নঈম নিজাম : ‘বেণীমাধব, বেণীমাধব তোমার বাড়ি যাব,/বেণীমাধব, তুমি কি আর আমার কথা ভাব’ -লোপামুদ্রা মিত্র অসাধারণ গেয়েছেন। জয় গোস্বামীর কবিতাটি অনেক দিন আগে পড়া। পরে শুনলাম গান হিসেবে লোপামুদ্রার কণ্ঠে। এত চমৎকার গেয়েছেন তুলনা হয় না। শেষ বেলায় এসে সবাই কমবেশি পুরনো দিনে হারিয়ে যাই। হয়ে উঠি নস্টালজিক। স্মরণ করি বেণীমাধব কিংবা অঞ্জন দত্তের গানের বেলা বোসদের। জীবনের পরতে পরতে অপার রহস্য নিয়েই বেঁচে থাকে মানুষ। যখন চলে যায় তখন শেষ হয়ে যায় সবকিছু। স্মৃতি ছাড়া আর কিছু থাকে না। আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় স্মৃতিও কেউ রাখতে চায় না। সময়টা এখন কঠিন। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম একজন চিকিৎসক চলে গেছেন নিঃসঙ্গ অবস্থায়। বাড়িতে একাই ছিলেন। সন্তান থাকত বিদেশে। স্ত্রী গেলেন সন্তানের কাছে বেড়াতে। চিকিৎসক একাকী ঢাকার বাসায়। হঠাৎ অসুস্থতা অনুভব করলেন। কাউকে ডাকার সময় পেলেন না। আশপাশে কেউ ছিল না ডাক শুনে ছুটে আসবে। নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা গেলেন সেই চিকিৎসক। কেউ জানলই না। লাশ পচে গেল। গন্ধ ছড়াল। কেউ এলো না এগিয়ে। ভদ্রলোকের আত্মীয়স্বজন হঠাৎ খেয়াল করলেন ফোনের জবাব মিলছে না। তারা চেষ্টা করলেন যোগাযোগের। পেলেন না ফোনে। ঘটনাটি রাজধানী ঢাকার মগবাজারের। ভদ্রলোক অন্যের চিকিৎসা করতেন। শেষ মুহূর্তে নিজের চিকিৎসা নিতে পারলেন না! মৃত্যুর সঙ্গে একাকী লড়াই করলেন। পরাস্ত হলেন। চলে গেলেন। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করল। মানুষের জীবন এমন হয় কেন? চারপাশে সবকিছুর বিশাল বলয় তৈরির পরও কেন অসহায়ভাবে চলে যেতে হয়?
যৌবনে কারও সমস্যা নেই। সবকিছু উথালপাথাল। শেষ বয়সটা কঠিন। যৌবনের উত্তাল সময়ে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-পরিজনের অভাব হয় না। পাশে থাকে সবাই। সচ্ছল হলে তো কথাই নেই। সবাই আসবে, তোয়াজ করবে। বয়স বাড়লে, অর্থবিত্ত খোয়ালে সব শেষ হয়ে যায়। পাশে থাকার সময় নেই কারও। আপনজনেরাও ব্যস্ত থাকে নিজেদের নিয়ে। বৃদ্ধ বয়সে অনেকে আক্ষেপ করেন, পুরো জীবন পরিবার-পরিজনের জন্য বিলিয়ে দিয়েছি। অথচ শেষ বয়সে কাউকে পাশে পাচ্ছি না। এমনকি মৃত্যুর সময়ও না। করোনাকালে ধানমন্ডির বাড়িতে একজন বিত্তশালী বয়স্ক মানুষ মারা গেলেন। সন্তানরা ছিলেন বিদেশে। লাশ দাফন করল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। দেখার ছিল না নিকটজনেরা। কিছুদিন আগে আরেক ভদ্রলোক নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করলেন। একসময় ভদ্রলোকের সব ছিল। শেষ বয়সে এসে আপনজনদের অবহেলা সহ্য করতে পারেননি। তাই আত্মহত্যা। কেউ কেউ নিজেই আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার কারও সন্তানরা বাবা-মাকে পাঠিয়ে দেন সেখানে। খোঁজ নেন না। মাঝেমধ্যে দিবসভিত্তিক ফোন করেন। জানতে চান কেমন আছে। জবাবে শত কষ্টেও কোনো বাবা-মা খারাপ আছেন বলেন না। বৃদ্ধাশ্রমের জীবনেও প্রার্থনা করেন সন্তানদের মঙ্গল কামনায়।
ছাত্রলীগ করেও অন্য ১০ জনের মতো লুটপাটে জড়াতে পারেননি আনিস। চাঁদাবাজিতে ছিলেন না। দুঃসময়ে দলে ভূমিকা রেখেছিলেন। সুসময়ে আনিসদের দরকার হয় না! তাদের খবর কেউ রাখে না। সরকারি দলের রাজনীতি এখন তোষামোদকারী চাটুকারদের হাতে। সুসময়ে আনিসরা অভিমানী হন। আত্মহননে সমাধানের পথ বেছে নেন। একজন আনিসের নিষ্ঠুর প্রয়াণ সমাজকে স্পর্শ করে না। মানুষের আবেগ জাগিয়ে তোলে না। মানুষ এখন খারাপকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। ভালো দেখলে বিস্মিত হয়। ভালোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। আর ভান করে নিজেকে চিরসুখী দেখানোর। সেদিন এক বন্ধু বললেন, এখন কারও সঙ্গে চলতে ভয় লাগে। কথা বলতে, কারও উপকার করতে সাতবার চিন্তা করতে হয়। আজ যার উপকার করলাম, কাল সে হয়ে ওঠে ভয়াবহ চরিত্র। ক্ষতি করা, হিংসা-বিদ্বেষ ভয়াবহ ব্যাধির মতো ছড়ানোই হয় তার কাজ। এখন কেউ কারও ভালো চায় না। মঙ্গল দেখলে হিংসুটে হয়ে ওঠে। ওয়ান-ইলেভেন শেষ করে দিয়েছে সুস্থধারার রাজনীতি। ২১ আগস্ট শেষ করেছে সৌহার্দ্যরে সংস্কৃতি। করোনাকালের নিঃসঙ্গতা ধ্বংস করেছে মানুষের বিবেক বুদ্ধি। ভালো কিছু এখন আর কেউ চিন্তা করতে নারাজ। ভালো কাজের প্রশংসা একজন করলে ১০ জন করে বিরোধিতা।
রাজনীতিবিদরা ভুলে গেছেন ওয়ান-ইলেভেনের সেই সময়ের কথা। তাঁরা বুঝেও বোঝেন না দুঃসময়ে আমলাকুল, চামচাকুল কেউই থাকে না। তোষামোদকারীরা সটকে পড়ে। খারাপ সময় দেখলে উড়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। হজরত খোয়াজ খিজির (আ.)-এর চোখের চশমা দিয়ে সব দেখতে পেলে সবাই বাস্তবতা অনুধাবন করত। তখন এত জটিলতা হতো না। সাদা চোখে কঠিন বাস্তবতা বোঝা যায় না। দূষিত সমাজ-সংস্কৃতির রূপ দেখতে দরকার খোয়াজ খিজির (আ.)-এর চোখের সেই চশমার। যা দিয়ে হজরত মুসা (আ.) দেখেছিলেন দুনিয়ার নষ্ট মানুষের রূপ। হজরত মুসা (আ.) দুনিয়াদারির কঠিন পরিস্থিতি নিয়ে আল্লাহর মুখোমুখি হলেন। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে জানতে চাইলেন দুনিয়ায় তাঁর চেয়ে জ্ঞানী কোনো মানুষ আছে কি না। জবাবে আল্লাহ বললেন, অবশ্যই আছে। তুমি শহরে প্রবেশ কর। দেখতে পাবে চশমা পরা এক মুচি বসে আছে। সে জুতা সেলাই করছে। তুমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ কর। সে তোমার চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞানী। হজরত মুসা (আ.) বিস্মিত হলেন। একজন মুচি কী করে আল্লাহর নবীর চেয়ে বেশি জ্ঞানী হয়! হজরত মুসা (আ.) গেলেন নির্দিষ্ট স্থানে। দেখলেন একজন মুচি জুতা সেলাই করছেন। হজরত মুসা (আ.) তাঁর সামনে গিয়ে কিছু বলার আগেই তিনি নিজের চোখের চশমা খুলে হজরত মুসা (আ.)-এর হাতে তুলে দিলেন। বললেন সেই চশমা পরতে। হজরত মুসা (আ.) সেই চশমা পরলেন। তারপর দেখলেন তাঁর সামনে হেঁটে বেড়ানো মানুষগুলোর চেহারা বদলে গেছে। তারা কেউ হিংস্র কুকুর, কেউ ফণা তোলা বিষধর সাপ, কেউ নেকড়েসহ ভয়ংকর প্রাণীর রূপ নিয়েছে। মানুষ হিসেবে ঘুরে বেড়ালেও তারা আসলে ভয়াবহ হিংস্র প্রাণী। মানুষের এমন ভয়াবহ দুই রকম চেহারা দেখে আল্লাহর নবী কষ্ট পেলেন। তিনি চমশা খুললেন। খালি চোখে সামনে তাকালেন। দেখলেন সব স্বাভাবিক। মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে। শুধু চশমা পরে তাকালেই বদলে যাচ্ছে সবকিছু। হজরত মুসা (আ.) বুঝলেন দুনিয়ায় তাঁর এখনো অনেক কিছু জানা-বোঝার বাকি আছে।
মানুষের ভয়াবহ চেহারা দেখে হজরত মুসা (আ.)-এর ভাবনায় পরিবর্তন এলো। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আরও অনেক কিছু জানতে হবে। আলাপ-পরিচয়ে বুঝলেন তাঁর সামনে মুচি হিসেবে বসে থাকা মানুষটিও আল্লাহর একজন নবী। নাম খোয়াজ খিজির (আ.)। তিনি মানুষের দুনিয়ার সত্যিকার রূপ দেখতে পান। যা অন্য কেউ পায় না। আল্লাহ তাঁকে সেই শক্তি দিয়েছেন। অধিক জ্ঞান আহরণের জন্য হজরত মুসা (আ.) সঙ্গ চাইলেন তাঁর। কিন্তু খিজির (আ.) তাঁকে সঙ্গে নিতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আপনি পারবেন না আমার সঙ্গে চলতে। আপনার এত ধৈর্য নেই। আর আমার কাজ আপনার ভালো লাগবে না। চলতে গেলে আমাকে সেসব নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন না। আর প্রশ্ন করলে বিদায় করে দেব পথ থেকে। জবাবে হজরত মুসা (আ.) বললেন, আপনার কাছে আল্লাহ পাঠিয়েছেন। খারাপ লাগার কারণ নেই। খারাপ লাগলেও আমি তা প্রকাশ করব না। আপনাকে বিরক্ত করব না। আমি আরও বুঝতে পারব। জানতে পারব। অনেক আলোচনার পর আল্লাহর প্রিয় দুই নবী একসঙ্গে বের হলেন। তার পরের ঘটনাগুলো আরও জটিল। সেসব নিয়ে আরেক দিন আলোচনা করব।
আমরা সাদা চোখে অনেক বাস্তবতা দেখতে পাই না। সমাজের জটিল অংশগুলো অনুধাবন করি না। সব সংকটের সমাধানে যাই সাময়িক। একবার ম্যাচাসুসেটসের ছোট্ট শহর সান্ডারল্যান্ডের পথে হাঁটছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম কৃষকের খামারের সামনের একটি দোকানে কোনো বিক্রেতা নেই। সব পণ্যর ওপর দাম লেখা। পাশে একটি ক্যাশ আছে। কোনো বিক্রেতা নেই। ক্রেতারা নিজেদের মতো কেনাকাটা করে মোবাইলে দাম পরিশোধ করেন। ক্যাশ রাখারও সুযোগ আছে। সিসিটিভি বসানো আছে। দোকানদার হাজার মাইল দূরে থাকলেও সব দেখতে পান। অসৎ কাস্টমার তেমন একটা যায় না এ দোকানে। তাই সমস্যা হয় না। ক্রেতারা সবাই স্থানীয় অধিবাসী। এখানে সবাই সবাইকে জানে। আমাদের দেশে কি এমন একটি দোকান চালানো সম্ভব? জানি জগজ্জুড়ে খারাপ মানুষের সংখ্যা বেশি। পাশের মানুষটিকে আপনি হয়তো আপন ভাবছেন। কিন্তু বাস্তবে দেখবেন তার দিন কাটছে আপনার অমঙ্গল কামনায়। কেউ হয়তো আপনাকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটছে, আপনার পাশের মানুষটি সেই খবর জানার পর আপনাকে কিছু বলবে না। নীরবে যোগাযোগ করবে খুনির সঙ্গে। তারপর খুনিকে জানাবে কত নিষ্ঠুরভাবে আপনাকে খুন করলে মৃত্যুযন্ত্রণা দীর্ঘ হবে। খারাপের দুনিয়ার ভয়াবহতা দেখতে হজরত খিজির (আ.)-এর চশমার দরকার আজকাল হয় না। চলার পথে আপনার একটা খারাপ সময় এলেই টের পাবেন দুনিয়াদারি কতটা নিষ্ঠুর। কতটা ভয়াবহ।
ক্ষমতার দুনিয়ায় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিদায় দেখলাম। পালানোর সময় তিনি বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনাল ব্যবহার করে সাধারণ ফ্লাইট নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সিঙ্গাপুর অথবা দুবাই। ভাবনায় ছিল প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ ছাড়বেন। তারপর পাঠাবেন পদত্যাগপত্র। কিন্তু ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা তাঁর পাসপোর্টে সিল মারতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাঁরা পালানোর চেষ্টাকারী প্রেসিডেন্টকে বললেন, সাধারণ ফ্লাইটের যাত্রী হয়ে আপনি ভিআইপি টার্মিনালে গেলে পাসপোর্টে সিল দেওয়া সম্ভব নয়। সাধারণ ফ্লাইটে গেলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে লাইন দিয়ে আসুন। সিল দেব। সাধারণ মানুষের কাতারে যাওয়ার সাহস হলো না রাজাপক্ষের। তিনি পরে একটি সামরিক ফ্লাইট নিয়ে গেলেন মালদ্বীপ। সেখান থেকে সিঙ্গাপুর। ক্ষমতার দুনিয়া বড় কঠিন। বিদায়ী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের চলে যাওয়ার ক্ষণে কষ্টমাখা আবেগময় বক্তৃতা রাখলেন। তিনি বললেন, ‘ক্ষমতার মায়া সবাই ত্যাগ করতে পারে না। পৃথিবীর সেরা এ পদটি ছেড়ে দিতে আমার খারাপ লাগছে, কিন্তু রাজনীতিতে কেউ অপরিহার্য নয়।’ শুধু রাজনীতি কেন, জগৎসংসারে কোথাও কেউ অপরিহার্য নয়।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন