বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও দেশের ৬টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম থামছেই না। ঋণ বিতরণে ধারাবাহিক অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোর মন্দ ঋণ বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে দিনদিন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও রুগ্ন হয়ে পড়ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ফার্স্ট ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আভিভা ফাইন্যান্স, (পূর্বের নাম রিলায়েন্স ফাইন্যান্স) এবং প্রিমিয়ার লিজিং।
প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্লাসিফাইড লোন বা শ্রেণিবদ্ধ ঋণ বৃদ্ধি, সম্পদের মানের অবনতি, সুশাসন এবং নিয়মনীতির অভাব দীর্ঘদিনের। অনিয়ম বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে ৬ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পৃথক সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক সভায় সিদ্ধান্তের পর ঐ বছরের মার্চ মাসে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। বরং প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি দৃশ্যমান অগ্রগতির পরিবর্তে আরও নিচে নেমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২১ সাল শেষে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নন পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বা মন্দ ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত ছিল ২ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের পর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েকবার তাদের অগ্রগতি প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মহামারির কারণ দেখিয়ে প্রতিবেদন দিতে ব্যর্থ হয়। মহামারির অজুহাত দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূলধনের ঘাটতি, ক্রেডিট বৃদ্ধি, শ্রেণীবদ্ধ ঋণের পুনরুদ্ধারসহ সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ থেকে দূরে থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি ব্যালেন্স শীট থেকে তাদের মন্দ ঋণ লুকিয়ে রেখেছিল। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে আসে। যদিও প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্মকাণ্ড ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের আর্থিক অবস্থা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সভায় আলোচনা হলেও তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না। কারণ, প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো নানা কেলেঙ্কারী এবং অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে তাদের অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে সেটা তাদের কাছ থেকে আগে জানতে হবে। তবে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংকটে পড়া এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু করোনা মহামারি আসায় খুব কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়নি। প্রতিষ্ঠানগুলো তখন করোনাভাইরাসের অজুহাত দিচ্ছিল। তবে এটি সত্য যে মহামারির কারণে তারা ঋণ আদায় করতে পারেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় শিল্প মালিকদের পকেট প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তারা এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে বলে মনে করেন তিনি। বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ব্যবসায়ী বা প্রতিষ্ঠানগুলো ম্যানুপুলেট করে থাকে। এ কারণেই কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক সময় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চায় না বা পারে না। সাবেক গভর্নর মনে করেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাধারণ মানুষ খুব একটা সুবিধা পান না, বরং কোনো প্রতিষ্ঠান অনিয়মে জড়িয়ে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হন আমানতকারীরা। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে এই ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে।
তিনি বলেন, প্রথমত তাদের সতর্ক করতে হবে। এরপরও যদি ঠিক না হয় তাহলে দ্রুত এদের ব্যবস্থাপনা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রশাসক নিয়োগ করতে পারে। এছাড়া বিকল্প কিছু নেই। শক্ত ব্যবস্থা না নিলে কোনো লাভ হবে না। তবে এর আগে তাদের আইনত সময় দিতে হবে। আবার বেশি সময়ও যেন না দেয়। তখন আবার টাকা পাচার করে ফেলবে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ সময়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নিলে শুধুমাত্র সমঝোতা করে বেশি কিছু হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরিকল্পনা করে সামনে আগাতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এই খাতে আরও কিছু নিয়ম-কানুন চালু করা দরকার বলে মনে করেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং: প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাদের কার্যক্রমে ভালো করেছিল। কিন্তু তাদের আর্থিক বিবৃতি অনুযায়ী, এরপর থেকে তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। ২০১৫ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ১২.২৫ কোটি টাকা। এর পরের বছর দাঁড়ায় ১১.৪২ কোটি টাকা। এরপর ২০১৯ সালে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। সে সময় তাদের লোকসান দাঁড়ায় ৪১.৪২ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির নন পারফর্মিং লোন (এনপিএল) ছিল ৫৯৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ সেই এনপিএল দাঁড়ায় ৩২১০.৩৬ কোটি টাকায়।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম খান জানান, প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ধ্বংসের পথে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেজন্য আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি। এরমধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান একেবারে বসে গিয়েছিল। যারা টাকা দিতে পারবে না। তাদেরকে আমরা বিভিন্নভাবে ছাড় দিয়ে যাচ্ছি, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছি যাতে তারা ঠিকভাবে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারে এবং টাকা ফেরত দিতে পারে। কিন্তু কিছু লোকের নামে মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা পালিয়ে রয়েছে। তাদের কোম্পানিও নষ্ট হয়ে গেছে। এখন তারা টাকা দেবে কীভাবে? এটা বড় অসুবিধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেও কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে কিছু ছোট প্রতিষ্ঠানকে আমরা টাকা দিচ্ছি।
ফার্স্ট ফাইন্যান্স: ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মন্দ ঋণ ছিল ৪৬৬ কোটি টাকা। বর্তমানে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৪১.৭২ কোটি টাকা। যা তাদের মোট বিতরণকৃত ঋণের ৮৩ শতাংশ। কোম্পানিটি ১৫৭.৪৮ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। এ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান খান মোহাম্মদ মইনুল হাসান বলেন, এখানে সঠিক তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে, যাতে প্রতিষ্ঠানের মূল সমস্যাটি সম্পর্কে সবাই জানতে পারেন। কারণ রোগের ওষুধ দিতে হলে রোগ সম্পর্কে আগে জানতে হয়। ২০২০ সালের আগস্ট থেকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন খান মোহাম্মদ মইনুল। তিনি বলেন, ইতিপূর্বে যারা ম্যানেজমেন্টে ছিলেন তারা সব সময়ই এই বিয়ষগুলো গোপন রাখতেন। তবে আমরা চাচ্ছি সঠিক বিষয়টি তুলে ধরতে। আগের ম্যানেজমেন্ট মিথ্যা তথ্য দিয়ে আত্মতুষ্টিতে থাকতেন। যে লোন আমাদের রিকভারি হওয়ার কথা, কিন্তু অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা রিকভারি না করে বিভিন্নভাবে ছলচাতুরি করে তারা এতদিন চলেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি যে সমস্যার মধ্যে রয়েছে, আমরা চাচ্ছি সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে। তিনি বলেন, আমরা এখন বড় বড় অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে কিছু নিলাম বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছি। কোনোক্রমেই তাদের কাছ থেকে আমরা টাকা আনতে পারছিলাম না। এই অবস্থায় আমরা গত শুক্রবার একটি নিলাম দিয়েছিলাম। এই ৫ দিনে তারা আমাদের ৯০ লাখ টাকা জমা দিয়ে গেছি। এভাবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা টার্গেট দিয়ে কাজ করছি। এই বছরে আমরা আমাদের কর্মকর্তাদের ২০০ কোটি টাকার একটা টার্গেট দিয়েছি। এই বছরের মধ্যে আমরা যদি ১০টি ক্লাসিফাইড লোন উদ্ধার করতে পারি তাহলে আমাদের এনপিএল কমে যাবে। তখন আমাদের লাভের পরিমাণও বাড়বে।
আভিভা ফাইন্যান্স: আভিভা ফাইন্যান্সের ২০২১ সালে এনপিএল ছিল ৬৯৬ কোটি টাকা, যা তার মোট বকেয়া ঋণের ২৬ শতাংশ। এখন তাদের ২৫.৩০ কোটি টাকার প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। আর ২০১৯ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের মন্দ ঋণ ছিল ৫৮৩ কোটি টাকা।
প্রাইম ফাইন্যান্স: প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কিছুটা উন্নতি দেখিয়েছে। এর এনপিএল সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ ১৫৬ কোটি টাকা থেকে ১২৬.৩২ কোটি টাকায় নেমে এসেছে।
ফারইস্ট ফাইন্যান্স: ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের নন পারফর্মিং লোন ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৮৭২ কোটি টাকা। যা তার মোট বিতরণ করা ঋণের ৯০ শতাংশ। সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত তাদের মন্দ ঋণ ছিল ৪০৬ কোটি টাকা।
প্রিমিয়ার লিজিং: প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সের মন্দ ঋণ ২০২১ সালে ছিল ৬১৭.৫৭ কোটি টাকা, যা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ৪২৪ কোটি টাকা। এর পরিমাণ ছিল তার মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪৬.৩৫ শতাংশ। এতে তারা ১৪১ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতির সম্মুখীন হয়। সূএ:মানবজমিন