তসলিমা নাসরিন: বাংলাদেশ কেন বার বার আগুনে পুড়ছে? বাংলাদেশের দালানকোঠায়, দোকানপাটে, কলে, কারখানায়, আড়তে, গুদামে ক’দিন পর পরই আগুন লাগে। ক’দিন আগে সীতাকুন্ড উপজেলার কদমরসুল এলাকায় একটি কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণ ঘটে। কমপক্ষে ৪১ জন নিহত, এবং ৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ছিল এবং তা আগুন নিয়ন্ত্রণে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। সড়ক দুর্ঘটনায়, লঞ্চডুবিতে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে নিয়মিত। মানুষের মৃত্যুর চেয়ে সহজ বোধহয় আর কিছু নেই। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয়। অসুখে অভাবে মানুষ মরছে। ক্যান্সার এখন ঘরে ঘরে। নিউইয়র্কের স্লোন কেটেরিং ক্যান্সার হাসপাতাল নতুন একটি ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার করেছে। রেকটাল ক্যান্সার সেই ওষুধে সেরে গেছে। ওষুধ বলতে ইমিউনোথেরাপি। শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর ওষুধ। যদি এই আবিষ্কার শেষ অবধি সফল হয়, শুধু রেকটাল নয়, অন্য ক্যান্সারও এই ইমিউনোথেরাপিতে সেরে যায়, তাহলে তো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা মানবজাতির বিরাট একটি উপকারই করবেন। হৃদরোগও আমাদের ঘরে ঘরে। সঙ্গীতশিল্পী কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ তাঁর হৃদরোগের বুক-ব্যথাকে অ্যাসিডের ব্যথা বলে অ্যান্টাসিড খেতেন। মঞ্চে যখন ভক্তকুলের আনন্দধ্বনি শুনে তিনি আবেগে উত্তেজিত, তাঁর ধমনীর রক্ত তখন প্রবল বেগে বইতে থাকে, সেই বেগে ধমনীর দেয়ালে জমে থাকা প্লেক হৃদপিন্ডে গিয়ে হৃদপিন্ডের ধমনী আটকে দেয়, রক্তচলাচল বন্ধ হয়ে যায় হৃদপিন্ডে। কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ বা কেকেই যদি সমাজের উচ্চশ্রেণিতে বাস করে নিজের হৃদরোগের ব্যাপারে অজ্ঞ রয়ে যান, তখন কল্পনা করতে পারি কত সহস্র লোক এমন অজ্ঞতার অন্ধকারে বাস করছেন। আগুন যেন না লাগে কোথাও, সড়ক দুর্ঘটনা যেন আর না হয়, রেল দুর্ঘটনা, বাস খাদে পড়া, লঞ্চ বা নৌকোডুবি যেন না হয়, বন্যা, খরা এবং নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় যেন না রাখা হয়, অযথা অকালে মানুষের যেন মৃত্যু না হয় তার ব্যবস্থা করা যেমন আমাদের হাতে, নানা অসুখ বিসুখে অকালমৃত্যু থেকে বাঁচাও অনেকটা আমাদের হাতে। জীবনের নিরাপত্তা যে অঞ্চলে নেই, সে অঞ্চলকে উন্নত বলা ঠিক নয়। রাজকোষে অঢেল টাকা থাকলেও, মানুষের মাথাপিছু আয় অঢেল হলেও বাংলাদেশকে আমরা উন্নত বলতে পারবো না, যতক্ষণ না প্রতিটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, গণতন্ত্র সবল হয়, নারীরা সমানাধিকার পায়, সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো সমান সুবিধে পায়, সবার জন্য স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা নিশ্চিত হয়, দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়।
কুসংস্কারে সমাজ ডুবে আছে। ধর্মান্ধতায় ডুবে আছে সমাজ। যুক্তির কোনও কদর নেই। যুক্তিবাদিরা সমাজে ব্রাত্য। তারপরও আশা জাগে নিজেদের স্বার্থেই মানুষ একদিন কুসংস্কারের অন্ধকার সরিয়ে আলোর পথে যাত্রা করবে, নিজেদের স্বার্থেই ধর্মান্ধতা থেকে নিজেদের মুক্ত করবে।
৩. ভারতের টাকায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ছবি, বাংলাদেশের টাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, ইংল্যান্ডের টাকায় রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবি। দেখতে দেখতে বোর হয়ে গেছি। এবার নাকি ভারতের টাকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং আরও ক’জন গুণী ব্যক্তিত্বের ছবি থাকবে। চমৎকার আইডিয়া। রাজা রানির স্থান দখল করেছে জাতির পিতা বা মাতা। সভ্য দেশে রাজা রানি যেমন থাকতে নেই, জাতির পিতা বা মাতাও থাকতে নেই। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণই জাতির পিতা মাতা থেকে শুরু করে নাতি পুতি পর্যন্ত। দেশের প্রতিভাবান শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিকের ছবি বা দেশের মুখ উজ্জ্বল যাঁরা করেছেন, তাঁদের ছবিই তো থাকা উচিত টাকায়। কেউ কেউ বলবেন অর্থের সঙ্গে তাঁদের কী সম্পর্ক। অর্থের সঙ্গে না থাক সম্পর্ক, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ প্রতিদিন নমস্যদের স্মরণ করবে, ব্যাপারটিই তো অর্থপূর্ণ।
৪. গতকাল সুইডেনের ন্যাশনাল দিবস ছিল। এই দিবসের কোনও মানে নেই। অনেক দেশে জাতীয় দিবস আছে, শুধু তাদের দেশে নেই, এ তো ঠিক নয়, এই ভেবে কিছু সুইড জাতীয় পতাকা দিবস বানালো, ওই জাতীয় পতাকা দিবসের নামই এখন জাতীয় দিবস। ঠিক রাজার মতো, এত দেশে রাজা আছে, কিন্তু সুইডেনে কেন রাজা নেই, এই ভেবে কিছু সুইড ফ্রান্স থেকে নেপোলিয়নের এক জেনারেলকে ধরে নিয়ে এসে সুইডেনের রাজা বানিয়েছিল। সেই থেকে সুইডেনে রাজা রানি চলছে। চরম গণতন্ত্রের দেশে পুতুল রাজা রানি দিব্যি আছেন। জাতীয় দিবসে ঘোড়ার গাড়িতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-নাতি-নাতনিসহ চড়ে শহর ঘোরেন রাজা।
কিছু সুইড পতাকার রঙের বেলুন ওড়ায়, আর মদ খেতে খেতে নাচে। বেশির ভাগ সুইডের এই দিবস নিয়ে কোনও আবেগ নেই। জাতীয় দিবস টিবস আমিও পছন্দ করি না। এসব দিবস জাতীয়তাবাদিদের উত্তেজিত করে। ইউরোপ জানে জাতীয়তাবাদিরা কী ভয়ংকর হতে পারে! নাৎসিদের বীভৎসতা আর কেউ ভুললেও ইউরোপ ভুলবে না।
৫. বাংলার- দুই বাংলারই মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেরা একেকটা স্পয়েল্ট ব্র্যাট। শুধু বাংলাই বা বলি কেন, পুরো ভারতবর্ষেই, বা ভারতীয় উপমহাদেশেই দেখছি একই ঘটনা। সন্তানদের, মূলত ছেলেদের, সুস্থ স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠতে দেন না বাবা-মা। শুরু থেকেই পরনির্ভর বানান। পঙ্গু বানান। সংসারের কোনও কাজ করতে ছেলেদের শেখান না। দুনিয়ার বাস্তবতা থেকে ওদের দূরে সরিয়ে রাখেন। নিজের ঘর নিজে গুছিয়ে রাখা, নিজের জামা কাপড় পরিষ্কার রাখা, ইস্কুলের জন্য নিজে নিজে তৈরি হওয়া, নিজের খাবার নিজে বানাতে শেখা, সময়মতো খাবার খেয়ে নেওয়া, নিজের এঁটো বাসনপত্র ধুয়ে রাখা, দায়িত্ববান হওয়া, বাড়ির টুকটাক কাজ করা- না, এসব কিছুই ছেলেকে করতে দেবেন না বাবা-মা। ছেলেকে স্বনির্ভর হতে দিতে নারাজ তাঁরা। ব্যাবহারিক জ্ঞান বাড়ানোর জন্য কোনও উৎসাহই দেন না। ছেলে যা চায়, যে জিনিসই চায়, তাই দেবেন বাবা মা, যে করেই হোক দেবেন, সাধ্যের বাইরে হলেও দেবেন। না চাইতেই দেবেন। কলকাতার অনেক পরিবারে দেখেছি ছেলের চৌদ্দ পনেরো বছর বয়স হয়ে গেলেও বাবা-মা ছেলের জন্য আলাদা ঘর বা আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করেন না, নিজেদের বিছানাতেই ছেলেকে ঘুমোতে দেন। এমন ভাবে মা-নির্ভর হয়ে ওঠে ছেলেরা যে বিয়ের পর বিবাহিত হয় বটে, বড় হয় না। যত পুরুষ দেখি চারদিকে, সব পুরুষই পরনির্ভর। হয় বাবা-মার ওপর নির্ভরশীল, নয়তো স্ত্রীর ওপর। বাবা-মার ওপর নির্ভরশীল ছোটবেলায় সকলেই থাকে। কিন্তু তারপর তো ধীরে ধীরে বড় হয়, পৃথিবীর পথে একা চলার জন্য প্রস্তুত হয়। আমাদের অঞ্চলের ছেলেদের এই প্রস্তুতি নেওয়া হয় না। তাদের কখনও সত্যিকার অর্থে স্বাবলম্বী হওয়া হয় না। যে বয়সে পাশ্চাত্যের ছেলেরা ব্যাকপ্যাক নিয়ে পৃথিবী আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়ে, সে বয়সে আমাদের বাঙালি ছেলেরা মা খাইয়ে না দিলে নিজের হাতে ভাতটাও খেতে পারে না।
স্পয়েল্ট ব্র্যাটগুলোর প্রশংসায় পঞ্চমুখ বাবা-মা। ছেলে কাঁটা বেছে মাছ খেতে জানে না, জলটাও গ্লাসে ভরে খেতে জানে না, জুতোর ফিতে বাঁধতে জানে না, নিজের বিছানাপত্তর গুছিয়ে রাখতে জানে না- এ নিয়ে অস্বস্তি হওয়ার বদলে বাবা-মা’র স্বস্তি হয়। ছেলেকে নিজেদের ওপর নির্ভরশীল বানানোর বড় মওকা পেয়ে যান তাঁরা। তাঁরা কি সত্যিই সন্তানদের ভালোবাসেন?
মনে আছে একবার ভালো ছাত্র নামধারী বাংলাদেশের কিছু ছেলের ভয়ঙ্কর অজ্ঞতার নমুনা টিভিতে প্রচার হয়েছিল। এ নিয়ে টিভির বিরুদ্ধে মানুষের সে কী প্রতিবাদ! সকলেই ছেলেগুলোর পক্ষ নিয়েছে। যত ভুলই ছেলেরা করুক, তাদের কটাক্ষ করা যাবে না। যত হাস্যকর উত্তরই ছেলেরা দিক, হাসা নৈব নৈব চ। যত অন্যায়ই ওরা করুক, প্রতিবাদ করা যাবে না। ওরা ছেলে। ওরা পুত্রধন। ওরা ভগবান। ওদের কোমল হৃদয়, কটাক্ষ করলে ওদের কষ্ট হবে, অভিমান হবে। ওরা ছাত্র। পরীক্ষা দিয়েছে, পাস করেছে। এ কী কম কথা! ওরা মহান। ওরা বিশাল। ওরা গুষ্ঠি উদ্ধার করেছে। না, এভাবে ছেলেরা আর যাই হোক, মানুষ হয় না। হয়তো পরীক্ষায় ভালো নম্বর পায়, চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য জুটিয়ে ফেলে কিছু, কিন্তু জীবনের অনেক প্রশ্নে অজ্ঞ আর অশিক্ষিতই থেকে যায়।
৬. যদিও সাংবাদিকদের বাক স্বাধীনতার পক্ষে আমি ঝড় বাদল তুচ্ছ করে দাঁড়াই, সাংবাদিকদের বড় একটি অংশ কিন্তু আকাট মূর্খ অথবা মহা ধুরন্ধর। আঠাশ বছর আগে বাংলাদেশের সরকার আমাকে দেশ থেকে জোরপূর্বক বের করেছে এবং আজও দেশে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না, সব জানার পরও আমাকে নিয়ে খবর করতে গিয়ে আমার নামের আগে লেখে- স্বেচ্ছানির্বাসিত, সেলফ-এক্সাইল্ড। কখনও কোনও গ-মূর্খ এই শব্দটি আমার নামের আগে বসিয়েছিল হয়তো, সেই থেকে তার উত্তরসূরিরা কপি করে চলছে। আরও একটি কপির ব্যাপার আছে। সেটি হলো, বাংলাদেশের মৌলবাদিরা তান্ডব করেছিল দেশজুড়ে, লক্ষ মৌলবাদি আমার ফাঁসির দাবিতে মিছিল করেছিল দিনের পর দিন, সব নাকি ‘লজ্জা’ লিখেছি বলে। বাংলাদেশেরই সাংবাদিক, অথচ কী ভুল তথ্য! তারা জানে না যে প্রকাশ হওয়ার পর পরই লজ্জা বইটি ব্যান করেছিল সরকার, লজ্জা ব্যানের দাবি নিয়ে হিন্দুবিদ্বেষীদের তাই রাস্তায় নামতে হয়নি। আমাকে হত্যা করার জন্য যারা মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তারা নারী স্বাধীনতা এবং ধর্ম বিষয়ে আমার সত্য কথন সহ্য করতে পারেনি। তথ্য না জানলে রিসার্চ করলেই তো সব সত্য তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সাংবাদিকরা রিসার্চ করবে? মোটেও না। ভালো এবং সৎ সাংবাদিকরা রিসার্চ করেন, বাকিরা তক্কে তক্কে থাকেন, কে তাদের কবে নেমন্তন্ন করবে, কে পকেটে মোটা টাকা গুঁজে দেবে, কোন ক্রিমিনাল উপঢৌকন দেবে, কোন মন্ত্রী ফোন করবে!
সত্য নেই, এখন শুধু মিথ্যের বেসাতি।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন