জাফরুল্লাহর ভালোমন্দ ও বিদ্যানন্দ বিতর্ক

ছবি : সংগৃহীত

 

নঈম নিজাম :মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু যোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর রাজনীতি নিয়ে ভিন্নমত আছে আমার। ১৯৭২ সাল থেকেই তিনি নিজের মতো করে আলাদা রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রাখতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজের মতো আলাদা মত-পথের সন্ধানে ছিলেন। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলিয়েছেন। কতটা মিলেছে, কতটা মেলেনি জানি না। এক জীবনে মানুষের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলে না।  জাফরুল্লাহরও না মেলাটাই স্বাভাবিক।  তারপরও শেষ বয়সে তার মাঝে ক্লান্তি দেখিনি। অপরের সমালোচনা শুনে তিনি থামেননি। মেলাননি চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। কাজ করে গেছেন নীরবে। সেই কাজ মানুষের জন্য। মানবতার জন্য। সুন্দর একটা আগামী তৈরির জন্য। ১৯৭১ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেন জাফরুল্লাহ। স্বাধীনতার পর তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পাশে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। তার চিন্তার প্রশংসা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডেকে নিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে। মুক্তিযুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রশংসা করেন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসায় ভূমিকা রাখার জন্য হাসপাতালের জন্য বঙ্গবন্ধু নাম দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। নির্দেশ স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রামে নিয়ে যেতে। গণস্বাস্থ্যের জন্য বঙ্গবন্ধু জমি দেন সাভারে। পাশাপাশি বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন, উৎসাহ দেন।

 

বাংলাদেশের সূচনা লগ্নে জাফরুল্লাহ যাত্রা শুরু করেছিলেন কুমিল্লায়। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জমি পেয়ে চলে আসেন সাভারে। দেশীয় ওষুুধের বিকাশ ও বাজার তৈরিতে জাফরুল্লাহ নতুন সংগ্রাম শুরু করেন। তখন বাংলাদেশের ওষুুধের বাজার বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। জ্বরের জন্য সামান্য প্যারাসিটামল কিনতে হতো চড়া দামে। জাফরুল্লাহ একটা সংগ্রাম শুরু করেন। তার সংগ্রামের সাফল্য আজকে বাংলাদেশে এখন ৯০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন হয়। দেশীয় কোম্পানিগুলোর ওষুুধ দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে পরে বিদেশি ওষুধে বাজার বদলাতে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে তিনি ভূমিকা রাখেন। এরশাদ তাকে সহায়তা করেছেন। আমাদের চিকিৎসক সমাজ গ্রামে যেতে এখনো সম্মত নয়। তাই তারা স্বাস্থ্যনীতির বিরোধিতা করেন। জাফরুল্লাহর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। চিকিৎসক সমাজের সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। নিজের কাজ নিয়েই এগিয়ে যেতে থাকেন। এরশাদের শুরুতে জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রথম তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেই তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন তখনকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। নাম ছিল শামসুল আলম। পাকিস্তান আমলের জাঁদলের এই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা সব কিছু নেতিবাচকভাবে করতেন। এ কারণে অনেকে ভেবেছিলেন এবার জাফরুল্লাহর রেহাই নেই। তিনি ধরা খাবেন। জাফরুল্লাহ নিজে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানালেন, শামসুল আলম একজন সৎ কর্মকর্তা। তিনি তদন্ত করলে তার আপত্তি নেই। সবাই অবাক হলেন। শেষ পর্যন্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা দেখলেন, দেশের স্বাস্থ্যনীতি ভালো করা ছাড়া জাফরুল্লাহ আর কিছু চান না। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের কাছে জাফরুল্লাহর পক্ষে রিপোর্ট প্রদান করেন। সুপারিশে লেখেন, এমন মানুষকে কাজে লাগালে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হবে। চিকিৎসকদের গ্রামে যাওয়ার কথা বলার কারণেই সবাই তার বিরুদ্ধে। এখানে অন্য কিছু নেই।

কয়েক বছর আগের কথা। জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে একটা মামলা চলছে উচ্চ আদালতে। হঠাৎ তার বেঞ্চ পরিবর্তন হয়ে যায়। অনেকে ভাবলেন এবার জাফরুল্লাহ ধরা খাবেন। তারা জাফরুল্লাহকে পরামর্শ দিলেন আপনি আপত্তি দিন। এই বিচারক ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক ছিলেন। শুধু সমর্থক নন একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। মানুষের এসব কথা শুনে জাফরুল্লাহ এ নিয়ে মুখ খুললেন মিডিয়ার কাছে। সবাই স্তম্ভিত হলেন তার বক্তব্য শুনে। তিনি বললেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত দেশের একজন সেরা বিচারপতির আদালতে আমার মামলা পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তিনি আদালতের ভরসা, শতভাগ সৎ, নিষ্ঠাবান, ভালো বিচারপতি। এই যুগে এত ভালো বিচারপতি আছেন জেনে আনন্দিত। দলমত নির্বিশেষে সবাই তার আদালতে ভালো বিচার পাচ্ছে। কারও কোনো অভিযোগ কোনো দিন শুনিনি। প্রশংসার মাত্রা এত বেশি ছিল সেই বিচারক আর এই মামলা নিজের আদালতে রাখলেন না। কারণ পুরো বিষয়টি তার জন্য বিব্রতকর ছিল। এ নিয়ে জাফরুল্লাহকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বললেন, আসলেই তিনি একজন ভালো বিচারপতি। কিছু খারাপ মানুষ তাকে দলীয় কালার দেওয়াতে মন খারাপ করে কথাগুলো মিডিয়ার সামনে বলেছিলাম।

 

জাফরুল্লাহ আসলে ব্যতিক্রম ছিলেন। দেশের বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের নামও তিনি প্রস্তাব করেন। সেই সময়ে এ নিয়ে তিনি বলেন, একজন ভালো মানুষের নাম প্রস্তাব করেছি। তিনি সততার জন্য প্রশংসিত ছিলেন বিচারক থাকার সময়ে। মন্ত্রণালয়েও সুনাম ছিল। জাতি আগামীতে তার কাছে ভালো কিছু পাবে। ভালো কী মন্দ পাবে সময় তা বলে দেবে। তবে একজন জাফরুল্লাহ সাদা মনের মানুষ ছিলেন। যা ভালো মনে করতেন বলে ফেলতেন। কোনো লুকোচুরি ছিল না। অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতেন বাংলাদেশেই গণস্বাস্থ্যে। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে বুঝতে পারেন চিকিৎসা ব্যয় অনেক। তাই কম খরচে কিডনি রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন গণস্বাস্থ্যে।

 

সাদামাটা জীবনযাপন ছিল একজন জাফরুল্লাহর। চাইলে ভোগবিলাসী জীবন ধারণ করতে পারতেন। তিনি তা করতেন না। একটা শার্ট না ছিঁড়লে আরেকটা কিনতে চাইতেন না। পোশাকের প্রতি কোনো টান ছিল না। চলাফেরাতে ভাব ছিল না। মানুষকে বুঝতেন। মানবতাকে জানতেন। কাজ করতেন। একবার একজন টিভি সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনি একটা সময়ে আভিজাত্য নিয়ে চলতেন। পোশাকে ছিলেন ধোপদুরস্ত। বদলে গেলেন কেন? আপনার পরনের প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়ার পর আবার সেলাই করে পরেছেন। পরনের শার্টও পুরনো। জবাবে বললেন, ইংল্যান্ডে পড়ার সময় দামি গাড়ি ছিল। রেডিমেড স্যুট কিনতাম না। সেলাই করতাম। ব্রিটিশ রাজপুত্রের দর্জির কাছে যেতাম। দামি কাপড়ে তারা স্যুট সেলাই করে দিত। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বিলেতে জনমত গঠনের সময় বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী আমার গাড়িতে চড়েছেন। এখন তিনটা মাত্র শার্ট। একটার বয়স ২০ বছরে বেশি। ছিঁড়ছে না দেখে আর কেনা হয় না। সাদামাটাভাবে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিলেন। শেষ জীবনে পুরনো একটা সাধারণ গাড়িতে চলতেন।

 

শুধু চিকিৎসাসেবা, সমাজ পরিবর্তনে নয়, নারীদের এগিয়ে নিতেও তিনি ভূমিকা রাখেন। তার স্ত্রী শিরিন হক নারী আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় শিরিন হক, নাসরিন হক দুই বোনকে সামনের কাতারে দেখেছি। ’৮৮ সালের বন্যার সময় গণস্বাস্থ্য সারা দিন স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে রুটি বানাতো। সেই রুটি ও গুড় বিতরণ করত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে। যারা কাজ করেন, তারা অনেকভাবেই সবকিছু নিয়ে চেষ্টা করে। একবার হঠাৎ পত্রিকার পাতায় দেখলাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গাড়ির চালক হিসেবে নারীদের নিয়োগ দিচ্ছে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে তিনি বলেছেন, নারীরা সিদ্ধান্ত নিতে সব সময় স্থির থাকে। গাড়ি চালক হিসেবে তারা খুব ভালো করবে। ইংল্যান্ডে দেখেছি তারা খুব একটা দুর্ঘটনায় পড়ে না। তাছাড়া তাদের কর্মসংস্থানেরও দরকার আছে।

 

এভাবে সবাই পারে না। মানুষের জন্য কাজ করতে ভিতর থেকে একটা তাগিদ দরকার। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তাগিদটা ভিতর থেকেই ছিল। আর ছিল বলেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজ করেছেন মানবতার জন্য। মানুষের জন্য। মৃত্যুর আগে একজন জাফরুল্লাহ অনেক কিছুই করেছেন। তিনি হুট করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হলেন। বেগম জিয়ার সামনে বিএনপির ভুলগুলোর সমালোচনা স্পষ্ট ভাষায় করলেন। বাদ থাকল না ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন নিয়ে সমালোচনাও। সেই সমালোচনা কেউ পছন্দ করেননি। দলে নির্দেশ আসে, জাফরুল্লাহকে যেন বেগম জিয়ার কাছে না নেওয়া হয়। জাফরুল্লাহও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দেন। তিনি ছোটখাটো কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলা শুরু করেন। তাদের নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে সভা-সমাবেশে কথা বলতেন। দাবি জানাতেন। সরকারের ভালোমন্দের সমালোচনা করতেন।

 

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো সবাই পারে না। আর পারে না বলেই চলে যাওয়ার পর অনেক সম্মান পেয়েছেন তিনি। ভালো লেগেছে, অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা সামাজিক মাধ্যমে জাফরুল্লাহর ইতিবাচক অবস্থানগুলোর প্রশংসা করেছেন। সবাই কখনো এক মতের অনুসারী হবে না। ভিন্নমতের একজন মৃত মানুষের প্রতি সম্মান জানাতে বড় মানসিকতা দরকার। এটা সবাই দেখাতে পারে না। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুর পরও অনেক বিএনপি সমর্থক সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। প্রতিটি মানুষের নীতি আদর্শ আলাদা থাকবে। মত ও পথের ভিন্নতা থাকবে। তাই বলে মৃত্যুর পর নোংরামি করতে হবে কেন? মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এই দুটি শব্দ তৈরিতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের সম্মান জানানোর ভিতরে কারও কার্পণ্য থাকা উচিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন গর্বের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের ধারক বলে অপরকে সারা দিন গালি দিয়ে নিজের বড় হওয়ার কিছু নেই। বড় হতে বড় মনের দরকার।

 

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক ধারা বিলুপ্ত করে কার কী লাভ? কুৎসা আর মিথ্যার জাল দেখতে দেখতে একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ভিতরে বাড়ছে হিংসা-বিদ্বেষ। অথচ এমন পরিবেশ আমাদের ছিল না। দুনিয়াতে মানুষের জন্য কাজ করতে পারা অনেক কঠিন বিষয়। কিছু মানুষের জন্ম হয় অপরের জন্য কাজ করতে। আবার কিছু মানুষ একটা জীবন কাটিয়ে দেয় অপরের সমালোচনা করে। কাজ করা মানুষের সমস্যা অনেক। তারা কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ভুল করে। কাজ করলে ভুল হবে। না করলে কিছুই হয় না। সুযোগের অভাবে এই দেশে সবাই ভালো মানুষ। সুযোগ পাওয়ার পর জানা যায় কে কতটা ভালো মানুষী নিয়ে থাকেন। বিদ্যানন্দ নিয়ে কথা হচ্ছে। গালাগাল হচ্ছে। একদল মানুষ সামাজিক মাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে। একটা প্রতিষ্ঠান ভুল করলে তা ধরিয়ে দিতে হবে। সামান্য ভুলে তো আর ফাঁসি হতে পারে না। জারি হতে পারে না মৃত্যুদন্ড। পারিবারিক অনুষ্ঠান শেষে এক রাতে আমাদের বেশ কয়েক ডেকচি খাবার বেঁচে যায়। কেউ এসে পরামর্শ দিলেন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি পাঠিয়ে দিন। সবাই খুশি হবেন। কেউ বললেন, কাল আবার অনুষ্ঠান করুন বাড়িতে। সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। খাবার গরম রাখলেই হবে। পরামর্শের শেষ নেই। একপর্যায়ে প্রস্তাব এলো বিদ্যানন্দের কাউকে ডাকলেই হবে। তারা রাতে এই খাবার বিতরণ করবে খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে। খবর দিলে গাড়ি নিয়ে আসবে। কোনো ঝামেলা নেই। শুধু পরে ডেকচিগুলো নিয়ে আসতে হবে। অথবা তারাও পাঠিয়ে দিতে পারে। এই প্রস্তাব ফরিদা ইয়াসমিন ও আমার পছন্দ হলো।

 

সিদ্ধান্ত নিলাম বিদ্যানন্দের মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করব। আমাদের পরিচয় গোপন রাখতে বলব। মুখ থেকে বের হতেই এক সহকর্মী ফোন করলেন বিদ্যানন্দের কাউকে। তাদের মিরপুর এলাকার লোকজন আমাদের কাছাকাছি অবস্থান করেন। ফোন পেয়ে চলে এলেন বিদ্যানন্দের লোকজন। তারা সব খাবার তুলে নিলেন। সেই খাবার বিদ্যানন্দ বিতরণ করল কালসী, মিরপুর এলাকার বস্তিবাসীর মাঝে। কেউ একজন সামাজিক মাধ্যমেও খাবার বিতরণের ছবি, ভিডিও আপলোড করেন। সেই ছবি দেখে আমাদের ভালো লাগে। মনে মনে তাদের ধন্যবাদ দিলাম। দুনিয়াতে এমন প্রতিষ্ঠানেরও দরকার আছে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের সৃষ্টি হয়েছিল সামাজিক কাজে। তারা সাফল্য নিয়ে কাজ করছে। আস সুন্নাহসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সামাজিক কাজ করছে। করুক। সমস্যা নেই। আহছানিয়া মিশনের ইতিবাচক কাজগুলো সবার কাছে প্রশংসিত। চট্টগ্রামের কুন্ডেশ্বরী, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কিংবা ভারতেশ্বরী হোমসের ইতিবাচক কাজের কোনো শেষ নেই। ভালো কাজ বাস্তবায়নে অনেক ঝামেলা। অনেক প্রতিকূলতা। সবাই সমালোচনা করে মজা পায়। প্রশংসা করে সহায়তা নিয়ে কম মানুষই পাশে দাঁড়ায়। হিংসার দুনিয়াতে কথায় কথায় সবাই অপরকে শেষ করে দেওয়ার আলোচনাই করেন। সারা দিন চলেন ধোপদুরস্ত পোশাকে। মুখে রাখেন হাসি হাসি ভাব। জীবনে কেউ বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ানোর একটি নজিরও নেই। এই ভালোরূপে থাকা মানুষগুলো সারাক্ষণ ভাবে কীভাবে অপরের ক্ষতি করা যায়। সমাজে অন্যের সর্বনাশের চিন্তায় থাকা মানুষের সংখ্যাই এখন বেশি। কারও ভালো দেখলে বুকে আগুন ধরে যাওয়া মানুষই ভালো আছে। তবে এই মানুষেরা জগতের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। পারবেও না। মানুষের উপকার করতে হিম্মত লাগে। বিশাল উদারতা লাগে। হিংসার আগুনে জ্বলে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় না। সামাজিক ও ব্যক্তিগত মাধ্যমে কুৎসা ছড়িয়ে দিয়ে কারও উপকার করা যায় না। এতে দেশ ও সমাজের ক্ষতি করা যায়। একজন জাফরুল্লাহ হতে, একটা বিদ্যানন্দ করতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়।

 

মানুষ ভালো কাজও আজকাল বাঁকা চোখে দেখে। সুযোগ পেলেই সমালোচনার ঝাঁপি নিয়ে মাঠে নামে। মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। কভিডের পর আমরা অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। অপরের ভালো দেখে স্থির থাকতে পারি না। মানুষের ভিতরে হিংসা-বিদ্বেষ এখন সবচেয়ে বেশি। বিদ্যানন্দ কিছু ভুল হয়তো করেছে। সেই ভুল ধরিয়ে দিয়ে তাদের সংশোধন হতে বলতে হবে। জানাতে হবে একই গরু বারবার দেখাবে না। ওমুক চাচার ভিডিও বারবার আপলোড করবে না। আরও যা যা ভুল করেছো ঠিক হয়ে যাও। না হলে তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারপরও ঠিক না হলে রাষ্ট্রের আইন আছে। কানুন আছে। অনিয়ম করলে আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।  কোনো সমস্যা নেই। এমন একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধের আলোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। বিদ্যানন্দের পাশে সবার ইতিবাচক ভাবনায় থাকা উচিত। পাশাপাশি অন্য যারা ভালো কাজ করছে তাদের উৎসাহিত করা যায়।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। সূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুই-এক বছর দেখতে চাই : নুর

» চোখের সেবা সম্প্রসারণে অরবিসের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশ আগ্রহী : ইউনূস

» ভারতে বসে হাসিনা ষড়যন্ত্র করছেন : এ্যানি

» স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ২০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দে ইইউর সমর্থন চাইল বাংলাদেশ

» ধাপে ধাপে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে সরকার : হাসান আরিফ

» বিমান বাহিনীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা

» অনলাইনে আয়কর পরিশোধ সহজ করতে এনবিআর-এর সাথে পার্টনারশিপ করেছে ব্র্যাক ব্যাংক

» বেসরকারি মেডিকেল শিক্ষায় অশনি সংকেত অটোমেশন; ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা

» ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি খালেদা জিয়াকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি আলালের

» থানায় এসে কেউ যেন সেবা বঞ্চিত না হয়: ডিএমপি কমিশনার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

জাফরুল্লাহর ভালোমন্দ ও বিদ্যানন্দ বিতর্ক

ছবি : সংগৃহীত

 

নঈম নিজাম :মুক্তিযুদ্ধের লড়াকু যোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর রাজনীতি নিয়ে ভিন্নমত আছে আমার। ১৯৭২ সাল থেকেই তিনি নিজের মতো করে আলাদা রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রাখতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নিজের মতো আলাদা মত-পথের সন্ধানে ছিলেন। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলিয়েছেন। কতটা মিলেছে, কতটা মেলেনি জানি না। এক জীবনে মানুষের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলে না।  জাফরুল্লাহরও না মেলাটাই স্বাভাবিক।  তারপরও শেষ বয়সে তার মাঝে ক্লান্তি দেখিনি। অপরের সমালোচনা শুনে তিনি থামেননি। মেলাননি চাওয়া-পাওয়ার হিসাব। কাজ করে গেছেন নীরবে। সেই কাজ মানুষের জন্য। মানবতার জন্য। সুন্দর একটা আগামী তৈরির জন্য। ১৯৭১ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেন জাফরুল্লাহ। স্বাধীনতার পর তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে পাশে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। তার চিন্তার প্রশংসা করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডেকে নিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে। মুক্তিযুদ্ধে ফিল্ড হাসপাতালের প্রশংসা করেন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসায় ভূমিকা রাখার জন্য হাসপাতালের জন্য বঙ্গবন্ধু নাম দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। নির্দেশ স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রামে নিয়ে যেতে। গণস্বাস্থ্যের জন্য বঙ্গবন্ধু জমি দেন সাভারে। পাশাপাশি বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন, উৎসাহ দেন।

 

বাংলাদেশের সূচনা লগ্নে জাফরুল্লাহ যাত্রা শুরু করেছিলেন কুমিল্লায়। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে জমি পেয়ে চলে আসেন সাভারে। দেশীয় ওষুুধের বিকাশ ও বাজার তৈরিতে জাফরুল্লাহ নতুন সংগ্রাম শুরু করেন। তখন বাংলাদেশের ওষুুধের বাজার বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। জ্বরের জন্য সামান্য প্যারাসিটামল কিনতে হতো চড়া দামে। জাফরুল্লাহ একটা সংগ্রাম শুরু করেন। তার সংগ্রামের সাফল্য আজকে বাংলাদেশে এখন ৯০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদন হয়। দেশীয় কোম্পানিগুলোর ওষুুধ দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে পরে বিদেশি ওষুধে বাজার বদলাতে স্বাস্থ্যনীতি তৈরিতে তিনি ভূমিকা রাখেন। এরশাদ তাকে সহায়তা করেছেন। আমাদের চিকিৎসক সমাজ গ্রামে যেতে এখনো সম্মত নয়। তাই তারা স্বাস্থ্যনীতির বিরোধিতা করেন। জাফরুল্লাহর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেন। চিকিৎসক সমাজের সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। নিজের কাজ নিয়েই এগিয়ে যেতে থাকেন। এরশাদের শুরুতে জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে প্রথম তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। সেই তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন তখনকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। নাম ছিল শামসুল আলম। পাকিস্তান আমলের জাঁদলের এই উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা সব কিছু নেতিবাচকভাবে করতেন। এ কারণে অনেকে ভেবেছিলেন এবার জাফরুল্লাহর রেহাই নেই। তিনি ধরা খাবেন। জাফরুল্লাহ নিজে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানালেন, শামসুল আলম একজন সৎ কর্মকর্তা। তিনি তদন্ত করলে তার আপত্তি নেই। সবাই অবাক হলেন। শেষ পর্যন্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা দেখলেন, দেশের স্বাস্থ্যনীতি ভালো করা ছাড়া জাফরুল্লাহ আর কিছু চান না। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের কাছে জাফরুল্লাহর পক্ষে রিপোর্ট প্রদান করেন। সুপারিশে লেখেন, এমন মানুষকে কাজে লাগালে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হবে। চিকিৎসকদের গ্রামে যাওয়ার কথা বলার কারণেই সবাই তার বিরুদ্ধে। এখানে অন্য কিছু নেই।

কয়েক বছর আগের কথা। জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে একটা মামলা চলছে উচ্চ আদালতে। হঠাৎ তার বেঞ্চ পরিবর্তন হয়ে যায়। অনেকে ভাবলেন এবার জাফরুল্লাহ ধরা খাবেন। তারা জাফরুল্লাহকে পরামর্শ দিলেন আপনি আপত্তি দিন। এই বিচারক ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর সমর্থক ছিলেন। শুধু সমর্থক নন একটি ছাত্র সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। মানুষের এসব কথা শুনে জাফরুল্লাহ এ নিয়ে মুখ খুললেন মিডিয়ার কাছে। সবাই স্তম্ভিত হলেন তার বক্তব্য শুনে। তিনি বললেন, আমি অত্যন্ত আনন্দিত দেশের একজন সেরা বিচারপতির আদালতে আমার মামলা পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তিনি আদালতের ভরসা, শতভাগ সৎ, নিষ্ঠাবান, ভালো বিচারপতি। এই যুগে এত ভালো বিচারপতি আছেন জেনে আনন্দিত। দলমত নির্বিশেষে সবাই তার আদালতে ভালো বিচার পাচ্ছে। কারও কোনো অভিযোগ কোনো দিন শুনিনি। প্রশংসার মাত্রা এত বেশি ছিল সেই বিচারক আর এই মামলা নিজের আদালতে রাখলেন না। কারণ পুরো বিষয়টি তার জন্য বিব্রতকর ছিল। এ নিয়ে জাফরুল্লাহকে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বললেন, আসলেই তিনি একজন ভালো বিচারপতি। কিছু খারাপ মানুষ তাকে দলীয় কালার দেওয়াতে মন খারাপ করে কথাগুলো মিডিয়ার সামনে বলেছিলাম।

 

জাফরুল্লাহ আসলে ব্যতিক্রম ছিলেন। দেশের বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালের নামও তিনি প্রস্তাব করেন। সেই সময়ে এ নিয়ে তিনি বলেন, একজন ভালো মানুষের নাম প্রস্তাব করেছি। তিনি সততার জন্য প্রশংসিত ছিলেন বিচারক থাকার সময়ে। মন্ত্রণালয়েও সুনাম ছিল। জাতি আগামীতে তার কাছে ভালো কিছু পাবে। ভালো কী মন্দ পাবে সময় তা বলে দেবে। তবে একজন জাফরুল্লাহ সাদা মনের মানুষ ছিলেন। যা ভালো মনে করতেন বলে ফেলতেন। কোনো লুকোচুরি ছিল না। অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতেন বাংলাদেশেই গণস্বাস্থ্যে। কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে বুঝতে পারেন চিকিৎসা ব্যয় অনেক। তাই কম খরচে কিডনি রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন গণস্বাস্থ্যে।

 

সাদামাটা জীবনযাপন ছিল একজন জাফরুল্লাহর। চাইলে ভোগবিলাসী জীবন ধারণ করতে পারতেন। তিনি তা করতেন না। একটা শার্ট না ছিঁড়লে আরেকটা কিনতে চাইতেন না। পোশাকের প্রতি কোনো টান ছিল না। চলাফেরাতে ভাব ছিল না। মানুষকে বুঝতেন। মানবতাকে জানতেন। কাজ করতেন। একবার একজন টিভি সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, আপনি একটা সময়ে আভিজাত্য নিয়ে চলতেন। পোশাকে ছিলেন ধোপদুরস্ত। বদলে গেলেন কেন? আপনার পরনের প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়ার পর আবার সেলাই করে পরেছেন। পরনের শার্টও পুরনো। জবাবে বললেন, ইংল্যান্ডে পড়ার সময় দামি গাড়ি ছিল। রেডিমেড স্যুট কিনতাম না। সেলাই করতাম। ব্রিটিশ রাজপুত্রের দর্জির কাছে যেতাম। দামি কাপড়ে তারা স্যুট সেলাই করে দিত। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বিলেতে জনমত গঠনের সময় বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী আমার গাড়িতে চড়েছেন। এখন তিনটা মাত্র শার্ট। একটার বয়স ২০ বছরে বেশি। ছিঁড়ছে না দেখে আর কেনা হয় না। সাদামাটাভাবে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিলেন। শেষ জীবনে পুরনো একটা সাধারণ গাড়িতে চলতেন।

 

শুধু চিকিৎসাসেবা, সমাজ পরিবর্তনে নয়, নারীদের এগিয়ে নিতেও তিনি ভূমিকা রাখেন। তার স্ত্রী শিরিন হক নারী আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় শিরিন হক, নাসরিন হক দুই বোনকে সামনের কাতারে দেখেছি। ’৮৮ সালের বন্যার সময় গণস্বাস্থ্য সারা দিন স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে রুটি বানাতো। সেই রুটি ও গুড় বিতরণ করত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে। যারা কাজ করেন, তারা অনেকভাবেই সবকিছু নিয়ে চেষ্টা করে। একবার হঠাৎ পত্রিকার পাতায় দেখলাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গাড়ির চালক হিসেবে নারীদের নিয়োগ দিচ্ছে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে তিনি বলেছেন, নারীরা সিদ্ধান্ত নিতে সব সময় স্থির থাকে। গাড়ি চালক হিসেবে তারা খুব ভালো করবে। ইংল্যান্ডে দেখেছি তারা খুব একটা দুর্ঘটনায় পড়ে না। তাছাড়া তাদের কর্মসংস্থানেরও দরকার আছে।

 

এভাবে সবাই পারে না। মানুষের জন্য কাজ করতে ভিতর থেকে একটা তাগিদ দরকার। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তাগিদটা ভিতর থেকেই ছিল। আর ছিল বলেই এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজ করেছেন মানবতার জন্য। মানুষের জন্য। মৃত্যুর আগে একজন জাফরুল্লাহ অনেক কিছুই করেছেন। তিনি হুট করে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা হলেন। বেগম জিয়ার সামনে বিএনপির ভুলগুলোর সমালোচনা স্পষ্ট ভাষায় করলেন। বাদ থাকল না ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন নিয়ে সমালোচনাও। সেই সমালোচনা কেউ পছন্দ করেননি। দলে নির্দেশ আসে, জাফরুল্লাহকে যেন বেগম জিয়ার কাছে না নেওয়া হয়। জাফরুল্লাহও বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে দেন। তিনি ছোটখাটো কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে চলা শুরু করেন। তাদের নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে সভা-সমাবেশে কথা বলতেন। দাবি জানাতেন। সরকারের ভালোমন্দের সমালোচনা করতেন।

 

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো সবাই পারে না। আর পারে না বলেই চলে যাওয়ার পর অনেক সম্মান পেয়েছেন তিনি। ভালো লেগেছে, অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা সামাজিক মাধ্যমে জাফরুল্লাহর ইতিবাচক অবস্থানগুলোর প্রশংসা করেছেন। সবাই কখনো এক মতের অনুসারী হবে না। ভিন্নমতের একজন মৃত মানুষের প্রতি সম্মান জানাতে বড় মানসিকতা দরকার। এটা সবাই দেখাতে পারে না। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুর পরও অনেক বিএনপি সমর্থক সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। প্রতিটি মানুষের নীতি আদর্শ আলাদা থাকবে। মত ও পথের ভিন্নতা থাকবে। তাই বলে মৃত্যুর পর নোংরামি করতে হবে কেন? মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এই দুটি শব্দ তৈরিতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের সম্মান জানানোর ভিতরে কারও কার্পণ্য থাকা উচিত নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন গর্বের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের ধারক বলে অপরকে সারা দিন গালি দিয়ে নিজের বড় হওয়ার কিছু নেই। বড় হতে বড় মনের দরকার।

 

রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক ধারা বিলুপ্ত করে কার কী লাভ? কুৎসা আর মিথ্যার জাল দেখতে দেখতে একটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ভিতরে বাড়ছে হিংসা-বিদ্বেষ। অথচ এমন পরিবেশ আমাদের ছিল না। দুনিয়াতে মানুষের জন্য কাজ করতে পারা অনেক কঠিন বিষয়। কিছু মানুষের জন্ম হয় অপরের জন্য কাজ করতে। আবার কিছু মানুষ একটা জীবন কাটিয়ে দেয় অপরের সমালোচনা করে। কাজ করা মানুষের সমস্যা অনেক। তারা কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় ভুল করে। কাজ করলে ভুল হবে। না করলে কিছুই হয় না। সুযোগের অভাবে এই দেশে সবাই ভালো মানুষ। সুযোগ পাওয়ার পর জানা যায় কে কতটা ভালো মানুষী নিয়ে থাকেন। বিদ্যানন্দ নিয়ে কথা হচ্ছে। গালাগাল হচ্ছে। একদল মানুষ সামাজিক মাধ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিদ্যানন্দের বিরুদ্ধে। একটা প্রতিষ্ঠান ভুল করলে তা ধরিয়ে দিতে হবে। সামান্য ভুলে তো আর ফাঁসি হতে পারে না। জারি হতে পারে না মৃত্যুদন্ড। পারিবারিক অনুষ্ঠান শেষে এক রাতে আমাদের বেশ কয়েক ডেকচি খাবার বেঁচে যায়। কেউ এসে পরামর্শ দিলেন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি পাঠিয়ে দিন। সবাই খুশি হবেন। কেউ বললেন, কাল আবার অনুষ্ঠান করুন বাড়িতে। সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। খাবার গরম রাখলেই হবে। পরামর্শের শেষ নেই। একপর্যায়ে প্রস্তাব এলো বিদ্যানন্দের কাউকে ডাকলেই হবে। তারা রাতে এই খাবার বিতরণ করবে খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে। খবর দিলে গাড়ি নিয়ে আসবে। কোনো ঝামেলা নেই। শুধু পরে ডেকচিগুলো নিয়ে আসতে হবে। অথবা তারাও পাঠিয়ে দিতে পারে। এই প্রস্তাব ফরিদা ইয়াসমিন ও আমার পছন্দ হলো।

 

সিদ্ধান্ত নিলাম বিদ্যানন্দের মাধ্যমে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করব। আমাদের পরিচয় গোপন রাখতে বলব। মুখ থেকে বের হতেই এক সহকর্মী ফোন করলেন বিদ্যানন্দের কাউকে। তাদের মিরপুর এলাকার লোকজন আমাদের কাছাকাছি অবস্থান করেন। ফোন পেয়ে চলে এলেন বিদ্যানন্দের লোকজন। তারা সব খাবার তুলে নিলেন। সেই খাবার বিদ্যানন্দ বিতরণ করল কালসী, মিরপুর এলাকার বস্তিবাসীর মাঝে। কেউ একজন সামাজিক মাধ্যমেও খাবার বিতরণের ছবি, ভিডিও আপলোড করেন। সেই ছবি দেখে আমাদের ভালো লাগে। মনে মনে তাদের ধন্যবাদ দিলাম। দুনিয়াতে এমন প্রতিষ্ঠানেরও দরকার আছে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের সৃষ্টি হয়েছিল সামাজিক কাজে। তারা সাফল্য নিয়ে কাজ করছে। আস সুন্নাহসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান সামাজিক কাজ করছে। করুক। সমস্যা নেই। আহছানিয়া মিশনের ইতিবাচক কাজগুলো সবার কাছে প্রশংসিত। চট্টগ্রামের কুন্ডেশ্বরী, টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কিংবা ভারতেশ্বরী হোমসের ইতিবাচক কাজের কোনো শেষ নেই। ভালো কাজ বাস্তবায়নে অনেক ঝামেলা। অনেক প্রতিকূলতা। সবাই সমালোচনা করে মজা পায়। প্রশংসা করে সহায়তা নিয়ে কম মানুষই পাশে দাঁড়ায়। হিংসার দুনিয়াতে কথায় কথায় সবাই অপরকে শেষ করে দেওয়ার আলোচনাই করেন। সারা দিন চলেন ধোপদুরস্ত পোশাকে। মুখে রাখেন হাসি হাসি ভাব। জীবনে কেউ বিপদে পড়লে পাশে দাঁড়ানোর একটি নজিরও নেই। এই ভালোরূপে থাকা মানুষগুলো সারাক্ষণ ভাবে কীভাবে অপরের ক্ষতি করা যায়। সমাজে অন্যের সর্বনাশের চিন্তায় থাকা মানুষের সংখ্যাই এখন বেশি। কারও ভালো দেখলে বুকে আগুন ধরে যাওয়া মানুষই ভালো আছে। তবে এই মানুষেরা জগতের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। পারবেও না। মানুষের উপকার করতে হিম্মত লাগে। বিশাল উদারতা লাগে। হিংসার আগুনে জ্বলে মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায় না। সামাজিক ও ব্যক্তিগত মাধ্যমে কুৎসা ছড়িয়ে দিয়ে কারও উপকার করা যায় না। এতে দেশ ও সমাজের ক্ষতি করা যায়। একজন জাফরুল্লাহ হতে, একটা বিদ্যানন্দ করতে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়।

 

মানুষ ভালো কাজও আজকাল বাঁকা চোখে দেখে। সুযোগ পেলেই সমালোচনার ঝাঁপি নিয়ে মাঠে নামে। মুহূর্তে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। কভিডের পর আমরা অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। অপরের ভালো দেখে স্থির থাকতে পারি না। মানুষের ভিতরে হিংসা-বিদ্বেষ এখন সবচেয়ে বেশি। বিদ্যানন্দ কিছু ভুল হয়তো করেছে। সেই ভুল ধরিয়ে দিয়ে তাদের সংশোধন হতে বলতে হবে। জানাতে হবে একই গরু বারবার দেখাবে না। ওমুক চাচার ভিডিও বারবার আপলোড করবে না। আরও যা যা ভুল করেছো ঠিক হয়ে যাও। না হলে তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তারপরও ঠিক না হলে রাষ্ট্রের আইন আছে। কানুন আছে। অনিয়ম করলে আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।  কোনো সমস্যা নেই। এমন একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধের আলোচনা গ্রহণযোগ্য নয়। বিদ্যানন্দের পাশে সবার ইতিবাচক ভাবনায় থাকা উচিত। পাশাপাশি অন্য যারা ভালো কাজ করছে তাদের উৎসাহিত করা যায়।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। সূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com