সুলেখা আক্তার শান্তা : ও বাবা, কাঁদো না, কাঁদো না। এই তো আমরা এসে পড়েছি। বাচ্চাটা অস্থির হয়ে পড়েছে। ঢাকার বাসে প্রচণ্ড ভিড়। লোপা বাসের সিটে বসে থাকলেও, দাঁড়ানো যাত্রীদের হট্টগোলে বাসের ভেতর কান ফাটানো শব্দ হচ্ছে। সে হেলপারকে ডাকে, এই ভাই, শাহবাগ আসছে?
হেলপার এত যাত্রী সামলাতে ব্যস্ত যে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। পাশের সিটে বসে থাকা এক নারী জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় যাবেন?
পি.জি. হাসপাতালে।
আচ্ছা, আমিও যাচ্ছি। এর আগে গেছেন?
না।
চিন্তা করবেন না, চলুন আমার সঙ্গে। মেয়েটির নাম জলি। অচেনা এই শহরে একজন সঙ্গী পেয়ে লোপার মনে স্বস্তি এলো। পি.জি.তে পৌঁছে, জলি নিজে টিকিট, সিরিয়াল, সব করে দিলো। এমনকি টাকাটাও নিজে দিলো। লোপা বারবার না করল, আপু, এত কিছু করতে হবে না। কিন্তু জলি শুনল না। ডাক্তার দেখানোর পর, প্রেসক্রিপশনের ওষুধের লিস্ট দেখে জলি ওষুধ কিনে দিতে চাইল। লোপা বলল, না না আপু, অনেক করেছেন আপনি। আর কিছু লাগবে না।
পথে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে জলি বলল, আপু, চলেন বাচ্চাটাকে আর আপনাকে নাস্তা করাই।
না আপু, বাসায় গিয়ে খাবো।
জলি জানতে চাইল, আপার বাসা কোথায়?
মিরপুর।
আপনি চিনে যেতে পানবেন?
হ্যাঁ।
চিন্তা করবেন না, আমি আপনাকে দিয়ে আসব আপনার বাসায়।
জলি জিজ্ঞেস করে লোপাকে আপু, আপনার স্বামী?
লোপা হালকা হাসি বলে, বলা যায় নিরুদ্দেশ! কোথায় যায়, কোথায় থাকে, আমি তার কিছুই জানি না। জলি চমকে তাহলে চলেন কিভাবে? লোপা বলে, কয়েকটা মেয়ে রাখি। ওদের আমি রান্নাবান্না করে খাওয়াই। এভাবেই চলে। জলি আসছে তো লোপার বাসায় আসছেই যাওয়ার আর নাম নেই। কয়েকদিন হয়ে যায় জলি আর যাচ্ছে না। লোপাও বেশ খাতির যত্ন করে। জলি বলে, আপু, আপনি তো মেয়ে রাখেন। ওরা কেমন? ওরা আমার মতোই। কেউ স্বামীহীন, কেউ সংসার ভেঙে এসেছে। কিন্তু সবাই বাঁচতে চায়। আমি যতটা পারি, খাতির যত্ন করি। জলি চোখে অশ্রু আমি আপনাকে একটু সাহায্য করতে চাই। আপনি একা একা এইভাবে দিন পার করছেন।
লোপা হালকা গলায়, সাহায্য! এই শহরে একা থাকা মানে প্রতিদিন যুদ্ধ। কেউ পাশে থাকলে যুদ্ধটা একটু সহজ হয়। জলি বলে আপু, রান্নাবাড়া এইসব কাজ করতে আপনার তো অনেক কষ্ট হয়! তার চেয়ে আপনি আপনার মেয়েদের উঠিয়ে দেন। আমি এক রুমের ভাড়া দিব, খাবারের টাকাও দেব। আপনার তাতে কষ্ট হবে না। লোপা চোখে স্থিরতা, এই মেয়ে কয়টা থাকে অনেক কয়েক বছর ধরে। আমার সুখ-দুঃখের সঙ্গে এরাই সাথী। এদের আমি তাড়িয়ে দেবো? জলি চুপ থেকে কিন্তু আপনার তো কষ্ট হয়! লোপা নরম গলায় বলে, এই মেয়েগুলোর জন্য তিন বেলা রান্না করতে হয় ঠিকই। কিন্তু ওরা আমাকে একা থাকতে দেয় না। ওদের হাসি, কান্না, গল্প সব মিলিয়ে আমার জীবনের মতো। টাকার চেয়ে বড় তো সম্পর্কের বন্ধন। জলি নিমগ্ন আপনি সত্যিই আলাদা মানুষ, আপু। লোপা হালকা হাসি আমি শুধু যতটুকু পারি, ততটুকু করি। জলি নরম গলায়, আপু, আপনি চাইলে আমি সব দায়িত্ব নিতে পারি। ভাড়া, খাবার, খরচ সব আমি দেব। আপনি একটু বিশ্রাম নেন। লোপা একটু থেমে, মুখটা মলিন করে এই মেয়ে গুলোর সঙ্গে আমি একটা মায়ার বন্ধনে আটকে গেছি। ওরা আমার জীবনের অংশ। ওদের আমি কী করে না বলব, আমি বুঝতে পারছি না। জলি চুপচাপ থেকে বলে, আপনি তো নিজের কষ্টের কথাও ভাবেন না? লোপা চোখে অশ্রু, কষ্ট তো আছে, কিন্তু এই সম্পর্কগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। ওদের হাসি, ওদের গল্প, ওদের দুঃখ সব আমার নিজের হয়ে গেছে। জলি নিমগ্ন বলে, তাহলে আমি থাকি, আপনার পাশে। এই মায়ার বন্ধনে আমিও একটু জায়গা চাই।
লোপা জানালার পাশে বসে ছিল। বিকেলের আলো তার মুখে পড়ছিল, কিন্তু চোখে ছিল এক ধরনের অস্থিরতা। হঠাৎ দরজার সামনে একটা ছায়া, দেখে তার স্বামী রাসেল। সে হঠাৎ কোথা থেকে এসে হাজির! লোপা চমকে উঠে বলল, তুমি কোথায় যাও, কী করো? কিছুই তো আমাকে জানাও না। রাসেল একটু থেমে, ক্লান্ত গলায় বলল, আমি যে তোমাকে জানাবো, তেমন তো কিছু জানতে ইচ্ছা করে না। আমার মনটা যেন কেমন, কী করতে চায় মন সেটাও আমি জানি না। লোপার চোখে পানি এসে গেল। তুমি আমাদের কথা ভাবো না? আমাকে আর তোমার ছেলেকে রেখে চলে যাও, কখনো মনেও পড়ে না? রাসেল নরম গলায় বলে, পড়ে মনে।
রাসেল বাজার করে এনেছে, যেন কিছুটা দায়বদ্ধতা দেখাতে চায়। লোপা রান্না করে, রান্না শেষে খাওয়া শুরু হয়। জলি নিজেকে লোপার বোন বলে, নিজে থেকেই আলাপ করে রাসেলের সঙ্গে। দুলাভাই, আমি হচ্ছি আপার বোন। রক্তের সম্পর্ক না হলেও, সে আমার রক্তের চেয়ে বেশি আপন। আমি এক রুম ভাড়া নিছি। আপার জন্য চিন্তা করবেন না। টাকা-পয়সা লাগলে আমি দেব। আমার স্বামীর অনেক টাকা।
রাসেল চুপচাপ, খেতে থাকে।
লোপা বলে জলিকে আগে খেয়ে নিন, কথা পরে বলা যাবে।
রাসেল লোপাকে বলে, তুমি একে চেনো?
লোপা শান্তভাবে হ্যাঁ, আমি চিনি। কিছুদিন আগে পরিচয় হয়েছে।
রাসেল অসন্তুষ্ট এইভাবে একজনকে না চিনে বাসায় এনেছো? লোপা নরম গলায় তুমি হতাশ হয়ো না! মেয়েটা ভালো। কথা একটু বেশি বলে, কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই। রাসেল বলে, আমি থাকি না, কখন চলে যাই তার ঠিক নেই। সাবধানে থেকো।
পরদিন সকাল। রাসেল চলে গেছে, কিছু না বলে। লোপা বলে চলে গেছে যাক। শুরু থেকেই এমন। আসে আবার চলে যায়।
জলি একদিন হঠাৎ করে একজন অচেনা পুরুষকে সঙ্গে করে লোপার বাসায় নিয়ে আসে। এসে লোপার দিকে তাকিয়ে বলে, আপু, একটা কাজের জন্য আপনার সাহায্য দরকার।
লোপা একটু অবাক হয়, কী সাহায্য করতে পারি আমি?
জলি কিছুটা জড়সড় হয়ে বলে, আপু, আমার ভাইয়ের সামনে শুধু বলবেন আপনি আমার কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকা ধার নিয়েছেন। ব্যস, আর কিছু না। লোপা বিস্মিত হয়ে তাকায়, আমি? আমি কখন তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি!
না না, আসলে আপনি নেননি ঠিকই, কিন্তু বললেই হবে। আপনি বললে বাকিটা আমি সামলে নেব। আপনার কোনো ক্ষতি হবে না, কথা দিচ্ছি। লোপা দ্বিধায় পড়ে যায়। এমন একটা বড় মিথ্যে সে বলতে চায় না, কিন্তু জলির কাকুতি-মিনতি, ভরসার ভঙ্গি দেখে সে একবার ভাবে আমি শুধু বললেই যদি এতে তার উপকার হয়। অবশেষে সে রাজি হয়। ঠিক আছে, বলব, তবে কোনো বিপদ যেন না হয়।
সেদিন সন্ধ্যায়, জলি, তার ভাই দবির এবং লোপা একসঙ্গে বসে। হঠাৎ জলি শুরু করে, ভাইয়া, আপু আমার কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকা ধার নিয়েছে। সে অসহায় ছিল, তাই আমি তাকে সাহায্য করেছি। এমনকি আমি বাসার ভাড়াটাও দিচ্ছি একা। তারপর সে লোপার দিকে তাকিয়ে বলে, বলেন না আপু, সত্যি তো?
লোপা একবার চমকে যায়! কথা ছিল শুধু টাকার কথা, এখন বাসাভাড়ার প্রসঙ্গও জুড়ে দিল! তবু পরিস্থিতি সামাল দিতে সে মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, আমি ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। দবির একটু গম্ভীর গলায় বলে, আপনি জানেন তো, আমার বোন এই টাকা অনেক কষ্টে জোগাড় করেছে। তাই দয়া করে কিছুদিনের মধ্যে ফেরত দেবেন। লোপা বলে, দেব, অবশ্যই দেব।
কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই, জলি প্রতিদিন লোপার পেছনে লেগে যায়, আপু, আমার টাকা দেন। টাকা! আমি তো আপনার উপকার করলাম, এখন আপনি আমার উপকার করেন টাকা দিয়ে!
একসময় বিরক্ত, হতাশ লোপা বলে ফেলে, তুমি তো জানো আমি কিছু নিইনি। শুধু তোমার কথায় হ্যাঁ বলেছিলাম। এইভাবে প্রতিদিন এককথা বলবে না! জলি তখন রেগে গিয়ে বলে, আপনি টাকা নিয়েছেন, আপনার মুখেই তো বলছেন। বলছিলেন না আপনি বাসাভাড়ার ও টাকা নিয়েছেন? এরপর ঘটে সেই ঘটনা, যা লোপার দুঃস্বপ্নেও ছিল না।
জলি ও তার ভাই যেদিন কথা বলছিল, সেদিন তারা গোপনে ভিডিও করেছিল লোপার কথাগুলো। সেই ভিডিওতে দেখা যায় লোপা নিজেই বলছে, হ্যাঁ, আমি দুই লক্ষ টাকা নিয়েছি। ও বাসার ভাড়া দিচ্ছে। ভিডিওটা দেখাতে থাকে আশেপাশের মানুষকে, আত্মীয়স্বজনকে। চাপ আসে চারপাশ থেকে। আপনি নিজেই তো বলছেন আপনি টাকা নিয়েছেন। যতই অস্বীকার করেন, ভিডিও তো আছে! লোপার সামনে তখন দুটো পথ, এক, লড়াই করা। দুই, মানসম্মান রক্ষার জন্য চুপচাপ টাকা দিয়ে দেওয়া। কিন্তু লড়াই করার মতন অর্থ নেই, সমর্থন নেই, সাহসটাও নেই তখন আর। একসময় বাধ্য হয়ে সে নিজের দেশের জায়গা বিক্রি করে সেই টাকা জোগাড় করে দেয়। বাসাটাও ছেড়ে দিতে হয়। জীবনটা এলোমেলো হয়ে যায়।
টাকা হস্তান্তরের দিন, জলি তার দিকে এমনভাবে তাকায়, যেন কোনও অপরাধ করেনি সে। অন্যদিকে লোপা, চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। তার কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে ওঠে, তোমার জন্য আমি সব হারালাম। আমি তো শুধু তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম! জলি ঠান্ডা গলায় বলে,বিশ্বাস আর টাকা দুটোতেই হিসাব রাখতে হয়। সেখানে কেউ আপন হয় না। লোপা বলে, হ্যাঁ ঠিক বলেছো। তবে পৃথিবীর সব মানুষ এক নয়।
লোপার জীবনে এই ঘটনা একটা শিক্ষা রেখে যায়, তবে সব মানুষ এক নয়। আর সব সাহায্যই উপকার নয়। ছলনাময় মানুষ কখন যে আপনার দুর্বলতাকে অস্ত্র বানিয়ে ধ্বংস করে দেবে, আপনি টেরই পাবেন না।
Facebook Comments Box