ক্ষমতার নিষ্ঠুরতার পৃথিবীতে আপন কে

নঈম নিজাম : সময়টা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। দেশে ফিরলেন ইতিহাসের মহানায়ক। প্রিয় নেতাকে একনজর দেখতে অপেক্ষায় গোটা বাংলাদেশ। তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মানুষের ঢল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান ছাত্রনেতারা অপেক্ষা করছেন। আবেগাপ্লুত জনতা একনজর দেখতে চান তাঁকে। অবশেষে নেতা এলেন। বাঁধভাঙা জনস্রোত ছুটল তাঁর দিকে। বিমান থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু চার জাতীয় নেতাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাছে টেনে নিলেন ছাত্রনেতাদের। কাঁদলেন। কাঁদালেন। তারপর মিশে গেলেন জনতার স্রোতে। সে সময় খন্দকার মোশতাকও এগিয়ে এসেছিলেন। কিছুদিন আগে তাকে তাজউদ্দীন আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক ভূমিকা। প্রমাণও ছিল তাজউদ্দীনের কাছে। পররাষ্ট্র হারানোর অপমানে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মোশতাক। বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবরে বের হলেন। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে স্বাগত জানালেন। হাউমাউ করে কাঁদলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। খন্দকার মোশতাক অতি ভালোবাসা দেখাতে এমনই করতেন। বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জীবনের বন্ধু পরিচয় দিতেন নিজেকে। সবার সামনে চাটুকারিতা করতেন। আর তলে তলে করতেন সর্বনাশ। ১৯৭৪ সালের ৩১ মে মারা গেলেন বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন। সেদিন ঢাকার আকাশে ঝড় ছিল। ঝড়বাদল উপেক্ষা করে মোশতাক গেলেন টুঙ্গিপাড়ায়। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করলেন। মোশতাকের আচরণে বিরক্ত হলেন বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। বঙ্গবন্ধুর বাবার মৃত্যুর পরও মোশতাকের কান্নাকাটির শেষ ছিল না। মোশতাক নিজেকে আপনজন হিসেবে বেশি জাহির করতেন। তিনি ছিলেন তাজউদ্দীনবিরোধী। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে বিদেশ থেকে ফিরে তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের কিছু বিষয়ে সমালোচনা করলেন। এ নিয়ে মোশতাক ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। বললেন, তাজউদ্দীন সরকারের ক্ষতি করছে। তাকে বাদ দিতে হবে। এ এল খতিবের ‘হু কিল্ড মুজিব’ বইতে আছে অনেক কথা। ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াও লিখে গেছেন। রাজনীতিতে আপন-পর বলে কথা নেই। বঙ্গবন্ধুকে সবাই সতর্ক করতেন মোশতাক নিয়ে। তিনি সেসব বিষয়ে কান দিতেন না। একবার তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করলেন। বললেন, এই লোকটি মোশতাকের লোক। তথ্য মন্ত্রণালয়ে বসে আপনার সর্বনাশ করছে। হিমালয় উচ্চতার বঙ্গবন্ধু বললেন, সমস্যা কী তোমাদের? মোশতাক আমার লোক।

 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল ব্যক্তিত্বের, উদার মনের অধিকারী। সবাইকে আপন ভাবতেন। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে দেখতেন। কঠোর হতে পারতেন না কোনো কিছুতে। ১৯৭২ সালে অনেক গণপরিষদ সদস্যকে বাদ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করার। বঙ্গবন্ধু তাদেরও ক্ষমা করে দিলেন। যতটা কঠোর হওয়ার দরকার ছিল তা হননি। শুধু নিজ দল নয়, অন্যদের প্রতিও তিনি উদার ছিলেন। তিনি ছিলেন মানুষের নেতা। মাত্র ৫২ বছর বয়সে হয়েছিলেন জাতির পিতা। তোফায়েল আহমেদ বিষাদ সিন্ধুর মতো বঙ্গবন্ধুর অনেক উদারতার কথা তুলে ধরছেন। অনেক স্মৃতিচারণা শুনেছি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আমিনুল হক বাদশার কাছ থেকে। রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক কর্নেল (অব.) সরোয়ার হোসেন মোল্লার অনেক সাক্ষাৎকার ও লেখা প্রকাশ করেছি। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে আরও অনেক কিছু। স্বাধীনতার পরের সময়টা আসলে ছিল অন্যরকম। ইতিহাসের রাখাল রাজা নিজের কথা ভাবতেন না। চিন্তা করতেন না নিজের নিরাপত্তার কথা। ভাবতেও পারেননি কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। নেননি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। থাকতেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ছোট্ট বাড়িটিতে। এখানে কোনো নিরাপত্তা ছিল না। রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নূরুজ্জামান, দুই উপপ্রধান আনোয়ারুল আলম শহীদ, সরোয়ার মোল্লা, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ই এ চৌধুরী বারবার সতর্ক করেছেন। বলেছেন নিরাপত্তার স্বার্থে গণভবনে গিয়ে উঠতে। উৎকণ্ঠা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। ভারতীয় গোয়েন্দাপ্রধান ঢাকায় এলেন। কোনো বাধা ছাড়া প্রবেশ করলেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। যে-কেউ এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারত অবাধে। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দরজা খোলা ছিল জনতার জন্য। বিশ্বে এমন উদাহরণ দ্বিতীয়টি নেই। আর হবেও না কোনো দিন।

 

বঙ্গবন্ধু কাউকে প্রতিপক্ষ মনে করতেন না। সবাইকে আপন মনে করতেন। মওলানা ভাসানীর নিয়মিত খবর নিতেন। নিজে ছুটে যেতেন টাঙ্গাইলে। ঈদে উপহার পাঠাতেন পাঞ্জাবি, লুঙ্গি। ভুখা মিছিল শুরুর আগে বঙ্গবন্ধু ডেকে নিয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীর পরিচালক আর উপপরিচালকদের। বলেছেন, হুজুরের দিকে খেয়াল রাখতে। দৃষ্টি দিতে যেন মওলানা ভাসানীর কষ্ট না হয়। শুধু একই চিন্তার নন, ভিন্ন চিন্তার মানুষের পাশেও তিনি থাকতেন। পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় আটক হয়েছিলেন খান এ সবুর ও শাহ আজিজুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাদের পরিবারকে প্রতি মাসে অর্থ পাঠাতেন। তোফায়েল আহমেদের কাছে অসহায় মানুষের জন্য থাকত তালিকা ও ফান্ড। তাঁর এপিএস মিন্টু গিয়ে বিভিন্নজনকে দিয়ে আসতেন অর্থ। কারাগার থেকে খান এ সবুর একদিন বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লেখেন। খান এ সবুর লিখেছিলেন, ‘আমি আনন্দিত আমার স্নেহের প্রিয় মুজিব আজ বাংলার প্রধানমন্ত্রী। আর মুজিবের বাংলায় সবুর খান কারাগারে।’ এ চিঠির পরই বঙ্গবন্ধু মুক্ত করেন খান এ সবুরকে। জেলগেট থেকে বাড়ি পৌঁছাতে সমস্যা যেন না হয়, তার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেন তোফায়েল আহমেদকে। তোফায়েল আহমেদের এপিএস মিন্টু সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ আগস্টের পর মিন্টুকে হত্যা করে খুনিরা।

 

ইতিহাস সব সময় নিষ্ঠুর হয়। জাতির পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের ডালপালা ক্রমে বিস্তার লাভ করে। একদিকে দলের ভিতরে বেড়ে উঠেছিল সুবিধাবাদীরা। অন্যদিকে বাইরে ছিল হক-তোয়াহা, সিরাজ সিকাদারপন্থি চরমপন্থিরা। পাটের গুদামে আগুন লাগানো, এমপিদের হত্যা, নাশকতা- সব কাজই তারা করত। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছিল জাসদের গণবাহিনী। থানা লুট, বিদেশি কূটনীতিকদের ওপর হামলা, খুনোখুনি করত গণবাহিনী। জাসদের পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’-এর কাজ ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো ও গুজব ছড়ানো। সদ্যস্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু এক দিনের জন্যও শান্তি পাননি। মানুষের কল্যাণে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথে পথে চক্রান্তকারীরা বিছিয়ে রাখত কাঁটা। সেই কাঁটা সরিয়ে বঙ্গবন্ধু পথ চলতেন। কাজী ফিরোজ রশীদকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি জাসদের বিরুদ্ধে এত বক্তৃতা দেন কেন? জবাবে তিনি বললেন, স্বাধীনতার পর তাদের নিষ্ঠুরতার খেসারত দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। অথচ সবাই ছিলেন আমাদের আপনজন। রাজনীতিতে আপন-পর বলে কিছু নেই। মোশতাক মিশে ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে। ১৪ আগস্টও মোশতাক খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন গণভবনে। মেজর ডালিম ৩২ নম্বরে নিয়মিত যেতেন। বেগম মুজিবকে মা ডাকতেন। বেগম মুজিব তাকে সন্তানস্নেহে খাবার তুলে দিতেন। এখন কাউকে অতিরিক্ত চাটুকারিতা করতে দেখলে ভয় করে। আমাদের চারপাশেও অনেকে আছেন বন্ধু পরিচয়ে সর্বনাশ করেন।

 

সমাজে চাটুকারদের চেয়ে সমালোচকরাই ভালো। বিএনপির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমপি উকিল আবদুস সাত্তার দলের নির্দেশ মেনে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর ভালো লাগেনি দলের এই আদেশ। তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এখন অংশ নিচ্ছেন উপনির্বাচনে। এমন মানুষ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলে সমস্যা নেই। সমস্যা তাদের নিয়ে, যারা তলে তলে সিঁদ কাটে। দলীয় প্রধানের নির্দেশ থোড়াই কেয়ার করে। আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী বা দলীয় পদ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়। এই নষ্ট-ভণ্ডদের সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। কঠোর হতে হবে আগামীতে। অন্যথায় দিতে হবে খেসারত। শেখ হাসিনার আদেশ-নির্দেশ না মানলে কীসের আওয়ামী লীগার? পিতার মতো অনেক বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি উদার। সর্বনাশা লোকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো অতি উদারতা দেখানোর কিছু নেই। প্রয়োজনে বের করে দিতে হবে মুখোশধারীদের। আর কোনো খন্দকার মোশতাকের দরকার নেই আওয়ামী লীগে। মীর জাফরদের প্রয়োজন নেই বাংলায়। বাইরের মানুষ ক্ষতি করতে পারে না। ক্ষতি করে নিজের ঘরের লোকেরাই। পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধু অনুসারীদের বাড়ি চিনত না। তাদের গলি দেখিয়ে দিয়েছিল এ দেশের দালালরা। বঙ্গবন্ধুর ক্ষতি দলের ভিতর থেকেই হয়েছিল। দলের লোকজন চক্রান্তে না জড়ালে খুনিরা টিকতে পারত না এক দিনও। তাদের নিষ্ঠুর পরিণতির জন্য ’৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না।

 

সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও সময়টা এখন জটিল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস থাকা ভালো। অতি বিশ্বাস ক্ষতি করে নীরবে। মানুষ ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটি ধাঁচ নিয়ে বেড়ে ওঠে। অপরাধপ্রবণতা জন্মগতভাবে পাওয়া। সারা জীবন কারও জন্য করে যাওয়ার পরও সামান্য স্বার্থহানিতে মানুষের চেহারা বদলে যায়। মুহূর্তে ভুলে যায় অতীত। সুযোগ পেলেই দিয়ে দেয় সাপের মতো নিষ্ঠুর ছোবল। মানুষের দুনিয়ায় ফেরেশতা ও শয়তানের ঘুরে বেড়ানোর কথা পবিত্র কোরআনে আছে। প্রথম মানব আদম (আ.)-এর এক সন্তান খুন করেন আরেকজনকে। মহানবী (সা.)-কে মক্কায় বাস করতে দেয়নি মানুষ নামের ভয়ংকররা। মহানবী (সা.)-এর দাঁত শহীদ হয় পাথরের আঘাতে। নবীজি সব অত্যাচার সহ্য করেছেন। হিজরত করে চলে গিয়েছেন মদিনায়। তবু আল্লাহর দরবারে নিষ্ঠুর অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে বিচার দিয়ে তাদের ধ্বংস করেননি। বিদায় হজের ভাষণে বলে গেছেন মানবতার কথা। নবীজির সেই আহ্বানও অনেকে মানেনি। তাঁর চার খলিফার তিনজনই খুনের শিকার হন। নবীজির প্রিয় নাতি হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.)-কে হত্যা করা হয়। আল্লাহর সব নবী-রসুলের জীবনে অনেক অস্বস্তি ছিল। তাঁদের অনেক কষ্ট দিয়েছিল মানুষ নামধারীরা। তার পরও নবী-রসুলরা তাঁদের পথ থেকে সরেননি। মানবতার কথাই বলে গেছেন। কাজ করেছেন মানুষের জন্যই। ক্রুশবিদ্ধ ইসা (আ.) অথবা যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বর বা আল্লাহর কাছে নিজেকে রক্ষার কথা বলেননি। জানাননি মানুষের নিষ্ঠুরতা। সক্রেটিসকে হেমলক বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তার পরও পালিয়ে যাননি। মেনে নিয়েছিলেন বিচারের নামে প্রহসন। কারও বিরুদ্ধে ব্যক্ত করেননি ক্ষোভ।

 

যুগে যুগে বিশ্বকে জাগিয়ে তোলা মানুষই হন নিষ্ঠুরতার বলি। ইতিহাসে খুনিদের স্থান হয় অন্ধকার জগতে। আর নবাব সিরাজউদদৌলারা ঠাঁই পান মানুষের হৃদয়মন্দিরে। কুৎসা, মিথ্যাচার মানুষ বুঝতে পারে আগে, পরে। মীর জাফর, মোশতাকরা নির্বাসিত হয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। নিন্দা থেকে রেহাই মেলেনি রবীন্দ্র-নজরুলের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর খুনের শিকার হন প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। মহাত্মা গান্ধীরও রেহাই মেলেনি চারপাশে থাকা লোকজনের কাছ থেকে। ভারত স্বাধীন করার পরই তিনি খুনের শিকার হন। খুনির অভিযোগ ছিল তিনি মুসলমানদের নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। থামিয়ে ছিলেন দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলমান দুই পক্ষকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। খুনিরা চেয়েছিল অশান্তির অনল। গান্ধী ছিলেন শান্তির পক্ষে। মহানায়করা ক্ষণজন্মাই হন। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মাত্র ৩৩ বছর বেঁচেছিলেন। সাম্রাজ্য শাসনে বেশি সময় পাননি। তাঁর ইতিহাস অবশ্য আলাদা। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। ৫২ বছরে হয়েছিলেন জাতির পিতা। খুনিরা স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশের চাবি এখন তাঁর মেয়ের হাতে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাকে বিশ্বে নতুন উচ্চতা দিচ্ছেন তিনি। তাঁকে ঘিরেই বাংলাদেশের আগামী। বিশ্বাস করি, চারপাশের চক্রান্তের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন, এগিয়ে যাবেন। কোনো চক্রান্তই থামাতে পারবে না তাঁকে।

 

জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতিবন্ধকতা আছে, থাকবে। কবিগুরু বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…।’ জীবন থেমে থাকার নয়। পথ চলতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়-দিতে হয় রাষ্ট্রনায়কদের। বৃহত্তর স্বার্থে করতে হয় অনেক কাজ। পাছে লোকে কিছু বলে- এই চিন্তা করলে চলে না। এ নিয়ে একটা গল্প আছে শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার। প্রথম জীবনে হৈমন্তীর বেশির ভাগ গানের রেকর্ডিং হতো এইচএমভি কোম্পানিতে। কৃতজ্ঞতা নিয়ে তিনি এইচএমভি ছাড়া অন্য কোম্পানির ডাকে সাড়া দিতেন না। হৈমন্তীর নামডাকের সঙ্গে গান রেকর্ডিং প্রস্তাব ক্রমে বাড়তে থাকে। কী করবেন ভাবতে পারছিলেন না হৈমন্তী। কী করবেন জানতে একদিন গিয়েছিলেন গুরুজনের কাছে। গুরুজন তাঁকে বললেন, ছোটবেলায় গরুর দুধ খেয়েছিস। আবার ছাগলের দুধও খেতি। এখন কি গরু-ছাগলকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াবি? সময়ের সঙ্গে অবস্থানটাও বুঝতে হবে। সামনে যেতে হবে তোকে। সবকিছু ভাবলে হবে না। জীবন থেমে থাকার নয়। ইতিহাসে পথ চলতে হয় বাস্তবতার কঠিন নিরিখে। সাফল্য ঘরে তুলতে বাধা উপেক্ষা করতে হয়।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অন্তর্বর্তী সরকার ফেল করলে আমাদের বিপদ আছে : এ্যানি

» আওয়ামী লীগ কখনই গণতান্ত্রিক দল ছিল না, তারা ফ্যাসিবাদী দল: মির্জা ফখরুল

» তিন মাসে জ্বালানি খাতে সাশ্রয় ৩৭০ কোটি টাকা: জ্বালানি উপদেষ্টা

» জামায়াত সেক্রেটারি গত ১৫ বছরে সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারিনি

» ‘বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনো ফ্যাসিস্টকে নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না’

» ভবিষ্যত ধ্বংস করে দিয়ে পালিয়েছেন হাসিনা: রিজভী

» পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পর্শে তিন শিক্ষার্থী নিহত

» সোনার দামে বড় লাফ

» শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ ও আহতদের নামে স্মরণসভা করার নির্দেশ

» এক বছরের মধ্যেই নির্বাচন চান ৬১.১% মানুষ, সংস্কার শেষে নির্বাচনের পক্ষে ৬৫.৯%

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ক্ষমতার নিষ্ঠুরতার পৃথিবীতে আপন কে

নঈম নিজাম : সময়টা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। দেশে ফিরলেন ইতিহাসের মহানায়ক। প্রিয় নেতাকে একনজর দেখতে অপেক্ষায় গোটা বাংলাদেশ। তেজগাঁও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মানুষের ঢল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান ছাত্রনেতারা অপেক্ষা করছেন। আবেগাপ্লুত জনতা একনজর দেখতে চান তাঁকে। অবশেষে নেতা এলেন। বাঁধভাঙা জনস্রোত ছুটল তাঁর দিকে। বিমান থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু চার জাতীয় নেতাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাছে টেনে নিলেন ছাত্রনেতাদের। কাঁদলেন। কাঁদালেন। তারপর মিশে গেলেন জনতার স্রোতে। সে সময় খন্দকার মোশতাকও এগিয়ে এসেছিলেন। কিছুদিন আগে তাকে তাজউদ্দীন আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক ভূমিকা। প্রমাণও ছিল তাজউদ্দীনের কাছে। পররাষ্ট্র হারানোর অপমানে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মোশতাক। বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবরে বের হলেন। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে চুমু খেয়ে স্বাগত জানালেন। হাউমাউ করে কাঁদলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। খন্দকার মোশতাক অতি ভালোবাসা দেখাতে এমনই করতেন। বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জীবনের বন্ধু পরিচয় দিতেন নিজেকে। সবার সামনে চাটুকারিতা করতেন। আর তলে তলে করতেন সর্বনাশ। ১৯৭৪ সালের ৩১ মে মারা গেলেন বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন। সেদিন ঢাকার আকাশে ঝড় ছিল। ঝড়বাদল উপেক্ষা করে মোশতাক গেলেন টুঙ্গিপাড়ায়। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি করলেন। মোশতাকের আচরণে বিরক্ত হলেন বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। বঙ্গবন্ধুর বাবার মৃত্যুর পরও মোশতাকের কান্নাকাটির শেষ ছিল না। মোশতাক নিজেকে আপনজন হিসেবে বেশি জাহির করতেন। তিনি ছিলেন তাজউদ্দীনবিরোধী। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে বিদেশ থেকে ফিরে তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের কিছু বিষয়ে সমালোচনা করলেন। এ নিয়ে মোশতাক ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। বললেন, তাজউদ্দীন সরকারের ক্ষতি করছে। তাকে বাদ দিতে হবে। এ এল খতিবের ‘হু কিল্ড মুজিব’ বইতে আছে অনেক কথা। ড. ওয়াজেদ আলী মিয়াও লিখে গেছেন। রাজনীতিতে আপন-পর বলে কথা নেই। বঙ্গবন্ধুকে সবাই সতর্ক করতেন মোশতাক নিয়ে। তিনি সেসব বিষয়ে কান দিতেন না। একবার তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করলেন। বললেন, এই লোকটি মোশতাকের লোক। তথ্য মন্ত্রণালয়ে বসে আপনার সর্বনাশ করছে। হিমালয় উচ্চতার বঙ্গবন্ধু বললেন, সমস্যা কী তোমাদের? মোশতাক আমার লোক।

 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল ব্যক্তিত্বের, উদার মনের অধিকারী। সবাইকে আপন ভাবতেন। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে দেখতেন। কঠোর হতে পারতেন না কোনো কিছুতে। ১৯৭২ সালে অনেক গণপরিষদ সদস্যকে বাদ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করার। বঙ্গবন্ধু তাদেরও ক্ষমা করে দিলেন। যতটা কঠোর হওয়ার দরকার ছিল তা হননি। শুধু নিজ দল নয়, অন্যদের প্রতিও তিনি উদার ছিলেন। তিনি ছিলেন মানুষের নেতা। মাত্র ৫২ বছর বয়সে হয়েছিলেন জাতির পিতা। তোফায়েল আহমেদ বিষাদ সিন্ধুর মতো বঙ্গবন্ধুর অনেক উদারতার কথা তুলে ধরছেন। অনেক স্মৃতিচারণা শুনেছি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আমিনুল হক বাদশার কাছ থেকে। রক্ষীবাহিনীর উপপরিচালক কর্নেল (অব.) সরোয়ার হোসেন মোল্লার অনেক সাক্ষাৎকার ও লেখা প্রকাশ করেছি। প্রকাশের অপেক্ষায় আছে আরও অনেক কিছু। স্বাধীনতার পরের সময়টা আসলে ছিল অন্যরকম। ইতিহাসের রাখাল রাজা নিজের কথা ভাবতেন না। চিন্তা করতেন না নিজের নিরাপত্তার কথা। ভাবতেও পারেননি কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। নেননি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। থাকতেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ছোট্ট বাড়িটিতে। এখানে কোনো নিরাপত্তা ছিল না। রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নূরুজ্জামান, দুই উপপ্রধান আনোয়ারুল আলম শহীদ, সরোয়ার মোল্লা, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা ই এ চৌধুরী বারবার সতর্ক করেছেন। বলেছেন নিরাপত্তার স্বার্থে গণভবনে গিয়ে উঠতে। উৎকণ্ঠা ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। ভারতীয় গোয়েন্দাপ্রধান ঢাকায় এলেন। কোনো বাধা ছাড়া প্রবেশ করলেন ৩২ নম্বরের বাড়িতে। যে-কেউ এ বাড়িতে প্রবেশ করতে পারত অবাধে। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দরজা খোলা ছিল জনতার জন্য। বিশ্বে এমন উদাহরণ দ্বিতীয়টি নেই। আর হবেও না কোনো দিন।

 

বঙ্গবন্ধু কাউকে প্রতিপক্ষ মনে করতেন না। সবাইকে আপন মনে করতেন। মওলানা ভাসানীর নিয়মিত খবর নিতেন। নিজে ছুটে যেতেন টাঙ্গাইলে। ঈদে উপহার পাঠাতেন পাঞ্জাবি, লুঙ্গি। ভুখা মিছিল শুরুর আগে বঙ্গবন্ধু ডেকে নিয়েছিলেন রক্ষীবাহিনীর পরিচালক আর উপপরিচালকদের। বলেছেন, হুজুরের দিকে খেয়াল রাখতে। দৃষ্টি দিতে যেন মওলানা ভাসানীর কষ্ট না হয়। শুধু একই চিন্তার নন, ভিন্ন চিন্তার মানুষের পাশেও তিনি থাকতেন। পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় আটক হয়েছিলেন খান এ সবুর ও শাহ আজিজুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তাদের পরিবারকে প্রতি মাসে অর্থ পাঠাতেন। তোফায়েল আহমেদের কাছে অসহায় মানুষের জন্য থাকত তালিকা ও ফান্ড। তাঁর এপিএস মিন্টু গিয়ে বিভিন্নজনকে দিয়ে আসতেন অর্থ। কারাগার থেকে খান এ সবুর একদিন বঙ্গবন্ধুকে চিঠি লেখেন। খান এ সবুর লিখেছিলেন, ‘আমি আনন্দিত আমার স্নেহের প্রিয় মুজিব আজ বাংলার প্রধানমন্ত্রী। আর মুজিবের বাংলায় সবুর খান কারাগারে।’ এ চিঠির পরই বঙ্গবন্ধু মুক্ত করেন খান এ সবুরকে। জেলগেট থেকে বাড়ি পৌঁছাতে সমস্যা যেন না হয়, তার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেন তোফায়েল আহমেদকে। তোফায়েল আহমেদের এপিএস মিন্টু সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ আগস্টের পর মিন্টুকে হত্যা করে খুনিরা।

 

ইতিহাস সব সময় নিষ্ঠুর হয়। জাতির পিতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল ’৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের ডালপালা ক্রমে বিস্তার লাভ করে। একদিকে দলের ভিতরে বেড়ে উঠেছিল সুবিধাবাদীরা। অন্যদিকে বাইরে ছিল হক-তোয়াহা, সিরাজ সিকাদারপন্থি চরমপন্থিরা। পাটের গুদামে আগুন লাগানো, এমপিদের হত্যা, নাশকতা- সব কাজই তারা করত। তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছিল জাসদের গণবাহিনী। থানা লুট, বিদেশি কূটনীতিকদের ওপর হামলা, খুনোখুনি করত গণবাহিনী। জাসদের পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’-এর কাজ ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো ও গুজব ছড়ানো। সদ্যস্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু এক দিনের জন্যও শান্তি পাননি। মানুষের কল্যাণে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে পথে পথে চক্রান্তকারীরা বিছিয়ে রাখত কাঁটা। সেই কাঁটা সরিয়ে বঙ্গবন্ধু পথ চলতেন। কাজী ফিরোজ রশীদকে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, আপনি জাসদের বিরুদ্ধে এত বক্তৃতা দেন কেন? জবাবে তিনি বললেন, স্বাধীনতার পর তাদের নিষ্ঠুরতার খেসারত দিতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। অথচ সবাই ছিলেন আমাদের আপনজন। রাজনীতিতে আপন-পর বলে কিছু নেই। মোশতাক মিশে ছিলেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে। ১৪ আগস্টও মোশতাক খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন গণভবনে। মেজর ডালিম ৩২ নম্বরে নিয়মিত যেতেন। বেগম মুজিবকে মা ডাকতেন। বেগম মুজিব তাকে সন্তানস্নেহে খাবার তুলে দিতেন। এখন কাউকে অতিরিক্ত চাটুকারিতা করতে দেখলে ভয় করে। আমাদের চারপাশেও অনেকে আছেন বন্ধু পরিচয়ে সর্বনাশ করেন।

 

সমাজে চাটুকারদের চেয়ে সমালোচকরাই ভালো। বিএনপির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এমপি উকিল আবদুস সাত্তার দলের নির্দেশ মেনে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর ভালো লাগেনি দলের এই আদেশ। তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এখন অংশ নিচ্ছেন উপনির্বাচনে। এমন মানুষ নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলে সমস্যা নেই। সমস্যা তাদের নিয়ে, যারা তলে তলে সিঁদ কাটে। দলীয় প্রধানের নির্দেশ থোড়াই কেয়ার করে। আওয়ামী লীগের এমপি, মন্ত্রী বা দলীয় পদ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়। এই নষ্ট-ভণ্ডদের সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। কঠোর হতে হবে আগামীতে। অন্যথায় দিতে হবে খেসারত। শেখ হাসিনার আদেশ-নির্দেশ না মানলে কীসের আওয়ামী লীগার? পিতার মতো অনেক বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অনেক বেশি উদার। সর্বনাশা লোকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মতো অতি উদারতা দেখানোর কিছু নেই। প্রয়োজনে বের করে দিতে হবে মুখোশধারীদের। আর কোনো খন্দকার মোশতাকের দরকার নেই আওয়ামী লীগে। মীর জাফরদের প্রয়োজন নেই বাংলায়। বাইরের মানুষ ক্ষতি করতে পারে না। ক্ষতি করে নিজের ঘরের লোকেরাই। পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধু অনুসারীদের বাড়ি চিনত না। তাদের গলি দেখিয়ে দিয়েছিল এ দেশের দালালরা। বঙ্গবন্ধুর ক্ষতি দলের ভিতর থেকেই হয়েছিল। দলের লোকজন চক্রান্তে না জড়ালে খুনিরা টিকতে পারত না এক দিনও। তাদের নিষ্ঠুর পরিণতির জন্য ’৯৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না।

 

সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও সময়টা এখন জটিল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস থাকা ভালো। অতি বিশ্বাস ক্ষতি করে নীরবে। মানুষ ইতিবাচক-নেতিবাচক দুটি ধাঁচ নিয়ে বেড়ে ওঠে। অপরাধপ্রবণতা জন্মগতভাবে পাওয়া। সারা জীবন কারও জন্য করে যাওয়ার পরও সামান্য স্বার্থহানিতে মানুষের চেহারা বদলে যায়। মুহূর্তে ভুলে যায় অতীত। সুযোগ পেলেই দিয়ে দেয় সাপের মতো নিষ্ঠুর ছোবল। মানুষের দুনিয়ায় ফেরেশতা ও শয়তানের ঘুরে বেড়ানোর কথা পবিত্র কোরআনে আছে। প্রথম মানব আদম (আ.)-এর এক সন্তান খুন করেন আরেকজনকে। মহানবী (সা.)-কে মক্কায় বাস করতে দেয়নি মানুষ নামের ভয়ংকররা। মহানবী (সা.)-এর দাঁত শহীদ হয় পাথরের আঘাতে। নবীজি সব অত্যাচার সহ্য করেছেন। হিজরত করে চলে গিয়েছেন মদিনায়। তবু আল্লাহর দরবারে নিষ্ঠুর অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে বিচার দিয়ে তাদের ধ্বংস করেননি। বিদায় হজের ভাষণে বলে গেছেন মানবতার কথা। নবীজির সেই আহ্বানও অনেকে মানেনি। তাঁর চার খলিফার তিনজনই খুনের শিকার হন। নবীজির প্রিয় নাতি হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.)-কে হত্যা করা হয়। আল্লাহর সব নবী-রসুলের জীবনে অনেক অস্বস্তি ছিল। তাঁদের অনেক কষ্ট দিয়েছিল মানুষ নামধারীরা। তার পরও নবী-রসুলরা তাঁদের পথ থেকে সরেননি। মানবতার কথাই বলে গেছেন। কাজ করেছেন মানুষের জন্যই। ক্রুশবিদ্ধ ইসা (আ.) অথবা যিশুখ্রিস্ট ঈশ্বর বা আল্লাহর কাছে নিজেকে রক্ষার কথা বলেননি। জানাননি মানুষের নিষ্ঠুরতা। সক্রেটিসকে হেমলক বিষ পান করিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি পালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। তার পরও পালিয়ে যাননি। মেনে নিয়েছিলেন বিচারের নামে প্রহসন। কারও বিরুদ্ধে ব্যক্ত করেননি ক্ষোভ।

 

যুগে যুগে বিশ্বকে জাগিয়ে তোলা মানুষই হন নিষ্ঠুরতার বলি। ইতিহাসে খুনিদের স্থান হয় অন্ধকার জগতে। আর নবাব সিরাজউদদৌলারা ঠাঁই পান মানুষের হৃদয়মন্দিরে। কুৎসা, মিথ্যাচার মানুষ বুঝতে পারে আগে, পরে। মীর জাফর, মোশতাকরা নির্বাসিত হয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। নিন্দা থেকে রেহাই মেলেনি রবীন্দ্র-নজরুলের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর খুনের শিকার হন প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। মহাত্মা গান্ধীরও রেহাই মেলেনি চারপাশে থাকা লোকজনের কাছ থেকে। ভারত স্বাধীন করার পরই তিনি খুনের শিকার হন। খুনির অভিযোগ ছিল তিনি মুসলমানদের নির্বিচার হত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। থামিয়ে ছিলেন দাঙ্গা। হিন্দু-মুসলমান দুই পক্ষকে শান্তির পথে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। খুনিরা চেয়েছিল অশান্তির অনল। গান্ধী ছিলেন শান্তির পক্ষে। মহানায়করা ক্ষণজন্মাই হন। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট মাত্র ৩৩ বছর বেঁচেছিলেন। সাম্রাজ্য শাসনে বেশি সময় পাননি। তাঁর ইতিহাস অবশ্য আলাদা। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। ৫২ বছরে হয়েছিলেন জাতির পিতা। খুনিরা স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। প্রতিষ্ঠাতার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশের চাবি এখন তাঁর মেয়ের হাতে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা। রবীন্দ্র, নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাকে বিশ্বে নতুন উচ্চতা দিচ্ছেন তিনি। তাঁকে ঘিরেই বাংলাদেশের আগামী। বিশ্বাস করি, চারপাশের চক্রান্তের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন, এগিয়ে যাবেন। কোনো চক্রান্তই থামাতে পারবে না তাঁকে।

 

জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রতিবন্ধকতা আছে, থাকবে। কবিগুরু বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…।’ জীবন থেমে থাকার নয়। পথ চলতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়-দিতে হয় রাষ্ট্রনায়কদের। বৃহত্তর স্বার্থে করতে হয় অনেক কাজ। পাছে লোকে কিছু বলে- এই চিন্তা করলে চলে না। এ নিয়ে একটা গল্প আছে শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার। প্রথম জীবনে হৈমন্তীর বেশির ভাগ গানের রেকর্ডিং হতো এইচএমভি কোম্পানিতে। কৃতজ্ঞতা নিয়ে তিনি এইচএমভি ছাড়া অন্য কোম্পানির ডাকে সাড়া দিতেন না। হৈমন্তীর নামডাকের সঙ্গে গান রেকর্ডিং প্রস্তাব ক্রমে বাড়তে থাকে। কী করবেন ভাবতে পারছিলেন না হৈমন্তী। কী করবেন জানতে একদিন গিয়েছিলেন গুরুজনের কাছে। গুরুজন তাঁকে বললেন, ছোটবেলায় গরুর দুধ খেয়েছিস। আবার ছাগলের দুধও খেতি। এখন কি গরু-ছাগলকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াবি? সময়ের সঙ্গে অবস্থানটাও বুঝতে হবে। সামনে যেতে হবে তোকে। সবকিছু ভাবলে হবে না। জীবন থেমে থাকার নয়। ইতিহাসে পথ চলতে হয় বাস্তবতার কঠিন নিরিখে। সাফল্য ঘরে তুলতে বাধা উপেক্ষা করতে হয়।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com