শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট ঘটনা দিয়ে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ এখন বিস্ফোরণে রূপ নিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভে গতকাল উত্তাল ছিল দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। শাবি প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে হল ত্যাগের নির্দেশ দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষার্থীরা। ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শাবির বিভিন্ন প্রশাসনিক ভবনে তালা লাগিয়ে দেন। তাদের দাবি, শাবির উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে সরে যেতে হবে। একই সঙ্গে প্রক্টরিয়াল বডি ও ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টাকেও পদত্যাগ করতে হবে। ক্যাম্পাসে তারা উপাচার্যকে অবাঞ্ছিতও ঘোষণা করেছেন। উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা ‘যে ভিসি গুলি করে, সেই ভিসি চাই না’ এবং ‘ক্যাম্পাস কারও বাপের না, হল আমরা ছাড়ব না’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায়ে হল না ছেড়ে গতকাল রাত পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখে। তবে কোনো ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত না নিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন উপাচার্য। এদিকে রবিবার শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার ঘটনা খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয়েছে আট সদস্যের কমিটি।
ঘটনার শুরু যেভাবে : বৃহস্পতিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী হল বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্টের পদত্যাগ, হলের অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত এবং ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রভোস্ট কমিটি নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন কয়েক শ ছাত্রী। এ দাবিতে শুক্র ও শনিবারও বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন ছাত্রীরা। শনিবার সন্ধ্যায় ছাত্রীদের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। এর পরই পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়। সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরাই শুধু নন, ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শাবির সব সাধারণ শিক্ষার্থীর মধ্যে। ছোট ঘটনা মোড় নেয় বড় ঘটনার দিকে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি পূরণ ও ছাত্রলীগের হামলার বিচার চেয়ে রবিবার ফের আন্দোলন শুরু করেন। ওইদিন বেলা আড়াইটার দিকে রেজিস্ট্রার ভবনে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা শেষে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন শাবি উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। ওই সময় শিক্ষার্থীরা তাঁর পিছু নেন। তিনি কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে আশ্রয় নেন। শিক্ষার্থীরা সেখানে তাঁকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। খবর পেয়ে ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয় বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য। তাদের সঙ্গে ক্রাইসিস রেসপন্স টিমের (সিআরটি) সদস্যরাও ছিলেন। তখন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েনের বিরুদ্ধেও স্লোগান দিতে থাকেন। সেদিন বিকাল সোয়া ৫টার দিকে ভিসিকে মুক্ত করতে অ্যাকশনে যায় পুলিশ। এতে বাধা দেন শিক্ষার্থীরা। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। এতে শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। শিক্ষার্থীদের ছোড়া ইটপাটকেলে নিজেদের ১০ সদস্য আহত হয়েছেন বলে দাবি করে পুলিশ।
শাবি বন্ধ ঘোষণা, প্রভোস্টের পদত্যাগ : রবিবার অবরুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয়ে জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করেন ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। সভায় বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা ও শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট সহযোগী অধ্যাপক জাফরিন আহমেদ অসুস্থতার কারণে পদত্যাগ করেছেন বলে সিন্ডিকেট সভা শেষে জানান ভিসি। এ পদে অধ্যাপক ড. নাজিয়া চৌধুরীকে দায়িত্ব দেওয়ার কথাও জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্তের পর আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। তারা তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে রাতেই বিক্ষোভ মিছিল করেন।
যা ঘটল গতকাল : গতকাল সকাল থেকে ফের উত্তাল হয়ে ওঠে শাবি। টানা চতুর্থ দিনের আন্দোলনে ক্ষোভে-বিক্ষোভে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী আতঙ্কে হল ছাড়লেও সিংহভাগ প্রশাসনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে যোগ দেন। শিক্ষার্থীরা দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। তারা কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বরে, কখনো প্রশাসনিক ভবনের সামনে, আবার কখনো বিভিন্ন হলের সামনে অবস্থান নেন। বেলা ১১টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল শেষে মুক্তমঞ্চে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরতরা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্মম হামলার ঘটনায় উপাচার্যকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং জবাবদিহি করতে হবে। তাঁর পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন চলবে।’ এ ছাড়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় প্রক্টরিয়াল কমিটি এবং ছাত্র উপদেষ্টাকেও পদত্যাগ করতে হবে বলে দাবি তোলেন আন্দোলনরতরা। তারা হল না ছাড়ারও ঘোষণা দেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমরা সহযোগিতা কর। কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত তোমরা গ্রহণ কোরো না।’ তিনি দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে বলেও জানান।
ভিসির কথায় কর্ণপাত না করে গতকাল দুপুরে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শাবির বঙ্গবন্ধু হল, সৈয়দ মুজতবা আলী হল, প্রথম ছাত্রী হল ও বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হল, দুটি প্রশাসনিক ভবন, চারটি একাডেমিক ভবন, ইউনিভার্সিটি সেন্টার ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব ভবনে তালা লাগিয়ে দেন। শুধু ভর্তি কার্যক্রম চলা ভবনে তালা দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন শিক্ষার্থীরা। হলে শিক্ষক-কর্মকর্তা কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
গণস্বাক্ষর ও উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও : এদিকে গতকাল দুপুর ২টায় গণস্বাক্ষর কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরে ভিসির পদত্যাগের দাবিসংবলিত স্মারকলিপি বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য বরাবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা পুলিশ সদস্যদের ফুল দিয়ে বলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করছেন। তারা কোনো বিশৃঙ্খলা করছেন না। শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেন। শিক্ষার্থীরা ‘যেই ভিসি ছাত্র মারে, সেই ভিসি চাই না’ স্লোগান দেন। তখন পুলিশ সদস্যদের জলকামানসহ ফটকের বাইরে অবস্থান করতে দেখা যায়। তবে ফটকে শিক্ষার্থীরা তালা লাগিয়ে দেওয়ায় জলকামান ভিতরে ঢুকতে পারেনি।
তদন্ত কমিটি গঠন : এদিকে রবিবারের ঘটনা খতিয়ে দেখতে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, ফিজিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন অধ্যাপক রাশেদ তালুকদারকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির অন্যরা হলেন- সদস্যসচিব রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন, সদস্য শিক্ষক সমিতির সভাপতি তুলসী কুমার দাস, অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেস অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন আরিফুল ইসলাম, অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড মিনারেল সায়েন্সেস অনুষদের ডিন রুমেল আহমদ, লাইফ সায়েন্সেস অনুষদের ডিন মো. কামরুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন খায়রুল ইসলাম এবং সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন দিলারা রহমান। গত রাত ৮টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা অবধি শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান করছিলেন। তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যও সেখানে সতর্কাবস্থায় ছিলেন। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন