ছবি সংগৃহীত
অনলাইন ডেস্ক : প্রথমে পুলিশের গালাগাল। ঠিক একটু পর দৌড় দিতে বলেই পায়ে গুলি চালানো হয়। পেছনে ফিরে তাকালে চালান আরেকটা গুলি। তবু ক্ষান্ত হননি। গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলা হয় গোটা দেহ। রক্তাক্ত শরীরে বাঁচার আকুতি জানালেও বুক কাঁপলো না ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের। উল্টো ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নিয়ে গোল হয়ে লাশের চারদিকে দাঁড়িয়ে ছয় থেকে সাতজন পুলিশ সদস্য মৃত্যু উপভোগ করেছিলেন। এমনকি পুলিশ সদস্যদের বুট জুতা দিয়ে মাড়িয়ে বিকৃত করে দেওয়া হয় শহীদ তাইমের মুখ ও চেহারা।’
এভাবেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে ভাই নিহত হওয়ার মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছেন শহীদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই রবিউল আউয়াল। সোমবার (১৮ আগস্ট) জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ১১তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন তিনি। তার জবানবন্দি ও জেরা শেষ করা হয়েছে এদিন। এরপর আরও একজনের সাক্ষ্য শেষে মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য ২০ আগস্ট দিন ঠিক করেছেন।
এদিন ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
রবিউল বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমি সিলেটে অংশ নেই। আর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলায় অংশ নেয় ছোট ভাই তাইম। ১৬ থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত সে সারাদিন আন্দোলনে ছিল। তবে আন্দোলনে যেন যেতে না পারে সেজন্য তার ব্যাগ নিয়ে কাছাকাছি বসে থাকতেন আমার মা। ১৯ জুলাই রাতে কারফিউ জারি করে সরকার। ২০ জুলাই দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল ছিল। ওই সুযোগে মাকে চা খাওয়ার কথা বলে বাইরে গিয়ে আন্দোলনে যায় আমার ছোট ভাই।’
আন্দোলনে যাওয়ার পর তাইমকে দুবার কল করেন রবিউল। কিন্তু রিসিভ করেননি। দুপুর সাড়ে ১২টায় কল দিলে ছোট ভাইয়ের নম্বরটি বন্ধ পান তিনি। ১২টা ৫০ মিনিটে কল করেন মায়ের মুঠোফোনে। ঠিক তখনই রবিউলকে তাইমের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানানো হয়। বাড়িওয়ালার মাধ্যমে এমন সংবাদ পেয়েছেন বলেও ছেলেকে জানান মা।
জবানবন্দিতে সাক্ষী বলেন, ‘তাইমের গুলিবিদ্ধের খবর পেতেই ঘটনাস্থল অর্থাৎ কাজলা ফুটওভার ব্রিজের পাশে যান আমার মা। যেতেই সেখানে তাইমের জুতা আর রক্ত দেখতে পান তিনি। তবে উপস্থিত লোকজন আমার মাকে জানান যে, আপনার ছেলেকে ভ্যানে করে যাত্রাবাড়ী থানার দিকে পুলিশ নিয়ে গেছে। এছাড়া খবরটি খালা শাহিদাকে জানাই আমি। পরে তিনি কান্না করতে করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে খোঁজাখুঁজির পর তাইমকে না পেয়ে একজন সাংবাদিককে ছবি দেখান আমার খালা। এ সময় তায়িমকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে বলে জানান ওই সাংবাদিক।’
‘পরদিন ঢামেক থেকে লাশ নিয়ে কুমিল্লায় গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান বাবা। আর সিলেট থেকে বাড়িতে যান রবিউল। গ্রামেই ২১ জুলাই রাত ১০টায় শহীদ তাইমকে দাফন করা হয়। তাইমের শরীরে ২০০ ছররা গুলি ছিল বলে বাবার কাছ থেকে জানতে পারেন এই সাক্ষী। তার বাবা মো. ময়নাল হোসেন ভূঁইয়া বর্তমানে পুলিশের জ্যেষ্ঠ এসআই হিসেবে কর্মরত।’
তাইমের বন্ধুদের বরাত দিয়ে রবিউল বলেন, ‘২০ জুলাই পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে থাকলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। ওই সময় দুই বন্ধুসহ কাজলায় লিটনের চায়ের দোকানে আশ্রয় নেন তাইম। তবে তাদের দেখে ফেলে পুলিশ। একপর্যায়ে তিনজনকে টেনে বের করে বেধড়ক পেটান। একই সঙ্গে গালি দিয়ে দৌড় দিতে বলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তাদের কথামতো প্রথমে দৌড় দেন তাইম। ঠিক তখনই তার পায়ে প্রথমে গুলি করেন যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন এসআই সাজ্জাদুজ্জামান।’
প্রথম গুলি খাওয়ার পর পেছনে তাকান তাইম। তখন আরেকজনের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে তার শরীরের নিম্নাংশে দ্বিতীয় গুলি করেন এডিসি শামীম। খুব কাছ থেকে করায় তাইমের সামনের পা দিয়ে ঢুকে পেছন দিক দিয়ে গুলিটি বেরিয়ে যায়। এরপর তাকে অনবরত গুলি করতে থাকেন যাত্রাবাড়ী থানার তৎকালীন ওসি (তদন্ত) জাকির।
এ বর্ণনা দিয়ে সাক্ষী বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাইমকে বাঁচাতে পেছন দিয়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তার বন্ধু রাহাত। তখন তাকেও গুলি চালিয়ে তাইমকে ফেলে রেখে যেতে বাধ্য করে পুলিশ। রাহাত চলে যাওয়ার পর আধাঘণ্টা পর্যন্ত পড়েছিল আমার ভাই। রক্তাক্ত শরীরে কাঁতরাচ্ছিল আর আকুতি করছিল বাঁচান বাঁচান বলে। সাংবাদিকসহ উপস্থিত অনেকেই তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা তাকে নিতে দেননি। বরং তারা তার মৃত্যু উপভোগ করছিলেন। অথচ সেখান থেকে ২০ গজের মধ্যে রাস্তার দু’পাশে দুটি হাসপাতাল ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আধাঘণ্টা পর ভ্যানে করে আমার ভাইকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে নেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সেখানে ভ্যান থেকে মাটিতে নামিয়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বুট জুতা দিয়ে তাকে মাড়িয়ে চেহারা বিকৃত করে ফেলেন তারা। এর মধ্যে ছিলেন এডিসি শামীম, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির ও এসি নাহিদ। পরে কেউ তাইমকে ভ্যানযোগে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
সেদিনের ঘটনাস্থলে পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিয়ে রবিউল বলেন, ‘২০ জুলাই ঘটনাস্থলে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যুগ্ম কমিশনার প্রলয়, ডিসি ইকবাল, এডিসি মাসুদুর রহমান মনির, এসি নাহিদ, এসি তানজিল, ওসি আবুল হাসান, ওসি (অপারেশন) ওয়াহিদুল হক মামুনসহ ১০-১৫ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতেই আমার ভাই তাইমসহ যাত্রাবাড়ীতে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের নির্দেশে আন্দোলনকারী প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
এদিন রবিউল ছাড়াও শেখ হাসিনার মামলায় আরও দুজন সাক্ষ্য দেন। এর মধ্যে একজন শহীদ আস-সাবুরের বাবা মো. এনাব নাজেজ জাকি ও রাজশাহীর প্রত্যক্ষদর্শী জসিম উদ্দিন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ১২ জন সাক্ষী নিজেদের জবানবন্দি দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বুধবার (২০ আগস্ট) দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
ফেসবুকে ছড়িয়েপড়া ভিডিওতেও উঠে এসেছে এই মর্মস্পর্শী দৃশ্য। ২৭ বছর ধরে পুলিশে কর্মরত ময়নাল হোসেন ছেলে তাইমের মৃত্যুর পর থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ইমাম হাসান নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজী নগর এমডব্লিউ কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তখন মর্গে নিজের সন্তানের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার পর ফোনে ময়নালকে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার, আমার ছেলেটা মারা গেছে। বুলেটে ওর বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। স্যার, আমার ছেলে আর নেই।’
এই পুলিশ কর্মকর্তা প্রশ্ন রেখে তাকে বলেন, ‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে স্যার?’ একই কথা ট্রাইব্যুনালকে জানান শহীদ ইমাম হাসান তাইমের ভাই মামলার সাক্ষী রবিউল আউয়ালও।