সৈয়দ বোরহান কবীর :৮ আগস্ট ছিল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯২তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ এবং সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি পালন করে। মূল কর্মসূচির আয়োজন করেছিল মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতাকে নিয়ে বেশ কিছু স্মৃতিচারণা করেন। একটি স্মৃতিচারণা ছিল খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। স্মৃতিচারণাটি এ রকম : ‘আশপাশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের দেশের মানুষের বোধহয় একটা চরিত্র আছে। সরকারে কেউ থাকলে তার আশপাশে যারা থাকে, তারা দেশের সার্বিক পরিস্থিতিটাকে খুব সুন্দর করে দেখানোর চেষ্টা করে। সে সময় সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বঙ্গমাতার যোগাযোগ হতো। দেশের কোথায় কী হচ্ছে তা-ও আমার মা জানতেন। মা আব্বাকে বললেন, চালের দাম কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে। আব্বা অফিসে এসে খবর নিলেন। অফিসে একজন জানালেন, তত দাম না, এই দাম। আব্বা মাকে বললেন, আমি তো ওদের খবর নিতে বললাম, ওরা বলল এত কম। একটা অল্প দাম বলা হলো। তখন মা আব্বাকে বললেন, তোমাকে ঠিক তথ্য দেয়নি। তোমাকে টাকা দিচ্ছি, যে বলেছে তাকে বল আমাকে এক মণ চাল কিনে দিতে। তিনি সত্যি টাকা দিলেন। কিন্তু ওই দামে আর চাল পাচ্ছে না। তখন মা আব্বাকে বললেন, এরা সব সময় তোমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তুমি এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।’ ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এ ঘটনার বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত, সরকার -প্রধানের চারপাশে যারা থাকে তারা বিভ্রান্ত করে। সব ঠিকঠাক আছে দেখাতে চায়। প্রকৃত তথ্য গোপন করে। এ চাটুকারিতার ফলে সরকারপ্রধান এবং সরকারের ক্ষতি হয়। কোনো লাভ হয় না। দ্বিতীয়ত, সরকার যিনি পরিচালনা করেন তাঁর নিজস্ব তথ্যের উৎস থাকাটা জরুরি। যেন তিনি সত্য ও সঠিক খবরটা পান। তাহলে তাঁর বিভ্রান্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না। তৃতীয়ত, সরকার -প্রধানের কাছে নিঃস্বার্থ ব্যক্তি থাকা খুবই জরুরি। যিনি বা যারা তাঁর (সরকারপ্রধান) মঙ্গল এবং দেশের মঙ্গল চিন্তা করবেন। সবকিছুতে নিজের লাভ খুঁজবেন না।
সরকারপ্রধান জানেন তাঁর আশপাশে যারা আছেন তারাও পরিস্থিতিটা খুব সুন্দর করে দেখাতে চান। সত্য গোপন করেন। ’৭৫-এ যারা এভাবে চাটুকারিতা করে বঙ্গবন্ধুকে ভুল তথ্য দিয়েছিল সেই গোষ্ঠী এখনো সক্রিয়। বর্তমানে দেশের পরিস্থিতির কথাই ধরা যাক। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের ডেকে আর্তনাদ করলেন। তাঁর কথার ধরন, বাচনভঙ্গিতে মনে হলো তিনি রাষ্ট্রের ত্রাতা। দেশ এক ডুবন্ত জাহাজ। বললেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এজন্য সহনীয় পর্যায়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো। ভালো কথা। আমি ব্যক্তিগতভাবে ভর্তুকি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। সবকিছুতে লাগামহীন ভর্তুকি একটি রাষ্ট্রের উন্নয়নে বড় বাধা। তেলের দাম যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ে তাহলে তো দাম বাড়ানোই যৌক্তিক। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী এত দিন কোথায় ছিলেন? যখন বিশ্ববাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। ব্যারেলপ্রতি ১৭০ ডলার ছুঁয়েছিল তখন তিনি দাম বাড়াননি কেন? সে সময় তিনি কীসের অপেক্ষা করছিলেন? যেন সরকারের অর্থনৈতিক সংকট একটু গভীর হয়। এখন যখন তেলের দাম কমছে, সামনে আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে তখন তিনি এ সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? সরকারকে বিব্রত করার জন্য? বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর কথাবার্তা অসংলগ্ন, এলোমেলো। তিনি বললেন, ‘তেলের দাম না বাড়লে আমি দেউলিয়া হয়ে যেতাম।’ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘আমি প্রাইস বাড়াচ্ছি কারণ আমার দেউলিয়াত্ব থেকে আমি বাঁচতে চাই। আমার তো তহবিল খালি হয়ে যাচ্ছে।’ সত্যি তো উদ্বেগের কথা। একটি সরকারের অন্যতম কাজ হলো পরিস্থিতি অনুধাবন করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা। যুদ্ধ শুরু হলো ফেব্রুয়ারিতে। আর প্রতিমন্ত্রী আগস্টে এসে যুদ্ধ যুদ্ধ করছেন কেন? তার মানে পরিস্থিতির বাস্তবতা অনুধাবনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। সময়ের কাজটা সময়মতো করেননি। প্রতিমন্ত্রী বলছেন, বিপিসি দেউলিয়া হয়ে যেত। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলছে অন্য কথা। সরকারের হিসাব অনুযায়ী গত মে পর্যন্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পুঞ্জীভূত মুনাফা ৪৮ হাজার কোটি টাকা। হিসাবপত্রে দেখা যায় দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যাংক গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বিপিসি। তাহলে কোনটা সত্যি? এ প্রশ্ন নিয়ে যখন আলোচনা চলছে তখন বিপিসি টাকার হিসাব নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করল গত বুধবার। বিপিসির হিসাব দেখে আমার মোল্লা নস্রুদ্দীনের একটি গল্প মনে পড়ে গেল। মোল্লা বাজার থেকে ১ কেজি মাংস কিনে স্ত্রীকে রান্না করতে দিলেন। বললেন, আমি ঘুরে এসে খাব। এর মধ্যে স্ত্রীর আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলো। মোল্লার স্ত্রী ওই মাংস রান্না করে নিজের আত্মীয়স্বজনকে আপ্যায়িত করলেন। মোল্লা ফিরে এসে খেতে বসলেন। দেখলেন মাংস নেই। অবাক হয়ে মোল্লা স্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন মাংস কই। মোল্লার স্ত্রী বললেন, মাংস বিড়াল খেয়ে ফেলেছে। মোল্লা নস্রুদ্দীন বিড়ালকে ধরলেন। বাটখারা দিয়ে বিড়াল ওজন করলেন। বিড়ালের ওজনও ১ কেজি। মোল্লা তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন এটাই যদি মাংস হয় তাহলে বিড়াল কই আর এটা যদি বিড়াল হয় তাহলে মাংস কই। বিপিসির লাভের টাকায় উন্নয়ন হয়েছে। মোল্লার মতো আমাদেরও জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, বিপিসির লাভের টাকা কই আর টাকা দিয়ে যদি উন্নয়ন হয়, সে উন্নয়ন কোথায়? আসলে প্রতিমন্ত্রী নন, সাবেক এবং বর্তমান আমলারা মিলেই জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এমন সময় নিয়েছেন যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। তার মানে সরকারকে হেয় করতেই এটা করা হচ্ছে। চাটুকাররা নিশ্চয়ই সরকারপ্রধানকে বলেছেন, দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। দাম সহনীয় পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে। একসঙ্গে এত বিপুল মূল্যবৃদ্ধির ফলে সবকিছুতে যে আগুন লেগেছে তা সরকারপ্রধানকে কে বলবে? এর মধ্যে শুরু হয়েছে চাটুকারদের তারস্বরে চিৎকার। মানুষের কষ্ট নেই। মানুষ এখনো জামাকাপড় পরে ঘোরে। কেউ না খেয়ে নেই এসব কথা বলতে বলতে কোনো কোনো মন্ত্রী নিজেরাই বেসামাল হয়ে গেছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েই ছুটে গিয়েছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। বলেছিলেন, ‘বেতন বাড়ানো হয়েছে তাই দুর্নীতি সহ্য করা হবে না।’ কিন্তু চাটুকাররা কি প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনেছে? গত জুনে সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৩ হাজার কোটি টাকা। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড জানালেন, ‘সুইস ব্যাংকে জমা রাখা অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির তথ্য চায়নি।’ সুইস রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে একটু বিস্মিত হলাম। ডলার সংকটে এক অস্থিরতা চলছে। খোলাবাজারে ডলারের দাম ১২০ টাকা। অর্থমন্ত্রী পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেছেন। অথচ সরকার সুইস ব্যাংকে কারা অর্থ রাখল সেই তথ্য চাইল না কেন? আমার ভাবনার দরজা খুলে দিল বছরখানেক আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেনের এক বক্তব্য। তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশে বাড়ি-সম্পদ বেশি আমলাদের। আমরা মনে করতাম রাজনীতিবিদদেরই বোধহয় কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি। কিন্তু আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখলাম আমলারাই এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ।’ এজন্যই পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে উদ্যোগ নেই। এখন আবার ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ ছাড়। অর্থ পাচারকারীদের জামাই আদর দেওয়ার আয়োজন চলছে। আমলা বলে কথা। চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের বয়স প্রায় ২ হাজার বছর হবে। দুই বছর আগেও আমলাদের কথা উঠে এসেছে চাণক্যের লেখায়। চাণক্য লিখেছেন, ‘জিবের ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা। জলে বিচরণরত মাছ কখন জল পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব তেমনি নির্ণয় করা সম্ভব নয় কখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা তহবিল তছরুপ করে।’ চাণক্য লিখেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীরা দুই ভাবে বড়লোক হয়- হয় তারা সরকারকে প্রতারণা করে। অন্যথায় প্রজাদের অত্যাচার করে।’ সরকারের সঙ্গে প্রতারণা করে তারা বেগমপাড়া, নিউইয়র্কে, লন্ডনে সম্পদ গড়েছে। এখন জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে, দ্রব্যমূল্যের লাগাম ছাড়া ঊর্ধ্বগতি ঘটিয়ে, বাসভাড়া নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রজাদের সঙ্গে অত্যাচার করা হচ্ছে। আমি নিশ্চিত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনগণ যে মহাসংকটে পড়েছে তা প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর কেউ নেই। একজন বঙ্গমাতা নেই যিনি সরকারপ্রধানকে বলবেন, দেশের মানুষ কষ্টে আছে চালের বাজারে আগুন, গণপরিবহনে নৈরাজ্য, মধ্যবিত্ত দিশাহারা। এমন কেউ নেই যিনি বলবেন, ১ ঘণ্টার লোডশেডিং এখন ৬ ঘণ্টায় ঠেকেছে। যিনি বলবেন, ওরা তোমাকে ঠিক তথ্য দিচ্ছে না। এরা আসলে চাটুকার। এরা সবকিছু ঠিকঠাক দেখানোর চেষ্টা করে। তথ্য গোপন করে।
বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চেয়েছে। ঋণ বাংলাদেশ চাইতেই পারে। এমন না বাংলাদেশ আগে কখনো ঋণ চায়নি। কিন্তু এবার ঋণ নিয়ে যেন একটু বেশি হইচই। কারণ কী? ‘আশপাশের মানুষ’। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর দেখালেন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়নের ওপর। এখন তা ৪০ বিলিয়নের কিছু নিচে। এটা হতেই পারে। রিজার্ভ কমবেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আইএমএফ প্রতিনিধি দল এসে বলল, রিজার্ভের হিসাব ঠিক নেই। এটা যেন ‘গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই’র মতো ঘটনা। সাবেক গভর্নর সাবেক আমলাও বটে। তথ্য দিয়ে সংকট ঢেকে রাখার কৌশল তিনি ভালোই জানতেন। বর্তমান গভর্নরও আমলা। তিনি এসে বললেন, ‘অর্থনীতি সংকটে। আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি।’ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করবে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা ঠিক করবে। খেলাপি ঋণ বন্ধ করবে। টাকা পাচার রোধ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কবে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন বুঝলাম না। একদল আমলা বলছে সব ঠিক আছে। অন্য দল বলছে সংকট। দুটোই চাটুকারিতা। দুটোই সরকারকে বিব্রত করছে। আইএমএফের সফরের পর আমলা ও চাটুকারদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা সবার কাছে এখন ঋণের জন্য ধরনা দেওয়া হচ্ছে। তাহলে আসলে আমাদের রিজার্ভ কত? বিভ্রান্তি এমন পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে রিজার্ভ সম্পর্কে কোনো তথ্যই এখন আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্তত মানুষ বিশ্বাস করে না। এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক আস্থা কম। আশির দশকে অধ্যাপিকা রাজিয়া আক্তার বানু এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের মানুষের পারস্পরিক আস্থা অত্যন্ত কম। তার সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী একে অন্যকে বিশ্বাস করে। শহরাঞ্চলে পারস্পরিক আস্থার হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন মাত্র দুজন নেতা। একজন বঙ্গবন্ধু, অন্যজন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছিল তার আশপাশের লোকজন। তারা তথ্য গোপন করত। মিথ্যা তথ্য দিত। যা প্রধানমন্ত্রীর ৮ আগস্টের বক্তব্যে উঠে এসেছে। এখন সেই একই গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। জনগণের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। সে সময় যারা চাটুকারিতা করে তথ্য গোপন করত তারা ছিল ’৭৫-এর খুনি মোশতাক এবং তার দোসররা। এখন যারা চাটুকারিতা করে সত্য আড়াল করছে, সরকারপ্রধানকে আসল তথ্য দিচ্ছে না। কৃত্রিমভাবে সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে চাইছে তারা নব্য মোশতাক। আমাদের অর্থনীতি ভালো। সব ঠিক আছে এসব বলার দরকার কী? এসব বলে আবার আইএমএফের কাছে হাত পাতারই বা প্রয়োজন কেন? দুটো স্ববিরোধী। আইএমএফ হলো একালের মহাজন। এ সম্পর্কে ড. আকবর আলি খানের ‘মোল্লা নস্রুদ্দীনের অর্থনীতি’ প্রবন্ধের কিছু অংশ উল্লেখ না করে পারছি না। ড. আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘সাতশ বছর আগে মোল্লা যখন মারা যান তখন বিশ্বব্যাংক অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কথা কেউ কল্পনা করেনি। এমনকি ওয়াশিংটন শহরে, যেখানে প্রতিষ্ঠান দুটির সদর দফতর অবস্থিত, সেখানে কোনো শহরই ছিল না, আদৌ কোনো বসতি ছিল কি না তা সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু মোল্লা বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল না দেখলেও অনেক মহাজন দেখেছেন। মহাজনদের আচরণ জানতে পারলেই এ দুটো প্রতিষ্ঠানের নিয়মনীতি আঁচ করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে মোল্লার একটি কাহিনি মনে পড়ছে। কথিত আছে, মোল্লা নস্রুদ্দীনের একটি হাতি দেখে খুবই পছন্দ হয়। তিনি হাতিটি কেনার অর্থ সংগ্রহের জন্য মহাজনের দোরে গিয়ে হাজির হলেন। মোল্লা মহাজনকে বললেন, আমাকে কিছু টাকা ধার দিন। মহাজন বললেন, কেন? মোল্লা জবাব দিলেন, আমি একটি হাতি কিনতে চাই। মহাজন প্রশ্ন করলেন, তোমার যদি টাকা না থাকে তুমি হাতি পালবে কী করে? মোল্লা আক্ষেপ করে বললেন, আমি আপনার কাছে টাকার জন্য এসেছি, উপদেশের জন্য নয়।
যে-কোনো উন্নয়নশীল দেশের অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে মোল্লার আক্ষেপই শোনা যাবে। এই তো কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতে মস্কো যান। আলোচনার পর সাংবাদিকরা রাশিয়ার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রিমাকভের কাছে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চান। প্রিমাকভ সাংবাদিকদের জানান, তিনি আশা করেছিলেন মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় তাঁর ব্রিফকেস ভর্তি করে ডলার নিয়ে এসেছেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর ব্রিফকেস ভর্তি করে নিয়ে এসেছেন শর্তের কাগজপত্র। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তাবলি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন।’ (সূত্র : পরার্থপরতার অর্থনীতি; আকবর আলি খান; পৃষ্ঠা-৪০)
আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়াটা আমলাদের চিরন্তন শখ। এর ফলে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কমে। মন্ত্রীদের পুতুল বানিয়ে রাখা যায়। সবকিছুতে আইএমএফের ভূত দেখিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে কাবু রাখার এটি আমলাতান্ত্রিক মহৌষধ। আমরা যখন মহাজনের কাছে ধরনা দিচ্ছি তখন নিশ্চয়ই দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক ছন্দে নেই। এটা হতেই পারে। মানুষের জীবনে ভালো সময় আসে খারাপ সময় আসে। খারাপ সময় কোনো গোপন করার বিষয় না। বরং সবাইকে নিয়ে বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়াটাই প্রকৃত পন্থা। জনগণকে সত্যটা জানানো জরুরি। যেমন জাতির পিতা খোলামেলা কথা বলতেন। জনগণকে সত্য বলতেন। ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যে যা বলুক না কেন, আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিতে চাই, আমি আপনাদের ধোঁকা দিতে পারব না… তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারব না…।’ প্রধানমন্ত্রীও তাঁর ভাষণে বিশ্ব বাস্তবতায় সংকটের কথা বলছেন। সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা বলেছেন। আর অন্যরা চাটুকারিতা করে সার্বিক পরিস্থিতি ভালো দেখানোর চেষ্টা করছেন। জনগণকে প্রকৃত অবস্থা জানাতে হবে। স্বপ্লোন্নত দেশ হলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বেই। রাষ্ট্রের ভর্তুকিতে দিনরাত শীতাতপ বিলাস করা যাবে না। রাষ্ট্রের সম্পদ গ্যাসের যথেচ্ছ অপচয় বন্ধ করতে হবে। এ সত্যগুলো সাহস করে বলতে হবে। কিন্তু অসত্য বিভ্রান্তিকর এবং স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়ে সবকিছু ঠিক দেখানোর এক ভয়ংকর প্রবণতা চলছে। যারা চাটুকারিতার জন্য এসব করছেন তাদের পূর্বসূরিরা বঙ্গবন্ধুকেও বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাকে নিয়ে যে ঘটনাটি বলেছেন তা নিয়ে কথা হচ্ছিল আওয়ামী লীগের এক ত্যাগী নেতার সঙ্গে।
তিনি বললেন, আগেকার কর্মচারীদের (আমলা) ন্যূনতম সততা ছিল। এজন্য বঙ্গমাতার দেওয়া টাকায় সে চাল কেনেনি। এখনকার কর্মচারী (আমলা) হলে কী করত জানেন? আমি তার কথায় ব্যাপক আগ্রহ পেলাম। প্রবল উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কী করত? আওয়ামী লীগের ওই নেতা হাসতে হাসতে বললেন, ‘একালের আমলারা নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে চাল কিনত। বঙ্গমাতার টাকা থেকে কিছু টাকা ফেরত দিত। বঙ্গবন্ধুকে বলত, স্যার আমি চালের দাম একটু বেশি বলেছি। আসলে চালের দাম আরও কম। বঙ্গমাতা যে টাকা দিয়েছেন তা থেকে কিছু টাকা বেঁচে গেছে।’ তার কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ। তিনি বললেন, একালের আমলারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই বিভ্রান্ত করত না, তারা বঙ্গমাতাকেও বিভ্রান্ত করত। আমলা এবং চাটুকাররা বঙ্গমাতাকেও এমনভাবে ঘিরে রাখত যেন তিনি জানতেও পারতেন না চালের দাম কত।
তা ছাড়া আগে আওয়ামী লীগের তৃণমূল বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসত দেশকে ভালোবাসত, জনগণকে ভালোবাসত। এখন তৃণমূল শুধু নিজেদের ভালোবাসে। বঙ্গমাতাকে যেমন নেতা-কর্মীরা সাহস করে চালের দাম বাড়ার কথাটা বলেছে। এখনকার হাইব্রিডরা বলবে ‘মানুষ না খেয়ে নেই। থাকবেও না।’ সত্যপ্রবাহের ধমনিই এখন অকেজো হয়ে গেছে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
[email protected] সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন