২০১২ সালে বাবাকে হারিয়েছেন মো. কবির আহমেদ। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর তার বাবা বেঁচে ছিলেন ২ বছর। এই ২ বছরে পরিবারের সঞ্চয় থেকে শুরু করে বিক্রি করতে হয়েছে পৈতৃক বাড়িও। যার রেশ বয়ে বেড়াচ্ছেন সন্তানরা। রংপুরে বাবার মৃত্যুর পর পরই ঢাকায় চলে আসতে হয় তাদের। তার ছেলে শান্ত বলেন, বাবার ব্যবসায় যা সম্বল ছিল সব খরচ হয়ে যায়। এরপর বাড়ি বিক্রি করতে হয় ৬ লাখ টাকায়। সেটাও খরচ হয়ে যায়।
বাবার মৃত্যুর পর দেনা শোধ করতে রংপুরের কিছু আবাদি জমি ছিল সেটাও বিক্রি করতে হয়েছে। এখন আমরা আবাসহীন।
তিনি আরও বলেন, বড় ভাই এইচএসসি পাসের পর আর লেখাপড়া করতে পারেনি। আমি অনার্স পড়ছি, পাশাপাশি বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। মাকে নিয়ে একটা বাসা ভাড়া করে ঢাকায় থাকি। একমাত্র বোনের বিয়েটাও ভালোভাবে দিতে পারিনি। আমার এক কাজিনের বিবাহ বিচ্ছেদের পর বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে হয়।
১০ বছর আগের চিকিৎসা ব্যয়ে নাকাল পরিবারটি। কবিরের চিকিৎসা করানো হয় রংপুর, ঢাকা ও ভারতে। বর্তমানে এই চিকিৎসা ব্যয় আরও আকাশচুম্বী হয়েছে। গাইবান্ধা শহরে অটোরিকশা চালান মো. জয়নাল আবেদিন। সম্প্রতি তার স্ত্রী হঠাৎ পেটের পীড়ায় ভোগা শুরু করেন। তাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। জয়নাল জানান, প্রথমে ১০ টাকা টিকিটে স্ত্রীকে দেখানোর পর ওষুধ দেন কিছু। এরপর পেটের ব্যথা বাড়লে হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে সন্তুষ্ট না হওয়ায় নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানে এসে ধরা পরে তার পেটে পাথর জমেছে। অস্ত্রোপচার হয় তার। এখানে থাকেন ৮ দিন।
তিনি বলেন, সামান্য ওষুধ হাসপাতালে পেয়েছি। বাকি সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। আবার পরীক্ষা করাতে হয়েছে বাইরে থেকে। সব মিলিয়ে আমার ৪০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। এলাকা থেকে ১০ হাজার টাকার মতো সহযোগিতা পেয়েছি। বাকি টাকার জন্য একটা জমি বিক্রি করতে হয়েছে ৫০ হাজার টাকায়। আমার আবাদি জমি ২টা। বাড়ির কাছের এই জমিতে শাক আবাদ করে খেতাম। বিক্রিও করতাম। এখন কিনে খাওয়া লাগে। আমার তিন ছেলে- ভাবছিলাম তিন জনকে তিনটা জমি দেবো। এখন সে সুযোগ আর থাকলো না।
গেল বছরে ‘নিজ পকেট থেকে গৃহস্থালি ব্যয় সংকোচনের কৌশল’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয় দেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেয়া ৯৭ শতাংশ রোগীই ওষুধ পান না। চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধ তাদের কিনতে হয় বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে। একইভাবে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষাই রোগীকে করতে হয় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। এর ফলে বেড়ে যায় রোগীর চিকিৎসা ব্যয়। বিশেষ করে ক্যান্সার, কিডনি ডায়ালাইসিস ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় নিঃস্ব হয়ে যায় রোগী। প্রতি বছর এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েন ৮৬ লাখ মানুষ। একইসঙ্গে এই অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে দেশে চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত থাকে ১৬ শতাংশ রোগী।
চলতি বছরের ২রা এপ্রিল বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ আয়োজিত ‘স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বিকাশ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, চিকিৎসা খরচের ৬৭ ভাগের বেশি ব্যক্তির পকেট থেকে যাচ্ছে। দেশে চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না। কিছুদিন পর পর গণমাধ্যমে অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে চলমান ভঙ্গুর অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।
করোনাকালে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হাঁপিয়ে উঠেছেন অনেকেই। করোনায় বাবা ও নানাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়িয়েছেন ঐশী রহমান। রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী বলেন, বাবা যখন করোনা আক্রান্ত হলেন তখন আমরা দিনাজপুরে। শারীরিক সমস্যা বাড়তে থাকে। এরপর বাবাকে নিয়ে আসি ঢাকা মেডিকেলে। দিনাজপুর থেকে এম্বুলেন্স ভাড়া গুনতে হয় ১৮ হাজার টাকা। এরপর ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউতে সিট নেই। বাবার শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। এরপর অনলাইনে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনি ২২ হাজার টাকায়। রিফিল করতে হয় ৩ হাজার টাকায়। একদিন সেখানেই কেটে যায়। এ পর্যন্ত আমাদের খরচ হয় প্রায় এক লাখ টাকা। এরপর আইসিইউ বেড না মেলায় আমরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাই। সেখানে প্রতিদিন সব মিলিয়ে গুনতে হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। আর ওষুধ ও আমাদের খরচ মিলিয়ে আরও প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। বাবার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এভাবে ১২দিন পর বাবা মারা যান। মারা যাওয়ার আগে একটা ইনজেকশন দিতে হয় যেটার দামই ছিল ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে বাবার পেছনে আমাদের খরচ হয় সাত থেকে আট লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, এই টাকার জোগানের জন্য পাঁচ লাখ টাকা ধার করতে হয়। এই ধারের সুদ মেটাই আমরা প্রায় বছরখানেক। ভাইয়া প্রথমে বাইক বিক্রি করেন। এরপর আমরা হিসাব মেলাই এই সুদের টাকা শোধ করতে গেলে আসল টাকার জোগান দেয়া যাবে না। তাই মায়ের গহনা ও আমাদের গ্রামের বাড়ির জায়গা বিক্রি করে দেই।
শুধু তাই নয়, সাধারণ সমস্যা নিয়ে গেলেও মানুষের ভোগান্তির অন্ত থাকে না। সাধারণ সমস্যায় ফার্মেসিতে যাওয়াটাকেই প্রাধান্য দেন অনেকেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জিসান আহমেদের সম্প্রতি শরীরে ফোঁড়া উঠেছিল, সেই সঙ্গে ছিল জ্বর। তিনি বলেন, ফার্মেসিতে ওষুধ দিয়েছিল কিন্তু তা না খেয়ে যাই একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে ৪টি টেস্ট দেয়া হয় আমার। এরপর ফার্মেসি থেকে যে ওষুধ দিয়েছিল সেটিই তারা দেয়। এতে আমার প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হয়। পরীক্ষা করানো ভালো আমি যেহেতু ডাক্তার না তাই ভালো মন্দও বুঝবো না কিন্তু এতগুলো টেস্ট করানোটা কতোটুকু যৌক্তিক?
এসবের পাশাপাশি আছে পরীক্ষা করানোর ব্যয়। রাজধানীর একটি স্বনামধন্য হাসপাতাল থেকে হৃদ রোগের চিকিৎসা করিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। তার ১১ বছর পূর্বে ওপেন হার্ট সার্জারি করানো হয়েছিল। এরপর প্রতি বছরই করানো হয় পরীক্ষা। ১১ বছর আগে এনজিওগ্রাম করানোর ফি ছিল ১৫ হাজার টাকা। এখন সেটি হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও প্রতি বছরের চিকিৎসক দেখানোর আগে তার করাতে হতো ৬টি পরীক্ষা। ২০১৫ সালে এই পরীক্ষার জন্য লাগে ৬ হাজার ২৫০ টাকা। ২০১৬ সালে ৬ হাজার ৮৫০ টাকা। এরপর যথাক্রমে বাড়তে থাকে। ২০২১ সালে লাগে ৮ হাজার ৮৯০ টাকা ও এবছর লাগে ১০ হাজার ২২৫ টাকা। একইভাবে বেড়েছে ওষুধের দাম। ১১ বছর আগে মাসে ওষুধের পেছনে তার মাসে খরচ হতো প্রায় ১ হাজার টাকা। একই ওষুধ এখন তার কিনতে খরচ হয় ১ হাজার ৭০০ টাকা।
‘নিজ পকেট থেকে গৃহস্থালি ব্যয় সংকোচনের কৌশল’ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চিকিৎসা খাতে রোগীর পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় বাংলাদেশে। এ ক্ষেত্রে একেকজন রোগীকে চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫০ শতাংশ খরচ করতে হয় নিজেদের। ভারতে এই হার ৬৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে ৫১ শতাংশ, মালদ্বীপে ২১ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ভুটানে ১৩ শতাংশ।
গবেষণায় আরও বলা হয়, দেশে মাত্র তিন শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল থেকে ?ওষুধ পান। ফলে অধিকাংশ রোগীকে বেসরকারি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে হয়। মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে হয়ে থাকে। বাকিদের বিভিন্ন বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সেবা নিতে হয়। এতে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।
প্রায়শই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে গণমাধ্যমে দেখা যায় চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য সাহায্যের আবেদন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনলাইনে একজন কিডনি ডায়ালাইসিস রোগীর সাহায্যের আবেদনের সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। তার মেয়ে সানজিদা আক্তার জানান তার ভাই সে বছরের ৯ই ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বলেন, আমাদের প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করানো হয়েছে। কিন্তু ভাইকে বাঁচাতে পারিনি। ভাইয়ের শোকে মাও অসুস্থ। বাবা মারা গেছেন অনেক আগে। ভাইয়ের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে আমাদের পরিবার নিঃস্ব প্রায়। এখনো ঋণ আছে প্রায় তিন লাখ টাকা। অনেকেই সাহায্য করেছেন। প্রায় ৩ লাখ টাকা এসেছিল সাহায্য থেকে।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করোনার পরেও এত অর্থ খরচ হয়েছে। প্রতিটি ডায়ালাইসিসের সময় ওষুধ লাগতো কয়েক হাজার টাকা করে। সরকারি হাসপাতালে কোনো ওষুধ পাই নাই। কেন পাবো না আমরা কি দেশের নাগরিক না? সূএ: মানবজমিন