রেখে গেল। অল্প অল্প করে দোকানদারদের পাওনা দিলে এমন আর মহাভারত অশুদ্ধ হতো না। খামখা ঋণের বোঝা! আবুলকে চাল-ডালের টাকার সঙ্গে এখন কিস্তির টাকাও জোগাড় করতে হয়। অ্যাজমা আছে, আবার সুস্থ রাখা চাই। ইনহেলারের দায়টা তাই জামী নিজের ঘাড়ে নিয়েছে। এটা ইচ্ছা করে নিলেও সংসারের সারা কাজ ও আপনি পেয়েছে, অবশ্য তাতে আপত্তি নেই, এগুলো তো আর মা নিয়ে যেতে পারে না, কক্ষনোই না।

দুপুর ২টার পরে শিবানী, নারানীদের ওই বেঞ্চের ধারে কাঁখে করে একঝুড়ি পানিফল নিয়ে দাঁড়াল জামী। তার চেহারাটা যে কেমন? সারা গা ভিজে, দীর্ঘক্ষণ ঠান্ডা জলে থেকে ফ্যাকাশে যেন পচে গেছে, পা থেকে কোমর পর্যন্ত কাদামাখা ভেজা পোশাক লেপ্টে আছে; যেন একটা টাটকা সাদা ফুল কাদাজল থেকে কেউ তুলে এনেছে, কাদার কামড়ে যার নিচেটা থ্যাঁতলানো। চুলগুলো উড়ো উড়ো, কাদার ছিটে লেগেছে, মুখখানার যে কী রং! আতপচালের মতো ময়লাটে সাদা, কিন্তু ফ্যাকাসে নয়। বোধহয় সংসারের মানা-না-মানা চোঙের মধ্যে ঢুকলে, ওমুখ দিয়ে বেরুনোর পর এমন রঙ হয়। শীতে তিরতির করে কাঁপছে।

বটগাছের দুটো ঝুলন্ত ডালের ফাঁক দিয়ে বিকালের এক চিলতে রোদ পড়েছে শিবানীর পাশে। ঝুড়িটা বেঞ্চিতে ঝপ করে রেখে সেই রোদে সরে এসে চোয়াললাগা কণ্ঠে বলল জামী, দেখোতো মাসি পাঁচ কেজি হয়েছে কিনা?

শিবানী হাতের কাজ করছিল, জামীকে এ অবস্থায় দেখে শিউরে ওঠে, আরে! শীতে যে মরে যাচ্ছিস! দাঁড়া! নিজের গায়ের চাদরটা জামীর গায়ে জড়িয়ে দেয় শিবানী।

এই মেয়েটার জন্য শিবানীর একটা মমত্ববোধ আছে। সেটা ঠিক মাতৃত্বের কিনা জানে না। জামীর মা তার সমবয়েসী। এখানে শিবানীর সঙ্গে পানিফলও বেচত মাঝে-মধ্যে। জামী মায়ের আঁচল ধরে আসত তখন। শিবানীর সঙ্গে জামীর মায়ের সখ্য সেসব দিন থেকেই। শিবানী বলল, ঝুড়ির ওজন কত্তা করেছিস সোনা? দুশ গ্রাম, না?

জামীকে সোনা বলে ডাকে সে।

হুঁ, দুশ।

মানে খালি ঝুড়ির ওজন দুশ গ্রাম। শিবানী বাটখারার সঙ্গে দুশ গ্রামের একটা বাটখারা বেশি বসিয়ে ওজন করে দেখে, পাঁচ কেজি পুরতে অল্প বাকি।

দাঁড়িপাল্লার দিকে নজর রেখেছিল জামী। বলল, আর অল্প কয়েকটা দিলে বোধহয় পুরত!

হুঁ, তুই যা! ভিজে কাপড় পাল্টে আয়!

গেলে তো হবে না মাসী, এক খদ্দের আসবে, তাকে পাঁচ কেজিই দিতে হবে, বাবার ইনহেলার কিনতে হবে।

শিবানী বলে, আমারও তো আছে, নাকি? সেখান থেকে পুরণ করব, টাকাও রেখে দেব, তুই যা! ভিজে কাপড়ে আর কাঁপিস নে!…রান্না কে করেছে?

আমি ভাত চাপিয়ে গিয়েছিলাম, তরকারি রান্নার কথা বাবার, তক্ষণ হয়ে গেছে বোধহয়।

জামীর কাঁপুুনি একটু কমেছে। রোদের মতো শিবানীর কথাতেও উত্তাপ পেয়েছে সে।

জামী চলে যাওয়ার পর, সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে ছোট্ট সাদা একটা জিনিস পড়ে থাকতে দেখে শিবানী খপ করে তুলে নিয়ে দেখে একটা রুপার আংটি। এ তো সেই আংটি, জামীর মা একদিন গল্প করতে করতে বলেছিল, বুইছাও দি, আংটি পেয়ে মেয়ে আমার খুব খুশি, পানি-কাদা কিচ্চুতে আর মানাচ্ছে না, সবসময় আঙুলি পুরে থাকে, পড়তি বুসে আঙুলের দিকি হাঁ করে তাকাই থাকে হাহাহা, রাতিও মনে হয় ঘুমুত পারে না, আংটি দেকার জন্যি…হাহাহা। আমি কইছি, তোর বাপ তোরে এই জিনিস দিতে পারত না, ককখনোই না, আমি পানিফল বিচে বিচে দেলাম, যত্ন কুরে রাকিস!

শিবানীর আরও মনে পড়ে, জামীর মা একদিন বলেছিল, পঞ্চাশটা টাকা দাও না দিদি, মেয়েটা আংটি আংটি করে তিষ্টুত দেচ্চে না, এটটু এনে দি, মাসখানিক পরে আবার দিয়ে দেবানে! জামী তখন চার হাত-পায়ে মায়ের গা জড়িয়ে আঁচলের ফাঁক দিয়ে কেমন অনুনয়ের ঢঙে তার দিকে একটানা তাকিয়ে ছিল। তখন ওর মুখখানা দেখেই তো দিয়েছিল পঞ্চাশ টাকা।

তিন

বিকাল আর সন্ধ্যার মধ্যে যখন সময়ের ব্যবধান করা যায় না-ঠিক সেরকম একটা সময়ে শিবানীর কাছে এলো জামী। তখন মাঠের মধ্যে ধোঁয়ার কুন্ডলির মতো কুয়াশা আটকে আছে। ফসলি জমির মাথার কাছে ঘন চুলের মতো অন্ধকার হয়ে পড়েছে বাঁশবাগান। দেরি করার কারণ আর জিজ্ঞেস করল না শিবানী, সে বুঝতে পেরেছে-মেয়েটিকে রান্না করেই তবে দুটো খেতে হয়েছে।

এই নে! তোর বিক্রির একশ কুড়ি টাকা, কুড়িটা ফল কম পড়েছিল, আমি দিয়ে দিয়েছি, আর ফেরত দিতে হবে না।

শিবানী গাঁটি থেকে টাকা বের করে দিল। আংটির কথা তুলল না। আংটি যে হারিয়েছে, মেয়েটি তা জানে কিনা, কিংবা তার কোনো উদ্বেগ মেয়েটির মধ্যে আছে কিনা বুঝতে চায়। কিন্তু উদ্বিগ্নতা যখন শিশুর মধ্যে ঢোকে, বড়রা বড়দের মতো করে তা দেখতে পায় না। শিবানীও পেল না। তাই জামী যখন খালি ঝুড়িটা নিয়ে চলে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ডাক দিল, অ্যাই তোর কিছু হারিয়েছে?

জামী থমকে পিছন ফিরে শিবানীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখে হ্যাঁ কি না- কোনো উত্তরের আভাস নেই; যেন সে বুঝতে পারেনি। শিবানী হেসে বলে, কী রে বুঝতে পারছিস না! তোর কি কিছু হারিয়েছে?

জামী সেভাবে চেয়ে থাকে, যেন মুখটা পেতে রেখেছে, মাটির পাত্র যেমন নীরবে বৃষ্টি ধরে, তেমনি। শিবানী হাসে, কী পাগল রে তুই! আংটি হারিয়েছিস, এখনো টের পাসনি! ৫০০ টাকা দাম ওটার! মাথাটা একদম গেছে তোর!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবানী আরেক গাঁটি থেকে আংটিটা খুলে জামীকে দিতে গিয়ে দেখে, সে ছুটে চলে যাচ্ছে।

আরে ! শিবানী চেঁচায়, এটা নিয়ে যা! দাঁড়া!

জামী ছুটতে ছুটতে বলে, আমার দরকার নেই, ওটা তোমার ফলের দাম!

শীতকালের সন্ধ্যেবেলায় ধোঁয়াশা আঁধার ঠেলে মাঠের মধ্যে ছুটে চলছে জামী। শিবানী থ হয়ে দেখে, জামী যাচ্ছে উল্টো দিকে, কিন্তু এগোচ্ছে তার দিকে।…না, এটা শিবানীর মনের ভুল। জামী দূরেই চলে যাচ্ছে। মায়ের দেওয়া আংটিটা বড্ড ভার লাগছিল। ইচ্ছা করেই মায়ের শূন্যতা দিয়েছে মা। ইচ্ছা করেই, অকারণ। তাই মায়ের ভারকে ফেলতে আংটিটা ফেলে দিয়েছিল। শিশু মন, ভেবেছিল এভাবেই মাকে ভোলা যাবে। এখন সে ছোটে আর আঙুলটিতে হাত বোলায়। কিন্তু এতকাল যে আংটিটা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় রাত-দিন আঙুলে জড়িয়ে ছিল, হঠাৎ তার শূন্যতায় কেমন একটা ভার লাগে। মায়ের যে ভার নামাতে আংটিটি ফেলে দেওয়া, আঘাতের দিক থেকে এ ভার তেমন। কিন্তু তা কোনো ঘন-ঘোর বর্ষার সন্ধ্যায় ভিজতে থাকা নিঝুম বনের অন্ধকারের মতো অবোধ্য ও নতুন। আংটি ফেলার আগে সে বোঝেনি। কী আর করা! এই নতুন ভার বয়েই সে ওষুধের দোকানে যাবে, ইনহেলার কিনে ফিরবে বাড়ি, এই নতুন ভার বয়েই শ্বাসকষ্টে জীবন ওষ্ঠাগত বাবার পাশে বসবে। এই নতুন ভার বয়েই নতুন হবে সে, নিত্যনতুন।সূূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com